সূরা আলে ইমরান;(৩২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(৩২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:5:4 1-10-1403

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৬৯-১৭৩

সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ (১৬৯)


"যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে,তাদের কখনও মৃত মনে কর না,বরং তারা জীবিত এবং তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবিকা পেয়ে থাকে।" (৩:১৬৯)

ওহুদ যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হবার পর মদীনার মোনাফিকরা বন্ধু ও সান্ত্বনাদাতার বেশ ধরে শহীদ পরিবারগুলোর কাছে যায়। তারা মহানবী (সা.) ও তার সঙ্গীদেরকেই মুজাহিদদের শহীদ হবার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করে এবং এভাবে তারা অন্যান্য মুসলমানদের মনও দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। অন্যদিকে মক্কার মুশরিকদের নেতা আবু সুফিয়ান ওহুদ যুদ্ধ শেষে ৭০ জন মুসলমানের শাহাদাতকে বদর যুদ্ধে ৭০ জন মুশরিক হত্যার বদলা বলে উল্লেখ করে। মুশরিক ও মোনাফিকদের এইসব প্রচারণার জবাবে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন যাতে নিহত মুশরিক ও শহীদ মুসলমানদের মৃত্যুকে মানুষ একই ধরনের বলে ধারণা না করে। রাসূল (সা.) আবু সুফিয়ানের দাম্ভিকতাপূর্ণ দাবির জবাবে বলেন,আমাদের পক্ষে যারা শহীদ হয়েছে তারা বেহেশতে যাবে। আর তোমাদের পক্ষে যারা নিহত হয়েছে তারা যাবে দোযখে। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী শাহাদাতের মর্যাদা ও সওয়াবের চেয়ে বড় কোন কিছু নেই। তাই,আল্লাহর নবী ও আওলিয়াবৃন্দ আল্লাহর কাছে প্রার্থনার সময় শাহাদাত কামনা করতেন এবং তাঁদের অধিকাংশই শহীদ হয়েছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : শহীদকে মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত ভাবা ভুল চিন্তা মাত্র। শাহাদাত পরাজয় বা কোন কিছু হারানোর মত বিষয় নয়। বরং শাহাদাত হল অর্জন ও বিজয়।
দ্বিতীয়ত : শাহাদাত জীবনের অবসান ঘটায় না বরং শাহাদাত হলো ঐশী জীবনের সূচনা। অনেক জীবিত ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে মৃতের সমান। আবার অনেক নিহত ব্যক্তিও জীবিত ব্যক্তির সমান। অন্ধ মানুষ যেমন দেখা বা দৃষ্টির বিষয় বুঝতে পারে না,তেমনি আমরাও অদৃশ্য জগতের ব্যাপারে অন্ধ বলেই ঐ জগতের জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি না।

সূরা আলে ইমরানের ১৭০ ও ১৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَرِحِينَ بِمَا آَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِهِمْ مِنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (১৭০) يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ ((১৭১

"আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ থেকে তাদের যা দিয়েছেন তাতেই তারা সন্তুষ্ট। শহীদদের পক্ষের যারা এখনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি,তাদের সুসংবাদ দাও যে,তাদের ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।" (৩:১৭০) 
"তাদেরকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামতের সুসংবাদ দাও এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতিদান বা পুরস্কার নষ্ট করেন না।" (৩:১৭১)

এই আয়াতে শহীদ হবার কারণে শহীদদের আনন্দের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে তারা আল্লাহর পথে শহীদ হতে পেরে শুধু যে সন্তুষ্ট তাই নয়,একইসঙ্গে তারা অন্যান্য মুমিন ও বন্ধুদেরকেও এই উচ্চ মর্যাদার দিকে আহবান জানায়। তারা অন্যান্য মুমিনদের সুসংবাদ দিয়ে বলে শহীদ হলে কোন দুঃখ ও ভয়ই তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না বরং তারা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ পাবে এই আয়াত অনুযায়ী শহীদরা বারজাখ বা কবরের জীবনে অর্থাৎ ইহকাল ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী পর্যায়ে প্রকৃত জীবনের অধিকারী এবং এই জীবনে তারা জীবিকা,প্রাণ ও সুসংবাদ পায়। শহীদদের জীবিত থাকার অর্থ শুধু এই নয় যে,ইতিহাসে তাদের নাম অমর হয়ে থাকবে। তারা পৃথিবীর মানুষের মত জীবিত এবং রিজিক ও পেয়ে থাকেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আমাদের জন্য শহীদদের বাণী হল আল্লাহর পথে চলতে থাক,যতক্ষণ না শহীদ হও। শহীদ হলে ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন ভয় থাকবে না এবং অতীতের ব্যাপারেও কোন দুঃখ থাকবে না।
দ্বিতীয়ত : শহীদরা তাদের রক্ত ও কাজের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ পান।

