সূরা বাকারাহ;(৪৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৪৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:3:43 10-10-1403

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৬৩-১৬৬

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই সূরার ১৬৩ ও ১৬৪ নং আয়াতে বলেছেন-


وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ (১৬৩) إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ



"তোমাদের উপাস্য একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন প্রভু বা ইলাহ নেই। তিনি পরম দয়ালু ও দয়াময়। আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে, আর মানুষের উপকারের জন্য যেসব তরী সাগরে ভেসে বেড়ায় সেসবে আর আকাশ থেকে আল্লাহ যে বারিধারা বর্ষণ করেন-তাই দিয়ে মৃত মাটিকে বাঁচিয়ে তোলেন এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তরণে,বাতাসের গতির পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে জমে থাকা মেঘের সঞ্চারণে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" (২:১৬৩-১৬৪)

প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে যে সমন্বয় বিদ্যমান তা দেখেই তো তো আল্লাহর একত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মাটি, মেঘ, বৃষ্টি ও বাতাস, এ পৃথিবীতে প্রাণ, প্রবৃদ্ধি এবং অন্যান্য সৃষ্টির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরী করেছে। এই সমন্বিত ব্যবস্থা একদিকে যেমন বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার একত্বের প্রমাণ, তেমনি অন্যদিকে তা আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও শক্তির নিদর্শন। বলা যায় বিশ্বজগত এক অপূর্ব সুন্দর বিরাট কবিতা। এর মধ্যে রয়েছে অনেক পংক্তি ও চরণ। কিন্তু সবই একই ছন্দের ও একই অন্তর্মিলযুক্ত। আর এতে বোঝা যায়-মাত্র একজন রুচিশীল কবিই তা রচনা করেছেন। আল্লাহর একত্বের ওপর জোর দিতে গিয়ে এই আয়াতে আল্লাহর ছ'টি বড় নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে।
প্রথমতঃ আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি-তা একটি মাত্র সৌর জগতের অধীন। আর এই সৌর জগত হাজারো সৌর জগত নিয়ে গঠিত একটি ছায়াপথের অংশ মাত্র।
দ্বিতীয়তঃ পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, যার ফলে দিন ও রাত এবং বছরে বিভিন্ন ঋতুর বৈচিত্র সৃষ্টি হচ্ছে।
তৃতীয়তঃ পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ অনেক ভারী ও বড় হওয়া সত্ত্বেও সাগরে ভেসে মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এই সব জাহাজ সাগরে না ডুবে বরং বাতাসের প্রবাহে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়।
চতুর্থতঃ আল্লাহ আকাশ থেকে জমীনে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর ফলে মৃতপ্রায় শুষ্ক ভূ-পৃষ্ঠ সবুজ গাছ-পালা ও জীব- জন্তুতে সুশোভিত হয়। পানি হয় বিশুদ্ধ ও পরিস্কার এবং পরিবেশ ও বাতাস হয় সতেজ।
পঞ্চমতঃ বাতাসের গতি পরিবর্তন। এর ফলে শুধু জাহাজ চলে-তা নয়, একই সাথে উদ্ভিদের উন্মেষ, ফুলের পরাগায়ন, মেঘ-চালনা, ঠাণ্ডা ও গরম বাতাসের স্থান পরিবর্তন এবং শহরের দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধকরণ প্রভৃতি অনেক কাজ হয়।
ষষ্ঠতঃ মেঘমালা ব্যাপক পরিমাণে পানি বহন করে। কিন্তু মেঘমালা এত ভারী হওয়া সত্ত্বেও আকাশ ও জমিনের দিকে আকৃষ্ট না হয়ে ভাসমান অবস্থায় পানিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করে। এটা স্পষ্ট তারাই আল্লাহর এসব নিদর্শন থেকে তাঁর মতা ও একত্বের প্রমাণ উপলদ্ধি করতে পারবে,যারা এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং শুধু দেখেই ক্ষান্ত হয় না।

এরপর ১৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ

"আর এমন অনেক লোক রয়েছে যারা অন্য কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী। আর কতইনা উত্তম হতো যদি এ জালেমরা পার্থিব কোন কোন আযাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিতো যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর শাস্তিই সবচেয়ে কঠিনতর।" (২:১৬৫)

