সূরা আল মায়েদা;(৫ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(৫ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 8:50:25 2-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১২-১৪

সূরা মায়েদার ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا وَقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَآَتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآَمَنْتُمْ بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ فَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ

"আল্লাহ বনী-ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং আমি তাদের (১২ গোত্রের) মধ্য থেকে বার জন সর্দার নিযুক্ত করেছিলাম। আল্লাহ বলে দিলেনঃ আমি তোমাদের সঙ্গে আছি যদি তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাঁদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ বা উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে বিভিন্ন বেহেশতে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর (গাছপালার) তলদেশ দিয়ে বয়ে গেছে নানা ঝরণা বা স্রোতস্বিনী। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।" (৫:১২)

এই আয়াত ও পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে মহান আল্লাহ অতীতের জাতিগুলোর সাথে কৃত অঙ্গীকার বা চুক্তির কথা তুলে ধরেছেন। এসব অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল ওইসব জাতির নবী-রাসূলদের মাধ্যমে। এখানে মহান আল্লাহ বলছেন, তিনি হযরত মুসা (আ.) কে ইহুদি জাতি বা বনি ইসরাইলের নবী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। এ ছাড়াও তাদের ১২টি গোত্রের জন্য ১২ জন নেতা ঠিক করে দিয়েছিলেন যাতে তারা মুসা (আ.) থেকে আল্লাহর বিধানগুলো পাওয়ার পর সেগুলোকে গোত্রের লোকদের কাছে অবগত করেন। শত্রুদের মোকাবেলায় ইহুদি জাতিকে সাহায্য করার শর্ত হিসেবে তাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ধর্মীয় বিধি-বিধানগুলো মনে চলতে বলেছিলেন মহান আল্লাহ। এরই আলোকে তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনতে বলা হয় এবং নামাজ আদায় ও যাকাত প্রদানসহ দান-খয়রাত করতে বলা হয়েছে। এ ধরনের বিশ্বাসী ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর দয়া বা রহমত পাবে এবং জান্নাত বা বেহেশত হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হতে বর্ণিত কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, বনি ইসরাইলের ১২ জন নেতার মত শেষ নবী (সা.)'র উত্তরসূরী বা স্থলাভিষিক্ত হবেন ১২ জন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ ১২ জনই হবেন মুসলমানদের ইমাম বা নেতা। তাঁদের মধ্যে প্রথম হলেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) এবং শেষ নেতা হবেন হযরত ইমাম মাহদী (আ.)।

এ আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখা উচিত তা হলো:

এক. শুধু ঈমান আনা বা বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, সৎকর্মও জরুরি। নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনার পাশাপাশি তাঁদেরকে এবং তাঁদের ধর্মকেও সহযোগিতা করা ফরজ।

দুই. যে কোনো দান-খয়রাত আল্লাহর সাথে লেনদেন করার সমতূল্য। তাই গরিবদেরকে সাহায্য করে তাদের আমরা করুণা করছি বলে ভাবা উচিত নয়, বরং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাদের সাহায্য করা উচিত।

সূরা মায়েদার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ وَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَى خَائِنَةٍ مِنْهُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاصْفَحْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

"অতএব, তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদের উপর অভিসম্পাত করেছি ও (নিজ রহমত থেকে তাদের দূরে রেখেছি) এবং তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা আল্লাহর কালামকে বিকৃত করে দেয় বা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে এবং তাদেরকে যেসব উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তার একাংশ তারা ভুলে গেছে বা তা থেকে উপকার লাভ করার বিষয়টি বিস্মৃত হয়েছে। আপনি সর্বদা তাদের কোন না কোন প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অবগত হতে থাকেন, তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই এ ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ও তাদের হৃদয় কঠোর নয়। অতএব,হে নবী! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের ভুলগুলো মার্জনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীল বা অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন।" (৫:১৩)

এ আয়াতে ইহুদিদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার রক্ষা না করায় আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তাদের অন্তর সত্যকে মেনে নিতে পারেনি এবং এভাবে তাদের অন্তরগুলো পাথরের মত কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তারা শুধু অঙ্গীকার ভঙ্গ করেই ক্ষান্ত হয়নি, একইসঙ্গে অন্যায় কাজের সাফাই দেয়ার জন্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও বিকৃতি ঘটায় এমনকি এর কিছু অংশ মুছে ফেলে বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ফলে সবাই সেগুলো ভুলে যায়। এরপর বলা হয়েছে, কেবল হযরত মুসা (আ.)'র যুগের ইহুদিরাই যে এমন ছিল তা নয়, বিশ্বনবী (সা.)'র যুগে মদীনার ইহুদিরাও সব সময়ই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও মুমিনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত থেকেছে।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. কেবল পবিত্র ও স্বচ্ছ অন্তরই আল্লাহর বাণী গ্রহণ করে, অপবিত্র অন্তর আল্লাহর বাণী গ্রহণ তো করেই না, বরং এসব বাণীর শব্দ ও অর্থকে বিকৃত করে।

দুই. ইতিহাস পড়লেও দেখা যায় ইহুদিরা সব সময়ই চুক্তি লঙ্ঘন করতে ও ষড়যন্ত্র আঁটতে অভ্যস্ত ।

তিন. অন্যদের প্রতি দয়াদ্র হওয়ার ও উপকার করার সর্বোত্তম পন্থা হলো, ক্ষমা করা এবং তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো উপেক্ষা করা বা গোপন রাখা।

সূরা মায়েদার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَى أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

"যারা বলেঃ আমরা নাসারা বা হযরত ঈসার অনুসারী বলে দাবি করে, আমি তাদের কাছ থেকেও তাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। অতঃপর তারাও (ইহুদিদের মত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাদের মতই) যেসব উপদেশ (ধর্মগ্রন্থ) পেয়েছিল, সেসবের একাংশ ভুলে যায়। অতঃপর আমি কেয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিয়েছি। অবশেষে আল্লাহ শিগগিরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।" (৫:১৪)

আগের আয়াতে ইহুদিদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা তুলে ধরার পর এ আয়াতে খ্রিস্টানদের একই তৎপরতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যারা নিজেদেরকে ঈসা (আ.)'র অনুসারী বলে দাবি করে আমি তাদের কাছ থেকেও এ অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে তারা আল্লাহর ধর্মের সহায়তাকারী হবে এবং এ ক্ষেত্রে অবিচল থাকবে, কিন্তু তারাও অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ইহুদিদের অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ তারাও ধর্মীয় গ্রন্থের কিছু অংশ বিকৃত করে ও কিছু অংশ বাদ দিয়েছে। ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে শত্রুতা ও প্রতিহিংসা দেখা দেয় এবং কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। খ্রিস্টানরা এক খোদার এবাদতের পরিবর্তে তিন খোদার উপাসনা ও ত্রিত্ববাদের উদ্ভব ঘটায়। আর এটা ধর্মকে বিকৃত করার এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. ঈমানের দাবিদার অনেক, কিন্তু প্রকৃত অনুসারী খুবই কম।

দুই. আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ধর্মগুলোর মধ্যে বিরোধের ও মানব সমাজের মধ্যে বিভক্তি বা অনৈক্যের মূল কারণ। অন্যদিকে একত্ববাদ বা তাওহিদই মানব জাতির ঐক্যের মূল সূত্র।

তিন. অন্য ধর্মের অনুসারিরা যেভাবে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা লঙ্ঘন করে অভিশপ্ত হয়েছে তা আমাদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হয়ে আছে। তাই আমাদের উচিত ধর্মীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।