সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৯৬-২০০
সূরা আলে ইমরানের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي الْبِلَادِ (১৯৬) مَتَاعٌ قَلِيلٌ ثُمَّ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمِهَادُ ((১৯৭
"শহরগুলোতে অবিশ্বাসীদের অবাধ বিচরণ আপনাকে যেন প্রতারিত না করে।" (৩:১৯৬)
"(এসব যাতায়াতের অর্জন হলো)সামান্য ভোগ মাত্র। অতঃপর জাহান্নাম হবে তাদের স্থায়ী আবাস এবং তা খুবই নিকৃষ্ট স্থান।"(৩:১৯৭)
কাফেরদের অবস্থার সাথে মুমিনদের দুনিয়ার অবস্থার তুলনা করলে দেখা যায় কাফেররা ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের অধিকারী। অন্যদিকে মুমিনরা স্বল্প ধনসম্পদের কারণে কষ্টকর জীবন যাপন করে। তাই অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে ভোগ-বিলাসে মগ্ন কাফেররা খোদাদ্রোহী ও জালেম হওয়া সত্ত্বেও কেন এত নেয়ামতের অধিকারী এবং বিশ্বাসীরা সৎ কাজ করা সত্ত্বেও কেন জীবনে এত অভাব-অনটন ও সমস্যার সম্মুখীন? ইসলামের আবির্ভাবের সময়ও মুমিনদের মনে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। কারণ,মক্কার মুশরিক ও মদীনার ইহুদিরা অবাধ-ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনে সক্ষম ছিল। অন্যদিকে মুসলমানরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করা এবং মুশরিকদের অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে অর্থ-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে কষ্টকর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলছেন কাফেরদের বস্তুগত অবস্থা বা পার্থিব অবস্থা দেখে প্রতারিত হইও না। কারণ,প্রথমত কাফেরদের ভোগ-বিলাস ও ধন সম্পদের প্রাচুর্য ক্ষণস্থায়ী মাত্র,যেমনটি তোমাদের অর্থাৎ মুমিনদের দারিদ্র বা বঞ্চনাও সাময়িক। দ্বিতীয়ত : কাফেরদের প্রাচুর্যের ভিত্তি হলো,খোদাদ্রোহিতা। আর তাই পরকালে তাদেরকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
অতএব,কাফেরদের অবস্থার সাথে তোমাদের নিজেদের অবস্থার তুলনা করতে চাইলে তাদের ও তোমাদের শেষ অবস্থার দিকে তাকানো উচিত। তা না হলে তোমরাও কি কাফেরদের মতই নিজেদেরকে ধ্বংসশীল এই জগতের মধ্যেই সীমিত মনে করছ? অবশ্য একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে,এই পৃথিবীতে কাফের ও মুমিন নির্বেশেষে যারাই জ্ঞান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বেশী পরিশ্রম করবে তারাই তত বেশী সফল হবে। আর যারাই জ্ঞান ও গবেষণা থেকে দূরে থাকবে,তারাই কষ্ট এবং দুর্ভোগের শিকার হবে। এ সত্য কাফের ও মুমিন সবার জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই,কাফেরদের সাফল্যের কারণ কুফরী নয় বরং তাদের পরিশ্রম ও সাধনা । যেমনটি মুমিনদের কষ্ট ও দুর্ভাগ্যের কারণ তাদের ঈমান নয় বরং তাদের অলসতা বা নিষ্ক্রিয়তাই এজন্যে দায়ী। সুতরাং কাফের ও মুমিনদের সাফল্য এবং ব্যর্থতার ব্যাপারে এদিকটিও লক্ষ্য রাখা উচিত।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : কাফেরদের চাকচিক্যময় ও বিলাসী জীবন যেন আমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং দুনিয়ার সম্পদের আশায় আমরা যেন আমাদের ঈমান কে ক্ষুণ্ন না করি।
দ্বিতীয়ত : মানুষের মধ্যে তুলনা করার সময় তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়গুলোকে একইসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তৃতীয়ত : দুনিয়ার সুখ ও প্রাচুর্য এক সময় শেষ হয়ে যাবে। তাই চিরস্থায়ী কল্যাণ ও সুখের কথা ভাবা উচিত।
সূরা আলে ইমরানের ১৯৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
لَكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا نُزُلًا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ لِلْأَبْرَارِ ((১৯৮
"কিন্তু যারা নিজ প্রতিপালককে ভয় করে,তাদের জন্য রয়েছে বেহেশত,যার নীচ দিয়ে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। এটা তাদের জন্য আল্লাহর আতিথ্য। আল্লাহর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ যা আছে তা সৎকর্মশীলদের জন্য শ্রেয়।" (৩:১৯৮)
আগের আয়াতে পরকালে কাফেরদের অবস্থা কী হবে তা উল্লেখ করার পর এই আয়াতে পরকালে সৎকর্মশীলদের ও পবিত্রদের অবস্থা সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়ে বলা হচ্ছে যদিও খোদাভীতি ও ধর্মীয় আইনের অনুসরণ পৃথিবীতে কোন কোন সমস্যা সৃষ্টি করে এবং এর ফলে সম্পদ সঞ্চয় ও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু আল্লাহ পরকালে মুমিন তথা তার বন্ধুদেরকে সবচেয়ে ভালো পন্থায় আতিথ্য দান করবেন। বাগান,গাছ-পালা এবং নদী বিধৌত বেহেশত ও বেহেশতের প্রাসাদে জীবন যাপন মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আতিথেয়তার প্রাথমিক উপকরণ। মুমিনদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ আতিথেয়তা হলো,আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া বিভিন্ন আধ্যাত্মিক নেয়ামত।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ঈমান ও সৎকাজ কবুল বা গৃহীত হবার শর্ত হলো খোদাভীতি। খোদাকে ভয় করে না এমন সৎকর্মশীল ব্যক্তি সমাজের জন্য কল্যাণকর হলেও তার নিজের জন্য কোন কল্যাণ নেই।
