সূরা আল মায়েদা;(১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:33:46 1-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৩২-৩৫

সূরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ بَعْدَ ذَلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ

"এই কারণেই বনি ইসরাইলিদের এই বিধান দিলাম যে নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার কারণ ব্যতীত যদি কেউ কাউকে হত্যা করে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল। যদি কেউ একটি প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো। অতপর যদিও তাদের নিকট আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিল এরপরও তাদের মধ্যে অনেকেই সীমালঙ্ঘনকারীই থেকে গেল।" (৫:৩২)

এর আগে আমরা হযরত আদম (আ.)এর সন্তানের কাহিনী বর্ণনা করেছিলাম। আমরা জেনেছিলাম যে, কাবিল হিংসার বশবর্তী হয়ে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল এবং একটি কাকের দিক-নির্দেশনায় তাকে মাটিতে দাফন করেছিল। অবশেষে নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা করেছিল। এ আয়াতে বলা হয়েছে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় এই মর্মে যে, কেউ যদি কোনো একজন মানুষকে হত্যা করে সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল। কেননা কাউকে মৃত্যু থেকে মুক্তি দেয়া সমগ্র মানব সমাজকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার শামিল। কোরআন এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করেছে আর তা হলো মানুষের সমাজটা হলো পরিপূর্ণ একটি দেহের মত। সমাজের প্রতিটি মানুষ হলো সেই দেহের একেকটি অঙ্গ। এই সমাজের একটি অঙ্গের কোনো রকমের ক্ষতি হয় তার প্রভাব অপর অঙ্গের ওপর সুস্পষ্ট হয়ে যায়। একইভাবে কেউ যদি কোনো নিরপরাধের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করে সে অপর নিরপরাধী মানুষকেও আক্রমণ করতে পারে নির্দ্বিধায়। কেননা সে একজন খুনি তাই তার কাছে নিরপরাধ মানুষের আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। সৃষ্টি ব্যবস্থার দৃষ্টিতে হাবিলের মৃত্যু মানব সমাজের বৃহত একটি প্রজন্মের মৃত্যুর কারণ, যে প্রজন্মটি এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার এবং উপস্থিতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের জীবন রক্ষার জন্য কোরআন ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি একজনকে হত্যা করা মানে একটি সমাজকে হত্যা করা বলে কোরআন মনে করে। এসব সত্ত্বেও দু'টি ক্ষেত্রে হত্যা করাকে জায়েজ মনে করে। এক. হত্যাকারীর শাস্তি হিসেবে কেসাস বাস্তবায়ন করার জন্য।

দুই. যে ব্যক্তি সমাজে অন্যায়, ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে সে যদিও কাউকে হত্যা না করে কিন্তু তার অত্যাচারে সমাজ ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে এ ধরনের লোক পৃথিবী থেকে সরে যাওয়া উচিত।

ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী যে কেউ অন্যদের গোমরাহের কারণ হয় সে যেন একটা সমাজকেই গোমরাহ বানালো। আবার যে একজন মানুষকে হেদায়েত করলো সে যেন একটি সমাজকেই সুখ-সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করলো। আয়াতের শেষ দিকে বনী ইসরাইলের মাঝে আইন অমান্য করার রেওয়াজের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তাদের জন্য বহু নবী পাঠিয়েছি এবং সত্যের বাণী তাদের কানে পৌঁছিয়েছি কিন্তু তারা সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করেছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো, যুগ যুগ ধরে মানুষের ভাগ্য পরস্পর সম্পৃক্ত ছিল এবং আছে। মানব ইতিহাসটা শিকলের মত একটির সাথে আরেকটি জড়ানো। এই শিকলের একটি রিং যদি ভেঙ্গে ফেলা হয় তাহলে ব্যাপক ধ্বংসের কারণ হয়। কাজের মূল্য নির্ধারণ করে তার আদর্শ ও লক্ষ্যের ওপর। একজন মানুষকে আগ্রাসী উদ্দেশ্যে হত্যা করা একটি সমাজকে হত্যা করার শামিল। পক্ষান্তরে একজন খুনীকে কেসাস হিসেবে হত্যা করা সমাজকে জীবন দেয়ার শামিল। যাদের কাজ হলো মানুষকে মুক্তি দেয়া যেমন, চিকিৎসক কিংবা নার্স ইত্যাদি তাদের উচিত নিজেদের কাজের মূল্য উপলব্ধি করা। মৃত্যু থেকে প্রতিটি রোগীর বেঁচে ওঠা একটি সমাজ ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে ওঠার মত।

