সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৫৯-১৬৩
সূরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ ((১৫৯
"হে নবী! আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতেন,তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে যেত। তাই আপনি তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কাজেকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন,কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে আল্লাহর ওপর নির্ভর করুন। যারা আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তাদের তিনি ভালবাসেন।" (৩:১৫৯)
এই আয়াতে মহানবী (সাঃ)'র শ্রেষ্ঠ গুণ তথা তাঁর সুন্দর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে,আপনার দয়ার্দ্র হৃদয় ও সুন্দর ব্যবহারের কারণেই উগ্র ও যুদ্ধবাজ আরবরা আপনার প্রতি ঈমান এনে আপনার চারপাশে জড়ো হয়েছে। কিন্তু আপনিও যদি আরবদের মতোই উগ্র বা পাষাণ হৃদয় হতেন তাহলে কেউই আপনার কাছে আসতো না,আর যারা ঈমান আনতো তারাও পরে দূরে সরে যেত। তাই ওহুদ যুদ্ধে যারা আপনার নির্দেশ মান্য করেনি তাদের ক্ষমা করুন এবং আল্লাহর কাছেও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। ওহুদ যুদ্ধের আগে তাদের মতামত চেয়েছিলেন এবং এর ফলে যুদ্ধে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের নিজেদের ব্যাপারে পরামর্শ ও মতামত চাওয়া থেকে বিরত হবেন না। কারণ,আপনিই তাদের জন্য আদর্শ।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : দয়া ও কোমল ব্যবহার নবীদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এক বিশেষ উপহার। যারাই উঁচু ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল হন তাদের দয়ালু ও কোমল চিত্ত হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত : যারা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে বা আমাদের অধিকার ক্ষুন্ন করেছে তারা যদি অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়,তাহলে তাদেরকে ক্ষমা করা উচিত।
তৃতীয়ত : চিন্তা ও পরামর্শের পরও আল্লাহর ওপর নির্ভর করার বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
সূরা আলে ইমরানের ১৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنْ يَنْصُرْكُمُ اللَّهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمْ وَإِنْ يَخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَا الَّذِي يَنْصُرُكُمْ مِنْ بَعْدِهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ ((১৬০
"যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন,তবে তোমাদের ওপর কেউ জয়ী হতে পারবে না। আর তিনি অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের সাহায্য না করলে আর কে তোমাদের সাহায্য করবে?" (৩:১৬০)
আগের আয়াতে মহানবী (সাঃ) কে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার পরামর্শ দেয়ার পর এই আয়াতে মুমিনদেরকেও একই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর যুক্তি হিসেবে মহান আল্লাহ বলেছেন,সম্মান ও অসম্মান একমাত্র আল্লাহরই হাতে। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই মানুষের কল্যাণ ও ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ যদি কারো ভালো ও কল্যাণ চান,তাহলে কেউ-ই সেই কল্যাণে বাধা দিতে সক্ষম নয়। আর আল্লাহ যদি কাউকে অপদস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চান তাহলে কেউই তাকে রক্ষা করতে পারবে না। মানুষ যদি এই বাস্তবতা বুঝতে পারে,তাহলে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তির ওপর ভরসা করবে না এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যেই কাজ করবে। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না পাওয়া এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাহায্যের ব্যাপারে আশা না করা তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর ব্যাপারে নিরাশ হওয়াই হলো আল্লাহর ওপর ভরসা করা।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলোঃ
প্রথমতঃ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অন্যদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর নির্ভর করা উচিত। কারণ,সব কিছুই আল্লাহর হাতে রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন কারণে বাহ্যিক বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলেও আল্লাহর সাহায্য ঠিকই বজায় থাকে।
সূরা আলে ইমরানের ১৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَغُلَّ وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ((১৬১
