আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার নিয়মাবলী)-১ম পর্ব
  • শিরোনাম: আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার নিয়মাবলী)-১ম পর্ব
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:34:27 1-10-1403

শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা

নূর হোসেন মজিদী কর্তৃক অনূদিত

[মূল প্রবন্ধটি আরবী ভাষায় লিখিত। হোসেন মহিউদ্দীন কোমশেয়ী প্রবন্ধটি ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ইসলামী ইরানী দর্শন সমিতির মুখপত্র ‘জাভীদানে খেরাদ’ সাময়িকীর ৪র্থ খণ্ড,২য় সংখ্যা,শরৎ১৯৮১-তে (পৃ. ১৬-২৬) প্রকাশিত হয়। ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৎকালীন পি.এইচ.ডি. ছাত্র আলী নাকী বাকের শাহী প্রবন্ধটি ফার্সী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং তেহরান থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাময়িকী Al Tawhid-এর ৮ম খণ্ড,৪র্থ সংখ্যা (শাওয়াল-জিলহজ্ব,১৪১১)-এ প্রকাশিত হয়। এখানে ইংরেজি প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হলো।]

ফার্সী অনুবাদকের ভূমিকা

শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা সূফী তরীকার শীর্ষস্থানীয় শেখগণের অন্যতম। তাঁর মূল নাম আহমাদ এবং তাঁর খেতাব ছিল ‘আত-তাম্মাত আল কুবরা’। তিনি মধ্য এশিয়ার তৎকালে ইরানভুক্ত খাওয়ারিযমে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বরকতময় জীবনকাল ছিল প্রায় ৭৮ বছর। তিনি ৬১৮ হিজরী মোতাবেক ১২২১ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা যৌবনকালে দেশ ভ্রমণে বের হন। তিনি মিসরে উপণীত হবার পর সমকালীন খ্যাতনামা সুফীসাধক শেখ রুযবাহান মিছরীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর দারস ও বক্তৃতাসমূহে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। মহান সুফী শিক্ষক তাঁর শিষ্যের বুদ্ধিমত্তা ও নির্মল অন্তঃকরণ দৃষ্টে অভিভূত হন। তাই তিনি তাঁর শিষ্যকে নিজ সন্তানের মতো ভালবাসতেন। পরে তিনি নিজ কন্যাকে নাজমুদ্দীনের সাথে বিবাহ দেন।

কিছুদিন পর যুবক সুফীসাধক নাজমুদ্দীন কুবরা পুনরায় দেশ ভ্রমণ শুরু করেন এবং সমকালীন মুসলিম ভূখণ্ডের সকল শহরের শীর্ষস্থানীয় সুফীদের নিকট থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি পুনরায় মিসরে ফিরে আসেন। তখন শেখ রুযবাহান তাঁকে একজন কামেল ব্যক্তিরূপে দেখতে পান। শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা ইতোমধ্যে আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার গোপন রহস্যাবলী অবগত হয়েছেন এবং খোদাপ্রেমের বিভিন্ন স্তরের নিয়ম-কানুন ও পথসমূহ আয়ত্ত করেছেন। তিনি অন্যদের শিক্ষাদান ও পথ প্রদর্শনে সক্ষমতা অর্জন করেছেন। তাই শেখ রুযবাহান শেখ নাজমুদ্দীন কুবরাকে তাঁর জন্মস্থান খাওয়ারিযমস্থ খিয়ুক-এ গমন এবং আধ্যাত্মিক পথসন্ধানীদের শিক্ষাদান ও তাছাওউফের শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগের জন্য পরামর্শ দেন।

শেখ নাজমুদ্দীন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে খাওয়ারিযমে গমন করেন এবং সেখানে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করে সুফীতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রচার ও শিক্ষাদান শুরু করেন। তিনি যাহাবিয়্যাহ্ কুরবানিয়াহ্ ও অপর কয়েকটি সুফী ধারার প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর অনেক শিষ্যকে সুফীতাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে উপযুক্তরূপে গড়ে তোলেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ওয়ালী ও মুরশিদরূপে খ্যাতি অর্জন করেন। এদের মধ্যে মাজদুদ্দীন বাগদাদী,শেখ আত্তার,সা’দুদ্দীন হামাভী ও নাজমুদ্দীন রাযী সমধিক বিখ্যাত।

