সূরা বাকারাহ;আয়াত ২১৯-২২১
সূরা বাকারাহ'র ২১৯ ও ২২০তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ (২১৯) فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْيَتَامَى قُلْ إِصْلَاحٌ لَهُمْ خَيْرٌ وَإِنْ تُخَالِطُوهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ الْمُفْسِدَ مِنَ الْمُصْلِحِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَعْنَتَكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (২২০)
"তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করে,আপনি বলে দিন- এ দুটোর মধ্যেই রয়েছে মহাপাপ,যদিও মানুষের জন্যে কিছু উপকার রয়েছে। কিন্তু এর পাপ উপকারের চেয়ে বেশী। একইসঙ্গে তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে,তারা কি ব্যয় করবে? বলুন,নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবে আল্লাহ তাঁর নিদর্শন তোমাদের কাছে ব্যক্ত করেন যাতে তোমরা চিন্তা কর।" (২: ২১৯)
"তারা ইহকাল ও পরকাল এবং এতিমদের সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করে,আপনি বলুন- তাদের কল্যাণ সাধন করাই উত্তম। যদি তাদের সঙ্গে তোমরা জীবন-যাপন কর তবে তাতে কোন বাধা নেই। তারা তোমাদের ভাই,আল্লাহ জানেন কে কল্যাণকারী ও কে অনিষ্টকারী। যদি আল্লাহ ইচ্ছে করতেন তবে তিনি তোমাদের বিপদে ফেলতেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত ও বিজ্ঞানময়।" (২:২২০)
এই দুই আয়াতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে মুসলমানদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) নিজে সরাসরি উত্তর না দিয়ে ঐশী প্রত্যাদেশ বা ওহীর মাধ্যমে প্রশ্নগুলো জবাব দেয়া হয়েছে। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে যেসব নোংরা প্রথা চালু ছিল,সেসবের মধ্যে মদপান ও জুয়াখেলা ছিল অন্যতম। তাই অনেক মুসলমান মদ ও জুয়া সম্পর্কে রাসূল (সা.)কে প্রশ্ন করেছিলেন। রাসূল (সা.) ওহীর মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দেন যে,আঙ্গুরের চাষ ও তা থেকে মদ তৈরি ও বিক্রিতে কারো কারো অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে এবং জুয়া খেলাতেও কোন এক পক্ষ বেশী অর্থ-লাভ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দু'টি বিষয়ের অপবিত্রতা ও নোংরামী বা ক্ষতির দিক বাহ্যিক লাভের চেয়ে অনেক বেশী। তাই এ দু'টি কাজ থেকে দূরে থাকা উচিত। মুসলমানদের অন্য একটি প্রশ্ন ছিল দান বা সাহায্যের পরিমান কতটুকু হতে হবে অর্থাৎ কাদেরকে কোন জিনিষ কতটুকু দান করতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তরও রাসূল (সা.) নিজে না দিয়ে ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে বর্ণনা করেন। রাসূল (সা.)-কে আল্লাহ নির্দেশ দিলেন-এটা বলতে যে,যা কিছু প্রয়োজনের চেয়ে বেশী তা-ই যেন দান করা হয়। আর এমনভাবে দান কর যাতে নিজেও অভাবগ্রস্ত না হও এবং গরীবরাও উপেক্ষিত না হয়। অর্থাৎ মধ্যপস্থা অবলম্বন করতে হবে। রাসূল (সা.)'র কাছে আরো একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল এতিমদের দেখা-শুনা সম্পর্কে। এতিমের সম্পদের সাথে নিজেদের সম্পদ মিশে যাবে-এই ভয়ে অনেকেই এতিমদের সম্পদ,এমনকি তাদের খাবার ও থালা-বাটিও আলাদা করে রাখতো। এরফলে এতিমদের জন্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি হতো। রাসূলে খোদা ওহীর মাধ্যমে তাদের বলেন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ'ল এতিমের স্বার্থ। তাই এমনভাবে তাদের দেখা-শোনা ও তত্ত্বাবধান করতে হবে যাতে তাদের কল্যাণ হয়। এতিমদের সম্পদ ও মাল নিজেদের সম্পদের সাথে মিশে যাবে এই ভয়ে তাদেরকে দেখাশোনার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কিংবা তাদেরকে একাকী ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। এতিমদের সাথে একত্রে জীবন-যাপনের ফলে যদি তাদের সম্পদের ধ্বংস সাধন না হয়-বা তাদের সম্পদ আত্মসাৎ বা অপব্যবহারের কুমতলব না থাকে তাহলে এতে কোন বাধা নেই,আল্লাহ সবার কাজই লক্ষ্য করছেন-কারা এতিমের স্বার্থ চায় বা কারা দূর্নীতি করছে আল্লাহ তা বুঝতে পারেন। আল্লাহ মানুষকে এতিমের সম্পদ থেকে নিজেদের সম্পদ আলাদা করার নির্দেশ দিয়ে ঝামেলায় ফেলতে চাননা।
