সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১-২
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র জীবনের শেষের দিকে সূরা মায়েদা নাজিল হয়। এই সূরায় রয়েছে ১২০ আয়াত। এ সূরার ১১৪ ও ১১৫ নম্বর আয়াত থেকে সূরাটির নামকরণ ‘মায়েদা' করা হয়েছে। এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত ঈসা (আ.)'র দোয়ার বরকতে আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা বা মায়েদা নাজেল হয়েছিল।
সূরা মায়েদার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ أُحِلَّتْ لَكُمْ بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ (১)
"হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ কর। তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু (তথা এসব জন্তুর গোশত) হালাল করা হয়েছে, কিন্তু সেসব জন্তু নয় যা তোমাদের কাছে বিবৃত হবে। কিন্তু এহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকারকে হালাল মনে করো না! নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা তারই নির্দেশ দেন যা তিনি ইচ্ছা করেন।"(৫:১)
এ আয়াতটি নাজিল হয়েছিল এমন সময়ে যখন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেননি। তাই এ আয়াতে মুসলমানদের জন্য হজ্বের কিছু বিধান তুলে ধরা হয়েছে। যেমন এ আয়াতে এহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার না করতে বলা হয়েছে হজ্ব যাত্রীদেরকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নির্দেশ এ আয়াতের প্রথমেই দেয়া হয়েছে তা হলো, চুক্তি বা অঙ্গীকারগুলো মেনে চলা। এখানে অঙ্গীকার বা চুক্তি বলতে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক চুক্তিসহ সব ধরনের চুক্তি ও অঙ্গীকারকে বোঝানো হয়েছে, তা সেসব চুক্তি লিখিত বা মৌখিক কিংবা চুক্তির পক্ষগুলো দুর্বল বা শক্তিশালী অথবা শত্রু-মিত্র যাই হোক না কেন ।
ইসলামের অন্যান্য সূত্রের বিধান অনুযায়ী মুশরিক ও পাপীদের সাথেও চুক্তি রক্ষা করা জরুরি যতক্ষণ না তারা নিজেরাই চুক্তি লঙ্ঘন করে ।
এ আয়াত থেকে যে দু'টি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো-
এক. একজন মুসলমানের উচিত যে কোনো পক্ষ, ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে কৃত ওয়াদা বা চুক্তি রক্ষা করা। এ বিষয়টি আল্লাহর প্রতি মানুষের ঈমানের অন্যতম শর্ত।
দুই. পবিত্র মক্কা অঞ্চলে এবং হজ্বের সময় শুধু হজ্বযাত্রীরা নন সব জীবজন্তুই নিরাপদ। এ সময় যে কোনো শিকার নিষিদ্ধ বা হারাম।
সূরা মায়েদার দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَائِدَ وَلَا آَمِّينَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنْ رَبِّهِمْ وَرِضْوَانًا وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ((২
"হে মুমিনগণ! হালাল মনে করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহ এবং সম্মানিত মাসসমূহকে এবং কুরবানীর জন্যে কাবায় পাঠানো জন্তুকে এবং ঐসব জন্তুকে, যাদের গলায় কণ্ঠাভরণ রয়েছে এবং ঐসব লোককে যারা সম্মানিত গৃহ বা কাবাঘর অভিমুখে যাচ্ছে, যারা স্বীয় পালনকর্তার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে। অবশ্য যখন তোমরা এহরাম থেকে বের হয়ে আসবে, তখন শিকার করতে পার। হে মুমিনগণ! যারা পবিত্র মসজিদ তথা মক্কায় প্রবেশে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছিল, সেই সম্প্রদায়ের শুত্রুতা যেন তোমাদেরকে অবিচার বা সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। হে মুমিনগণ! সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা কঠোর শাস্তিদাতা।" (৫:২)
আগের আয়াতে হজ্বের একটি বিধান বর্ণনার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে: হজ্বের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্মানিত ও পবিত্র। এসব বিষয়ের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। কোরবানির পশু ও পবিত্র স্থানগুলো খোদায়ী নিদর্শন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালার মাসগুলোও পবিত্র এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ইচ্ছুক তাঁর ঘর-অভিমুখী যাত্রীরাও সম্মানিত। তাই এই সবেরই মর্যাদা বা সম্মান রক্ষা করা জরুরি। এরপর একই আয়াতে ষষ্ঠ হিজরির ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে বছর আল্লাহর রাসূল (সা.) সহ মুসলমানরা হজ্বব্রত পালনের জন্য মদীনা থেকে মক্কায় আসার পথে মক্কার উপকণ্ঠে মুশরিকদের বাধার সম্মুখীন হন। উভয়পক্ষ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য হোদায়বিয়া এলাকায় একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। মক্কা বিজয়ের পর কোনো কোনো মুসলমান ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চান। কিন্তু আল্লাহ ওহির মাধ্যমে তাদেরকে ওই কাজ না করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ তাদের উদ্দেশে বলেছেন: প্রতিশোধ না নিয়ে ও সীমালংঘন বা জুলুমের আশ্রয় না নিয়ে তোমরা বরং মানুষকে সৎ কাজের দিকে আহ্বান কর এবং এভাবে সমাজে সৎ কাজের সংস্কৃতি বিস্তারের পথ প্রশস্ত কর। অর্থাৎ সৎকাজের ব্যাপারে সংঘবদ্ধ হও, প্রতিশোধ নেয়া বা অবিচার করার জন্য পরস্পরকে সহায়তা করো না।
এ আয়াতে এটাও স্পষ্ট করা হয়েছে যে সমবায় ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবনে এর গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু অন্য সম্প্রদায়গুলোর বিপরীতে মুসলমানদের জন্য ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার একমাত্র ভিত্তি হলো সৎকাজ ও খোদাভীতি, জুলুম ও অন্যায়, পাপাচার নয় । ইসলামহীন সমাজগুলোর বেশিরভাগই এ কথা বলে যে, নিজের বন্ধু, ভাই ও স্বদেশীকে সাহায্য কর তা সে জালেম বা মজলুম যাই হোক না কেন!
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো-
এক. যা কিছু খোদায়ী রঙ্গে রঞ্জিত অবশ্যই তার সম্মান রক্ষা করা উচিত,এমনকি তা যদি কোরবানীর পশুও হয়।
দুই. কোনো এক সময়ে অন্যদের শত্রুতার জবাবে আমরাও যেন অন্য সময়ে জুলুমে লিপ্ত না হই।
তিন. ন্যায়বিচার, সততা ও খোদাভীতিই সামাজিক সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তি হওয়া উচিত, গোত্রপ্রীতি বা জাতীয়তা, বংশ বা ভাষা নয়।