শেখ নাজমুদ্দীন কুবরার মৃত্যু সম্পর্কে অভিন্ন মত হচ্ছে,মোঙ্গল হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে তিনি ও তাঁর শিষ্যগণ তাঁর শহরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে ৬১৮ হিজরীতে (১২২১ খ্রি.) দশ জমাদিউল আউয়াল তিনি শিষ্যগণসহ শাহাদাত বরণ করেন।

ঐতিহাসিকগণের মতে তিনি আটটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে একটি ছিল কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা (তাফসীর)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক,এর কোন কপি বর্তমান নেই। তাঁর একটি ক্ষুদ্র রিসালাহ্ গ্রন্থ হচ্ছে ‘ফী আদাবিস সালিকীন’ (আধ্যাত্মিক পথের পথিকদের আদব-কায়দা)। এর নাম আরবী ভাষায় হলেও গ্রন্থটি ফার্সী ভাষায় রচিত।

গ্রন্থটি বর্তমানে এশিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। বক্ষমান নিবন্ধটি আরবী ভাষায় রচিত শেখের অপর একটি রিসালাহ্ গ্রন্থ ‘আদাবুস সুলূক ইলা হাযরাতি মালিকিল মূলক’ (মহামহিম রাজাধিরাজের দিকে পথপরিক্রমার আদব-কায়দা ও রীতিনীতি)-এর অংশবিশেষ। গ্রন্থটির দু’টি অংশ রয়েছে। একটি অংশ হচ্ছে অমনোযোগিতার পর্দা,ব্যবধান ও অন্ধকারের পর্দাসমূহ অপসারণের মাধ্যমে হক (আল্লাহ তায়ালা)-এর দিকে আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমা বিষয়ক। অপর অংশটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট এ বিশাল ধরিত্রীর বুকে শারীরিকভাবে পরিক্রমণ বিষয়ক। এ দু’টি অংশের মধ্য থেকে আমরা এখানে আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমা সংক্রান্ত অংশটি অনুবাদ করেছি। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত কপির ভিত্তিতে এ অনুবাদ করা হয়েছে। সুফীবাদে পদযাত্রাকারী ও তাওহীদের শরাবে আসক্তদের খেদমতে এ প্রয়াসকে নিবেদন করা হলো।

আশা করা যায়,এ সংক্ষিপ্ত রচনাটির অনুবাদ গবেষকদের মনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে এবং তাঁরা মহান সুফীসাধক শেখ নাজমুদ্দীন কুবরার অন্যান্য রচনাও অনুবাদ করতে আগ্রহী হবেন।

শেখ মহীউদ্দনীন কোমশেয়ী

আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার নিয়মাবলী)

هو الحقُّ

‘তিনিই সত্য।’

সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা সর্বজ্ঞাতা ও পরম দয়াবান আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি তাঁর বান্দাদের সকল দিগন্তে পরিক্রমণের তওফীক দিয়েছেন-যাতে তারা এ বিশ্বজগতের সকল দিকে,প্রত্যন্ত এলাকায় ও প্রতিটি কোণে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার,জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিস্ময়কর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের নিদর্শনাদিও প্রত্যক্ষ করতে পারে। সেই আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা যিনি আধ্যাত্মিক পথের পথিকগণের কুপ্রবৃত্তিকে মৃত্যুদান করেন ও তাঁদের অভ্যন্তরস্থ সত্তার গোপন রহস্যাবলীকে প্রকাশমান করে দেন,পথপরিক্রমার কাঠিন্যের সাহায্যে গুপ্ত বিষয়কে প্রকাশ করে দেন। ঝুঁকি গ্রহণ,বাড়ীঘর ও সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্নতা,(আল্লাহ্ ছাড়া) অন্যদের সাহচর্য পরিহার এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সকলকে ও সবকিছুকে বর্জনের মাধ্যমে তাঁদের এ অবস্থা হাসিল হয়। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মানব প্রজাতির নেতা মানবকুল শ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.),তাঁর পবিত্র আহলে বাইত,তাঁর সাহাবিগণ ও তাঁর উম্মাহর প্রতি। অতএব,পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুন হযরতে হক (মহাসত্য আল্লাহ তায়ালা)-এর নিকট।

