সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৯৬-১৯৯
সূরা বাকারাহ'র ১৯৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ وَلَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ حَتَّى يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِنْ رَأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِنْ صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَمَنْ تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَلِكَ لِمَنْ لَمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
"আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন কর। যদি (এহরামের পর মক্কায় প্রবেশ করতে ) তোমরা বাধা প্রাপ্ত হও,তাহলে কোরবানীর জন্য যা কিছু সহজলভ্য,তাই তোমাদের ওপর ধার্য। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করবে না,যতক্ষণ না কুরবানি যথাস্থানে পৌঁছে যায়। যারা তোমাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বে কিংবা মাথায় কোন কষ্ট থাকার কারণে (তা নির্ধারিত সময়ের আগেই মুণ্ডন করবে),তারা তার পরিবর্তে রোজা করবে কিংবা দান করবে অথবা কুরবানি করবে। আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্ব ওমরাহ একত্রে একইসঙ্গে পালন করতে চাও,তবে যা কিছু সহজলভ্য,তা দিয়ে কুরবানি করাই তার ওপর কর্তব্য। যারা কোরবানীর পশু পাবে না,তারা হজ্বের দিনগুলোর মধ্যে রোজা রাখবে তিনটি আর সাতটি রোযা রাখবে ফিরে যাবার পর। এভাবে দশটি রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে। এ নির্দেশটি তাদের জন্য,যাদের পরিবার পরিজন মসজিদুল হারামের আশে-পাশে বসবাস করে না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। সন্দেহাতীতভাবে জেনো যে,আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন। (২: ১৯৬)
হজ্ব অনুষ্ঠানের প্রচলনকারী হলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। তার যুগেই আরবদের মধ্যে হজ্ব প্রচলিত হয়। ইসলামও এই অনুষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়। প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমানের জন্য সামর্থ থাকলে জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ। কিন্তু ওমরাহ বা জিয়ারত শুধু তার জন্যই ওয়াজেব হবে যে মক্কায় প্রবেশ করেছে এবং তাকে নামাজ পড়া ও আল্লাহর ঘর তাওয়াফসহ কিছু সংক্ষিপ্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। হজ্ব ও ওমরার নির্দেশ বর্ণনা করতে গিয়ে এক্ষেত্রে সম্ভাব্য কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে সহজ বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বোঝা যায়,আল্লাহ মানুষের শক্তি ও সামর্থের সীমা অনুযায়ী ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন। আল্লাহ মানুষের ক্ষমতার বাইরে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দিতে চান না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে ইসলাম বিভিন্ন নির্দেশ বা বিধান দিয়েছে। যারা হজ্বের অনুষ্ঠানাদি পালনে অক্ষম তারা সেক্ষেত্রে রোজা রাখতে পারেন অথবা সদকা দিতে পারেন কিংবা কুরবানির গোশত গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন।
এরপর ১৯৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ
"হজ্বের মাসগুলো সুনির্ধারিত। যে এই মাসগুলোতে হজ্ব করা নিজের জন্য কর্তব্য বলে মনে করে,তার জন্য হজ্বের সময় স্ত্রী-গমন,অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু কর,আল্লাহ তা জানেন। তাই তোমরা পরকালের পাথেয় সংগ্রহ কর। আত্ম সংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন মানুষ! তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।" (২: ১৯৭)
হজ্ব প্রতিবছর একবার এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। যারা হজ্বে যাবেন তাদেরকে প্রথম থেকেই পবিত্রতা ও আত্মসংযমকে এই আধ্যাত্মিক সফরের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং শুধু সৎকাজে লিপ্ত হলেই চলবে না অন্যায় ও দ্বন্দ্ব বিবাদ থেকেও দূরে থাকতে হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,মক্কা হচ্ছে নিরাপত্তা,ঐক্য ও ইবাদতের স্থান। তাই হজ্বের সময় সব ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত,অপরাধ,স্ত্রী গমন প্রভৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে যাতে আল্লাহমুখী পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এরপর আল্লাহ পাক এই সূরার ১৯৮ ও ১৯৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন-
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ () ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
"(হজ্বের সময় ব্যবসা বাণিজ্য,বিচার কার্য পরিচালনা করা বৈধ এবং) এ মাসে তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। যখন তোমরা আরাফাত থেকে দ্রুত গতিতে ফিরবে তখন মাশয়ারুল হারামে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাকে স্মরণ করবে। যদিও আগে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভূক্ত ছিলে।
তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। এরপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে দ্রুত গতিতে ফিরে আসে সেখানে থেকে তোমরাও দ্রুতগতিতে ফিরে আসবে। আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে,আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।" (২:১৯৮-১৯৯)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে,যেসব কাজে মুসলমানদের ঐক্য ও নিরাপত্তাকে হজ্বের সময় হুমকিগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন করতে পারে সেগুলো করা নিষিদ্ধ। কিন্তু এই আয়াতে অজ্ঞতার যুগের আরবদের বিশ্বাসের বিপরীতে হজ্বের মর্যাদা ও পবিত্রতার জন্য দরকার এমনসব অর্থনৈতিক লেনদেন বা কাজকে শুধু বৈধই করা হয়নি বরং একই সঙ্গে জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর হজ্বের অন্য একটি বিধানকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে,আরাফাত থেকে মাশয়ারুল হারাম নামক এলাকার দিকে যাওয়ার পথে প্রথমত: সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে এবং তিনি কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দিয়ে সুপথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন,তা নিয়ে ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত: সবার সাথে দলবদ্ধ হয়ে যেতে হবে। নিজের জন্য কোন অগ্রাধিকার চর্চা করা যাবে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে,
প্রথমতঃ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম এবং হজ্বের মত ইবাদতের পাশাপাশি জীবিকা অর্জন ও বৈষয়িক জীবনের প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ হজ্বের সফরের সময় বস্তুগত নেয়ামত ভোগ করা যাবে,কিন্তু আল্লাহকে স্মরণের ক্ষেত্রে অবহেলা করা যাবে না।
তৃতীয়তঃ হজ্বের সময় ব্যক্তির পদ ও খ্যাতির ব্যবহার করা যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে।