সূরা আল মায়েদা;(৮ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(৮ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 8:48:47 2-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ২৩-২৬

সূরা মায়েদার ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ رَجُلَانِ مِنَ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُونَ وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

"কিন্তু তাদের মধ্যে দু'জন যারা আল্লাহকে ভয় করতো এবং যাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ছিল তারা বলেছিল, তোমরা তাদের মোকাবেলা কর সঠিক দ্বার দিয়ে প্রবেশ কর একবার প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে তোমরা যদি মুমিন হও তবে আল্লাহর ওপর নির্ভর কর।" (৫:২৩)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, হযরত মুসা (আ.) অত্যাচারিদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য বনি ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং নিজেদের শহরকে মুক্ত করতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা সংগ্রাম কিংবা জিহাদ করতে রাজি হয়নি। বরং তারা বলেছিল আমরা শহরে ঢুকব না যদি না তারা নিজেরাই বেরিয়ে যায়। এ আয়াতে বলা হয়েছে, ইহুদি গোত্রপতিদের দু'জন যাদের নাম তৌরাতে বলা হয়েছে ইউসা ও কালেব তারা জনগণকে বলেছিল, শত্রুদেরকে ভয় করছ কেন? খোদাকে ভয় কর এবং তার ওপর ভরসা করে শহরের এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে শত্রুদের ওপর একেবারে ঝাপিয়ে পড়। যদি তোমাদের ঈমানের ওপর অটল থাক এবং আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে পড় তাহলে নিশ্চিত থেক তোমরা বিজয়ী হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. আল্লাহকে যারা ভয় করে অন্য কোনো শক্তিকে তারা ভয় করে না। আল্লাহর ওপর ঈমান ইজ্জত, সম্মান এবং শক্তির উৎস।

দুই. আমরা যদি অগ্রসর হই তাহলে ঐশী সাহায্য নাজেল হবে, না এগোলে সাহায্যের আশা বৃথা।

তিন. চেষ্টা প্রচেষ্টা ছাড়া তাওক্কুল করা বা নির্ভর করার কোনো অর্থ হয় না। সাহস এবং উদ্যমের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি রয়েছে তাকওয়া ও নির্ভরতারও।

এ সূরার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا أَبَدًا مَا دَامُوا فِيهَا فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلَا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ

"তারা বলেছিল হে মুসা! যতক্ষণ তারা সেখানে আছে ততক্ষণ আমরা সেখানে প্রবেশ করবই সুতরাং তুমি এবং তোমার প্রভু যাও এবং যুদ্ধ কর আমরা এখানেই বসে থাকব এবং পর্যবেক্ষণ করব।" (৫:২৪)

হযরত মুসা (আ.)এর আহ্বান এবং গোত্রের নেতাদের প্রেরণা সত্ত্বেও বনি ইসরাইল লড়তে রাজি ছিল না বরং পরিপূর্ণ ঔদ্ধত্য দেখিয়ে তারা মুসাকে বলেছিল, আমরা কেন যুদ্ধে যাব তুমি যাও। তোমার পরওয়ারদেগারতো তোমার সাথে রয়েছে, অবশ্যই বিজয়ী হবে। তুমি যখন শহর দখল করবে আমরাও তখন প্রবেশ করবো।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো:

এক. বনি ইসরাইল গোত্র হলো, বেয়াদবি, অজুহাত সন্ধানী, সুবিধাবাদী এবং অলসের নমুনা। আমরা যেন তাদের মত না হই এবং তাদের পরিণতি ভোগ না করি সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

দুই. সমাজ সংস্কারক এবং ঐশী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকার পরও মানুষের ওপর থেকে দায়িত্বভার চলে যায় না। তাই এ কথা বলার অবকাশ নেই অমুকতো রয়েছেন তাই আমাদের দায়িত্ব নেই।

সূরা মায়েদার ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ رَبِّ إِنِّي لَا أَمْلِكُ إِلَّا نَفْسِي وَأَخِي فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ

"সে বলেছিল হে আমার প্রভু! শুধুমাত্র আমার নিজের এবং আমার ভ্রাতার ওপর আমার আধিপত্য আছে সুতরাং এই বিদ্রোহী সম্প্রদায় থেকে আমাদের পৃথক করে দাও।" (৫:২৫)

ইতিহাস বেশ আশ্চর্যজনক। যে জাতি হযরত মুসা (আ.)এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল এমনকি নিজেদের স্বাধীন পরিচয় পেয়েছিল তারা আজ নিজেদের শহরে প্রবেশ করতেও কোনো রকম পদক্ষেপ নিতে রাজি নয়। তারা চাচ্ছে আল্লাহর নবীই সব কিছু করুক। তাদেরকে শহরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাক। এ বিষয়টি হযরত মুসা (আ.)কে কষ্ট দেয় যার ফলে তিনি বনি ইসরাইলকে অভিশাপ দেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, ফাসেক এবং অপরাধীদেরকে যেন শাস্তি দেয় এরপর আর তাদেরকে সংশোধন করার ইচ্ছা তার ছিল না। এই আজাব থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বলেছেন তাদের এবং আমাদের মাঝে পার্থক্য রেখা টেনে দাও।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো নবীই অবহেলা করেননি। সৌভাগ্যের লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছার ক্ষেত্রে চেষ্টা চালাতে অলসতা করেছে জনগণ।

দুই. আল্লাহর হুকুম পৌঁছে দেয়াই ছিল নবীদের দায়িত্ব, জনগণকে তা করতে বাধ্য করা নয়।

সূরা মায়েদার ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِينَ سَنَةً يَتِيهُونَ فِي الْأَرْضِ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ

"আল্লাহ বললেন, অতএব এই পবিত্র ভূমি চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো দেশে দেশে তারা উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে। তুমি কিন্তু এসব সত্য ত্যাগী বিদ্রোহী লোকদের দুঃখ করো না।" (৫:২৬)

ঐশী শাস্তি যে কেবল কেয়ামতেই হবে তা ঠিক নয় বরং কখনও কখনও আল্লাহপাক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এই দুনিয়াতেই তাদের কুকাজের শাস্তি দেন। বনী ইসরাইলের অজুহাত অন্বেষণ এবং নাফরমানির শাস্তি দিতে আল্লাহ চল্লিশ বছর তাদেরকে সিনাই প্রান্তরে আশ্রয়হীনভাবে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পবিত্র এই ভূখণ্ডের বরকত থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। মজার ব্যাপার হল, স্বয়ং তৌরাতে এ ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিনাই প্রান্তরে চল্লিশ বছর ধরে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ানোর পর এবং হযরত মুসা (আ.) কে হারানোর পর পুণরায় শহরে প্রবেশ করার জন্য সামরিক হামলা করতে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রথম পর্যায়ের অলসতা তাদেরকে এই চল্লিশ বছরের উদভ্রান্ত জীবন ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।

এ আয়াত থেকে শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

এক. শত্রুর মোবাবেলায় দুর্বলতা প্রদর্শন কিংবা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করা, বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং উদবাস্তু হওয়ার কারণ।

দুই. জেহাদের ময়দান থেকে পলায়নকারীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা উচিত।

তিন. আল্লাহর অলিগণ এমনকি পাপীদের শাস্তিও সহ্য করতে পারেন না। পাপীদের জন্যও তাদের মন পড়ে। তবে সমাজের প্রয়োজনে অপরাধীকে তিরস্কৃত করা তিতা স্বাধের ওষুধের মত।