হে আল্লাহর বান্দা! জেনে রাখুন,আপনি হচ্ছেন নিজ মালিকের সন্ধানে রত একজন পথিক (সালেক) এবং এমন এক দিন আসবে যখন আপনি তাঁর দীদার লাভ করবেন। একটি হাদীসে যেমন এরশাদ হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পেতে চায় তার জেনে রাখা উচিত,সেই সাক্ষাতের সময় অবশ্যই আসবে।’ জেনে রাখুন মহান আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নিরঙ্কুশ শক্তি-ক্ষমতা ও জ্ঞানবলে বনি আদমের জন্য দু’টি সফর বা পথপরিক্রমা নির্ধারণ করে রেখেছেন। একটি হচ্ছে বাধ্যতামূলক (কাহরী) পথপরিক্রমা ও অপরটি হচ্ছে ঐচ্ছিক (ইখতিয়ারী) পথপরিক্রমা।

বাধ্যতামূলক পথপরিক্রমা সম্বন্ধে বলতে হয়,এর সূচনাবিন্দু বা প্রথম স্তর হচ্ছে পিতার পৃষ্ঠদেশ,দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে মাতৃজঠর,তৃতীয় স্তর হচ্ছে বস্তুজগৎ,চতুর্থ স্তর হচ্ছে আলমে বারযাখ বা কবরের জগত যা হয় বেহেশতের বাগিচাসমূহের মধ্যকার একটি বাগিচা,নয়তো দোযখের গহ্বরসমূহের অন্যতম গহ্বর।

এ সফরের পঞ্চম স্তর হচ্ছে হাশরের দিবস যা এই পৃথিবীর দিবসের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এ স্তরের পরে আপনি আপনার চিরন্তন বাসস্থানে উপণীত হবেন;এটিই আপনার প্রকৃত আশ্রয়স্থল। অর্থাৎ আপনি যদি নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন এবং সত্যের বন্ধু হয়ে থাকেন তাহলে আপনি শান্তির ধাম (দারুস সালাম),নিরাপত্তা ও শান্তির বেহেশতে স্থান লাভ করবেন। আর খোদা না করুন,আপনি যদি পথভ্রষ্ট ও সত্যের দুশমন হয়ে থাকেন,তাহলে আপনার বাসস্থান হবে জাহান্নাম এবং আপনাকে কঠিন শাস্তির কবলে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন : ‘কিয়ামতের দিন একদল জান্নাতে ও একদল জাহান্নামে থাকবে।’

জেনে রাখুন,আপনি আপনার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আপনার জীবনের একেকটি দিন অতিক্রান্ত হওয়া জীবনের পথপরিক্রমায় একেকটি মাইলফলক অতিক্রমের সমান। আপনার জীবনের একেকটি মাস এ পথের একেকটি পর্যায় বা অংশ সমতুল্য এবং একেকটি বছর একেকটি মনযিলের ন্যায়। আপনার এ সফর চন্দ্র-সূর্যের এগিয়ে চলার মতো।

কিন্তু আপনার এ সফরের কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। আপনি যদি এ সফরে পিছিয়ে পড়েন-অজ্ঞতা ও উদাসীনতার শিকার হন,তাহলে আপনি আপনার কবরের জীবনের মনযিলের জন্য এবং হাশরের দিনের মনযিল ও চিরন্তন প্রকৃত আবাসস্থল অভিমুখী সফরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবেন না।