 

এই সূরার ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 

إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ (33) إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায় এবং সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রসারের জন্য, তাদের শাস্তি হচ্ছে তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশ বিদ্ধ করা হবে, অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে কিংবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। পৃথিবীতে এটাই হবে তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।" (৫:৩৩)

"ব্যতিক্রম হবে তারাই যারা তোমার আয়ত্বাধীনে আসার পূর্বে অনুতপ্ত হবে সে ক্ষেত্রে যেন রাখ যে আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।" (৫:৩৪)

আগের আয়াতে মানুষের জীবনের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, কেউ যদি এই সম্মান ও মর্যাদাকে রক্ষা না করে তাহলে তার জীবনও সম্মানজনক নয়। তাই তাকে কঠিনভাবে শাস্তি দেয়া উচিত যাতে অন্যরাও তা থেকে শিক্ষা পায়। এ আয়াতে চার রকমের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। হত্যা করা, ফাসি দেয়া, শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলা এবং নির্বাসন দেয়া। এই চারটির শাস্তি এক রকম নয়। ইসলামী শাসক অপরাধের মাত্রা অনুপাতে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। আয়াতের শেষাংশে এসেছে, অবশ্য দুনিয়াবি এই শাস্তির ফলে পরকালীন শাস্তি মাফ হয়ে যাবে না। ভয়াবহ শাস্তি সেখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে হ্যা এ ধরনের লোক যদি তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ যা কিছু তার সাথে সম্পর্কিত মাফ করে দিতেও পারেন। কোনোভাবেই মানুষের পাওনা ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না যিনি প্রাপ্য তিনি ক্ষমা করে না দেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. সমাজ সংস্কারের জন্য দিক-নির্দেশনা এবং উপদেশ যেমন জরুরী তেমনি আইন, আদালত ও শাস্তির বিধানও।

দুই. যারা সমাজের সুখ-শান্তি এবং নিরাপত্তা কেড়ে নেয় তাদেরকেও সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা উচিত।

এ সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

"হে মুমিনগণ! আল্লাহর প্রতি কর্তব্য কর তার সান্নিধ্য লাভের উপায় অন্বেষণ কর এবং সর্বশক্তি দিয়ে তার পথে সংগ্রাম কর যেন তোমরা সফলকাম হতে পার।" (৫:৩৫)

এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ঝঞ্ঝাপূর্ণ এই পৃথিবীতে মুক্তির উপায় দু'টি। তাকওয়া এবং তাওয়াস্‌সুল। মনের কামনা বাসনা চারিতার্থ করার প্রবণতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, গুনাহ বা পাপ সংগঠনের পথকে রোধ করে। আর কোরআনে কারিম সুন্নাতে রাসূল, তার আহলে বাইত এবং পবিত্র ওলী আওলিয়াগণ সবাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহযোগী। আর তাকওয়া হচ্ছে মানুষকে গুনার কাছ থেকে সরিয়ে রাখার মাধ্যম।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

এক. মুক্তি লাভ করার জন্য দূষণ থেকে যেমন দূরে থাকতে হবে, তেমনি পবিত্র জনদের নৈকট্য লাভ করতে হবে।

দুই. তাকওয়া এবং তাওয়াস্‌সুল সৌভাগ্যের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।