কোরআনের আলো অনির্বাণ
  • শিরোনাম: কোরআনের আলো অনির্বাণ
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:41:27 4-9-1403


২০১০ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি এলাকায় কিছু হিংস্র ও নিষ্ঠুর লোক কট্টরপন্থী এক খ্রিস্টান পাদ্রীর প্ররোচনামূলক পরিকল্পনার জের ধরে সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ অর্থাৎ আল কুরআনুল কারিমে অগ্নিসংযোগ করে দেড়শ' কোটি মুসলমানের অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো জানে না, কোরআনের আলো কোনোদিন নিভে যাবে না। সূরা তাওবার ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেনঃ ‘তারা চায় মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে কিন্তু আল্লাহ নিজের নূরকে পরিপূর্ণ করা ছাড়া আর কিছুই চান না, তাতে কাফেররা যতোই অসন্তুষ্ট হোক না কেন।' যাই হোক কোরআনের এই মাহাত্ম্য নিয়ে আজ আমরা খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ আল-কোরআন মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান নিয়ে এসেছে যাতে মানুষ সৌভাগ্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারে। কোরআন হচ্ছে একটি নূর বা আলোর গ্রন্থ। এই কোরআন জীবনের উত্তাল সমুদ্রে মুক্তির তরির মতো মানুষকে পথের দিশা দেয়। কোরআনে উপস্থাপিত উচ্চতর যে আদর্শ, তা বিশ্লেষণ করে জ্ঞানীজনেরা কোরআনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের সাথে মস্তক অবনত করে দেয়। কোরআনের যে অপার বিস্ময় তা প্রকৃত গবেষক এবং সত্যান্বেষীদেরকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে এবং তার আধ্যাত্মিক ঝর্ণাধারায় পরিতৃপ্ত করে। পবিত্র কোরআন বৈজ্ঞানিক এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সম্ভার, শিক্ষণীয় বহু গল্প কাহিনী, নৈতিক এবং মানবিক বহু জ্ঞান ও শিক্ষা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় এতো চমৎকারভাবে এবং এতো সুন্দর বাচনভঙ্গি আর শব্দমালায় উপস্থাপিত হয়েছে যে তা যে-কোনো পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে। ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, মনে হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর সর্বশেষ এবং পরিপূর্ণতম ঐশী গ্রন্থে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দরতম বর্ণনা ও বক্তব্যগুলোকে পাশাপাশি সাজিয়ে সাহিত্যিক এক বিস্ময় বা অলৌকিকত্ব সৃষ্টি করেছেন।
ইরানের বিখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাফি গুলপয়গানী বলেছেনঃ ‘কোরআনে কারিম মানব সমাজে পুনরায় জীবন দান করেছে। কোরআনে মানব অধিকার সংক্রান্ত যেসব আইন বা বিধান রয়েছে সেগুলো এতো বেশি দৃঢ় এবং উন্নত যে, মানবাধিকার ঘোষণার সাথে তার তুলনাই হয় না।' ইমাম আলী (আ) কোরআন সম্পর্কে বলেছেনঃ‘আল্লাহর কিতাবকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরো! কেননা এটি খুবই শক্তিশালী একটি বিষয় এবং সুস্পষ্ট নূরের আধার, বরকতপূর্ণ ও আরোগ্য দানকারী ঔষধ, জীবন দানকারী পানি যা সত্যানুসন্ধানী বা সত্যের জন্যে তৃষ্ণার্তদের তৃষ্ণা দূর করে। যে কেউ তাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, তাকে হেফজ করবে এবং যে কেউ তার ছায়ায় আশ্রয় নেবে, তাকে কোরআন মুক্তি দেবে।' কোরআনের বিধি বিধানগুলো এতো বেশি দৃঢ়,প্রামাণ্য এবং সুস্পষ্ট যে, কেউই তাকে বিকৃত করতে পারে নি কিংবা কোরআনের মতো একটি আয়াত কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের আইন-কানুন রচিত হয়েছে, বহু চিন্তাদর্শ, বাদ-মতবাদ, নৈতিক এবং মানব পথ-প্রদর্শনমূলক বহু বিধানের উদ্ভব হয়েছে।
কিন্তু ঐতিহাসিক কাল পরিক্রমায় এগুলোর কোনোটাই টেকে নি বা স্থায়িত্ব লাভ করেনি। সবসময়ই এগুলোতে পরিবর্তন পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ঘটেছে। এর কারণ হলো এসব আইন বা বিধি-বিধান মানুষ নিজেরাই তৈরি করেছে যাদের সর্বজ্ঞ জীবনদৃষ্টি নেই। কিন্তু কোরআন হচ্ছে চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতার আধার। এটি আল্লাহর কালাম বা ওহীর সংকলন। কালের বিবর্তনেও তার ওপর প্রাচীনত্বের কোনো ধুলা পড়বে না এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোরআনের বিধি বিধানগুলো অপরিবর্তিত এবং জীবন্ত আছে,কেয়ামত পর্যন্তও সেরকমই থাকবে।