আকাশ, জমীন, সাগর, উদ্ভিদ, প্রাণীকূল, ও অজৈব সব কিছু আল্লাহর একত্বের প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও-এসব নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করে অনেকে এসবকে শুধু বাহ্যিক উপকরণ হিসেবে দেখে এবং আল্লাহর পরিবর্তে এসবের উপাসনা করে। তারকারাজিকে অনেকে নিজেদের জীবনে প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে মনে করে এবং এটাকে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করে। কেউ কেউ গরুর মত জীব-জানোয়ারকে পবিত্র হিসেবে সম্মান ও ভক্তি করে। অনেক সময় নিজেরা কাঠ বা পাথর দিয়ে মূর্তি বানিয়ে তার সামনে নত হয় এবং নিজের সব ভক্তি শ্রদ্ধা তার জন্য উজাড় করে দেয়। অনেক সময় মানুষকেও খোদার আসনে বসিয়ে তাকে খোদার মত ভাগ্য নিয়ন্ত্রক বলে মনে করে-তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়। এইসব বস্তুর প্রতি অত্যধিক ভালোবাসার কারণে তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ঐসব নির্বাক ও নিস্ক্রিয় খোদাদের উপাসনা করে। অথচ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের জন্য যা দরকার তা হলো, সব কিছুর চেয়ে, আল্লাহর প্রতি মানুষের বেশী ও সুদৃঢ় ভালবাসা এবং সকল ভালবাসা, ভক্তি হতে হবে আল্লাহর জন্যেই আর এই প্রেম বা ভালবাসা জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত হয়। মুশরিকরা তাদের খোদাদেরকে ভালবাসে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও খেয়ালীপনার ভিত্তিতে, কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার ভিত্তি সে রকম নয়। অবশ্য মুশরিকরাও যদি পরকাল ও পারলৌকিক শাস্তি দেখতে পেতো, তাহলে তারাও বুঝতো যে সমস্ত শক্তি আল্লাহরই হাতে এবং তারা বুঝতো সম্মান ও শক্তি লাভের জন্যে তারা বৃথাই আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দ্বারস্থ হয়েছে।

এরপর ১৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ

"অবিশ্বাসীরা যাদের উপাসনা করতো,(কিয়ামতের দিন) সেই সব উপাস্যরাই যখন তাদের উপাসকদেরকে অস্বীকার করবে, তখন তারা সবাই আল্লাহর শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।" (২:১৬৬)

এই আয়াতে মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, তোমরা ধীরস্থির হয়ে, ভেবে দেখ কে তোমাদের প্রভু? কার অনুসরণ করছ তোমরা এবং কাকে শ্রদ্ধা করছ? আমরা এমন কাউকে ভালবাসবো যিনি নিজের স্বার্থের জন্য আমাদের ভালবাসা চান না। যেসব মানুষকে আমরা খোদার আসনে বসিয়ে ভালবাসবো তারাই কিয়ামতের দিন আমাদেরকে ঘৃণা করে আমাদের থেকে দূরে থাকবে। নেতা নির্বাচনেও আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। কারণ পরকালে আমাদের ভাগ্যও তাদের সাথে যুক্ত। সে সময় প্রত্যেককে তাদের ভালবাসার পাত্র ও নেতা-নেত্রীর সাথে একত্র করা হবে।

এবারে সূরা বাকারাহ'র ১৬৩ নম্বর থেকে ১৬৬ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরছি-
এক. আল্লাহকে জানার বিভিন্ন পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো, প্রকৃতিকে জানা। কারণ এ প্রকৃতি হলো আল্লাহর বিধান, ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রকাশ।
দুই. আল্লাহর জায়গায় অন্য কিছুকে মাবুদ হিসেবে শ্রদ্ধা করা শির্ক ।
তিন. ঈমানের লক্ষণ হলো আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম ও ভালোবাসা, যা কাজে-কর্মে প্রকাশ পায়।
চার. কিয়ামতের দিন প্রবৃত্তির খেয়ালীপনার কারণে জন্ম নেয়া মিথ্যা ভালোবাসা ঘৃণা ও অভিশাপে পরিণত হবে।
পাঁচ. খোদাবিমুখ নেতৃবৃন্দ ও তাগুতি শক্তি, কিয়ামতের দিন যে শুধু ক্ষমতাবিহীন থাকবে তা নয়-তারা এত দায়িত্বহীন হবে যে, নিজেদের অনুসারীদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করবে।