সূরা আল মায়েদা;(১৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(১৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:39:4 1-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৬০-৬৩

সূরা মায়েদার ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُمْ بِشَرٍّ مِنْ ذَلِكَ مَثُوبَةً عِنْدَ اللَّهِ مَنْ لَعَنَهُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ وَجَعَلَ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَالْخَنَازِيرَ وَعَبَدَ الطَّاغُوتَ أُولَئِكَ شَرٌّ مَكَانًا وَأَضَلُّ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ

"(হে নবী! আপনি) বলুনঃ আমি কি তোমাদের জানাব যে,কারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মন্দ প্রতিফল পাবে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন এবং যারা তাগুতের আরাধনা বা উপাসনা করেছে, তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সত্যপথ থেকেও সবচেয়ে বেশি দূরে রয়েছে।" (৫:৬০)

আগের আলোচনায় আমরা জেনেছি, কোনো কোনো ইহুদি ও খ্রিস্টান মুসলমানদের চেয়েও মূর্তিপুজারীদের সঙ্গে বেশি যোগসাজশ বা খাতির রাখত। এমনকি তারা নামাজ ও এবাদতরত মুমিনদেরকে উপহাস করত। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন: যারা মুসলমানদের ধর্মকে উপহাস করছে এবং এমনকি তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করছে, তারা কেন নিজ বাবা-মায়ের কলঙ্কজনক পরিণতির কথা ভাবছে না? তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় এবং খোদায়ী নির্দেশকে নিয়ে খেল-তামাশা করায় আল্লাহর এমন কঠোর আজাবের শিকার হয়েছিল যে তাদের কেউ কেউ বানর ও কেউ কেউ শুকরের চেহারাযুক্ত অথবা এইসব পশুর স্বভাব-সম্পন্ন হয়ে পড়ে। তারা কেন এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয় না ও সংযত হয় না?

এটা স্পষ্ট যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র যুগে ইহুদিরা শুকর বা বানরের মত চেহারা-বিশিষ্ট ছিল না। কিন্তু জাত্যাভিমানী ইহুদিরা তাদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব ও অহংকার করত বলে কোরআন তাদের পূর্ব পুরুষদের ওই কলঙ্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের অহংকার চূর্ণ করছে ও তাদেরকে হেয় করছে।

আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধের শিকার হওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তির পাত্র হওয়া। অথচ আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে অনেক সময় পাপীরাও বঞ্চিত হয় না। অপরাধের ধরন ও মাত্রার আলোকেই তারা আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধের শিকার হয়। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের সীমালংঘনকারী বা হঠকারী পাপীরা আল্লাহর এবাদত পরিত্যাগ করে এবং খোদাদ্রোহী শাসকদের অনুগত হয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. মানবীয় মর্যাদা হারিয়ে ফেলা এবং মানুষের চেহারা-বিশিষ্ট পশুতে পরিণত হওয়া এক ধরনের খোদায়ী শাস্তি।

দুই. যারা আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধের শিকার হয়, মুমিন বা বিশ্বাসীদের মধ্যে তাদের কোনো স্থান থাকা উচিত নয়।

সূরা মায়েদার ৬১ ও ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا جَاءُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَقَدْ دَخَلُوا بِالْكُفْرِ وَهُمْ قَدْ خَرَجُوا بِهِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا يَكْتُمُونَ (৬১) وَتَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يُسَارِعُونَ فِي الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (৬২)

"যখন তারা তোমাদের কাছে আসে তখন বলে : আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অথচ তারা কুফর নিয়ে এসেছিল এবং কুফর নিয়েই বের হয়ে গেছে। তারা যা গোপন করত, আল্লাহই সে বিষয়ে পুরোপুরি জানেন।" (৫:৬১)

"আর আপনি তাদের অনেককে দেখবেন যে,পাপাচার,সীমালঙ্ঘন এবং হারাম খাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই দ্রুত বা অগ্রসর। তারা যা করছে তা অত্যন্ত মন্দ কাজ।" (৫:৬২)

মুমিন মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদি-খ্রিস্টানদের আচরণ তুলে ধরার পর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন- মুমিনদের সাথে এ ধরনের নিকৃষ্ট বা হীন আচরণ করা সত্ত্বেও তারা ঈমান আনার দাবি করত, অথচ তারা কখনও মুমিন হয়নি বা ঈমান আনেনি, বরং তারা নাফরমানি ও কুফরিতে ভরপুর মন নিয়েই মুমিনদের সারিতে প্রবেশ করেছে এবং একই অবস্থায় মুমিনদের সারি বা শিবির থেকে বের হয়েছে। তারা তাদের এ অবস্থাকে গোপন রাখলেও আল্লাহ তাদের আসল অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত এবং তিনিই তাদের কুফরির তথা পাপাচার, হারাম খাওয়া ও সীমালঙ্ঘনের সবচেয়ে ভাল সাক্ষী। কারণ, এ ধরনের কাজ ঈমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অবশ্য কোরআন বলেনি যে সব ইহুদি ও খ্রিস্টান এ ধরনের পাপাচারে জড়িত, বরং বলেছে যে তাদের বিপুল সংখ্যকই এ ধরনের মানুষ। এটা স্পষ্ট, ইহুদি ও খ্রিস্টান তথা আহলে কিতাবদের অনেকেই বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল ছিল।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে:

এক. ঈমানদার হওয়া কেবল দাবির বিষয় নয়, সৎ কাজের মধ্যেই ঈমানের পরিচয় ফুটে উঠে।

দুই. নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিস্তার ধর্মীয় সমাজকে পতনের দিকে টেনে নেয়। ক্ষমতা ও সম্পদের লোভ এবং প্রবৃত্তির পূজাই এসব পাপের উৎস।

তিন. সৎ কাজের প্রতিযোগিতা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য, আর কাফের ও মোনাফেকদের সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো অসৎ কাজ ও দুর্নীতির প্রতিযোগিতা।

চার. প্রকাশ্যে পাপ করা বা পাপ-কর্ম প্রকাশ করে বেড়ানো, পাপাচারের স্বভাব ও পাপে নিমজ্জিত হওয়া-এসব পাপের চেয়েও নিকৃষ্ট।

সূরা মায়েদার ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَوْلَا يَنْهَاهُمُ الرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ عَنْ قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

"ইহুদিদের দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদেরকে পাপপূর্ণ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? বস্তুত তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।" (৫:৬৩)

এ আয়াতে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গুরু-দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। সমাজের বহু লোককে পাপ ও বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হতে দেখেও ইহুদি পণ্ডিত ও নেতারা কেন তাদের বাধা দিচ্ছে না এবং তাদেরকে সতর্ক করছে না? আসলে কেবল নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখাই যথেষ্ট নয়, পাপীদেরকেও পাপ থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ, অন্যদের পাপাচারের ব্যাপারে নীরব থাকার অর্থ এসব কাজে সন্তুষ্ট থাকা। আর এ ধরনের নিস্ক্রিয়তার জন্যও মানুষকে শাস্তি পেতে হবে।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. পাপের মোকাবেলায় নীরবতা ও নিস্ক্রিয়তা পাপকে উৎসাহ যোগায় এবং এর ফলে পাপীদের স্পর্ধা বেড়ে যায়।

দুই. সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে বাধা দেয়ার দায়িত্ব সর্বাগ্রে আলেম সমাজকেই পালন করতে হবে।

তিন. জ্ঞানের মূল্য রয়েছে তার প্রকাশের মধ্যে ও অজ্ঞতাসূলভ আচরণ প্রতিহত করার মধ্যে।