সূরা আন নিসা; আয়াত ৮৯-৯১
সূরা নিসার ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا فَتَكُونُونَ سَوَاءً فَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ أَوْلِيَاءَ حَتَّى يُهَاجِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ((৮৯
"মোনাফিকরা চায় তারা যেমন কাফের,তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও যাতে তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকে ৷ অতএব তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধ হিসাবে গ্রহণ কর না,যে পর্যন্ত না তারা তওবা এবং আল্লাহর পথে হিজরত না করে ৷ এরপর যদি তারা বিমুখ হয় এবং কাফেরদের সথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখে,তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর ৷" (৪:৮৯)
আগের আলোচনায় আমরা বলেছি,মুসলমানদের মধ্যে এমন এক দল সরলমনা লোক আছে যারা মোনাফেকদের পক্ষে কথা বলে এবং তাদেরকে সমর্থন করে ৷ এই আয়াতে এসব সরলমনা লোককে সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে,মোনাফেকরা এত বেশী নিকৃষ্ট স্বভাবের যে,তারা শুধু নিজেরাই কাফের নয় বরং তারা চায় তোমরাও তাদের মত কাফের হয়ে যাও যাতে তাদের সাথে তোমাদের কোন পার্থক্য না থাকে ৷ আসলে এসব লোক তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার যোগ্যতা রাখে না ৷ সুতরাং তারা কুফরী ও মুনাফেরীর পথ থেকে ইসলামের পথে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না ৷ কিন্তু তারা যদি তা না করে,অর্থাৎ কুফরির পথ থেকে ফিরে না আসে তাহলে তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গ্রেফতার এবং প্রয়োজনে হত্যা করতে হবে ৷ কারণ তারা ইসলামের নামকে অপব্যবহার করছে ৷কিন্তু অন্যদিকে,পবিত্র কোরআনে মুসলিম দেশে বসবাসকারী ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন ও তাদেরকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে এবং কারোরই তাদের উপর আক্রমণ চালানোর অধিকার নেই ৷ কিন্তু মোনাফেকরা যেহেতু ইসলামের নামে অন্যায় ও ক্ষতি করার চেষ্টা করে,সেজন্য তাদের ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর নির্দেশ জারী করা হয়েছে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,
প্রথমত: মোনাফেকদের সৃষ্ট বিপদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদেরকে কখনই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না ৷ কারণ তারা কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট ৷
দ্বিতীয়ত: প্রকৃত ঈমানের নিদর্শন হচ্ছে,আল্লাহর পথে হিজরত ৷ যে ধর্মের জন্য দেশ ত্যাগে রাজি হবে না সে প্রকৃত ঈমানদার নয় ৷
তৃতীয়ত: তওবার মাধ্যমে সব ধরনের গোনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় ৷
সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
إِلَّا الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ أَوْ جَاءُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَنْ يُقَاتِلُوكُمْ أَوْ يُقَاتِلُوا قَوْمَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَسَلَّطَهُمْ عَلَيْكُمْ فَلَقَاتَلُوكُمْ فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَاتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ فَمَا جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلًا ((৯০
"কিন্তু যারা এমন কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হয় যাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিবদ্ধ এবং তারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসে যে,তাদের অন্তর তোমাদের ও স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয় ৷ অবশ্য আল্লাহ যদি ইচ্ছে করতেন এবং তোমাদের ওপর তাদের ক্ষমতা দিতেন তাহলে তারা অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতো ৷ কিন্তু তারা যদি তোমাদের কাছ থেকে চলে যায়,তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদেরকে শান্তি ও সমঝোতার প্রস্তাব দেয়,তাহলে আল্লাহ তাদের ওপর আক্রমণ চালাবার কোন পথ তোমাদের জন্য রাখেননি ৷" (৪:৯০)
এ আয়াতে মোনাফেকদের দু'টি দল বা শ্রেণীর ব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে ৷ যারা মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার নীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে-তারা ঐ দু্ই দলের অন্তর্ভূক্ত ৷ অর্থাৎ প্রথম দলটি মুসলমানদের সাথে চুক্তি করার কারণে এবং অন্য দলটি যুদ্ধে নিরপেক্ষতা ঘোষণার কারণে মুসলমানদের কাছ থেকে নমনীয় আচরণ পাবে ৷
