সূরা বাকারাহ;আয়াত ২০০-২০৫
সূরা বাকারাহ'র ২০০,২০১ ও ২০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آَبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا فَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ ( (وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (( أُولَئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ
"যখন হজ্বের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবে,তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষকে স্মরণ করতে। বরং আল্লাহকে আরো বেশী ও ভালো পন্থায় স্মরণ কর। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকে বলে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ইহকাল দাও। আসলে পরকালে তাদের জন্য কোন অংশ নেই।
এবং তাদের মধ্যে অনেকে বলে- হে আমাদের প্রতিপালক ! আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও এবং পরকালেও কল্যাণ দাও এবং আমাদের অগ্নিযন্ত্রণা থেকে রক্ষা কর।
এরা পৃথিবীতে চেষ্টা ও প্রার্থনার মাধ্যমে যা পেয়েছে,তা তাদেরই প্রাপ্য অংশ এবং আল্লাহ তাদের দ্রুত হিসাব নেবেন।" (২:২০০-২০২)
ইতিহাসে দেখা যায় ইসলাম পূর্ব যুগে হজ্ব অনুষ্ঠানের পর আরবরা কোন একস্থানে সমবেত হয়ে নিজেদের গোত্র,কবিলা ও পিতৃপুরুষদের তৎপরতা নিয়ে গর্ব করতো। কোরআনে বলা হয়েছে,পূর্ব পুরুষদের গর্ব করা বাদ দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ কর। অতীতে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং তারই কাছে নিজেদের ভবিষ্যৎ কল্যাণ কামনা কর। এরপর কোরআন মানুষের মধ্যে দু'টি দল থাকার কথা উল্লেখ করেছে। একদল ওই পবিত্র স্থানে হজ্বের পর শুধু পার্থিব ও বৈষয়িক চাহিদা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং আল্লাহর কাছে এসব ছাড়া অন্য কিছু চায় না। তাই স্বাভাবিকভাবে কিয়ামত বা শেষ বিচারের দিনে মানুষ যখন পার্থিব বিষয় ছাড়া অন্য সব কিছুর মুখাপেক্ষী হবে তখন এসব দুনিয়া পুজারীদের হাতে কিছুই থাকবে না। কিন্তু দ্বিতীয় দলটি তাদের দোয়ায় পার্থিব সুখ কামনার পাশাপাশি শেষ বিচারের দিনেও মর্যাদা এবং শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা করে।
এসব আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে,
এক. দোয়া ও আল্লাহর স্মরণের ক্ষেত্রে সীমিত ও বাহ্যিক দৃষ্টি দেয়া এবং শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও পৃথিবীর কয়েক দিনের জীবনকে প্রাধান্য দেয়া উচিত নয়।
দুই. ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। ইসলাম ইহকাল ও পরকালকে পাশাপাশি উল্লেখ করেছে যাতে কেউ এমনটি না ভাবে যে মুসলমানরা জাগতিক উন্নতি ও সমাজ কল্যাণ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না।
তিন. আমরা আল্লাহর কাছে যেন নিজেদের শান্তি,সৌভাগ্য ও কল্যাণ কামনা করি। সীমিত কোন কিছু যেন আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না করি,কারণ আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ এবং কোন কোন বিষয় আমাদের জন্য কল্যাণকর তা জানি না।
এই সূরার ২০৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-
وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقَى وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
"(হজ্বের সময়) নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। কেউ যদি মীনাতে দু'দিন থেকেই সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসে,তবে তার কোন পাপ হবে না। আর কেউ যদি মীনাতে বিলম্ব করে ( অর্থাৎ তিন দিন থাকে ),তবে তারও কোন পাপ নেই। অবশ্য যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা আল্লাহর হুকুমের বিরোধীতার জন্য বিলম্বে বা তাড়াতাড়ি চলে আসে না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রাখ তোমাদেরকে তার কাছে একত্রিত করা হবে।" (২:২০৩)
