সূরা রা’দ; (১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা রা’দ; (১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:30:50 1-10-1403

সূরা রা’দ; আয়াত ২৯-৩১

সূরা রা’দের ২৯ নম্বর আয়াতে কি বলা হয়েছে-

الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ طُوبَى لَهُمْ وَحُسْنُ مَآَبٍ

“যারা (আল্লাহর ওপর ) বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে তাদের জন্যই রয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য এবং শুভ পরিণাম।” (১৩:২৯)

এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর স্মরণ ঈমানদার মুসলমানের মনকে প্রশান্ত করে, এর ফলে তাঁরা মানসিক সুখ ও প্রশান্তি অনুভব করেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে , ঈমানদার ব্যক্তিরা সব সময় সৎকর্মশীল। তারা প্রত্যেক কাজে এবং পদক্ষেপে আল্লাহর সম্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন। ফলে তাঁরা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। তাদের জীবন ঐশী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে ওঠে। তাদের জীবনের পরিণতিও হয় অত্যন্ত শুভ।

একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পবিত্র কুরআনে সাধারণত ঈমানের পাশাপাশি সৎকর্মের বিষয়টিকে স্থান দেয়া হয়েছে। বিষয়টি এমন যে ঈমান এবং সৎকর্ম যেন অবিচ্ছেদ্য। যারা ঈমানদার তাদের বৈশিষ্ট্য মুনাফিক এবং ফাসেকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন ফাসেকের মনে আল্লাহর বিশ্বাস থাকলেও সে অনেক ক্ষেত্রে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু মুনাফিক মন থেকে আল্লাহকে বিশ্বাস না করলেও জন সম্মুখে নিজেকে ঈমানদার বা মুসলমান হিসেবে প্রকাশ করে।

ধন-সম্পদই পার্থিব সুখ-শান্তির একমাত্র উপাদান নয়। যাদের মনে ঈমানের আলো নেই তাদের পার্থিব জীবনও সুখের হয় না। সুখময় জীবনের জন্য ঈমান অত্যন্ত জরুরি। একজন ঈমানদার ইহকালেও যেমন সফল পরকালেও তেমনি সফল। অপর দিকে যার মনে ঈমান বা আল্লাহর বিশ্বাস নেই তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য খুবই ক্ষণস্থায়ী।

সূরা রা’দের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

كَذَلِكَ أَرْسَلْنَاكَ فِي أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهَا أُمَمٌ لِتَتْلُوَ عَلَيْهِمُ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ قُلْ هُوَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ مَتَابِ

“(হে নবী!) এভাবেই আমি আপনাকে এমন এক জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি যার পূর্বে বহু জতি গত হয়েছে। (আপনাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো) আমি আপনাকে যা প্রত্যাদেশ করেছি তা আপনি তাদের নিকট আবৃত্তি করবেন। তথাপি তারা যদি করুনাময় (আল্লাহকে) অস্বীকার করে, বলুন! তিনিই আমার প্রতিপালক, তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তাঁরই উপর আমি নির্ভর করি এবং তাঁরই নিকট আমার প্রত্যাবর্তন।” (১৩:৩০)

যুগে যুগে নবী-রাসূলদের আগমন, বহু জাতি গত হওয়া এবং সত্যকে গ্রহণ করার ব্যপারে মক্কার কাফেরদের উদাসীনতার প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াতে বলা হয়েছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) প্রথম নবী বা রাসূল নন যে তার নব্যুয়তের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকবে। প্রত্যেক জাতির জন্যই আল্লাহ পয়গম্বর প্রেরণ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই প্রত্যাদেশ বাণী মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন। তারা নিজ থেকে বা মনগড়া কোন কথা মানুষকে বলেন নি। তারা সবাই একটি বাণীই প্রচার করেছেন, আর তা হলো আল্লাহ এক এবং তিনিই উপাসনার যোগ্য। আল্লাহ ছাড়া আর কোন অবলম্বন নেই। সকলকেই তার দিকে ফিরে যেতে হবে।

এই আয়াতের দুটো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

এক. সত্যকে গ্রহণের ক্ষেত্রে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস তাদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে অধ্যয়ন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

দুই. অবিশ্বাসী শত্রুদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত।

এই সূরার ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْ أَنَّ قُرْآَنًا سُيِّرَتْ بِهِ الْجِبَالُ أَوْ قُطِّعَتْ بِهِ الْأَرْضُ أَوْ كُلِّمَ بِهِ الْمَوْتَى بَلْ لِلَّهِ الْأَمْرُ جَمِيعًا أَفَلَمْ يَيْئَسِ الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ لَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيعًا وَلَا يَزَالُ الَّذِينَ كَفَرُوا تُصِيبُهُمْ بِمَا صَنَعُوا قَارِعَةٌ أَوْ تَحُلُّ قَرِيبًا مِنْ دَارِهِمْ حَتَّى يَأْتِيَ وَعْدُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ

“যদি কুরআন দ্বারা পর্বতকে গতিশীল করা হত, অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করা হত, অথবা মৃতের সাথে কথা বলা যেত (তবুও তারা বিশ্বাস স্থাপন করত না) তবে সমস্ত বিষয়ই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। ঈমানদাররা কি ওদের ঈমান না আনার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়নি? তারা কি জানে না যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয়ই সকলকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন! যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের কর্মফলের জন্য তাদের বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে, অথবা বিপর্যয় তাদের ঘরের আশেপাশেই আপতিত হতেই থাকবে যে পর্যন্ত না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সমাগত হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। (১৩:৩১)

নবী করিম (দ.) এর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার বর্ণনা দেয়ার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, কাফের অবিশ্বাসীরা যেন এটা মনে না করে যে, তারা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়েছে, কাজেই নিজেদের ইচ্ছা মত চলতে পারবে। তাদের মনে রাখা উচিত, মহান আল্লাহ তাদের হঠকারীতার জন্য পার্থিব জগতে যেমন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন তেমনি পরকালেও তাদেরকে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

কাফের অবিশ্বাসীদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একদল আছে, যাদের সামনে যুক্তি বা নিদর্শন উপস্থাপিত হলে সত্যকে গ্রহণ করার মত মানসিকতা তাদের রয়েছে। আরেকটি দল আছে যারা এতটাই গোঁড়া যে মৃত ব্যক্তিও যদি তাদের সঙ্গে কথা বলে তাহলেও তারা সত্যকে মেনে নেবে না। এই আয়াত এই শ্রেণীর ঔদ্ধত্য কাফেরদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ফলে মানুষ সত্যকে গ্রহণ করতে পারে আবার তা প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। কাজেই ঈমানদারদের এটা প্রত্যাশা করা উচিত নয় যে দুনিয়ার সব মানুষই সত্যকে গ্রহণ করে ভালো মানুষ হয়ে যাবে।

আল্লাহর চান মানুষ স্বাধীনভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমে সত্যকে গ্রহণ করুক। তা না হলে তিনি পারতেন সকলকে ঈমানদার বানিয়ে ফেলতে।