সূরা আন নিসা;আয়াত ৮৬-৮৮
সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا ((৮৬
"কেউ যখন তোমাদের সালাম দেয় ও শুভেচ্ছা জানায়,তখন তোমরা তার চেয়েও ভালোভাবে সালামের জবাব এবং শুভেচ্ছা জানাবে অথবা অনুরূপভাবেই জবাব দিবে ৷ আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী ৷" (৪:৮৬)
এ আয়াতে মুসলমানদের পারস্পরিক আচরণের ধরন উল্লেখ করে বলা হচ্ছে,ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা অন্যদের সঙ্গে কথায় ও কাজে সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত৷ কারো সাথে দেখা হলে একে অপরকে সালাম করা এবং বন্ধুদের সাথে ও পারিবারিক সাক্ষাতে উপহার বিনিময় করা এসবের ওপর ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে ৷ এই আয়াতে সালাম ও উপহার দেয়াকে সার্বজনীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কেউ কখনো শুভেচ্ছা ও সালাম জানালে তাকে আরো ভালো কিছু দেয়া বা ভালো জবাব দেয়া কিংবা অন্তত: অনুরূপ জবাব দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ৷ অর্থাৎ কারো সম্বর্ধনা বা সালামের জবাব আরো উষ্ণভাবে দেয়া উচিত ৷ ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে,ইমাম হাসান মুজতবার এক দাসী তাকে একটি ফুলের তোড়া উপহার দিলে তিনি তাকে মুক্ত করে দেন এবং এর ব্যাখ্যা হিসাবে পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের কথা উল্লেখ করেন৷
এই আয়াতে শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,
প্রথমত: অন্যদের যে কোন ধরনের শুভেচ্ছা ও সৌজন্যতার জবাব সবচেয়ে ভালো পন্থায় এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে দেয়া উচিত ৷
দ্বিতীয়ত: কল্যাণকামীতা বা উপহার প্রত্যাখ্যান করা অপছন্দনীয় কাজ ৷ উপহার গ্রহণ করা উচিত এবং আরো ভালোভাবে উপহারের জবাব দিতে হবে৷
তৃতীয়ত: অন্যদের সালাম ও সৌজন্যতা উপেক্ষা করার পরিণতি ভালো হয় না ৷ এ জন্যে মানুষকে পৃথিবীতে ও পরকালে নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে হবে ৷
সূরা নিসার ৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا ((৮৭
"আল্লাহ এক এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই,তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন-যে দিনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই,তোমাদেরকে একত্র করবেন ৷ হে মানুষ- কে আল্লাহর চেয়ে বেশী সত্যবাদী?"(৪:৮৭)
এর আগে ৮৬ নম্বর আয়াত শেষে বলা হয়েছিল,আল্লাহ মানুষের সব কাজের হিসাব রাখেন এবং কোন ভাল ও মন্দ কাজ তার কাছে গোপন থাকে না ৷ এই আয়াতে বলা হচ্ছে-সেই আল্লাহ এক,সৃষ্টির শুরু হয়েছিল যাঁর হাতে এবং শেষও হবে তাঁর হাতে ৷ তিনি সমস্ত মানুষকে একটি নির্দিষ্ট দিনে এক জায়গায় জড়ো করবেন এবং এরপর সবাইকে তাদের কাজের প্রতিফল দেবেন ৷
এরপর স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে-কেন কেউ কেউ বিচার দিবসের ব্যাপারে সন্দেহ করছে? তাহলে তারা কি আল্লাহর চেয়েও সত্যবাদী কারো অস্তিত্বের কথা জানে? আর আল্লাহর মিথ্যা বলার কি প্রয়োজনই বা রয়েছে? মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা ভয় পেয়ে অথবা অজ্ঞাত কারণে মিথ্যা বলতে পারে ৷ কিন্তু আল্লাহর কোন কিছুরই প্রয়োজন হয় না এবং তিনি কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন৷ আল্লাহ সর্ব শক্তিমান ও সর্বজ্ঞ ৷ তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে কিয়ামত বা বিচার দিবস সম্পর্কে মিথ্যা ওয়াদা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: এখন থেকেই বিচার দিবস বা কিয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা বা দাসত্ব পরিহার করতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: কিয়ামতের ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদা ও ন্যায়বিচারের মত বহু যু্ক্তি থাকায় এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই ৷ যে আল্লাহ তোমাদেরকে অনস্তিত্ব বা শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন,তিনি কি আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম নন?
