সূরা আল মায়েদা; আয়াত ২৭-৩১
সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آَدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآَخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
"আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিল) ঘটনা সঠিকভাবে শুনান। যখন তারা উভয়েই ( আল্লাহর উদ্দেশ্যে) কিছু উৎসর্গ বা কোরবানি নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত না হওয়ায় সে (কাবিল) বললঃ আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। অপর ভাই বললঃ আল্লাহ কেবল খোদাভীরু বা ধর্মভীরুদের কোরবানিই কবুল করেন।" (৫:২৭)
ইসলামী বর্ণনায় ও তাওরাতের জেনেসিস অধ্যায়ে এসেছে, প্রথম দিকে হযরত আদম (আ.)'র দুই সন্তান ছিল। তাদের নাম ছিল হাবিল ও কাবিল। পশু-পালন ছিল হাবিলের জীবিকা। আর কাবিল ছিল কৃষক। হাবিল তার সবচেয়ে ভাল ভেড়াটি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করে। অন্যদিকে কাবিল তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফসল আল্লাহর উদ্দেশ্যে দান করে। ফলে কাবিলের এ দান গৃহীত হয়নি। আল্লাহর দরবারে তার এ দান গৃহীত না হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ ওহির মাধ্যমে হযরত আদম (আ.)-কে দিয়ে বা অন্য কোনো মাধ্যমে হাবিল ও কাবিলকে জানিয়ে দেন। কাবিল ছিল হিংসুক প্রকৃতির ও কুৎসিত হৃদয়ের অধিকারী। সে নিজেকে সংশোধনের উদ্যোগ না নিয়ে ভাইয়ের প্রতি হিংসায় অন্ধ হয়ে উঠে এবং তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হাবিল ছিল পবিত্র অন্তরের অধিকারী। সে এই হুমকির জবাবে বলল, আমাদের কাজগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে গৃহীত হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি কারণহীন কোনো ব্যাপার নয়। তাই তুমি অযথাই আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হচ্ছ। আল্লাহ কেবল সেসব কাজই কবুল করেন যা আন্তরিক ও পবিত্র চিত্তে করা হয়, তা সেই কাজ যত ক্ষুদ্র বা বড়ই হোক না কেন। কেবল এ ধরনের কাজই মূল্যবান অন্য কাজগুলো আল্লাহর কাছে মূল্যহীন।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. অতীতের ইতিহাস ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষার মাধ্যম। তাই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পর্যালোচনা করা জরুরি।
দুই. ভাল কাজ করাই যথেষ্ট নয়, এর পেছনে সৎ উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা থাকা দরকার। তা না থাকলে ভাল কাজও মূল্যহীন।
তিন. হিংসা মানুষকে সহদোর ভাইকে হত্যার মত জঘন্য কাজে লিপ্ত করতে পারে। হযরত ইউসুফ (আ.)'র ভাইদেরকেও শয়তান হিংসার মাধ্যমে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল।
সূরা মায়েদার ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ (28) إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ
"হাবিল তার ভাই কাবিলকে বলল: যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দাও, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হাত বাড়াব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি।" (৫:২৮)
"আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি।" (৫:২৯)
কাবিলের মত হিংসুক ও অপরাধী ভাইয়ের মোকাবেলায় হাবিল কোনো ধরনের সহিংস পন্থার দিকে না গিয়ে শুধু এটা বলেছে যে, যদিও আমি জানি যে, তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও, কিন্তু আমি তোমার আগে এ ধরনের উদ্যোগ নেব না। কারণ, আমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালককে ভয় পাই যিনি বিচার দিবসের মালিক এবং এ দিবসে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আর আমি এটাও জানি যে, কেউ আমাকে হত্যা করবে-এই অজুহাতে আগেভাগেই হত্যার প্রতিশোধ নেয়া বৈধ নয়।
