সূরা আন নিসা;(৬ষ্ঠ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(৬ষ্ঠ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:37:36 1-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৯-২৩

সূরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آَتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا (১৯)

"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য এটা বৈধ নয় যে, তোমরা জোর করে মহিলাদের বিয়ে করে তাদের উত্তরাধিকারী হবে। তাদের কাছ থেকে মোহরানার অংশবিশেষ আদায়ের জন্যেও চাপ প্রয়োগ করা বৈধ নয়, যদি না তারা প্রকাশ্য ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে ভালো না লাগলেও তালাক দিও না। কারণ আল্লাহ যাতে ব্যাপক কল্যাণ ও মঙ্গল রেখেছেন তোমরা হয়তো তাই অপছন্দ করছো।" (৪:১৯)

এ আয়াতের প্রথম অংশে পারিবারিক বিষয়ে মহিলাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা হয়েছে এবং মহিলাদের ব্যাপারে যে কোন ধরনের অপছন্দনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকতে পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছে। আয়াতের শেষাংশে পরিবার ব্যবস্থা রক্ষার ব্যাপারে একটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। সম্পদের প্রতি লোভ স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি অপছন্দনীয় রীতি। এ আয়াতে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, স্ত্রী নির্বাচনের এই মাপকাঠি বৈধ নয়। একইসঙ্গে কোন কোন সমাজে স্ত্রীদেরকে মোহরানা দেয়ার পর তার কিছু অংশ জোর করে ফেরত নেয়াও খুবই নোংরা রীতি । বিশেষ করে মোহরানার অংক যদি খুব বড় হয়,তার অংশবিশেষ ফেরত দেয়া স্ত্রীদের জন্য খুবই কষ্টকর। পবিত্র কোরআন এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছে এবং স্ত্রীদের সম্পদ ও অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছে। শুধুমাত্র স্ত্রীদের প্রকাশ্য ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে তাদের সাথে কঠোর আচরণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে। যেমন স্ত্রী প্রকাশ্যে ব্যভিচারী হলে তাকে মোহরানা না দিয়ে তালাক দেয়া যেতে পারে। এরপর মহান আল্লাহ এক সামগ্রীক নীতির বর্ণনা দিয়ে স্ত্রীদের সাথে ভালো আচরণ করতে পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন, কোন কারণে স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হও অথবা স্ত্রীর প্রতি তোমাদের ভালবাসা কমে যায় এবং স্ত্রীকে ভালো না লাগে তাহলে দ্রুত তালাকের সিদ্ধান্ত নিও না ও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করো না। কারণ,অনেক কিছুই মানুষের কাছে অপছন্দনীয় মনে হলেও আল্লাহ সে সবের মধ্যে অনেক কল্যাণ ও বরকত রেখেছেন।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পদের আকাঙ্ক্ষা যেন মানদণ্ড না হয়। ভালবাসাই বিয়ের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত,সম্পদ নয়।

দ্বিতীয়ত : স্ত্রীই মোহরানার একমাত্র মালিক। পুরুষ স্ত্রীকে দেয়া মোহরানার বা স্ত্রীর অন্য কোন সম্পদের ওপর কোন ধরনের মালিকানার অধিকার রাখে না।

তৃতীয়ত : পরিবার ব্যবস্থা রক্ষার দায়িত্ব পুরুষের। কঠোরতা ও ভুল বোঝাবুঝি যেন খারাপ আচরণ এবং পরিশেষে তালাক বা বিচ্ছিন্নতার কারণ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা পুরুষের দায়িত্ব।

সূরা আন নিসার ২০ ও ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآَتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا (২০) وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنْكُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا ((২১

"যদি তোমরা স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নাও, সে ক্ষেত্রে তাদের একজনকে মোহরানা হিসেবে প্রচুর অর্থ দিয়ে থাকলেও তা থেকে কিছু ফেরত নিও না। তোমরা কি মোহরানা ফেরত নেয়ার জন্য স্ত্রীদের ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেবে এবং প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত হবে?"(৪:২০)

"কিভাবে তা ফেরত নেবে যখন তোমরা একে অপরের সাথে সংগত হয়েছিলে এবং তারা বিয়ের সময় তোমাদের কাছ থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিল?"(৪:২১)

