সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৭৯-১৮২
সূরা আলে ইমরানের ১৭৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا فَلَكُمْ أَجْرٌ عَظِيمٌ ((১৭৯
"অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় আছ,আল্লাহ বিশ্বাসীদের সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা আল্লাহ তার রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং তাঁকে অদৃশ্য সম্পর্কে জানিয়ে দেন। তাই তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের ওপর ঈমান আন। যদি তোমরা ঈমানদার ও সংযমী হও,তবে তোমাদের জন্য মহাপ্রতিদান আছে।" (৩:১৭৯)
এই আয়াত ওহুদ যুদ্ধ সম্পর্কিত সর্বশেষ আয়াত। ওহুদ যুদ্ধের সুখময় ও তিক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য মুমিনদের উদ্দেশ্যে এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন,কেউ ঈমান আনার দাবী করলেই আল্লাহ তা মেনে নেবেন এবং তাকে সব সময় সুখময় ও আরামদায়ক অবস্থায় রাখবেন এমনটি ভাবা ঠিক নয়। বরং আল্লাহ মানুষের ঈমানের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য তাদেরকে সুখ ও দুঃখ দিয়ে পরীক্ষা করবেন। আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর জানেন এবং তিনি পরীক্ষা না নিয়েও তা জানতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় কোন কোন নবী ছাড়া অন্য কেউ গোপন বিষয় জানেনা বলেই আল্লাহ তিক্ত ও দুঃখজনক ঘটনার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন এবং এরই ভিত্তিতে শাস্তি বা পুরস্কার দেন। ওহুদ যুদ্ধ ছিল মোনাফিকদের চেনার এক ভালো মাধ্যম। যদি সাধারণ মানুষেরা অদৃশ্যের জ্ঞানের মাধ্যমে ভালো ও মন্দ বুঝতে পারতো,তাহলে সামাজিক বন্ধনে বিপর্যয় নেমে আসতো এবং জীবন হয়ে উঠতো দুঃসহ। তাই মানুষের স্বাভাবিক জীবনের স্বার্থেই তাদের গোপন রহস্য পরীক্ষার মাধ্যমে ও পর্যায়ক্রমে উদঘাটিত হওয়া উচিত।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সূরা আলে ইমরানের ১৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ যেমনটি বলেছেন,কুফরীর ওপর অটল কাফেরদেরকে আল্লাহ তাদের নিজ অবস্থায় ছেড়ে দেবেন এবং কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেবেন। অন্যদিকে যারা ঈমানের দাবী করবে আল্লাহ তাদেরকে নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দেবেন না।
দ্বিতীয়ত : মানুষের গোপন রহস্য জানার চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ আল্লাহ তা পছন্দ করেন না।
তৃতীয়ত : শুধুমাত্র আল্লাহ এবং তাঁরই ইচ্ছায় কোন কোন নবী অদৃশ্যের খবর জানেন।
চতুর্থত : ঈমান আনা ও সংযমী হওয়াই আমাদের দায়িত্ব । কঠোর তপস্যা বা সাধনা করে মানুষের ভবিষ্যৎ জানা ও অন্তরের অবস্থা বা তাদের অন্য কোন গোপন রহস্য জানা এবং অন্যদের তা জানানো আমাদের দায়িত্ব ও কাজ নয়।
সূরা আলে ইমরানের ১৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ((১৮০
"আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তোমাদের যা কিছু দান করেছেন,তা থেকে অন্যদের দান করার ব্যাপারে যারা কার্পণ্য করে তারা যেন মনে না করে যে,এটা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। তারা যে বিষয়ে কৃপণতা করবে কিয়ামতে তাই তাদের গলার বেড়ী হবে। আল্লাহ আসমান ও জমীনের চরম স্বত্বাধিকারী। তোমরা যা কর,আল্লাহ তা জানেন।" (৩:১৮০)