অবশ্য জুলুমের মোকাবেলায় প্রতিরোধ করা জরুরি, কেউ পাপের ইচ্ছা করল বলেই তাকে পাপের শাস্তি দেয়া যায় না। কারণ, এ ধরনের অনেক ইচ্ছাই বাস্তবায়ন পর্যন্ত গড়ায় না। অবশ্য অপরাধ যাতে না ঘটে সে জন্য আগে ভাগেই অপরাধের মাধ্যম বা হাতিয়ারগুলোকে মানুষের হাত থেকে কেড়ে নেয়া বৈধ।
যাই হোক, হাবিল কাবিলকে বলল, আমি এ কাজে তোমার চেয়ে অগ্রগামী হতে চাই না, কিন্তু তুমি যদি তা কর বা আমাকে হত্যা কর, তবে জেনে রাখ যে তুমি জাহান্নামে যাবে এবং আমি সেখানেই তোমার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করব। কারণ, তুমি জীবনে কোনো সৎ কাজ করনি যে তার পূণ্য থেকে আমাকে কিছু দেবে। তাই আমার গোনাহর বোঝাও তোমার ঘাড়ে নিতে তুমি বাধ্য হবে। আর এভাবে তোমার শাস্তি বেড়ে যাবে।
এ আয়াত থেকে আমাদের যা শেখা দরকার:
এক. হিংসুক ও একগুঁয়ে প্রকৃতির মানুষের মোকাবেলায় আমাদের উচিত শান্তভাবে কথা বলা, হিংসুকদের হিংসার আগুন আরো প্রজ্জ্বলিত করার মত কথা বলা ঠিক হবে না।
দুই. মহান আল্লাহর মহত্ত্বকে ভয় করেই আমরা যেন পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকি, দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে পাপ বর্জন করার কোনো মূল্য নেই। হাবিল এ কথা বলেনি যে, আমার শক্তি নেই বলেই তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, বরং সে এ কথা বলেছিল যে, আমি ভ্রাতৃহত্যার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করছি।
তিন. আল্লাহর ভয়ই পাপ ও অন্যায় থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় মানসিক চালিকাশক্তি।
সূরা মায়েদার ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتَلَهُ فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ (30) فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَابًا يَبْحَثُ فِي الْأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْأَةَ أَخِيهِ قَالَ يَا وَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْأَةَ أَخِي فَأَصْبَحَ مِنَ النَّادِمِينَ
"অতঃপর তার অন্তর (যা হিংসা ও শয়তানের কূমন্ত্রণায় খোদাদ্রোহী হয়ে পড়েছিল তা) তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। এরপর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।" (৫:৩০)
"আল্লাহ এক কাক পাঠালেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, নিজ ভাইয়ের মৃতদেহ কিভাবে আবৃত করবে। সে বললঃ আফসোস, আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ আবৃত করি। অতঃপর সে অনুতাপ করতে লাগল।" (৫:৩১)
কাবিলের প্রতি হাবিলের উপদেশ ও তাদের সংলাপ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রবৃত্তির কূমন্ত্রণার কাছে পরাজিত কাবিল ভাইকে হত্যা করে। কিন্তু খুব শিগগিরই সে এ জন্য অনুতপ্ত হয়। কিন্তু তখন আর অনুতাপ করে কি লাভ? ভাইকে তো আর জীবিত করা যাবে না। তাই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে লাগল ভাইয়ের লাশকে কী করবে। এরপর মহান আল্লাহর পাঠানো একটি কাকের মাটি খোঁড়া দেখে সে বুঝতে পারে যে লাশ কিভাবে দাফন করতে হবে। এরপর কাবিল ভাইয়ের লাশ মাটিতে দাফন করে। এভাবে সংঘটিত হয় মানব জাতির মধ্যে প্রথম নরহত্যার ঘটনা। আজও বহু মানুষ মানুষেরই হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হলো:
এক. সত্য ও মিথ্যার লড়াই মানব জাতির ইতিহাসের মতই প্রাচীন। মানুষের প্রথম মৃত্যু ছিল শাহাদতের ঘটনা।
দুই. পশু-পাখি কখনও কখনও ঐশী দায়িত্ব পালন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মানুষের শিক্ষক। মানুষ পশু-পাখির কাছ থেকে অনেক কল্যাণকর জ্ঞান শিখেছে। যেমন, পাখির উড্ডয়ন থেকে বিমানের উদ্ভাবন।
তিন. মহান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের লাশ অবশ্যই মাটিতে দাফন করা উচিত। লাশ মমি করে রাখা বা পুড়িয়ে ফেলা বৈধ নয়।