সূরা আল মায়েদা; (২২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা; (২২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:25:44 1-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৭৬-৮০

সূরা মায়েদার ৭৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ أَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّ‌ا وَلَا نَفْعًا وَاللَّـهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿৭৬

(হে রাসূল!) বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুর উপাসনা কর ? যার না ক্ষতি করার সাধ্য আছে, আর না উপকার করার, অথচ একমাত্র আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (৫:৭৬)

আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই বিগত আসরে উপস্থাপিত আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতো হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন খোদা। এ আয়াতে তারি ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছেঃ কীভাবে তোমরা ঈসাকে পূজা করছো। অথচ সে তোমাদের ভালো-মন্দ কোনোটারই মালিক নয়। যেখানে একজন নবী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মানুষের জীবনে কোনোরকম ভূমিকা রাখার যোগ্যতা রাখেন না, সেখানে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে ইবাদাত লাভের কোনোরকম যোগ্যতা তার নেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. শেরেকির পথের অসারতা একটু ধৈর্য ধরলেই এবং একটু বুদ্ধি বিবেচনা খাটালেই স্পষ্ট হয়ে পড়ে কেননা আল্লাহ পাক মানুষকে এই প্রশ্নটি করবেন যে যা তোমাদের জীবনে কোনোরকম প্রভাবই ফেলে না তা কি প্রার্থনার যোগ্য?

দুই. আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য (নকল) খোদা এমনকি দেখতে, শুনতে এবং মানুষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতেও অক্ষম,ফলে সমস্যা সমাধান করার তো প্রশ্নই আসে না।

এ সূরার ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ‌ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِن قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرً‌ا وَضَلُّوا عَن سَوَاءِ السَّبِيلِ ﴿৭৭

(হে রাসূল!) তুমি বল, ‘হে গ্রন্থধারীরা! তোমরা তোমাদের ধর্মে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি কর না এবং সেই সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না যারা পূর্বেই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং বহু সংখ্যক লোককে পথভ্রষ্ট করেছে, আর সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।’(৫:৭৭)

আগের ক'টি আয়াতে নবীদের ব্যাপারে আহলে কিতাবের বাড়াবাড়ির কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে আবারো তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে অতিশয়োক্তি করা থেকে বিরত থাকার জন্যে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নবীদের পরিপূর্ণতার বর্ণনা তোমাদেরকে যেন এ রকম বাড়াবাড়ির পর্যায়ে

না নিয়ে যায় যে তোমরা তাঁদের ব্যাপারে অসত্য বলে ফেল। মানবেতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, একদল উগ্র ও কট্টর লোক নবীদেরকে মানুষের সাধারণ পর্যায় থেকেও নিচে নামিয়ে এনেছিল। তারা নবীদেরকে পাগল, অজ্ঞ বলেও অভিহিত করেছে। আবার অন্য দল নবীদেরকে মানুষের পর্যায় থেকে এতো উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে যে, একেবারে খোদার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অতএব নবীগণ মানুষেরই পর্যায়ভুক্ত। তবে পূত-পবিত্রতা এবং পূণ্য কাজের মাধ্যমে তাঁরা ঐশী কালাম গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছে- এ ধরনের অতিশয়োক্তি ইহুদি এবং খ্রিস্টানদেরকে তাদের পূর্ববর্তী মুশরিকদের আকিদা বিশ্বাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

এখান থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো- দ্বীনের ভিত্তি মধ্যপন্থা এবং ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যে-কোনো রকমের বাড়াবাড়ি ধর্মীয় শিক্ষার আলোকেই অসংলগ্ন।

সূরা মায়েদার ৭৮ এবং ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُ‌وا مِن بَنِي إِسْرَ‌ائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْ‌يَمَ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿৭৮﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ‌ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ﴿৭৯

বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী ছিল তাদের প্রতি দাউদ এবং মারইয়াম-তনয় ঈসার ভাষায় অভিসম্পাত করা হয়েছে; কারণ, তারা অবাধ্যতা করত এবং সর্বদা সীমালঙ্ঘন করত। (৭৮) এবং তারা যেসব জঘন্য কাজ করত, তা থেকে একে অপরকে নিষেধ করত না, তারা যা করত তা অবশ্যই নিকৃষ্ট ছিল।(৭৯)