এবারে সূরা নিসার ৮৮ নম্বর এ আয়াতে বলা হয়েছে,
فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ وَاللَّهُ أَرْكَسَهُمْ بِمَا كَسَبُوا أَتُرِيدُونَ أَنْ تَهْدُوا مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا ((৮৮
"হে বিশ্বাসীগণ,কেন মোনাফেকদের সম্পর্কে তোমরা দু'দলে বিভক্ত হয়ে গেলে? অথচ আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পূর্ববস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন! আল্লাহ যাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পথভ্রষ্ট করেছেন,তোমরা কি তাদের সুপথে আনতে চাও? যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন,তুমি তার জন্যে মুক্তির কোন পথ পাবে না ৷" (৪:৮৮)
এই আয়াতে মোনাফেকদের সঙ্গে একদল মুসলমানের সহজ-সরল আচরণের সমালোচনা করে বলা হয়েছে,তোমাদের মধ্যে একদল কেন এত সরলমনা? তারা মনে করে,মোনাফেকরা তাদের সঙ্গে রয়েছে ৷ তারা কখনই তোমাদের সঙ্গে ছিল না এবং তারা কখনও মন থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি ৷ এই সব কপট লোকেরা শুধু মুখে মুখেই ইসলাম ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল ৷ ঈমানের লক্ষণ হল,আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ বাস্তবে পালন করা ৷ শুধু বাহ্যিক চাল-চলন ও কথাবার্তার মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মান্য করা যথেষ্ট নয় ৷ কপট বা মোনাফেকরাই এ ধরনের আচরণ করে থাকে ৷'মুখে মধু অন্তরে বিষ' নীতির চর্চাকারীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি পাবার কারণে সৌভাগ্য ও মুক্তির সোপান থেকে বঞ্চিত৷ তারা মনে করে,জনগণকে তো ভালোই ধোঁকা দিয়েছি ৷ কিন্তু বাস্তবে এরা নিজেদেরকেই ধোঁকা দিয়েছে ৷ এই আয়াত থেকে বোঝা গেল-অন্তরে ঈমান না এনে যারাই বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ঈমানদার সাজার চেষ্টা করবে,তারা মুক্তির পথ থেকে বঞ্চিত হবে ৷ এমনকি মহানবী (সা.)ও তাদেরকে সুপথ বা মুক্তির পথ দেখাতে সফল হবেন না৷ যদিও এখানে বলা হয়েছে যে,আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় পথভ্রষ্ট অবস্থায় ফিরিয়ে নেন,কিন্তু এর আগেই সাবধান করে বলা হয়েছে,এসবই তাদের কাজের ফল মাত্র৷ আল্লাহ সুপথ পাবার ক্ষেত্রগুলো সবার জন্য সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন৷ কিন্তু কেউ যদি সুপথ বা মুক্তির পথ না ধরে বরং একে নিয়ে ছলচাতুরী করে এবং আল্লাহর নির্দেশকে হেয় করে তাহলে সে তো সুপথ পাবেই না একই সাথে সু-পথ পাবার পরবর্তী ক্ষেত্রগুলো থেকেও সে বঞ্চিত হবে৷ ঠিক এ অর্থেই আল্লাহ তাদের পথভ্রষ্ট করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এ অবস্থার বাইরে আল্লাহ কখনই কাউকে পথভ্রষ্ট করেন না ৷ যার চিন্তা-ভাবনা সম্পুর্ণ বিপরীত ও কপটতায় পরিপূর্ণ এবং যার তত্পররতা শুধু শত্রুর জন্যেই নিবেদিত সে ব্যক্তিও সুপথ পাবে-এমন প্রত্যাশা কোনমতেই যৌক্তিক ও ঠিক নয় ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের অধঃপতনের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী ৷ আল্লাহ কাউকে বিনা কারণে পথভ্রষ্ট করেন না৷
দ্বিতীয়ত: মোনাফেকদের মোকাবেলার ব্যাপারে সরল বিশ্বাসী ও অদূরদর্শী হওয়া উচিত নয়৷ মোনাফেকদের মন জয়ের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তাদের জন্য আমাদের বিন্দুমাত্র মনে দুঃখ রাখাও ঠিক নয়৷