সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৯১-১৯৫
সূরা আলে ইমরানের ১৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ((১৯১
"জ্ঞানী তারাই যারা দাঁড়িয়ে,বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে যে হে আমাদের প্রতিপালক,আপনি এসব বৃথা সৃষ্টি করেননি। আপনি অর্থহীন কাজ থেকে পবিত্র। দোজখের আগুন থেকে আপনি আমাদের রক্ষা করুন।" (৩:১৯১)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে,আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বা নিদর্শন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে,তারাই জ্ঞানী যারা সব সময় সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা করে এবং সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তু দেখে এসব সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা করে। তারা এটাও বোঝেন যে,আল্লাহ নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে এই বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন। সাধারণ মানুষও কোন বাড়ী নির্মাণের সময় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিশেষ নক্সা অনুযায়ী বাড়ীর বিভিন্ন কক্ষ ও অন্যান্য অংশ নির্মাণ করে। তাহলে এটা কি মেনে নেয়া সম্ভব যে স্রষ্টা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই এ বিশাল জগত সৃষ্টি করেছেন? যদি বিশ্ব জগত সৃষ্টির কোন উদ্দেশ্য থাকে তাহলে সেখানে আমাদের ভূমিকা ও অবস্থান কী তা ভেবে দেখা কি উচিত নয়? এই সৃষ্টি জগত থেকে আমরা যতটা উপকৃত হচ্ছি তার কৃতজ্ঞতা হিসেবে স্রষ্টা ও সৃষ্টি জগতের ব্যাপারে আমাদের কী কর্তব্য? তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলছেন,যারা জ্ঞানী তারা এইসব বিষয় নিয়ে সব সময় চিন্তা ভাবনা করেন এবং কর্তব্যে অবহেলার জন্য তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি দোজখের আগুন থেকে মুক্তি লাভের জন্য দোয়া করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : বিশ্ব জগতের সব কিছুর মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন দেখা ও আল্লাহকে স্মরণ করা জ্ঞানের লক্ষণ। প্রকৃত চিন্তাশীল ব্যক্তিরাই আল্লাহকে স্মরণ করেন।
দ্বিতীয়ত : চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে অর্জিত ঈমানের মূল্য সাধারণ ঈমানের চেয়ে অনেক বেশী। সাধারণভাবে আল্লাহকে স্মরণের চেয়ে চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করাই বেশী কল্যাণকর।
তৃতীয়ত : সব সৃষ্টির মত মানুষ সৃষ্টিরও উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা এ লক্ষ্য থেকে যতই দূরে সরে যাব ততই দোযখ আমাদের কাছে চলে আসবে।
সূরা আলে ইমরানের ১৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ((১৯২
"হে আমাদের প্রতিপালক,আপনি যদি কাউকে অন্যায় কাজের জন্য দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করেন,তাহলে নিশ্চয়ই সে লাঞ্ছিত হবে এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।" (৩:১৯২)
এই আয়াতে খোদায়ী শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যদিও দোযখের আগুন যন্ত্রণাদায়ক এবং দগ্ধকারী। কিন্তু জ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বেশী শোক ও দুঃখের কারণটি হলো,দোযখে থাকার লাঞ্ছনা বা অপমান। যারাই দোযখে যাবে তারাই এ কলংকের ভাগী। সাধারণ মানুষ দোযখের আগুনকেই ভয় করে। কিন্তু জ্ঞানীরা বিচার দিবসে অপমানিত হওয়াকে ভয় করেন। কারণ তাদের দৃষ্টিতে পবিত্র ও সৎ ব্যক্তিদের সামনে কলংকিত হওয়া দোযখের আগুনে পোড়ার চেয়েও বেশী কষ্টকর।
এই আয়াত থেকে আমাদের যা মনে রাখা উচিত তা হলো,
প্রথমত : সৃষ্টি জগতের ব্যাপারে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা এবং একে খেলার সামগ্রী মনে করার অর্থ নিজের আত্মার ওপর জুলুম করা ও মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পদগুলো হাত ছাড়া করা।
দ্বিতীয়ত : আর যারা অত্যাচারী,তারা বিচার দিবসে আল্লাহর আওলিয়াদের সুপারিশ বা শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবে।
সূরা আলে ইমরানের ১৯৩ ও ১৯৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آَمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآَمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ (১৯৩) رَبَّنَا وَآَتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَى رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ ((১৯৪
"হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমরা এক আহবানকারীকে ঈমানের দিকে আহবান করতে শুনেছি যিনি বলছিলেন,তোমরা নিজ প্রতিপালকের ওপর ঈমান আন। তাতেই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের অপরাধগুলো ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে পূণ্যবানদের সাথে মৃত্যু দান করুন।" (৩:১৯৩)
"হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,সে অনুযায়ী আমাদের ওপর রহম করুন,কিয়ামতের দিন আমাদের লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি অঙ্গীকারের ব্যতিক্রম কিছু করেন না।" (৩:১৯৪)
যারা জ্ঞানী তারা নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আহবানে সাড়া দেয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা উপলদ্ধি করেন। আল্লাহর উপর ঈমান আনার জন্য নবীদের আহবানেও তারা ইতিবাচক সাড়া দেন এবং তাদের ঈমানকে প্রকাশ করেন। তারা নিজেদের ছোট ও বড় অন্যায়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং অবশেষে নিজেদের জীবনের জন্য কল্যাণ কামনা করেন। জ্ঞানীরা এটাও বোঝেন ভাল কাজ করার জন্য ভাল প্রতিদান বা পুরস্কার পাওয়াটা তাদের অধিকার নয়। বরং আল্লাহ পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন বলেই খোদার রহমত পাবার সুযোগ হয়েছে। তাই তারা সব সময় আল্লাহর কাছে এ দোয়া করেন যে আল্লাহ যেন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। অবশ্য আল্লাহ কখনো তাঁর ওয়াদা খেলাপ করেন না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : সত্যকে গ্রহণ করা এবং আল্লাহর বাণী বা সত্যের বাণী শুনে তা মেনে নেয়া বিচক্ষণতার লক্ষণ।
দ্বিতীয়ত : নিজের অপরাধ ও খারাপ কাজের দিকে লক্ষ্য রেখে সে সবের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। গোনাহর জন্য ক্ষমা চাওয়া ঈমান ও চিন্তা ভাবনার জন্যে জরুরী।
তৃতীয়ত : দূরদৃষ্টি এবং সৎ ও মহৎ লোকদের মত মৃত্যুবরণ করা ঈমানদার জ্ঞানীদের দু'টি বৈশিষ্ট্য।
সূরা আলে ইমরানের ১৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ ((১৯৫
"তারপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে,আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না,তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা পরস্পরে এক। তারপর যারা হিজরত করেছে,তাদেরকে নিজেদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের প্রতি উৎপীড়ন করা হয়েছে আমার পথে এবং যারা লড়াই করেছে ও মৃত্যুবরণ করেছে,অবশ্যই আমি তাদের উপর থেকে অকল্যাণকে অপসারিত করব। এবং তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতে যার তলদেশে নহর সমূহ প্রবাহিত। এই হলো বিনিময় আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম বিনিময়।"(৩:১৯৫)
পূর্ববর্তী কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা জেনেছি ঈমানদার জ্ঞানী ব্যক্তিরা চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে তাদের ঈমান মজবুত করেন এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের কথা ঘোষণার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের গোনাহ ও ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করেন। এই আয়াতে আল্লাহ তাদের দোয়া ও তওবা কবুল করে তাঁর একটি সামগ্রিক বা চিরন্তন বিধানের কথা উল্লেখ করেছেন। এই চিরন্তন বিধান হলো,কোন সৎ কাজই বৃথা যায়না এবং সে ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ,তারা মানুষ হিসেবে সমান এবং তাদেরকে একই উৎস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে কেউ কারো চেয়ে বেশী মর্যাদা বা অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য নয়। মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র তারাই শ্রেষ্ঠ যারা খোদাভীরু ও সংযমী। এরপর পবিত্র কোরআন হিজরত ও জিহাদকে ইসলামী সমাজের জন্য সম্মান এবং স্থায়ীত্বের উৎস হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে,শুধুমাত্র ঈমানই যথেষ্ট নয়। আবার শুধুমাত্র জ্ঞান ও বিবেকও যথেষ্ট নয়। বরং নেক আমল বা সৎকাজ তাও শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে করা সৎকাজ ইহকাল ও পরকালে মানুষের সৌভাগ্যের জন্য জরুরী। যারা ঈমান আনার পর ঈমানের পাশাপাশি বাস্তবেও আন্তরিকতার সাথে ঈমানী দায়িত্ব পালন করবে তারা আল্লাহর কাছ থেকে বড় পুরস্কার লাভ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : প্রত্যেক সৎ কাজেরই পুরস্কার রয়েছে। তবে শর্ত হলো,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎ কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : ইসলাম ও আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদা এবং সম্মান অর্জনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে।
তৃতীয়ত : মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত গোনাহ ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পবিত্রদের স্থান অর্থাৎ বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না।