সূরা আলে ইমরানের ১৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ ((১৭২

"যারা আঘাত পাবার পরও আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলছিল অর্থাৎ পুনরায় যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল,সেই সব খোদাভীরু এবং সৎকর্মশীলদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।" (৩:১৭২)

এই আয়াত সম্পর্কে ইতিহাসের বর্ণনায় এসেছে কাফেররা ওহুদ যুদ্ধে জয়লাভের পর মক্কার দিকে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে তারা ভাবলো,পরাজিত হবার পর মুসলমানদের যুদ্ধের শক্তি শেষ হয়ে গেছে। আর তাই মদীনায় বাদ বাকী মুসলমানদের ওপর হামলা চালানো এবং ইসলামকে চিরতরে নির্মূল করার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। কাফেররা নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এ খবর পাওয়ার পর মহানবী (সা.) সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন। এমনকি তিনি ওহুদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদবৃন্দকেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানালেন। কাফের সর্দার আবু সুফিয়ান যুদ্ধের জন্য মুসলমানদের গণ-প্রস্তুতির খবর পেয়ে ভাবলেন মুসলমানরা রণক্ষেত্রে নতুন সাহায্যকারী সেনা পাঠিয়েছে এবং তারা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে কাফেরদের বিজয়ের আনন্দকে পরাজয়ের তিক্ত গ্লানিতে রূপান্তর করতে চায়। এই ভেবে আবু সুফিয়ান মদীনা হামলার সংকল্প ত্যাগ করে সদলবলে মক্কা ফিরে গেলেন। যদিও কাফেরদের সঙ্গে সেই যাত্রায় পুনরায় যুদ্ধ হয়নি,তবুও আল্লাহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ায় আহত মুজাহিদদের প্রশংসা করেন এবং তাদের জন্য বড় পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি নেয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে কাজ সম্পাদিত হল কিনা সেটা পরবর্তী বিবেচ্য বিষয়। কেউ যদি নিতান্ত অনিচ্ছায় এবং প্রস্তুতি বা আগ্রহ ছাড়াই কোন কাজ সম্পন্ন করে,তবে সে কাজের কোন মূল্য নেই। 
দ্বিতীয়তঃ যার মধ্যে খোদাভীরুতা নেই এবং সৎকাজের ইচ্ছাও নেই,সে যুদ্ধে অংশ নিলেও তা হবে মূল্যহীন ।

সূরা আলে ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ((১৭৩

"যারা প্রকৃত মুমিন জনগণ তাদেরকে যখন বলেছিল তোমাদের ধ্বংস করার জন্য একদল কাফের সমবেত ও সংগঠিত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের ভয় কর। কিন্তু এতে ভয়ের পরিবর্তে তাদের ঈমান দৃঢ়তর হয়েছিল। তারা বলেছিল,আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট,তিনি উত্তম সহায়তাকারী এবং তত্ত্বাবধায়ক।" (৩:১৭৩)

মুসলমানদের জন্য একটা বড় বিপদ বিশেষ করে সাধারণ ও সরলমনা মুসলমানদের জন্য একটা বড় সমস্যা হল শত্রুদের বড় করে দেখা এবং নিজেদের ছোট করে দেখা। সাধারণতঃ এই ভয় এবং শত্রুদের সামনে নিজেদের বিকিয়ে দেয়ার কারণে অনেক মুসলমান যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এই বদ স্বভাবের কারণে শুধু তারা নিজেরাই যে শত্রুর মোকাবেলা করতে যান না এমন নয়। একইসঙ্গে তারা ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে অন্যান্য মুসলমানদেরকেও যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন। কিন্তু প্রকৃত মুমিনরা শত্রুদের ভয় পাবার পরিবর্তে আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং আল্লাহকেই নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। কারণ আল্লাহর হাতেই রয়েছে সমস্ত শক্তি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যুদ্ধের সময় শত্রুদের অনুপ্রবেশ এবং আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তাদের ছড়িয়ে দেয়া প্রচারণা সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত : শত্রুরা যতই বেশীসংখ্যক বা শক্তিশালী হোক না কেন আল্লাহর ক্ষমতা তার চেয়েও বেশী। তাই শত্রুকে ভয় পাবার পরিবর্তে আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে।
তৃতীয়ত : জিহাদের অনেক তিক্ততা ও কঠোরতা সত্ত্বেও এর অনেক সুফলও রয়েছে। মুজাহিদ ও অন্যান্য মুসলমানদের ঈমান জোরদার হওয়া জিহাদের অন্যতম কল্যাণকর দিক।