সূরা বাকারাহ;(২৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(২৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:40:43 10-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ৭০-৭৪
সূরা বাকারাহ'র ৭০ ও ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّنْ لَنَا مَا هِيَ إِنَّ الْبَقَرَ تَشَابَهَ عَلَيْنَا وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ لَمُهْتَدُونَ () قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَا ذَلُولٌ تُثِيرُ الْأَرْضَ وَلَا تَسْقِي الْحَرْثَ مُسَلَّمَةٌ لَا شِيَةَ فِيهَا قَالُوا الْآَنَ جِئْتَ بِالْحَقِّ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُوا يَفْعَلُونَ

"বনী ইসরাইল মূসাকে বললো,গরুটি কি ধরনের হতে হবে তা তোমার প্রতিপালককে আমাদের জন্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল। আমাদের কাছে গরুতো একই রকম। আর আল্লাহ চাইলে আমরা নিশ্চয়ই সঠিক পথ পাব। মূসা জবাবে বললেন,আল্লাহ বলছেন তা এমন এক গরু যা জমি চাষ ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়নি-সুস্থ ও নিখুঁত। তারা বললো,এখন তুমি ঠিক কথা বলেছ। এরপর তারা গরুটি জবাই করলো,যদিও তারা প্রায় এ কাজ বর্জনে উদ্যত হয়েছিল।" (২:৭০-৭১)
গত পর্বে আমরা বলেছিলাম,আল্লাহপাক হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। বনী ইসরাইল গোত্রের একাংশ নানা অজুহাত খাড়া করতে লাগল এবং উপহাস করে গরুর রং ও বয়স জিজ্ঞাসা করতে থাকে। এ আয়াতেও বনি ইসরাইল বা ইহুদীদের আনা একের পর এক অজুহাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাক গরুর রং ও বয়স বলে দেয়ার পরও তারা বললো,হে মূসা! ওই গরুকে চেনার জন্য আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলো। হযরত মূসা যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই গরুর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দিল তখন বনি ইসরাইলীদের আর কোন অজুহাত থাকল না এবং তারা ওই গরুকে জবাই করলো। যদিও আল্লাহর নির্দেশ মানার কোন আগ্রহ তাদের ছিল না।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়,মানুষের একগুঁয়েমি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়,যে সে নিজের ইচ্ছা ও মতকেই শুধু সঠিক বলে মনে করে। তাই দেখা যায় হযরত মূসা (আ.) গরু সম্পর্কে এত বর্ণনা দেয়ার পরও বনী ইসরাইল ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে বলে,"এতক্ষণে তুমি সঠিক বলেছো। "
এবারে সূরা বাকারাহ'র ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا فَادَّارَأْتُمْ فِيهَا وَاللَّهُ مُخْرِجٌ مَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ () فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا كَذَلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَى وَيُرِيكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
"স্মরণ কর যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করছিলে। কিন্তু তোমরা যা গোপন রাখছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। এরপর আমি বললাম,গরুর কোন একটি অংশ দিয়ে নিহত ব্যক্তিকে স্পর্শ কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং নিজের নিদর্শন তোমাদেরকে দেখিয়ে থাকেন। যাতে তোমরা উপলদ্ধি কর।" (২:৭২-৭৩)
এর আগের আয়াতগুলোয় বনী ইসরাইলের নানারকম অজুহাতের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ দুই আয়াতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে,তোমরা হত্যা করেছিলে এবং হত্যাকারীর পরিচয় গোপন রেখেছিলে। কিন্তু আল্লাহ তার অসীম ক্ষমতার মাধ্যমে তোমাদের অন্যায় ফাঁস করে দিয়েছেন। তাই জেনে রাখ আল্লাহ অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করার ক্ষমতা রাখেন। মৃতকে জীবিত করার অসীম ক্ষমতা যে আল্লাহ রাখেন এ আয়াত তারই নিদর্শন। আল্লাহর এ ধরনের ক্ষমতা দেখে মানুষ যাতে পরকালের ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে এবং জেনে রাখে যে আল্লাহ ইচ্ছা করলে একটি মৃত দেহের ওপর আরেকটি মৃতের অংগের স্পর্শে জীবিত করতে পারেন।
এরপর ৭৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
"অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। পাথরের মধ্যে এমনও আছে; যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়,এমনও আছে,যা বিদীর্ণ হয়,এরপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং এমনও আছে,যা আল্লাহর ভয়ে (পাহাড় থেকে) খসে পড়তে থাকে! আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।" (২:৭৪) সূরা বাকারাহ'র ৪৯ নম্বর আয়াত থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বনী ইসরাইলীদের প্রতি আল্লাহর বহু নেয়ামত ও মোজেযার কথা বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি,নীল নদ দু'ভাগে বিভক্ত হওয়া,বাছুর পূজার তওবা কবুল,ঐশী খাবার-দাবার লাভ,মেঘকে ছায়া হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর সর্বশেষ ঘটনা হলো- অলৌকিক উপায়ে হত্যাকারীর পরিচয় উদ্ঘাটন। কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার এতসব নিদর্শন ও মোজেযা দেখার পরও বনী ইসরাইল আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পন করেনি বরং আল্লাহর হুকুম এড়িয়ে যাবার জন্য নানারকম পাঁয়তারা করছিল। যাকে কিনা কোরআন 'পাষাণ হৃদয়'বিশেষণে আখ্যায়িত করেছে। মানুষ অনেক সময় এমন অধঃপতনের শিকার হয় যা তাকে জীব-জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্টে পরিণত করে কিংবা তাকে পাথরের চেয়ে কঠিন করে ফেলে। এ আয়াতে বলা হয়েছে- কঠিন পাথর অনেক সময় ফেটে তা থেকে পানি প্রবাহিত হয় কিংবা অন্তত: নীচের দিকে ধ্বসে পড়ে। কিন্তু কিছু মানুষের অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত। কোন ভালবাসা কিংবা প্রেমে তাদের অন্তর বিগলিত হওয়াতো দূরের কথা আল্লাহর ভয়েও তাদের হৃদয় কাঁপে না। তাই তারা মানুষের উপকারও করে না এবং আল্লাহর হুকুম-নির্দেশও মেনে চলে না।
সূরা বাকারাহ'র ৭০ থেকে ৭৪ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে-
এক. আল্লাহর নির্দেশ এড়ানোর জন্যে ছলচাতুরির আশ্রয় কিংবা একগুঁয়েমি করা ঠিক নয়। এ উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করাও অন্যায়। কারণ দেখা যায়,প্রশ্ন অনেক সময় জানার জন্যে নয় বরং দায়িত্ব এড়ানোর জন্য প্রশ্ন করা হয়ে থাকে।
দুই. আল্লাহর নির্দেশে যে পশু জবাই করা হবে তা নিখুঁত হওয়া দরকার। তাই হজ্বের সময় হাজীরা কোরবানীর ঈদের দিন ত্রুটিমুক্ত পশু জবাই করেন।
তিন. আমাদের প্রকাশ্য-গোপন সব কাজের ব্যাপারেই আল্লাহ পূর্ণ অবগত। তিনি চাইলে আমাদের ঐসব কাজ প্রকাশ করে আমাদের অপদস্ত করতে পারেন। তাই পাপ করা উচিত নয় কিংবা নিজের পাপ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়।
চার. অনেক ক্ষেত্রে এ দুনিয়াতেই আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার শক্তি প্রদর্শন করেন এবং আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন কেয়ামত সম্পর্কে গভীর চিন্তা করতে।