সূরা রা’দ; আয়াত ৩২-৩৫
সূরা রা’দের ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِنْ قَبْلِكَ فَأَمْلَيْتُ لِلَّذِينَ كَفَرُوا ثُمَّ أَخَذْتُهُمْ فَكَيْفَ كَانَ عِقَابِ
“হে মুহাম্মদ! আপনার পূর্বে বহু রাসূলকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছে। অতঃপর আমি অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে কিছু অবকাশ দিয়েছি। তারপর তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি। অতএব ভেবে দেখুন, আমার শাস্তি কেমন ছিল।” (১৩:৩২)
এর আগের কয়েকটি আয়াতে কাফেরদের একগুঁয়েমি ও হঠকারিতা কথাবার্তা ও সত্যকে গ্রহণ না করার জন্য নানা বাহানার কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে; যা আমরা গত আসরে আলোচনা করেছি। এই আয়াতেও একই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে নবী করিম (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, আপনি এটা মনে করবেন না যে, কাফেররা কেবল আপনাকে নিয়েই ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বরং এর আগে বহু নবী রাসূল এ ধরনের ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন। তাদেরকে আমি তৎক্ষণাৎ পাকড়াও না করে কিছুটা সময় দিয়েছি যাতে তারা সত্য পথে ফিরে আসার সুযোগ পায়। কিন্তু যখন তারা সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগায়নি তখন আমি তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করলাম।
পাপ বা অন্যায় করার পরও দেখা যায় অনেকেরই কিছুই হয় না কিংবা তাদের ওপর ঐশী শাস্তি আসতে দেখা যায় না। এর কারণ হলো মহান আল্লাহ অনেক সময় বান্দাকে অনুশোচনার জন্য সময় দেন। কিন্তু যখন সময় পেয়েও মানুষ নিজের পাপ বা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হয় না বা তওবা করে না, তখনই তার ওপর নেমে আসে নানা বিপদাপদ। এ জন্য পাপাচারি মানুষকে জীবনের কোন এক সময় তার পাপের শাস্তি ভোগ করতে হয়।
সূরা রা’দের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াত বলা হয়েছে,
أَفَمَنْ هُوَ قَائِمٌ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ وَجَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ قُلْ سَمُّوهُمْ أَمْ تُنَبِّئُونَهُ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي الْأَرْضِ أَمْ بِظَاهِرٍ مِنَ الْقَوْلِ بَلْ زُيِّنَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا مَكْرُهُمْ وَصُدُّوا عَنِ السَّبِيلِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ (33) لَهُمْ عَذَابٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآَخِرَةِ أَشَقُّ وَمَا لَهُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَاقٍ
"যিনি প্রত্যেক মানুষ ও তার কর্মের প্রতি লক্ষ্য রাখেন তিনি কি তাদের সমান যাদেরকে তারা অংশী করে? অথচ তারা আল্লাহর বহু অংশী করেছে। বলুন, আল্লাহর অংশীদের পরিচয় দাও। অথবা তোমরা আল্লাহকে এমন কিছুর সংবাদ দাও যা তিনি জানতেন না। তা না হলে অসার কথা বলছো। না, যারা কাফের তাদের ছলনা তাদের নিকট শোভন প্রতীয়মান হয় এবং তার সৎ পথ থেকে নিবৃত হয়। আর আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার জন্য কোন পথপ্রদর্শক নেই।” (১৩:৩৩)
“তাদের জন্য পার্থিব জীবনে রয়েছে শাস্তি এবং পরকালের শাস্তি তো আরও কঠোর এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই।" (১৩:৩৪)
যারা মুশরিক অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রতীমা বা দেব-দেবীর কাছে সাহায্য কামনা করে, নিজেদের হাতে বানানো মূর্তির আরাধনা করে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে এই আয়াতে বলা হয়েছে, বিশ্বজগতের সকল কিছু যে আল্লাহর নিয়ন্ত্রাধীন, তাঁকে বাদ দিয়ে পাথর বা মাটির তৈরি মূর্তি বা প্রতীমার ধর্ণা দেয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে? এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বর্ণনা দেয়ার পর বলা হয়েছে, এ ধরনের মানুষের জন্য বাতিল বা অসত্য অত্যন্ত শোভন বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে মিথ্যার পেছনে ছুটে চলে। আসলে যারা পাপের কারণে ঐশী নির্দেশনা লাভের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, তাদেরকে সুপথে আনার সাধ্য কারো নেই।
পবিত্র কুরআনে এভাবে মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে সক্রিয় করার জন্য অনেক কিছু প্রশ্ন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা নির্ণয় করতে পারে।
সূরা রা’দের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَى الَّذِينَ اتَّقَوْا وَعُقْبَى الْكَافِرِينَ النَّارُ
"ধর্মপ্রাণ, পরহেজগারদের জন্যে প্রতিশ্রুত জান্নাত এমন বাগানসদৃশ যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তার ফলগুলো এবং ছায়া চিরস্থায়ী। এটা তাদের প্রতিদান যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রতিফল হচ্ছে নরক বা অগ্নি।" (১৩:৩৫)
এই আয়াতে পরকালে মুমিন কিংবা মুসলমানদের অস্থার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, খোদাভীরু মুত্তাকিদেরকে যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে জান্নাত বা বেহেশত। যাতে রয়েছে রকমারী ফলমূল এবং আহার্য দ্রব্য। তা যেন সবুজঘেরা গাছপালায় পরিবেষ্টিত অপূর্ব সুন্দর এক বাগান বিশেষ। তবে তা এ জগতের বাগানের সাথে যেমন তুলনার যোগ্য নয়, তেমনি কল্পনারও অতীত। এ জন্য পবিত্র কুরআনে ‘মেস্ল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ যদি কেউ কল্পনা করতে চায় তাহলে সে সবুজ গাছপালায় আচ্ছ্বাদিত ছায়ায় ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোরম কোন বাগানের কথা ভাবতে পারে। এখানে লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, এই আয়াতে মুশরিকদের বিপরীতে মুত্তাকি বা খোদাভীরু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে মুমীন শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। এ থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি যে, ঈমানের সাথে তাকওয়া বা খোদাভীতিটাও অপরিহার্য। তাকওয়া ছাড়া ঈমান মূল্যহীন। শুধু মুখে ঈমান আনলে বা মুসলমান হবার দাবি করলেই হবে না, ঈমানের সাথে সাথে পাপ ও সকল মন্দ কাজ পরিহার করতে হবে।