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আয়াতে জিহাদ ও আল্লাহর রাস্তায় জীবন দান সম্পর্কে আলোচনার পর এই আয়াত ও পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে আল্লাহর পথে অর্থ সম্পদ দান খয়রাতের কথা বলা হয়েছে। কারণ,মুমিন ব্যক্তি সমাজের বঞ্চিতদের ব্যাপারে উদাসীন থেকে শুধু নিজের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। তাই,মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ পরীক্ষা হলো,বঞ্চিতদের প্রতি তাদের আচরণ। অর্থাৎ তারা বঞ্চিতদের সাহায্য করেন নাকি এ ব্যাপারে কার্পণ্য করেন আল্লাহ তা দেখবেন। এই আয়াতে আরো বলা হয়েছে,এমনকি যদি তোমরা ভবিষ্যতের কল্যাণ চাও তাহলেও দান খয়রাতই করা উচিত। কারণ,এতেই তোমাদের কল্যাণ হবে। আর যদি কার্পণ্য কর তাহলে এই দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরকালেও কার্পণ্যের কারণে শাস্তি পাবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আমরা অন্যদের কিছু দান না করলে আরো সম্পদশালী হব,এমন ধারণা ভুল। ধন সম্পদ আল্লাহরই দান। আল্লাহ চাইলে অন্যদের দান করার ফলে সম্পদ না কমে বরং বাড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত : যে সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয় না তা কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বয়ে আনে।
তৃতীয়ত : এ পৃথিবী ও বিশ্বের সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আমরা খালি হাতে এসেছি এবং খালি হাতেই চলে যাব। তাহলে আমরা কেন কৃপণ হবো?
চতুর্থত : কিয়ামত বা বিচার দিবসে আমাদের কাজ কর্মগুলো স্পষ্ট হবে। দুনিয়ায় যারা সম্পদের দাসত্ব করবে,তারা পরকালেও বন্দী দশায় থাকবে।
সূরা আলে ইমরানের ১৮১ ও ১৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمُ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ (১৮১) ذَلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ ((১৮২
"অবশ্য আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন,যারা বলে নিশ্চয়ই আল্লাহ দরিদ্র ও আমরা ধনবান। তারা যা বলেছে এবং অন্যায়ভাবে যেসব নবীগণকে হত্যা করেছে তা আমি লিপিবদ্ধ করব। আর আমি তাদের বলবো,তোমরা দহনকারী আজাব ভোগ কর।" (৩:১৮১)
"এটা তোমাদেরই কাজের ফল এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর অত্যাচার করেন না।" (৩:১৮২)
বর্ণনায় এসেছে,ইসলামের নবী (সাঃ) মদীনার আশপাশের কোন এক ইহুদী গোত্রের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ,নামাজ আদায়,যাকাত দেয়া ও দান করার আহবান জানিয়েছিলেন। ঐ গোত্রের প্রধান এর উত্তরে পরিহাস করে বলেন,এই আহবান অনুযায়ী আল্লাহ আমাদের মুখাপেক্ষী এবং আমরা কারো মুখোপেক্ষী নই। আল্লাহ আমাদের কাছে অর্থ চেয়েছেন এবং কিয়ামতের দিন বেশী প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা দিয়েছেন। ইহুদী গোত্র প্রধানের পরিহাসের জবাবে এ দুই আয়াতে মহানবী (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন,এই সব অন্যায় বক্তব্য এবং আল্লাহর নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার প্রতি তাদের সন্তুষ্টির জন্য সাজা পেতে হবে। পরকালে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবার শাস্তি।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো,
প্রথমত : গরীবদের দান খয়রাত করা বা ধার দেয়ার জন্য আল্লাহর আহবান তার দরিদ্র হবার লক্ষণ নয়। যে ধন সম্পদ আমাদের কাছে আছে,তা আসলে আল্লাহরই সম্পদ এবং তা শুধু আমানত হিসেবেই আমাদের কাছে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : পবিত্র সব কিছুর পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। ধর্ম ও ধর্মের পবিত্রতার অবমাননা করার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
তৃতীয়ত : অবান্তর বা ফাহেশা কথা বলা ও ঈমানদারদের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখা নবীগণকে হত্যার চেয়ে কোন অংশেই ছোট অপরাধ নয়।
চতুর্থত : পরকালের শাস্তি আমাদেরই কর্মফল মাত্র। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ বা অত্যাচার নয়।