অন্যদিকে ঐচ্ছিক সফর দু’ধরনের। এক ধরনের সফর হচ্ছে জগৎসমূহের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার দিকে আত্মা ও হৃদয়ের সফর। দ্বিতীয় ধরনের সফর হচ্ছে আল্লাহর দুনিয়ায় শারীরিক সফর (সাফারে জিসমানী)। আপনারা যাতে এ দু’সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হবার জন্য প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশ লাভ করতে পারেন,কাম্য ভবিষ্যতের দরজা উন্মুক্ত করার জন্য পাথেয় প্রস্তুতকরণে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ পেতে পারেন,প্রতিটি উত্তম ও নেক আমল প্রশ্নে আপনার সাথী ও সাহায্যকারীস্বরূপ নিয়ম-কানুন ও রীতিনীতি শিক্ষা করার জন্য এবং যাতে তা খোদাপ্রেমিক লোকদের এ সফরে সাহায্য করতে পারে,তেমনি ইনশাআল্লাহ্ তা যাতে অত্র লেখকের জন্য শেষ বিচারের দিনে তথা তার প্রভুর সাক্ষাতের সময় নাজাতের উসিলা হিসেবে গণ্য হতে পারে,সে লক্ষ্যে আমরা এ দু’ধরনের সফর সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা করব।

হে আমার রব! আমাদের জন্য আপনার দয়া ও অনুগ্রহের দরজা উন্মুক্ত করে দিন। হে আমার রব! হে পরম দয়াময় ও মেহেরবান! হে মহান প্রভু!

প্রথম অধ্যায়

মহাপরাক্রমশালী রবের দিকে পথপরিক্রমা ও এর গুরুত্ব

হে আল্লাহর বান্দা! জেনে রাখুন,মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কেবল এ উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন,সে যেন তার হৃদয় ও আত্মাকে তাঁর দিকে পথপরিক্রমার জন্য,তাঁর সাথে মিলিত হবার জন্য এবং তাঁর মহিমা কীর্তন ও তাঁর সৌন্দর্যের প্রকাশ-প্রচারের জন্য সক্ষম করে গড়ে তোলে। বস্তুত এটিই হচ্ছে সকল লক্ষ্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং সকল নিয়ামত ও অনুগ্রহের উদ্দেশ্য। এ বিশ্বজগৎ ও তাতে যা কিছু আছে এবং পরজগৎ ও তাতে যা কিছু আছে তার সবই একই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। নবী রাসূলগণের আগমন এবং কোরআন মজীদ ও অন্যান্য আসমানী কিতাব নাযিল করার পেছনেও একই উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

و ما خلقت الجنّ و الإنس إلّا ليعبدون

‘আমি জ্বিন ও মানব প্রজাতিকে কেবল এ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি,তারা আমার দাসত্ব করবে।’ (সূরা আয-যারিআত : ৫৬)

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন,এ আয়াতে ليعبدون (লিইয়াবুদুন-যাতে তারা আমার ইবাদত বা দাসত্ব করে) কথাটির অর্থ হচ্ছে ليعرفون (লিইয়ারিফুন-যাতে তারা আমাকে চিনতে পারে)। অর্থাৎ সবকিছুই আল্লাহকে চেনার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে।

একটি হাদীসে কুদ্সীতে বলা হয়েছে,আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

كنت كنْزاً مخفيّاً فأحببتُ أنْ أعرفَ فخلقتُ الخلق لكي أعرف

‘আমি ছিলাম একটি গুপ্তধন,অতঃপর আমি পরিচিত হতে চাইলাম,তাই সৃষ্টিনিচয়কে সৃষ্টি করলাম যাতে আমি পরিচিত হতে পারি।’

এ সফরের তাৎপর্য প্রসঙ্গে জেনে রাখুন যে,মানুষের অন্তঃকরণকে বিভিন্ন ধরনের পর্দা,প্রতিবন্ধকতা ও দূরত্বের (আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য হতে বিচ্ছিন্নতার) সাথে লড়াই করতে হয়।

আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যের বিভিন্ন মাত্রা,স্তর ও মনযিল রয়েছে। ব্যক্তি যদি এ পথের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে না পারে তাহলে তার পক্ষে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের কোন