এই আয়াত থেকে আমরা যা যা শিখলাম তা হলো-
এক. মদ তৈরি ও বিক্রি এবং জুয়াখেলার মত কাজ মানুষের মন ও আত্মার জন্য।
দুই. সমাজের মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হবে। মদ পান মানুষের বিবেক ও চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে এবং জুয়া অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা,হিংসা,বিদ্বেষ ও অপরাধের জন্ম দেয় বলে ইসলাম এসবকে নিষিদ্ধ করেছে।
তিন. সম্পদ যদি উদ্বুত্ত থাকে,তবে তা থেকে পরিমাণমত গরীবদের দান করতে হবে,এতে সমাজ দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে।
চার. আশ্রয়হীন এতিম শিশুদেরকে একা ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। ইসলামী সমাজের উচিত তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও তাদের সম্পদ রক্ষা করা।
এই সূরার ২২১তম আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
"তোমরা মুশরেক বা অংশীবাদী নারীদেরকে মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করো না। এমনকি তাদের সম্পদ ও সৌন্দর্য তোমাদের মন হরণ করলেও ঈমানদার দাসী নিশ্চয়ই অমুসলিম নরীর চেয়ে উত্তম। অংশীবাদী পুরুষরা ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দিও না। মুশরেক বা অংশীবাদী পুরুষরা তোমাদের কাছে পছন্দনীয় হলেও বিশ্বাসী দাস তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। কেননা এরাই তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহবান জানায়। আর আল্লাহ নিজের ইচ্ছায় তোমাদেরকে বেহেশত ও মাগফিরাতের দিকে আহবান করেন। আল্লাহ মানুষের জন্য তার নিদর্শন বর্ণনা করেন যাতে তারা স্মরণ করে।" (২:২২১)
ইসলাম বিয়ে ও পরিবার গঠনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছে। সহধর্মী বা সহধর্মীনী বেছে নেয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হ'ল-আল্লাহর প্রতি যথাযথ ঈমান আনা। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে পারিবারিক পরিবেশ এবং পিতামাতার আচার-আচরণের ধরণ সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে ব্যক্তির অর্থ-বিত্ত ও সামাজিক অবস্থান,বিয়ের পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় গুণাবলী এক্ষেত্রে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিতে একজন ঈমানদার-দাস সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিচু শ্রেণীর হলেও অবিশ্বাসী ব্যক্তির চেয়ে উত্তম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্রতা হল শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড,সম্পদ ও পদ নয়।
এই আয়াত থেকে আমরা যা যা শিখলাম তা হলো-
প্রথমতঃ বিয়ের পবিত্র বন্ধন- অবশ্যই ঈমানের ভিত্তিতে হতে হবে,যাতে ভবিষ্যত বংশধর হয় পবিত্র ও সৎ।
দ্বিতীয়তঃ বিয়ের পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাহ্যিক সৌর্ন্দয্যের চেয়ে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণ ও বৈষয়িক দিকটা প্রাধান্য না দিয়ে ভবিষ্যত পরিণতির বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ এই বিয়েটি আমাদের জন্য বেহেশত লাভের পটভূমি সৃষ্টি করছে না দোযখের পটভূমি তৈরি করল তা নিয়ে ভাবতে হবে।