এই আয়াতে শিক্ষণীয় দু'টি দিক হলো,
প্রথমত: সব ধরনের চুক্তি এমনকি কাফেরদের সাথে স্বাক্ষরিত রাজনৈতিক ও সামরিক চুক্তির প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে-যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চুক্তি লঙ্ঘন করবে ৷
দ্বিতীয়ত: ইসলাম ধর্মে যে জিহাদ বা সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে,তা প্রতিশোধ গ্রহণ বা আধিপত্য কায়েমের জন্যে নয় ৷ শত্রু পক্ষ যদি চুক্তি মেনে চলে অথবা শান্তির প্রস্তাব দেয় এবং যুদ্ধের নীতি থেকে সরে দাঁড়ায় তাহলে কেউই তাদের ওপর আক্রমণ করার অধিকার রাখে না ৷
সূরা নিসার ৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
سَتَجِدُونَ آَخَرِينَ يُرِيدُونَ أَنْ يَأْمَنُوكُمْ وَيَأْمَنُوا قَوْمَهُمْ كُلَّ مَا رُدُّوا إِلَى الْفِتْنَةِ أُرْكِسُوا فِيهَا فَإِنْ لَمْ يَعْتَزِلُوكُمْ وَيُلْقُوا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ وَيَكُفُّوا أَيْدِيَهُمْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأُولَئِكُمْ جَعَلْنَا لَكُمْ عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا مُبِينًا ((৯১
"খুব শীঘ্রই তুমি এমন একদলকে পাবে যারা তোমাদের এবং তার জাতির সঙ্গে শান্তি ও নিরাপদে থাকতে চায় ৷ কিন্তু যখনই তাদেরকে ফ্যাসাদ বা মূর্তি পুজার প্রতি মনোনিবেশ করানো হয়,তখন তারা তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় ৷ ফলে তারা যদি তোমাদের সঙ্গে বিবাদ করা থেকে বিরত না হয়,শান্তির প্রস্তাব না দেয় এবং শত্রুতার হাতকে গুটিয়ে না নেয়,তাহলে তাদেরকে যেখানেই পাও গ্রেফতার এবং হত্যা কর ৷ আমি তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অধিকার ও ক্ষমতা দান করেছি ৷" (৪:৯১)
মক্কার একদল মুশরেক যখনই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে আসত তখনই বলতো,তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে ৷ কিন্তু আবার যখন মক্কায় ফিরে যেত তখন তারা আগের মতো মূর্তি পুজা করতো এবং কাফেরদের সাথে যাতে সম্পর্ক খারাপ না হয় সেজন্য তাদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতো ৷ এভাবে তারা উভয় পক্ষের কাছ থেকেই স্বার্থ আদায় করতো এবং উভয় পক্ষের বিপদ থেকেই নিরাপদে থাকত ৷ আসলে তারা অন্তর থেকে কাফেরদের সাথে ছিল এবং তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে অংশ নিত ৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতটি নাজিল হয় এবং মোনাফেকদের এই দলের ব্যাপারে কঠোর হবার নির্দেশ দেয়া হয় ৷ কারণ এ ধরনের লোক মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ কাফেলায় শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হিসাবে কাজ করে এবং তাদের পক্ষ থেকে ঐসব কাফেরদের চেয়েও মারাত্মক বিপদের আশংকা রয়েছে যেসব কাফের কোন বিবেচনা ছাড়াই দ্রুত যুদ্ধ ঘোষণা করে ৷ সূরা নিসার ৯০ নম্বর আয়াতে মোনাফেকদের যে দু'টি দলের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে নমনীয়তা প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে তাদের বিপরীতে এই আয়াতে উল্লেখিত মোনাফেক দলটি প্রতারক,ধোঁকাবাজ ষড়যন্ত্রকারী ৷ এরা যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা প্রদর্শন তো করেই না বরং যুদ্ধের আগুনকে আরো প্রজ্জ্বলিত করে ৷ এ কারণে এদের ব্যাপারে নির্দেশের সাথে আগের দুদলের ক্ষেত্রে নির্দেশের তফাৎ রয়েছে ৷ মোনাফেকদের ষড়যন্ত্রকারী ও ভন্ড দলটির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ হলো,এদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গ্রেফতার এবং প্রয়োজনে হত্যা করতে হবে ৷
সূরা নিসার ৯১ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,
প্রথমত: মুসলমানদেরকে শত্রুর প্রকারভেদ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং শত্রুর ধরন বুঝে তার সাথে সেরকম ব্যবহার করতে হবে ৷
দ্বিতীয়ত: ইসলামী শাসন ব্যবস্থা উৎখাতের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে ৷
তৃতীয়ত: মোনাফেকদের চেনার উপায় হলো,তারা শুধু দুনিয়াবী সুখ-শান্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং ঈমান বা ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।