এ দু'টি আয়াতে অজ্ঞতার যুগে আরব সমাজে বহুল প্রচলিত একটি নোংরা প্রথার উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রথা অনুযায়ী পুরুষরা নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাইলে, প্রথম স্ত্রীর নামে মিথ্যা অপবাদ রটাতো,যাতে প্রথম স্ত্রী মানসিক চাপের শিকার হয়ে মোহরানা মাফ করে দেয় এবং স্বামী সহজেই তাকে তালাক দেয়। এরপর পুরুষ ওই মোহরানা দিয়েই দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই নোংরা প্রথা নাকচ করে দিয়ে বলছেন,তোমরা দাম্পত্য জীবনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ এবং তাতে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। আর এরই ভিত্তিতে অনেক বছর একসঙ্গে ঘর-সংসারও করেছ,এখন কিভাবে অন্যকে পাবার জন্য আগের চুক্তি ভঙ্গ করবে? এমনকি নিজের সতী স্ত্রীকেও অপবাদ দিতে দ্বিধাবোধ করছ না?

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমতঃ ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকারের সমর্থক এবং ইসলাম প্রথম স্ত্রীর অধিকার ক্ষুন্ন করে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি পুরুষকে দেয়নি।

দ্বিতীয়তঃ মোহরানা ফেরত নেয়া বৈধ নয়। বিশেষ করে কেউ যদি স্ত্রীকে অপবাদ দিয়ে বা তার মর্যাদাহানি করে মোহরানা ফেরত নেয়ার যুক্তি দেখায়,তাহলে তা ওই পুরুষের পাপ আরও বৃদ্ধি করবে।

তৃতীয়তঃ বিয়ের চুক্তি একটি সুদৃঢ় চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে আল্লাহ নারী ও পুরুষকে পরস্পরের জন্য বৈধ করেছেন। তাই এ চুক্তি রক্ষা করা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্যেই জরুরী।

 

সূরা নিসার ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 

وَلَا تَنْكِحُوا مَا نَكَحَ آَبَاؤُكُمْ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاءَ سَبِيلًا (২২) حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلَائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ وَأَنْ تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا ((২৩

 

"নারীদের মধ্যে তোমাদের পিতৃপুরুষ যাদের বিয়ে করেছে,তোমরা তাদের বিয়ে করো না,অতীতে যা হবার হয়েছে,এখন নয়। এটা অশ্লীল,অতিশয় ঘৃণ্য এবং নিকৃষ্ট আচরণ।" (৪:২২)

 

তোমাদের জন্য অবৈধ করা হল তোমাদের মা,মেয়ে,বোন,ফুফু বা পিতার বোন,খালা বা মায়ের বোন, ভাই এবং বোনের মেয়ে,দুধ মা, দুধ বোন, শাশুড়ী এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সহবাস হয়েছে,তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে জন্ম নেয়া কন্যা ও যারা তোমার অভিভাবকত্বে আছে। তবে যদি তাদের সাথে সহবাস না হয়ে থাকে, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই এবং তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দুই বোনকে একসঙ্গে বিয়ে করা। অতীতে যা হবার হয়েছে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।" (৪:২৩)

যেসব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম এই দুই আয়াতে তাদের তালিকা দেয়া হয়েছে। এই সব মহিলাদের বিয়ে করা মানব প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সামগ্রীকভাবে তিনটি ক্ষেত্রে বিয়ে বৈধ নয়।

প্রথমত : রক্তের সম্পর্কের অধিকারী মহিলারা। যেমন-মা ,বোন, কন্যা, ফুফু, খালা, ভাগনী ও ভাইঝিকে বিয়ে করা হারাম।

দ্বিতীয়ত : বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্ট বাধার ক্ষেত্রে যেমন স্ত্রীর মা, বোন ও স্ত্রীর পূর্ববর্তী স্বামীর ঔরসে জন্ম নেয়া কন্যাকে বিয়ে করা হারাম।

তৃতীয়ত : দুধের সম্পর্ক যেমন, দুধ মা ও দুধ বোনকে বিয়ে করা হারাম