সূরা বাকারাহ;(২৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(২৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:40:31 1-10-1403

সূরা বাকারাহ; আয়াত ৯৪-৯৮

সূরা বাকারাহ'র ৯৪ ও ৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


قُلْ إِنْ كَانَتْ لَكُمُ الدَّارُ الْآَخِرَةُ عِنْدَ اللَّهِ خَالِصَةً مِنْ دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ () وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ



"(ওই ইহুদীদের) বলে দিন,যদি পরকালের বাসস্থান আল্লাহর কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে-অন্য লোকদের বাদ দিয়ে,তবে তোমরা নিজেদের মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।" (২:৯৪)
"কিন্তু তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য কখনোই মৃত্যু কামনা করবে না। আর আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের সম্পর্কে অবহিত ৷" (২:৯৫)

অতীতকাল থেকে ইহুদীরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করতো। তারা বিশ্বাস করতো বেহেশত তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং দোজখের আগুন তাদেরকে স্পর্শ করবে না। আর তারা আল্লাহর সন্তান ও তারই বন্ধু। এই মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা একদিকে তাদের খুশীমত জুলুম-অত্যাচার ও পাপ কাজ করতো আর অন্যদিকে আক্রান্ত হতো আত্মম্ভরিতা,গর্ব ও অহঙ্কারের ব্যাধিতে। ফলে এই আয়াতে তাদের বিবেকের ওপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, "বেহেশত একমাত্র ইহুদীদের জন্য" যদি তোমাদের এ দাবি সত্য হয় তাহলে তোমরা কেন দ্রুত বেহেশতে যাওয়ার জন্য মৃত্যু কামনা কর না? কেন মৃত্যুকে ভয় পাও? মৃত্যু ভয় অনেকটা চালকের ভ্রমণভীতির মত। ওই চালকই সফর করতে ভয় পায় যে রাস্তা চেনে না,জ্বালানি নেই কিংবা অপরাধ করেছে, অথবা চোরাই মাল বহন করছে বা গন্তব্যস্থলে থাকার কোন জায়গা নেই৷ কিন্তু প্রকৃত মোমিন রাস্তা চেনে,সৎকাজের মাধ্যমে জ্বালানি সংগ্রহ করেছে,তওবার মাধ্যমে অপরাধ মার্জনা করে নিয়েছে, তার কাছে চোরাই কিছু নেই এবং পরকালেও তার রয়েছে বাসস্থান বা বেহেশত।

অধিকাংশ মানুষ যারা মৃত্যুকে ভয় পায়,তাদের ভীতি মূলত: দু'টি কারণে৷
প্রথমত: তারা মৃত্যুকেই চূড়ান্ত ধ্বংস মনে করে। দ্বিতীয়ত: তারা হয়ত পরকালে বিশ্বাস করে, কিন্তু নিজেদের পাপ ও অন্যায় কাজের জন্যে মৃত্যুকে ভয় পায়। কারণ মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয় মানুষের কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ। আর তাই মৃত্যু যাতে দেরীতে আসে ইহুদীরা সেটাই কামনা করতো। কিন্তু নবী-রাসুল এবং আল্লাহর অলীরা মৃত্যুকে বিনাশ ও ধ্বংস মনে করেন না বরং একে আরেকটি জীবনের সূচনা বলে বিশ্বাস করেন। তারা তাদের কর্মে ও চিন্তায় কোন অপরাধ করেননি বলে মৃত্যুকে ভয় পান না বরং উদ্যম ও আগ্রহের সাথে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন,খোদার কসম! মৃত্যুর প্রতি আমার আকর্ষণ মাতৃস্তনের প্রতি নবজাতকের আকর্ষণের চেয়ে বেশী৷

৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ

 

"আপনি তাদেরকে (ইহুদীদেরকে) জীবনের প্রতি সবার চাইতে,এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা দেখেন।" (২:৯৬)