নবীগণ হলেন ঐশী রহমত এবং হেদায়াতের ওসিলা। কিন্তু তাঁরা বর্ণবাদী কিংবা জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। সে কারণে তাঁরা নিজের গোত্রের খারাপ আচরণকে না দেখার ভান করে চুপচাপ থাকতেন না। তাঁরা ছিলেন সবার ক্ষেত্রেই ভারসাম্যপূর্ণ। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, বনী ইসরাইল যখন শনিবারের ছুটি সংক্রান্ত আল্লাহর আদেশকে উপেক্ষা করেছিল হযরত দাউদ (আ.) তখন তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। একইভাবে এই গোত্রেরই মুরব্বিরা যখন ঈসা (আ.) এর কাছে ঐশী খাবার চেয়েছিলো এবং ঈসা (আ.) এর দোয়ায় আল্লাহ যখন তা নাযিল করলেন তখন তাদের একদল ঐশী এই মোজেযাকে গ্রহণ করল না। এ কারণে দাউদ (আ.) এর মতো হযরত ঈসা (আ.) ও তাদেরকে অভিশাপ দিলেন। এ আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক আচরণের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ কেবল যে পাপীরাই গুনাহ করতো কিংবা ঐশী সীমালঙ্ঘন করত তা নয়, বরং সৎ এবং নেককারগণও নীরবতা পালন করার মধ্য দিয়ে পাপীদেরকে পাপ করার ক্ষেত্র সৃষ্টিতে সাহায্য করতো এবং তাদেরকে খোদার নাফরমানী করা থেকে বিরত রাখতো না।

এ আয়াত থেকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

এক. নবীগণ দয়ার মূর্ত প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো অভিশাপও দেন, কেননা তাঁরা ঐশী সীমালঙ্ঘনকারীদের সাথে কোনোভাবেই আপোষ করেন না।

দুই. ইতিহাসের যুগে যুগে বনী ইসরাইলদের বৈশিষ্ট্য ছিল আইন লঙ্ঘন করা।

তিন. কেবল গুনাহগাররাই নয় বরং যারা নীরব থেকে কিংবা হাঁসি দিয়ে পাপীদের জন্যে পাপের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে সাহায্য করে তারাও ঐশী ক্রোধের শিকার হয়।

চার. অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা প্রত্যেক মুমিনের সামাজিক দায়িত্ব।

এ সূরা ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

تَرَ‌ىٰ كَثِيرً‌ا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُ‌وا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ أَن سَخِطَ اللَّـهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ ﴿৮০

(হে রাসূল!) তুমি তাদের (ইহুদীদের) অনেককেই দেখবে যে, তারা অবিশ্বাসীদের সাথে বন্ধুত্ব করে; তারা তাদের জন্য পূর্ব থেকেই যা প্রেরণ করেছে অবশ্যই তা নিকৃষ্ট, ফলে আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং তারা চিরদিন শাস্তি ভোগ করবে।

বনী ইসরাইলের ইতিহাস বর্ণনার ধারাবাহিকতায় ইসলামের নবীর উদ্দেশ্যে এ আয়াতে বলা হচ্ছেঃ তারা কেবল ইসলামের আগমনের আগেই নয় বরং ইসলামের আগমনের পরও মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব করার পরিবর্তে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতো এবং তাদেরকেই অগ্রাধিকার দিতো। এই ঘটনাও আল্লাহর নবীদের অভিশাপের একটি কারণ।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবোঃ

এক. কুফরি নেতৃত্ব গ্রহণ-তা যেরকম বা যতোটুকুই হোক না কেন-আল্লাহর ক্রোধের কারণ।

দুই. কিয়ামত হলো পার্থিব এ জগতে মানুষের কর্মকাণ্ডের ফসল, আর দোযখ হলো মানুষের নিজের হাতে জ্বালানো আগুন।