মহা এই গ্রন্থের ঔজ্জ্বল্য অযথা হৈ চৈ আর বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নির্বাপিত হবে না বরং আরো অনেক বেশি মানুষের অন্তরকে কোরআনের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলবে, কোরআন নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করবে। কোরআনকে সুরক্ষা করার ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সূরায়ে হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ নিঃসন্দেহে আমরা কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর চূড়ান্ত সংরক্ষক। একইভাবে সূরা ফুসসিলাতের ৪১ এবং ৪২ নম্বর আয়অতেও বলা হয়েছেঃ নিশ্চয়ই যারা কোরআন আসার পর তা অস্বীকার করে তা (আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে না) এবং এটি এমন এক সম্মান ও মর্যাদাময় কিতাব যা পুরোপুরি অব্যর্থ, কোনো ধরনের মিথ্যা বা বাতিলের প্রভাব এর ওপর পড়ে না-না সামনের দিক থেকে, না পেছনের দিক থেকে। কেননা; মহা প্রজ্ঞাময় এবং প্রশংসিত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এই মহাগ্রন্থটি অবতীর্ণ হয়েছে।
মানবেতিহাস পরিক্রমায় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সঠিক পথ-নির্দেশ দেওয়ার জন্যে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। ইতিহাসে এরকম প্রেরিত মহাপুরুষ বা নবী-রাসূলের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজারেরও বেশি বলে উল্লেখ রয়েছে। এই নবীরাসূলগণের ওপর অবতীর্ণ বহু গ্রন্থ বা সহিফার লিখিত নমুনা এখনো লক্ষ্য করা যায়। যেমন সহিফায়ে ইব্রাহীম, মূসা (আ) এর তৌরাত, দাউদ (আ) এর যাবুর, ইসা (আ) এর ইঞ্জিল ইত্যাদি। এইসব গ্রন্থ সমকালীন পৃথিবী ও মানুষের জন্যে যথাযথ এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন মানুষকে সঠিক পথ-নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবোর্ত্তম প্রকাশনা বা গ্রন্থ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের শিক্ষাগুলো বিশ্বজনীন এবং এই কোরআন পূর্ববর্তী ঐশীগ্রন্থগুলোকে প্রত্যয়ন করে।
কোরআন ঐশী গ্রন্থগুলোর মাঝে তৌরাত এবং ইঞ্জিলের প্রতি বেশি ইঙ্গিত করেছে। অসংখ্য আয়াতে এই দুটি ঐশীগ্রন্থের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এবং হযরত মূসা (আ), হযরত ইসা (আ) এর জীবন কাহিনীসহ তাদেঁর অনুসারীদের গল্পও কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল-কোরআন তৌরাত এবং ইঞ্জিলকে নূর এবং পথ-প্রদর্শনকারী গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেইসাথে মুসলমানদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যেন বিগত নবী রাসূলদের কেতাবগুলোর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসস্থাপন করে এবং আল্লাহর নবীদের মাঝে যেন কোনো পার্থক্য সৃষ্টি না করে। তার কারণ হলো আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী রাসূলই মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগি করার জন্যে সঠিক পথনির্দেশ দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং সেই লক্ষ্যেই তাঁরা তাদেঁর সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "বলো! আমরা মুসলমান এবং আমরা ইমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং আমাদের ওপর যেসব গ্রন্থ অবতীর্ণ করা হয়েছে সেসবের ওপর! এবং ইব্রাহিম (আ), ইসমাইল (আ), ইসহাক (আ), ইয়াকুব (আ) এবং তাঁদের সন্তান বা বংশধরদের মধ্য থেকে যেসব নবী-রাসূলের ওপর গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর ওপর এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মূসা, ইসা (আ)সহ অন্যান্য নবীর ওপর যেসব দেওয়া হয়েছে সেগুলোর ওপর। তাদেঁর মাঝে কোনোরকম পার্থক্য বা বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসী নই এবং আল্লাহর আদেশের কাছে আমরা সদাসর্বদা অনুগত ও বিনয়ী।"
কোরআনের এই সার্বজনীনতা এবং বিশ্বজনীনতাই কোরআনকে চিরভাস্বর করে রাখবে। যেমনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।(রেডিও তেহরান)