"কোন নবীর পক্ষেই অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করা সম্ভব নয়। যে অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করে কেয়ামতের দিন অর্থাৎ বিচার দিবসে সে তা নিয়ে আসবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করেছে তার পূর্ণ প্রতিফল তাকে দেয়া হবে এবং কারো ওপর জুলুম করা হবে না।" (৩:১৬১)
ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবী (সঃ) একদল মুসলমানকে একটি গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত করে বলেছিলেন,আমরা জয়ী বা পরাজিত হলেও এই স্থান ত্যাগ করবে না। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গনীমতে তোমাদের অংশ রক্ষা করা হবে। কিন্তু যুদ্ধের প্রথমদিকে মুসলমানদের বিজয়ের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠলে এই দলের অধিকাংশ মুসলমানই পাহারার কাজ বাদ দিয়ে গনীমতের সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়। এই আয়াতে তাদের উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ বলছেন,তোমরা কি ভেবেছিলে যে রাসূল (সঃ) গনীমতে তোমাদের প্রাপ্য অংশ আত্মসাৎ করবেন এবং এ জন্যেই কি তোমরা প্রহরার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলে! অথচ আত্মসাৎ করা নবীদের মত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের কাজ হতে পারে না। নবীরা আল্লাহ ও মানুষের প্রতি পরিপূর্ণ আমানতদার।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : কোন কোন সাহাবী রাসূল (সাঃ)'র আমানতদারী,সততা ও পবিত্রতার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে রাসূলেরও বিচ্যুতির সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেছিলেন। নাউজুবিল্লাহ। অর্থাৎ রাসূল (সাঃ)'র প্রতি ঈমান দৃঢ় ছিল না। আমরা যেন এমন গোনাহ'র শিকার না হই,সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত : অনেক মানুষ আল্লাহর নবীর ব্যাপারে খারাপ সন্দেহ পোষণ করছিলেন এই দূরাশা নিয়ে যে সব মানুষ তাদের কাজের প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। সব মানুষকে সন্তুষ্ট করা কখনও সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহকেই সন্তুষ্ট রাখা আমাদের দায়িত্ব।
তৃতীয়ত : বিচার দিবসের শাস্তি আমাদেরই কর্মফল। বান্দার প্রতি আল্লাহর জুলুমের ফল নয়।
সূরা আলে ইমরানের ১৬২ ও ১৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَفَمَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَ اللَّهِ كَمَنْ بَاءَ بِسَخَطٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (১৬২) هُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ ((১৬৩
"যে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করেছে সে কি তার সমান হতে পারে যার ওপর আল্লাহ ক্ষুব্ধ হয়েছেন? তার বাসস্থান জাহান্নাম এবং তা নিকৃষ্ট পরিণাম তথা প্রত্যাবর্তনের স্থান।" (৩:১৬২)
"আল্লাহর কাছে তারা বিভিন্ন পর্যায়ের। তারা যা করে আল্লাহ তা দেখছেন।" (৩:১৬৩)
এই দুই আয়াতে মুমিন ও মুনাফিকদের পরিণতির তুলনা করে আল্লাহ বলছেন যাদের কাজ কর্মের লক্ষ্য খোদাবিমুখ বা খোদাবিরোধী শক্তিকে সন্তুষ্ট করা নয়,অর্থাৎ যাদের কাজ কর্মের লক্ষ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা তারা তাদের সৎ কাজের পরিমাণ অনুযায়ী মর্যাদা বা প্রতিফল পাবে। অন্যদিকে যারা নিজেদের কামনা বাসনার স্বার্থে আল্লাহকে পেতে চায় তারা আসলে ধর্মকে মাধ্যম বানিয়ে দুনিয়ার স্বার্থই হাসিল করতে চায়। এ ধরনের লোকদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসে। ফলে ইহকাল ও পরকালে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
বিভিন্ন বর্ণনায় বলা হয়েছে,রাসূলে খোদা (সঃ) যখন ওহুদ প্রান্তরের দিকে রওনা হবার জন্য মুজাহিদদের নির্দেশ দিলেন তখন একদল মোনাফিক বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মদীনায় থেকে যায়। একদল দুর্বলমনা মুসলমানও তাদের অনুসরণ করে। এই আয়াতে এইসব লোকের পরিণতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে,তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু যারা যুদ্ধে অংশ নিয়ে হতাশ বা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল তারা অনুতপ্ত হওয়ায় ক্ষমা লাভ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : সবচেয়ে পবিত্রতম লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই লক্ষ্য অন্য যে কোন লক্ষ্যের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত : ইসলামী সমাজের যেসব মানুষ জিহাদে অংশ নেয় এবং যারা জিহাদে অংশ নেয় না,তারা সমান মর্যাদা সম্পন্ন নয়। কারণ,যারা জিহাদ থেকে দূরে থাকে,আল্লাহ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।