সূরা বাকারাহ; আয়াত ৯৯-১০২
সূরা বাকারাহ'র ৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
وَلَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ آَيَاتٍ بَيِّنَاتٍ وَمَا يَكْفُرُ بِهَا إِلَّا الْفَاسِقُونَ
"হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি স্পষ্ট নিদর্শন অবতীর্ণ করেছি যা অবাধ্যরা ছাড়া অন্য কেউ অস্বীকার করে না।" (২:৯৯)
মদীনার ইহুদীরা ইসলাম গ্রহণ না করার জন্য নানা অজুহাত উত্থাপন করতো ৷ এর মধ্যে একটি ছিল, ফেরেশতা জিবরাইল রাসূলে খোদার কাছে ওহী আনায় তারা রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে না। কারণ ফেরেশতা জিবরাঈল(আ.)-কে তারা শত্রু মনে করত। আর এ আয়াতে তাদের আরেকটি অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে৷ ইহুদীরা বলতো আমরা এ কিতাবের কিছু বুঝি না এবং এর বিষয়বস্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আর তাই আমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনব না এবং কোরআনকেও তার মোজেযা হিসাবে গ্রহণ করব না। অথচ পড়লে ও কোরআনের বক্তব্য নিয়ে একটু চিন্তা করলেই ইসলামের নবীর সত্যতা এবং কোরআনের অলৌকিত্ব বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। অবশ্য এই সত্য তারাই উপলদ্ধি করতে পারে যাদের অন্তর পাপে কলুষিত হয়নি এবং যাদের মধ্যে সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব আছে। কারণ পাপ কাজ কুফরী বা সত্যকে প্রত্যাখ্যানের পটভূমি সৃষ্টি করে। মানুষ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা অনুসরণের মাধ্যমে কুফরীর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সত্যকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করে। কারণ ওই সত্য গ্রহণ করলে সে আর অনায়াসে পাপ কাজ করতে পারবে না।
এরপরের আয়াত অর্থাৎ একশ' নম্বর আয়তে বলা হয়েছে-
أَوَكُلَّمَا عَاهَدُوا عَهْدًا نَبَذَهُ فَرِيقٌ مِنْهُمْ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
"কি আশ্চর্য, যখন তারা (ইহুদীরা আল্লাহ ও তার পয়গম্বরদের সঙ্গে) কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের একদল তা ছুঁড়ে ফেলে,বরং অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।" (২:১০০)
এ আয়াতে রাসূলে খোদা (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, যাতে তিনি ইহুদীদের কার্যকলাপে দুঃখ না পান৷ কারণ ইহুদীদের আচরণ বিস্ময়কর। তারা তাদের নিজেদের গোত্রের নবীদের প্রতি দেয়া অঙ্গীকার রাখেনি। তারা হযরত মূসা (আ.)এর সাথে বিভিন্ন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর নানা অজুহাতে সেটা অমান্য করতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় আসার পর সেখানকার ইহুদীরা নবীজীর সাথে অঙ্গীকার করলো যে অন্তত তারা মুসলমানদের শত্রুকে সাহায্য করবে না৷ কিন্তু অচিরেই তারা তাদের সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আহযাবের যুদ্ধে তারা মুশরিকদের সাথে হাত মিলায়। একইভাবে আজও ইসরাইলের ইহুদীবাদীরা কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অঙ্গীকার মেনে চলছে না। কোন চুক্তি করার পরপরই তারা অবলীলায় তা ভঙ্গ করে বসে। কারণ এরা হলো বর্ণ বিদ্বেষী ও সুবিধাবাদী জাতি।
এরপর ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
"যখন রাসূলে খোদা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসাবে তাদের কাছে এলেন এমন কিছু নিদর্শন নিয়ে যার সাথে তাদের কাছে রাখা নিদর্শনের মিল ছিল, তখন ঐশী গ্রন্থের অনুসারীদের একদল আল্লাহর কিতাবকে অগ্রাহ্য করে বসে৷ যেন তারা সে সম্পর্কে কিছুই জানে না।" (২:১০১)
রাসূলে খোদা (সাঃ)এর আবির্ভাবের আগে ইহুদী পণ্ডিতরা জনগণকে তার আগমন সম্পর্কে সুসংবাদ দিতো। তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তওরাতে নবীজী সম্পর্কে যেসব নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো জনগণের মধ্যে বলে বেড়াতো। কিন্তু সত্যিই সর্বশেষ নবীর আগমন হয় তখন তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে এমনভাবে অস্বীকার করলো যেন তাঁর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।
মূলত: পদমর্যাদার লোভ অধিকাংশ মানুষের জন্য বিশেষ করে পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য একটি বিপজ্জনক বিষয়। যখন ইহুদী পণ্ডিতরা মনে করলো যে, তারা মহানবী (সাঃ)এর নবুয়্যতের সত্যতা স্বীকার করলে নিজেদের দুনিয়াবী পদমর্যাদা হাতছাড়া হবে, তখন তারা তাঁর নবুয়্যাতকে বেমালুম অস্বীকার করে বসলো। তবে ইহুদীদের মধ্যে যারা সত্যপন্থী এবং সৎ তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পবিত্র কোরআন বলেছে, অধিকাংশ লোক সত্যকে অস্বীকার করলেও তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করেছিল ৷