স্তরেই উপণীত হওয়া সম্ভব নয়।

এক

যতক্ষণ কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির পর্দাসমূহ ছিন্ন না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নিকট পরম পবিত্র সত্তা সমুদ্ভাসিত হবে না। অতএব,পরম শক্তিমান সত্তা ও বান্দার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী প্রথম পর্দা হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে অজ্ঞতা। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালার সাথে শরীক করা এবং তাঁর মহান ও পূর্ণতাবাচক গুণাবলীতে সন্দেহ পোষণের বিষয়টি এ অজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত। এ হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করার শামিল যা সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক অন্ধকার পর্দা।

আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

إنَّ الله لا يغْفِرُ أن يشركَ به...

‘আল্লাহর সাথে শরীক করা হলে কিছুতেই তিনি তা ক্ষমা করবেন না।’ (সূরা নিসা : ৪৮,১১৬)

সুতরাং যারা আল্লাহর সন্ধান করে তাদের জন্য জ্ঞানের আলোর সাহায্যে স্বীয় অন্তঃকরণের অজ্ঞতার অন্ধকারকে প্রোজ্জ্বলতায় রূপান্তরিত করা,সন্দেহের অন্ধকার দূরীভূত করে প্রত্যয়ের জ্যোতি অর্জন করা,শিরকের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে তাওহীদে উপণীত হওয়া এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে মুক্ত করে ঈমানের আলোর অধিকারী হওয়া অপরিহার্য। অন্যথায় তার শরীর ও আত্মা চিরন্তন অন্ধকারে এবং দোযখের নিম্নতম স্তরের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় নিপতিত হবে যা আল্লাহ তায়ালা কাফের,নাস্তিক ও আল্লাহর দুশমনদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন।

দুই

আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিলের দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্ব। কারণ আল্লাহ্ আদেশ করেছেন : ‘হে মানব জাতি! তোমাদের রবের ইবাদত কর।’ এ ছাড়া রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন,‘আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন : যারা আমার নৈকট্য কামনা করে তারা আমার পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক হিসেবে নির্ধারিত কাজসমূহ যে পরিমাণে সম্পাদন করে কেবল সে পরিমাণেই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের অধিকারী হয়। আমার বান্দা সব সময়ই নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য সন্ধান করে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার প্রতি আমার মুহব্বত আকর্ষণে সক্ষম হয়।’

অতএব,যে তার প্রভুকে চিনতে পারবে সে অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করবে;যে তার প্রভুকে আবিষ্কার করতে পারবে সে অবশ্যই তাঁর ইবাদাত করবে। অন্যথায় সে খোদাদ্রোহিতার পর্যায়ের গুনাহসমূহের অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে। কারণ গুনাহ হচ্ছে আল্লাহ্ থেকে দূরে পড়ে থাকার একটি পর্যায় এবং আনুগত্য হচ্ছে তাঁর নৈকট্য অর্জনের একটি উপায়।

