সূরা বাকারাহ; আয়াত ২১১-২১৪
সূরা বাকারাহ'র ২১১তম আয়াতে বলা হয়েছে-
سَلْ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَمْ آَتَيْنَاهُمْ مِنْ آَيَةٍ بَيِّنَةٍ وَمَنْ يُبَدِّلْ نِعْمَةَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُ فَإِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
"বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করুন,তাদেরকে আমি কত স্পষ্ট নির্দশনাবলী দান করেছি। আর আল্লাহর নেয়ামত পৌঁছে যাওয়ার পর কেউ যদি সে নেয়ামতকে পরিবর্তিত করে দেয়,তবে আল্লাহর আযাব অতি কঠিন।" (২:২১১)
ইতিহাস,শিক্ষা বা অভিজ্ঞতালাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আল্লাহ বনী ইসরাইল জাতিকে অনেক আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক নেয়ামত দিয়েছেন। ইহুদীদের জন্য মূসা ( আঃ) এর মত ত্রাণকর্তা পাঠিয়েছিলেন যিনি ইহুদিদেরকে ফেরাউনের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি দেন। একইসঙ্গে ইহুদিরা পার্থিব জীবনযাপনের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর দেয়া সুযোগ সুবিধা ও অনুগ্রহকে তারা ভুল পথে ব্যয় করেছে। তারা আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে বাছুর পুজা শুরু করেছিল এবং তারা মুসা (আ.)র কাছে না গিয়ে সামেরীর কাছে গিয়েছিল। আর তাই,আল্লাহ তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তারা এ পৃথিবীতেই বিপর্যস্ত হয়। বর্তমানেও শিল্প-সমৃদ্ধ বিশ্বে মানুষ অনেক সূযোগ-সুবিধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে থাকায় তারা পাপ,আত্মহনন ও বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
এরপর ১১২তম আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
زُيِّنَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُونَ مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَالَّذِينَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
"যারা অবিশ্বাস করছে,তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে এবং (এজন্যে) তারা বিশ্বাসীদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করে থাকে। অথচ কিয়ামতে বা উত্থান দিবসে তাঁরা অতি উচ্চ মর্যাদায় থাকবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।" (২:২১২)
দুনিয়ার চাকচিক্য কাফেরদের কাছে কত মোহনীয় যে তারা এজন্যে অহংকারী হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাসীরা দুনিয়ার চাকচিক্যকে নির্বোধ বা বোকা বলে ঠাট্টা করে। অথচ মানুষের মর্যাদার মাধ্যম হলো ঈমান ও খোদাভীতির মত আধ্যাত্মিক ও ঐশী মূল্যবোধ ।
এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তাহলো- দুনিয়া প্রীতি বা দুনিয়া পুজার ফলে মানুষ নিজেকে বড় ভাবতে শিখে এবং অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অন্যদিকে খোদাভীরুতা ও আল্লাহর প্রেম দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্য লাভের মাধ্যম এবং আল্লাহর অশেষ দয়া লাভের পাথেয়।
এই সূরার ২১৩ তম আয়াতে বলা হয়েছে-
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلَّا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
"মানুষ (আদিতে) ছিল এক জাতি। (পরে মানুষই বিভেদ সৃষ্টি করলো) এরপর আল্লাহ নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন। এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে মতভেদ তৈরী হয়েছিল তার মীমাংসার জন্য তিনি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন,এবং যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল। তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনাদি আসার পর তারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ বিরোধিতা করতো। অতঃপর আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হেদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে,যে ব্যাপারে তারা মতভেদ লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা,সরল পথে পরিচালিত করেন।"(২:২১৩)
এই আয়াতে মানব-সমাজ পরিচালনায় ধর্ম ও ঐশী আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,মানুষ প্রথম দিকে সহজ-সরল ও স্বল্প পরিসরে জীবন যাপন করত। কিন্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্র সৃষ্টির পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে মতভেদ ও বিরোধ দেখা দেয় । ফলে মানুষের জন্য শাসক ও আইনের প্রয়োজন দেখা দেয় । ঠিক এ কারণেই মানুষকে পথ প্রদর্শন ও মুক্তি দেয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী বা পয়গম্বর পাঠানো হয়েছে। তাঁরা আল্লাহর কিতাব বা আইন অনুযায়ী বিচার ও শাসন পরিচালনা করতেন। যদিও তাঁরা সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতেন,কিন্তু বহু মানুষ হিংসা ও বিদ্বেষবশতঃ নবীদের মোকাবেলায় গোয়ার্তুমী করত এবং তারা সত্যকে মেনে নিতে চাইতো না। অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী মানুষেরা পরকাল ও নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে ও শান্তিতে থাকতো এবং সত্য ও মুক্তির পথে চলতো। আর অবিশ্বাসীরা পার্থিব বিষয়ে মতভেদের কারণে বিচ্যুতি বা বিভ্রান্তি থেকে কখনও মুক্তি পায়নি।
এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হলো :
প্রথমত : সমাজ আইন ও শাসকের মুখাপেক্ষী । আর সবচেয়ে ভালো আইন হলো ধর্মীয় গ্রন্থের আইন এবং শ্রেষ্ঠ শাসক হলেন নবী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ।
দ্বিতীয়ত : পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে মতভেদ দূর করার সবচেয়ে ভালো পন্থা হল খোদায়ী বিধানের কাছে নিজেকে সমর্পন করা ।
এরপরের আয়াত অর্থাৎ ২১৪তম আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
"(হে বিশ্বাসীরা) তোমারা কি মনে করেছ যে,এমনিতেই বেহেশতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমরা এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থার মধ্যে পড়নি। বিপদ ও দুঃখ তাদের স্পর্শ করেছিল এবং তারা এত ভীত ও কম্পিত হয়েছিল যে রাসূল ও বিশ্বাসীরা বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? সতর্ক হও,নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী। " (২: ২১৪)
সৌভাগ্যলাভ লাভ এবং বিভ্রান্তি ও মতভেদ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আগের আয়াতে তা বলা হয়েছে । আর এই আয়াতে বলা হচ্ছে- শুধু বিশ্বাস বা ঈমানই যথেষ্ট নয়। বিপদে বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আল্লাহর পথে পথচলা ত্যাগ করা যাবে না। কারণ,বিপদ- আপদ হল মানুষের জন্য পরীক্ষা। ব্যক্তির ঈমানের গভীরতা কতখানি তা এসব পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় ।
এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তা হলো-
সমস্ত মানুষকে পরীক্ষা করা আল্লাহরই রীতি যাতে প্রত্যেকেই তাদের প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারে । সবশেষে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আমরা যেন অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার না করি । শত্রুদের উপহাস ও বিদ্রুপকে যেন আমরা ধৈর্য দিয়ে মোকাবেলা করি। একইসাথে আমরা যেন আল্লাহর আইনের কাছে পুরোপুরি নিজেদেরকে সমর্পন করি এবং কোন কঠিন বিপদের কারণে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস যেন না হারাই।