সূরা আন নিসা;(৪র্থ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(৪র্থ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:31:28 1-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ১১-১৪

সূরা নিসার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِنْ كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا (১১) وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُنَّ وَلَدٌ فَإِنْ كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَكُمْ وَلَدٌ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُمْ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِنْ كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلَالَةً أَوِ امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ فَإِنْ كَانُوا أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ فَهُمْ شُرَكَاءُ فِي الثُّلُثِ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ وَصِيَّةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ (১২)

"আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের উত্তরাধিকারগত সম্পদ সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। কিন্তু দুয়ের বেশী কন্যা থাকলে তারা পাবে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ, আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ । মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পিতা ও মাতা প্রত্যেকেই পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। আর যদি মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হয় এবং শুধু তার পিতা মাতাই উত্তরাধিকারী হলে তার মায়ের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ,আর মৃত ব্যক্তির ভাই বোন থাকলে মা পাবে ১/৬ ভাগ। এসব কিছুই সে যা অসিয়ৎ করে গেছে, সেই অসিয়ৎ পালন এবং তাঁর ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য । তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য বেশী উপকারী তা তোমরা জান না,এও আল্লাহর নির্দেশ । নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।" (৪:১১)

"তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধাংশ তোমাদের জন্য যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে, তাদের সন্তান থাকলে,তোমাদের জন্য তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ । এসব কিছুই তারা যা ওসিয়ত করে, তা দেয়ার পর এবং তাদের ঋণ শোধের পর। তোমাদের সন্তান না থাকলে, তাদের জন্য তোমাদের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ, আর তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের জন্য তোমাদের সম্পত্তির ৮ ভাগের এক ভাগ। এসবই তোমরা যা ওসিয়ত করবে তা দেয়ার পর ও ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য। যদি কোন পুরুষ মারা যায় (সন্তান ও পিতা-মাতাহীন অবস্থায়) এবং বৈমাত্রেয় ভাই-বোনই যদি তার একমাত্র উত্তরাধীকারী হয় অথবা কোন নারী যদি মারা যায় (সন্তান ও পিতা-মাতাহীন অবস্থায়,তার ভাই-বোনই যদি তা একমাত্র উত্তরাধীকারী হয় তাহলে তারা প্রত্যেকেই পাবে এক ষষ্ঠাংশ । তারা এর বেশী হলে সকলে অংশীদার হবে এক তৃতীয়াংশের। এটাও ওসিয়ত ও ঋণ শোধের পর প্রযোজ্য। যদি এটা কারও জন্য হানিকর না হয়। এটা আল্লাহর নির্দেশ । আল্লাহ সর্বজ্ঞ,সহনশীল।" (৪:১২)

মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহই যেহেতু ধর্মীয় বিধি-বিধান দিয়েছেন তাই তার নির্দেশ ও আইন-কানুন মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে বস্তু জগতের সম্পর্ক,মালিকানা, কর্তৃত্ব সব কিছু ছিন্ন হয় এবং মানুষ অন্য জগতে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মানুষ মৃত্যুর আগে জীবদ্দশায় সে সব অর্জন করে সে সবের কি পরিণতি হয় এবং সে গুলো কার কাছে হস্তান্তর করা হয়? কিছু গোত্রের মধ্যে মৃত ব্যক্তির ধন সম্পদ তার পিতা,পুত্র,ভাই এ ধরনের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার রীতি প্রচলিত আছে। ওই সব গোত্রে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী,কন্যা সন্তান বা মহিলারা কোন সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পান না। আর বর্তমান আধুনিক কিছু দেশে মৃত ব্যক্তির সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ওই সম্পদে সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকারের কোন স্বীকৃতি দেয়া হয় না। কিন্তু ইসলামের বিধান এ থেকে ভিন্ন। ইসলাম ধর্মে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ ছেলে ও মেয়ে সন্তান,স্ত্রী এবং নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। একইসঙ্গে ইসলাম ধর্মে মৃত ব্যক্তির জন্যও কিছু অধিকার দেয়া হয়েছে। মৃত ব্যক্তি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ ইচ্ছেমত ওসিয়ত করতে পারবে যাতে তা তার মৃত্যুর পর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ব্যয় করা হয়। ইসলামের এ অসাধারণ উত্তরাধিকার আইনের ফলে যাদের যথেষ্ট সম্পদ আছে তারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্মতৎপরতা চালায়। কারণ তারা জানে যে তাদের মৃত্যুর পর সম্পদের মালিক হবে তাদেরই সন্তান-সন্তুতি যারা কিনা তার নাম ও স্মৃতি চিরঞ্জীব রাখবে। এ জন্য ইসলাম ধর্মে প্রথম ধাপে উত্তরাধিকার ভাগ করা হয় সন্তানদের মধ্যে এবং এরপর নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের দ্বিগুণ সম্পদ দেয়া হয়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে সংসারের ভরণ-পোষণের দায় দায়িত্ব পুরুষের। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে পুরুষকে অধিক অর্থ উপার্জনের চেষ্টা চালাতে হয়। তাই তার মূলধন ও পুঁজির প্রয়োজন হয় বেশী। বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হবে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন মহিলাদের বিপক্ষে। কিন্তু ইসলামের অন্যান্য আইন কানুনের দিকে তাকালে বুঝা যায়,আসলে উত্তরাধিকার আইন নারীর স্বার্থের অনুকূলে। কারণ ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় অর্থ উপার্জনের কোন দায়িত্ব স্ত্রীর ওপর অর্পিত হয়নি। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ,পোশাক-আশাক, বাসস্থানসহ যাবতীয় চাহিদা মেটাবার দায়িত্ব স্বামীর। ফলে মহিলারা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী একভাগ সম্পত্তি পেলেও পুরোটাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় কিংবা নিজের জন্য সঞ্চয় হিসেবে রেখে দিতে পারেন। পুরুষ উত্তরাধিকারসূত্রে দুই ভাগ সম্পত্তি পেলেও তাকে কমপক্ষে অর্ধেক সম্পদ অথবা তারও বেশী স্ত্রীর মোহরানা ও ভরণ পোষণ বাবদ ব্যয় করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মহিলারা উত্তরাধিকার সূত্রে যে একভাগ সম্পত্তি পান সেটার মালিক এবং পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যে দুভাগ সম্পত্তি পায় তারও এক অংশের মালিক। অর্থাৎ মহিলারা একভাগ সম্পত্তি সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পারে এবং স্বামীর সাথে অংশীদার আরেক ভাগ সম্পদ দৈনন্দিন ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। অথচ স্ত্রীর সম্পত্তির ওপর পুরুষের কোন অধিকার নেই এবং পুরুষকে নারীর সব প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাতে হয়।

সূরা নিসার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মৃত ব্যক্তির বাবা-মা,সন্তান-সন্ততি এবং স্ত্রীর মধ্যে সম্পদ বণ্টনের নিয়ম বলা হয়েছে। অবশ্য ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের খুঁটিনাটি সব কিছু এ দুই আয়াতে বলা হয়নি। নির্ভরযোগ্য হাদিসে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। অবশ্য বলে রাখা দরকার যে,মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বণ্টনের আগে প্রথমে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ এবং তার ওসিয়ত বাস্তবায়ন করতে হয়। কারণ উত্তরাধিকারদের চেয়ে মৃত ব্যক্তি এবং অন্যান্য মানুষের অধিকার অগ্রগণ্য।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে,

এক. উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে থাকে। এটা তাদের প্রতি অবিচার নয়। বরং এটা সামাজিক জীবনের পার্থক্য এবং মহাবিজ্ঞ আল্লাহ পাকের নির্দেশ থেকে উৎসারিত হয়েছে।

দুই. মানুষের অধিকার আদায় করা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দুই আয়াতে চার বার এ সম্পর্কে জোর দেয়া হয়েছে। যাতে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা অন্য মানুষের অধিকারের কথা ভুলে না যায়।

সূরা নিসার ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (১৩) وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ (১৪)

"এ সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা । কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত,সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বাস করবে এবং এটা মহাসাফল্য।" (৪:১৩)

"আর কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তার নির্ধারিত সীমা লংঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।" (৪:১৪)

উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতের পর এ দুই আয়াতে আল্লাহপাক বিশ্বাসী ব্যক্তিদেরকে আর্থিক ব্যাপারে বিশেষ করে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার আআহ্বান জানিয়েছেন এবং তার নির্দেশ লংঘনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা ভয়াবহ কঠিন। এ দুই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে,আল্লাহর আনুগত্য মানে কেবল তার এবাদত বা উপাসনা নয়। বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার মেনে চলা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও ধার্মিকতার শর্ত। সেই ব্যক্তি ও সমাজই কল্যাণের অধিকারী হবে যে এই বিধান তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে মেনে চলবে।

এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,

প্রথমত : দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণের অধিকারী হওয়ার উপায় হচ্ছে ইসলামের বিধান মেনে চলা।

দ্বিতীয়ত : মানুষের অধিকার যারা গ্রাস করে তারা কাফেরদের পর্যায়ে পড়ে এবং তারা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।

তৃতীয়ত: মৃত ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ অথবা সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য যদিও উপস্থিত নেই,তবুও মনে রাখা দরকার যে,আল্লাহ আছেন এবং যারা মানুষের অধিকার পদদলিত করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।