তিন

আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিলের তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে উত্তম আচরণ। সুতরাং যে ব্যক্তি হক-এর সন্ধানী তাকে স্বীয় অশোভন আচরণকে প্রশংসনীয় আচরণে পরিণত করতে হবে। কারণ প্রতিটি প্রশংসনীয় আচরণই রবের নৈকট্য হাসিলের একেকটি মাধ্যম। প্রতিটি নৈতিক অপরাধ যেভাবে তাঁর থেকে দূরে সরে যাওয়ার একেকটি পদক্ষেপস্বরূপ এবং তাঁর অসন্তোষ উদ্রেককারী,ঠিক সেভাবেই সত্যসন্ধানীর জন্য অহংকারের জাহেলিয়াত থেকে বিনয়ের আলোর দিকে,লোভ-লালসার নীচতা থেকে স্নেহ-ভালবাসার উত্তম গুণের দিকে,কার্পণ্যের কলুষতা থেকে মহানুভবতা ও দানশীলতার মহত্ত্বের দিকে,অকৃতজ্ঞতার অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে কৃতজ্ঞতার সমুন্নত শিখরের দিকে,কপটতার অন্ধকার থেকে অকপটতা ও আন্তরিকতার আলোর দিকে,বস্তুজগতের বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সম্পদের সাথে জড়িয়ে পড়ারূপ মরু মরীচিকা থেকে প্রেমের বাগিচা এবং আসমানসমূহ ও ধরণির মহান অধিপতির ওপর নির্ভরতার দিকে,নিজেকে নিরাপদ গণ্য করার মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ধারণা এবং অসচেতনতারূপ অন্ধকার থেকে আল্লাহ্ভীতিরূপ আলোকের দিকে,হতাশা ও অবিশ্বাসের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে আশা ও আস্থার আলোর দিকে,ক্রোধ ও আক্রোশের ছায়া থেকে ধৈর্য ও সহনশীলতার আলোর দিকে,প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বিপদাপদের মুখে অধৈর্য ও উদ্বিগ্ন হওয়ারূপ অন্ধকার থেকে ধৈর্য ও তাকদীরের তিক্ততার নিকট আত্মসমর্পণরূপ আলোর দিকে,উদাসীনতার অন্ধকার থেকে সচেতনতা ও স্মরণ রাখারূপ আলোকের দিকে,জটিল পরিস্থিতিজনিত হতবিহ্বলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অন্ধকার থেকে দৃঢ়তা ও বিনয়ের আলোকের দিকে,পার্থিব উপায়-উপকরণের ওপর নির্ভরশীতার অন্ধকার থেকে যিনি সকল প্রভুর প্রভু তাঁর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণরূপ আলোকের দিকে এবং প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার গোলামিরূপ অন্ধকার থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যরূপ আলোর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। সুতরাং এ পথপরিক্রমাও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পথপরিক্রমাসমূহের অন্যতম। তাই যারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল করতে চায় এবং যারা সর্বোচ্চ স্তরের রহমত ও পারলৌকিক চিরন্তন গৃহের অধিকারী হতে চায় তাদের সকলের জন্য এ পথপরিক্রমা অপরিহার্য।

চার

আধ্যাত্মিক পথপরিক্রমার চতুর্থ ধাপ হচ্ছে পরম সত্যের (حق) সুন্দর নামসমূহ (الأسماء الحسني)-এর মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণ। যে সব কারণ মানুষকে আল্লাহ্ থেকে দূরে নিয়ে যায় যখন সত্যসন্ধানী তা থেকে নিজেকে পুত-পবিত্র করে এবং নৈকট্যের রীতিনীতি অনুসরণ করে স্বীয় অন্তঃকরণ (বাতেন)-কে পরিশুদ্ধ ও দ্যুতিময় করে তখন সে জগৎসমূহের অধিপতির দিকে অগ্রসর হবার উপযুক্ত হবে এবং তার মধ্যে আল্লাহ প্রেমের শুভফল ও তাঁর দয়া-অনুগ্রহ পরিস্ফুটিত হবে।

এ ধাপে আউলিয়া ও আসফিয়া (নির্বাচিতগণ)-এর মধ্যে স্তরগত পার্থক্য রয়েছে। আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ বিন আলী আত-তিরমিযী বলেন,‘মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের স্বীয় নামসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন,আর তাঁর প্রতিটি নামেরই একটি সুনির্দিষ্ট (আধ্যাত্মিক) ক্ষেত্র (اقليم) রয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই একটি কর্তৃপক্ষ (سلطان) রয়েছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রের লোকদের জন্যই সমাবেশ,ভাষণ এবং তাদের প্রদেয় দান ও পুরস্কার রয়েছে। আর তিনি (আল্লাহ তায়ালা) নির্বাচিতদের অন্তঃকরণের জন্য কতগুলো বিশেষ মনযিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। হতে পারে,একজন ওয়ালী প্রথম ইকলীমে (ক্ষেত্রে) অবস্থান করছেন এবং আল্লাহ তায়ালার নামসমূহের মধ্য থেকে কেবল ঐ ইকলীমের সাথে সংশ্লিষ্ট নামগুলোর সাথে তিনি পরিচিত। অনেক সময় এমনও দেখা যায়,একজন ওয়ালী একই সময় দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ ইকলীমের একটি মনযিলে অবস্থান করেন। সুতরাং তিনি যখন কোন বিশেষ ইকলীমের প্রতি মনোসংযোগ করেন তখন তাঁকে সেই ইকলীমের নাম প্রদান করা হয়। ফলে তিনি এমন এক ওয়ালীর পর্যায়ে উপনীত হন যিনি সকল নামেরই অংশবিশেষের অধিকারী হন। তিনি হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি সকল নাম থেকেই উপকৃত হন এবং তিনি হন ওয়ালীকুল শিরোমণি বা ওয়ালীদের নেতা।’

