সূরা আল মায়েদা;(২৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(২৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:23:19 1-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৮১-৮৩

সূরা মায়েদার ৮১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَـٰكِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ

"যদি তারা আল্লাহর প্রতি ও রাসূলের প্রতি এবং তাঁর (রাসূলের) ওপর নাজেল হওয়া বিষয়ে ঈমান আনত, তবে কাফেরদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই দুস্কিৃতিকারী।" (৫:৮১)

আগের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ইহুদিদের অনেকেই কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে। তাই মহান আল্লাহ তাদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, এই বন্ধুত্ব ও নিজেদের ওপর কাফেরদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়া থেকে বোঝা যায়, ইহুদিরা সত্যিকার অর্থে আল্লাহ, ইসলামের নবী (সা.) ও পবিত্র কোরআনের প্রতি ঈমান আনেনি। কারণ, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল এবং কোরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখত তাহলে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাত না ও তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করত না। তারা যে শুধু ইসলামের নবী (সা.) ও কোরআনের প্রতি ঈমান আনেনি তা নয়, এমনকি নিজেদের নবী ও ধর্মগ্রন্থ বা তাওরাতের প্রতিও প্রকৃত ঈমান রাখে না। ইহুদিরা নিজ নবী ও ধর্মগ্রন্থের নির্দেশনার বিপরীত কাজই করত।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. কাফেরদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আল্লাহর প্রতি ও তাঁর দেয়া ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য।

দুই. কাফেরদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া ও তাদের সাথে আপোস করা ধর্মহীনতা এবং দুরাচারের লক্ষণ।

সূরা মায়েদার ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِينَ آمَنُوا الْيَهُودَ وَالَّذِينَ أَشْرَكُوا وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُم مَّوَدَّةً لِّلَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَىٰ ذَٰلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيسِينَ وَرُهْبَانًا وَأَنَّهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ

"(হে নবী!) আপনি সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতায় ইহুদী ও মুশরেকদেরকেই সবচেয়ে কঠোর দেখতে পাবেন এবং আপনি সবার চাইতে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বে অধিক নিকটবর্তী তাদেরকে পাবেন, যারা নিজেদেরকে খ্রিস্টান বলে। এর কারণ এই যে, খ্রিস্টানদের মধ্যে আলেম রয়েছে, দরবেশ রয়েছে এবং তারা (সত্য বা আল্লাহর মোকাবেলায়) অহঙ্কার করে না।" (৫:৮২)

 

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মহানবী (সা.)'র নবুওয়্যতের পঞ্চম বছরে তাঁর নির্দেশে একদল মুসলমান মুশরিকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আবিসিনিয়ায় হিজরত করে। সেখানকার বাদশাহ নাজ্জাশি ছিলেন একজন খ্রিস্টান। কিন্তু তিনি হিজরতকারী এই মুসলমানদেরকে সাদরে বরণ করেন এবং মুশরিকদের প্রতিনিধির হাতে তাদেরকে তুলে দিতে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, নাজ্জাশির দরবারের খ্রিস্টান পাদ্রিরা জাফর ইবনে আবি তালেবের কণ্ঠে সূরা মরিয়মের আয়াত শুনে কেঁদে ফেলেন এবং মুসলমানদের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন।

মদীনায় রাসূল (সা.)'র হিজরতের পর ইহুদিরা প্রথমদিকে এ শহরে মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু তারা এ চুক্তি লঙ্ঘন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের শরিক হয়। তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফলেই আহজাবের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

এ আয়াতে মুসলমানদের সাথে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আচরণের তুলনা করে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.) ও মুসলমানদেরকে আল্লাহ বলছেন: খ্রিস্টানরা তুলনামূলকভাবে তোমাদের প্রতি বেশি ঘনিষ্ঠ। কারণ, তাদের মধ্যে এমন একদল আলেম ও দরবেশ রয়েছেন যারা আল্লাহ বা সত্যের মোকাবেলায় বিনম্র। কিন্তু ইহুদিরা কেবল তোমাদেরকে তো সাহায্য করছেই না, বরং মুশরিকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