আগের আয়াতের সূত্র ধরে বলা হয়েছে হজ্বের সময় হাজীরা পূর্ব পুরুষদের নিয়ে গর্ব না করে যেন আল্লাহকে স্মরণ করে। এই আয়াতে আল্লাহকে স্মরণের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ১০ই জিলহজ্ব কোরবাণীর ঈদ উৎসবের পর জিলহজ্ব মাসের ১১,১২ ও ১৩ তারিখেও হাজীরা মীনায় থাকতে পরেন। এই স্থান ইবাদত,বিশ্বজগত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনার জন্য উপযুক্ত সুযোগ। তাই এই আয়াতে পূর্ব পুরুষদের গোত্রীয় অহঙ্কার বা গর্বের বিষয়গুলোকে স্মরণ না করে আল্লাহকে স্মরণ করতে বলা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,
যদি মানুষ আল্লাহকে ভয় করে তাহলে আল্লাহ তাদেরকে কিছু ছাড় দেন বা তাদের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ করেন। তাদের কাজ কম হলেও তিনি তা গ্রহণ করেন এবং তাদের কাজের দুর্বলতা ও বিচ্যুতিকে আল্লাহ ঢেকে রাখেন।
এরপর ২০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ
"মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যার পার্থিব জীবন সম্পর্কে কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে,আসলে সে মুমিনদের ঘোর বিরোধী।" (২:২০৪)
এই আয়াতে একদল কপট ব্যক্তির কপটতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,অনেক লোক তাদের কথাবার্তায় বিশ্বাসী বা ঈমানদার হওয়ার দাবী করে। তারা পার্থিব জীবন সম্পর্কে এমন আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলে যে মুমিন বা বিশ্বাসীদের অনেকে তাদের কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়। কোরআন এইসব ব্যক্তিদের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে বলছে,এইসব লোকদের বিশ্বাস কর না। এদের অন্তরে ঈমান নেই বরং এরা বিশ্বাসীদের কঠোরতম শত্রু। কিন্তু তারা তাদের শত্রুতাকে গোপন রেখেছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,বাহ্যিক চাকচিক্য ও সৌন্দর্যে এবং ধাঁধাঁ লাগানো কথাবার্তা ও প্রচারণার কাছে আমরা যেন প্রতারিত না হই। আমাদেরকে বুঝতে হবে বক্তার কথার আসল উদ্দেশ্য কী। তার কথা কি আমাদের মধ্যে বস্তুবাদকে শক্তিশালী করছে? নাকি আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট করছে ?
২০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ
"(বিশ্বাসীদের প্রতি কপট বিশ্বাসীদের শত্রুতার লক্ষণ হলো) যখন তারা ক্ষমতা লাভ করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং শস্যক্ষেত্র ও জীব-জন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।" (২:২০৫)
কিছু লোক আছে যারা সুন্দর সুন্দর কথা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলে যে,যদি আমরা ক্ষমতা পাই তাহলে সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে বেহেশতের সুখ পাইয়ে দেব। কিন্তু যখন তারা ক্ষমতা লাভ করে তখন তারা নিজেদের স্বার্থপূরণের জন্য জনগণের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পাশাপাশি তারা যুব প্রজন্মকেও বিচ্যুতির দিকে ঠেলে দেয়। পবিত্র কোরআনের অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে,"যখনই সৎ লোকেরা শাসন-ক্ষমতা লাভ করে,তারা জনগণের ধর্মীয় ও পার্থিব কুসংস্কার নির্মুলের চেষ্টা করে,তারা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সুন্দরতম মাধ্যম নামাজকে সমাজে জোরদার করে এবং জনগণ ও বঞ্চিতদের সম্পর্ক তথা যাকাতের প্রসার ঘটায়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,কারো সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে শুধু তাদের বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য না করে তাদের কাজ কর্ম কেমন তাও লক্ষ্য রাখতে হবে। দেখতে হবে তারা কি সমাজের কল্যাণে কাজ করেছে? নাকি সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিচ্ছে।