সূরা বাকারাহ'র ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
"ইহুদীরা (তওরাত অনুসরণের পরিবর্তে) সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তান যা আবৃত্তি করতো তার অনুসরণ করতো। অথচ সুলায়মান কখনো যাদু করেনি এবং সত্য প্রত্যাখ্যান করেনি। কিন্তু শয়তান মানুষকে যাদু শিক্ষা দিতো এবং কাফের হয়ে গিয়েছিল। ইহুদীরা বাবেল শহরের দুই ফেরেশতা হারুত ও মারুতের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছিল তা অনুসরণ করত। 'আমরা তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ-সুতরাং যাদুকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে কাফের হইও না'-এ কথা না বলে ওই দুই ফেরেশতা কাউকে কিছু শিক্ষা দিত না৷ কিন্তু তারা ওই দুই ফেরেশতা থেকে শুধু এমন কিছু শিখত যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। অথচ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। তারা শুধু ওই সব অংশই শিখত যা ছিল তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের জন্য কোন ধরনের উপকারী ছিল না। আর তারা নিশ্চয়ই জানত, যে এ পণ্য ক্রয় করবে পরকালে তার কোন মুনাফা পাবে না ৷ যে জিনিসের বদলে তারা নিজেদের বিক্রি করল তা বড়ই নিকৃষ্ট, যদি তারা জানত ৷" (২:১০২)
হযরত সোলায়মান (আ.)এর যুগে যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাই হযরত সোলায়মান (আ.) যাদুকরদের সব কাগজ-পত্র এক জায়গায় জমা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হযরত সোলায়মানের পর একদল লোক ওই কাগজ-পত্রের খোঁজ পায় এবং শরু করে যাদু শিক্ষা ও তার চর্চার। এ আয়াতে বলা হয়েছে- বনী ইসরাইলের কিছু লোক ঐশী গ্রন্থ তওরাত অনুসরণের পরিবর্তে ওই যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আর তারা তাদের এ কাজকে জায়েয করার জন্যে বলে বেড়াতে লাগলো যে,এই বই-পত্রতো সোলায়মানের এবং তিনি ছিলেন শক্তিশালী যাদুকর। পবিত্র কোরআন তাদের এ মিথ্যা দাবির জবাবে বলেছে সোলায়মান কখনোই যাদুকর ছিলেন না। বরং তিনি হলেন আল্লাহর নবী। তিনি যেসব অলৌকিক নিদর্শন দেখাতেন সেসব ছিল আল্লাহর দেয়া মোজেযা। বরং তোমরা এর মাধ্যমে ওইসব শয়তানের অনুসরণ করছো যারা যাদু চর্চা ছড়িয়ে দিয়েছে৷
অবশ্য আরেকটি উপায়েও ইহুদীরা যাদুবিদ্যা অর্জন করেছিল। আল্লাহর নির্দেশে বাবেল শহরে একবার হারুত ও মারুত নামে দুই ফেরেশতার আগমন ঘটে। মানুষরূপী এ দুই ফেরেশতার কাজ ছিল মানুষকে যাদু-তন্ত্রের প্রভাব নস্যাৎ করার উপায় বাতলে দেয়া। এ দুই ফেরেশতা একইসঙ্গে মানুষকে সতর্ক করে দিতো যাতে কেউ যাদু বিদ্যার অপব্যবহার করে নিজেদের বস্তুগত স্বার্থ হাসিল না করে। কিন্তু ইহুদীরা ওই দুই উপায়ে যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র শিখে এর মাধ্যমে নিজেদের অন্যায় স্বার্থ পূরণ করতো। যদিও তারা জানতো যে, যাদুর কাজ কুফরীর শামিল এবং এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার ও সমাজ। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সব কিছুর উর্দ্ধে একমাত্র আল্লাহ। তাই তার আশ্রয় প্রার্থনা,তার ওপর ভরসা,দোয়া এবং সদকা বা দান-খয়রাতের মাধ্যমে যাদুর দুষ্ট প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সূরা বাকারাহ'র ৯৯ থেকে ১০২ নম্বর আয়াতের মূল শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. ধর্মের প্রতি অনেকের অবিশ্বাস থেকে ধর্মের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিৎ নয়, বরং মনে রাখতে হবে পাপ কাজের কারণে মানুষের আত্মা সত্য গ্রহণের মনোভাব হারিয়ে ফেলে ৷
দুই. কেবল বিদ্যা শিক্ষাই যথেষ্ট নয় বরং এর সাথে সত্য গ্রহণের মনোভাব থাকাও জরুরী৷ ইহুদী পণ্ডিতরা তওরাতের বদৌলতে ইসলামের নবীর শুভ আগমনের কথা জানতো৷ কিন্তু তারা নিজেরাও নবীজীর প্রতি ঈমান আনেনি এবং অন্যদেরকেও নিষেধ করেছে ঈমান আনতে৷
তিন. জ্ঞান সব সময় মানুষের জন্য উপকারী নয়৷ বরং জ্ঞান হলো ধারালো চাকুর মতো৷ যদি তা অস্ত্রোপচারকারী ডাক্তারের হাতে পড়ে তাহলে তা দিয়ে তিনি রুগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। আর যদি খুনীর হাতে পড়ে তাহলে সে তা দিয়ে হত্যা করে নিরপরাধ মানুষকে ৷
চার. শয়তান পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ ও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। আর অন্যদিকে ফেরেশতারা চেষ্টা করে তাদের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি স্থাপনের। একইভাবে মানুষও দু'দলে বিভক্ত৷ একদল শয়তানের পথে আরেক দল ফেরেশতাদের পথে।