এ আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলামের ইতিহাসের পরিক্রমায় সব যুগেই ইহুদিরা মুসলমানদের সবচেয়ে কঠোর শত্রু হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। বর্তমান যুগেও ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে এবং তাদেরকে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও ইহুদিরা মুসলমানদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা সফল হয়নি।

দুই. জাতিগুলোর সামাজিক আচরণের গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে আলেম ও আবেদ বা দরবেশদের ভূমিকা লক্ষণীয়। তারা যদি সৎ ও সংশোধিত হন তবে সমাজও সৎ ও শুদ্ধ হয়, আর এর বিপরীতটি ঘটলে সমাজ বা জাতিও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

তিন. ইসলাম অন্ধ-বিদ্বেষের অনুমোদন দেয় না। এ ধর্ম অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে ন্যায়-সঙ্গত আচরণ করে। এর প্রমাণ হলো, মহান আল্লাহ কোরআনে সূরা মায়েদার ৮৩ নম্বর আয়াতে একদল খ্রিস্টান দরবেশ ও আলেমের প্রশংসা করেছেন।

এবারে সূরা মায়েদার ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَىٰ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ

"আর তারা (অর্থাৎ ওইসব খ্রিস্টান দরবেশ ও আলেম) রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলেঃ হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতএব, আমাদেরকেও সত্যের সাক্ষ্যদাতা বা মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন।" (৫:৮৩)

নাজ্জাশির দরবারের খ্রিস্টান পাদ্রিরা জাফর ইবনে আবি তালেবের কণ্ঠে সূরা মরিয়মের আয়াত শুনে কেঁদেছিলেন। শুধু তাই নয়, হিজরতকারী মুসলমানরা যখন আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরে আসেন তখন একদল খ্রিস্টানও বিশ্বনবী (সা.)'র সাথে সাক্ষাতের জন্য মক্কায় আসেন। সেখানে সূরা ইয়াসিনের আয়াতের তিলাওয়াত শুনে তাদের চোখে অশ্রুর ঢল নেমেছিল। এ আয়াতে সত্য মেনে নেয়ার সৎ মানসিকতার জন্য ওই খ্রিস্টানদের পবিত্র অন্তরের প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ। তারা আল্লাহর বাণী শুনেই সাথে সাথে প্রভাবিত হয়েছিল, আর এই সাহসী মানসিকতার কারণেই কোরআনের শিক্ষাগুলো তাদের কাছে তুলে ধরার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বলে কোরআন মনে করে।

অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, অশ্রু বিসর্জন তখনই মূল্যবান হয় যখন তা হবে জ্ঞান ও উপলব্ধির গভীর থেকে উৎসারিত। নিছক আবেগের আতিশয্যে যে কান্না সেই স্বল্পস্থায়ী আবেগের কোন মূল্য নেই। মানুষ স্বভাবতঃ সত্যের প্রেমিক। যাদের মন পরিচ্ছন্ন তারা দ্রুত সত্যকে মেনে নেয়। সন্তান যেমন বহু বছর ধরে মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার পর পুনরায় মায়ের সাক্ষাৎ পেয়ে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করে, তেম্নি সত্য প্রেমিকরাও সত্যকে উপলব্ধি করেই একই অনুভূতি লাভ করে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. মানুষের পরিপূর্ণতা জ্ঞানপূর্ণ ভালবাসার ওপর নির্ভরশীল। সত্যকে মনের দিক থেকেও মানতে হবে এবং তা যে সত্য তা জ্ঞান দিয়েও উপলব্ধি করতে হবে।

দুই. মানুষের অন্তর যদি সমৃদ্ধ বা উপযুক্ত অবস্থায় থাকে তাহলে শত বছরের পথ এক রাতেই অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব। বহু মুসলমান বহু বছর ধরে রাসূল (সা.)'র সাহচর্য পেয়েও সত্যকে বুঝতে পারেনি এবং তাদের ঈমান মৌখিক দাবির উর্ধ্বে উঠতে পারেনি, অথচ একদল খ্রিস্টানের অন্তর আল্লাহর কয়েকটি বাণী শুনেই এত আমূলভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল যে আল্লাহ নিজে তাদের প্রশংসা করেছেন।