রাসূলে খোদা (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে এ আয়াতে বলা হয়েছে, বেহেশতের দাবিদার ইহুদীরা মৃত্যু কামনাতো করেই না বরং অন্যান্য মানুষ এমনকি মুশরিকরা যারা পরকালে বিশ্বাস করে না এবং মৃত্যুকে জীবনের ধ্বংস বলে মনে করে, তাদের চেয়েও এ দুনিয়ার প্রতি তারা বেশী লোভী। তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি এতই আসক্ত যে, পৃথিবীতে হাজার বছর জীবন-যাপন করতে চায়। যাতে আল্লাহর শাস্তি থেকে দূরে থাকা যায় এবং জমা করা যায় দুনিয়ার ধন-সম্পদ। কিন্তু আল্লাহপাক জবাবে বলেন, তাদেরকে এক হাজার বছর বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া হলেও ওই দীর্ঘায়ূ তাদের প্রাপ্য শাস্তি ঠেকাতে পারবে না। কারণ তাদের সমস্ত কাজ আল্লাহ দেখেন, কাজেই এই শিশুসুলভ চিন্তা তাদের জন্য কোন ফল বয়ে আনবে না ৷

এরপর ৯৭ ও ৯৮ নম্বর আল্লাহ পাক বলেছেন-


قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَهُدًى وَبُشْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ () مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ

 

"আপনি বলুন-যে জীবরাঈলের শত্রু সে জেনে রাখুক, জিবরাঈল আল্লাহর নির্দেশে আপনার হৃদয়ে কোরআন পৌঁছে দিয়েছে, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও শুভ সংবাদ। যে কেউ আল্লাহ, তার ফেরেশতা, রাসূলগণ এবং জিবরাঈল ও মিকাঈলের শত্রু, সে জেনে রাখুক আল্লাহ নিশ্চয় সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের শত্রু ৷" (২:৯৭-৯৮)

রাসূলে খোদা (সাঃ) যখন মদীনায় আসলেন তখন কিছু ইহুদী তাদের একজন পুরোহিতসহ রাসূলের কাছে এসে কিছু প্রশ্ন করল। তাদের একটি প্রশ্ন ছিল, তোমার কাছে যে ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসে তার নাম কি? রাসূলে খোদা জবাবে বলেন, জিবরাঈল। তখন ইহুদীরা বলল,যদি ওহীর ফেরেশতা মিকাঈল হতো তাহলে আমরা ঈমান আনবো। কারণ জিবরাঈল আমাদের শত্রু। সে আমাদের জন্য জেহাদের মত কঠিন বিধান নিয়ে আসে৷ মানুষ যখন সত্যকে মেনে নিতে চায় না তখন অজুহাত খুঁজে বেড়ায়৷ এমনকি তারা আল্লাহর ফেরেশতাকেও অযৌক্তিকভাবে দায়ী করে যাতে সত্য থেকে পালিয়ে থাকা যায়। জিবরাঈল, মিকাঈল প্রমুখ ফেরেশতাগণ নিজের থেকে কোন বাণী আনেন না। তাঁরা আল্লাহর বাণী পয়গম্বরদের কাছে পৌঁছে দেন। তারা কেবল আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে মাধ্যম হিসাবে কাজ করেন৷ তাই এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে ইহুদীবাদীদের এ দাবি ছিল ইসলাম গ্রহণ না করার একটি বাহানা।

আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
এক. প্রত্যেক মানুষকে এমনভাবে জীবন-যাপন করা উচিত ,যাতে সে যেকোন সময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি থাকতে পারে।এই পৃথিবীতে কেউ যদি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে এবং অপরাধের জন্য তওবা করে তাহলে মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই ।
দুই. দীর্ঘ জীবন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। একমাত্র আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যমেই জীবন হয়ে উঠে মূল্যবান৷ তাই দেখা যায় ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) তার এক দোয়ায় বলেছেন, হে আল্লাহ! আমার আয়ু যদি তোমাকে মেনে চলার মাধ্যম হয় তাহলে তা বাড়িয়ে দাও৷ আর যদি শয়তানের অনুসরণের জন্য হয় তাহলে তা সংক্ষিপ্ত করে দাও ।
তিন. ধর্ম হলো অনেকগুলো বিশ্বাসের সমষ্টি৷ তাই কেউ যদি বলে আল্লাহকে বিশ্বাস করি কিন্তু তার ফেরেশতা আমার শত্রু বা ওই নবীকে বিশ্বাস করি না তাহলে তার ঈমান নেই৷ সুতরাং একজন প্রকৃত মুমিন হলো সেই যে আল্লাহ, সব নবী ও সব ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস রাখে।