দ্বিতীয়ত: মুমিনরা পরকালে আল্লাহর মেহমান। আর বেহেশত তাদেরকে আপ্যায়নের প্রাথমিক পর্যায় মাত্র,যেমনটি মেহমানদের আপ্যায়নের শুরুতে শরবত দেয়া হয়। সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্যান্য যেসব পুরস্কার দেয়া হবে সেগুলো আরো উত্তম।
সূরা আলে ইমরানের ১৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنَّ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَمَنْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِمْ خَاشِعِينَ لِلَّهِ لَا يَشْتَرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ ((১৯৯
"আর আহলে কিতাবদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রয়েছে,যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং যা কিছু আপনার ওপর অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর উপর,তারা আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত থাকে এবং আল্লার আয়াতসমুহকে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে সওদা করে না,তারাই হলো সেইসব লোক যাদের জন্য পারিশ্রমিক রয়েছে তাদের পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যথাশীঘ্র হিসাব চুকিয়ে দেন।" (৩:১৯৯)
মক্কা থেকে মদীনায় মুসলমানদের হিজরতের পর সেখানকার এবং তার আশ-পাশের ইহুদী,খ্রিস্টানরা ইসলাম ধর্মের সাথে পরিচিত হয় এবং তাদের অনেকেই মহানবী (সা.)'র প্রতি ঈমান আনেন। এমনকি আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান বাদশা নাজ্জাশীও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাই নাজ্জাশীর ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে নিয়ে তার জন্য গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়ান এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। তখন কোন কোন মুনাফিক বলে ওঠে ইসলামের নবী (সা.) এমন এক কাফেরের জন্য নামাজ পড়েছেন যাকে তিনি কখনও দেখেননি। তখন মোনাফিকদের বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ এই আয়াত নাজেল করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অমুসলমানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে এবং তাদের মধ্যে যারা ভাল তাদের প্রশংসা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর কাছে নিরহঙ্কারী ব্যক্তির ঈমানই গ্রহণযোগ্য। দাম্ভিক ও অহঙ্কারী ব্যক্তির ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না।
সূরা আলে ইমরানের ২০০ নম্বর বা সর্বশেষ আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ((২০০
"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অভ্যন্তরীণ কু-প্রবৃত্তি ও বাইরের শত্রুর মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য ধারণে প্রতিযোগিতা কর এবং সীমান্তের শত্রুদের মোকাবেলার জন্য সব সময় প্রন্তুত থাক। আল্লাহকে ভয় কর,যাতে তোমরা তোমাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পার।" (৩:২০০)
এই আয়াত সূরা আলে ইমরানের সর্বশেষ আয়াত,যাতে পরপর চারটি নির্দেশ বা পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রথম তিনটি নির্দেশে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের ব্যাপারে আন্তরিক হতে বলা হয়েছে। মুমিনদের উদ্দেশ্যে এই আয়াত নাজিল হওয়ায় এটা স্পষ্ট যে,ঈমানের শর্ত হল ধৈর্য ও প্রতিরোধ। ব্যক্তিগত,সামাজিক ও পারিবারিক সংকটে ধৈর্য ধারণ করা এবং মুসলমানদের ধ্বংস করতে উদ্যত বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। তবে এর চেয়েও জরুরী হল আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের সীমান্ত রক্ষা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের আকাশ স্থল ও পানিসীমা রক্ষা করা। অবশ্য ধৈর্য এবং প্রতিরোধ তখনই কল্যাণকর যখন তা হবে খোদাভীতির আওতায়। একমাত্র তখনই ইহকাল ও পরকালে সাফল্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। তাই এই আয়াতের চতুর্থ নির্দেশে মুমিনদেরকে খোদাভীরু হতে বলা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ যদি শত্রুরা মিথ্যা ও অসত্যের পথে দৃঢ় এবং ধৈর্যশীল হয়,তবে আমরা কেন আল্লাহর পথে তথা তার ধর্ম রক্ষার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা থেকে বিরত থাকবো অথবা কেনইবা পাহাড়ের মত অটল থাকবো না?
দ্বিতীয়তঃ ধৈর্য ও প্রতিরোধ হতে হবে খোদাভীতির ছায়াতলে। তা না হলে ধৈর্য এবং প্রতিরোধ বিদ্বেষ ও অন্যায় একগুঁয়েমিতে পরিণত হবে।
(সূরা আলে ইমরান সমাপ্ত )