আত-তিরমিযী আরো বলেন,‘আল্লাহ তায়ালার নামসমূহ থেকে সাধারণ মানুষ যা লাভ করে তা হচ্ছে এ নামসমূহের প্রতি তাদের ঈমান পোষণ। আর যাঁরা মধ্যম স্তরে অবস্থিত তাঁরা ও সে সাথে সাধারণ ওয়ালিগণ আল্লাহ তায়ালার নাম থেকে কতটুকু লাভ করবেন তা এ সব নামের প্রতি তাঁদের হৃদয়ের উন্মুক্ততার মাত্রার ওপর এবং আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞানের কারণে তাঁদের মধ্যে যে জ্যোতি বিকীর্ণ হয় তার ওপর নির্ভর করে। যে কোন ব্যক্তি স্বীয় সক্ষমতা বা ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী এবং তাঁর অন্তরে অবস্থিত আধ্যাত্মিক আলোর পরিমাণ অনুযায়ী এ থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন। কিন্তু আল্লাহর ওয়ালিগণের মধ্য থেকে যাঁরা দুনিয়াদারীর পোশাককে পুরোপুরি দূরে নিক্ষেপ করেছেন এবং একটি নতুন আধ্যাত্মিক পোশাকে নিজেদের ভূষিত করেছেন তাঁরা যে কল্যাণ লাভ করেন তা হচ্ছে তাঁরা খোদায়ী গুণাবলীকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন এবং স্বীয় অন্তঃকরণে এ সব গুণের জ্যোতি গ্রহণ করেন।

এর ভিত্তিতে আমাদের শেখ (রহ.) উল্লেখ করেছেন,‘দেখা যাচ্ছে,প্রত্যেক ওয়ালীই বিশেষভাবে তাঁর জন্য নির্ধারিত একটি মনযিলের অধিকারী হন এবং তিনি তা অতিক্রম করতে পারেন না। বস্তুত তাঁর সামর্থ্য এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর জন্য নির্ধারিত স্তর অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এ মনযিলের অধিকারী করেন। সুতরাং তাঁর অন্তঃকরণ যখন সেই জ্ঞাত মনযিলের অধিকারী হয় তখন তাঁর মরমী পথপরিক্রমা তাঁর লক্ষ্যস্থলে উপণীত হয় ও তাঁর সফর চূড়ান্ত পর্যায়ে উপণীত হয়।

এ সফরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার প্রশ্ন নেই;এ সফরে সালেকের জন্য না স্থানগত ভ্রমণের কথা বলা হয়,না এতে কোন লক্ষ্যস্থলের কথা বলা হয়। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তির ঘাড়ের শাহ-রগের চেয়েও নিকটে অবস্থান করছেন। এখানে সফর বা পথপরিক্রমা মানে সালেকের অন্তঃকরণের দৃষ্টিশক্তিকে বাধাগ্রস্তকারী এবং তাঁর অন্তরে মহান আল্লাহ তায়ালার গুণাবলীর জ্যোতি নিপতিত হবার পথে বাধাদানকারী পর্দাসমূহ অপসারণ করা। আর এ সফরের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

(জ্যোতি, বর্ষ ২, সংখ্যা ১)