তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
  • শিরোনাম: তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:13:32 1-10-1403

কিছু সংখ্যক খ্যাতনামা সূফী ‘তাসাউফ’কে ইসলামী নৈতিকতার নির্যাস বলে অভিহিত করেছেন। ‘তাসাউফ’ পরিভাষার শব্দ প্রকরণগত ও মতাদর্শগত উৎপত্তি সম্পর্কে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করা হযেছে। ইতোপূর্বে সাধারণত ধরে নেয়া হত যে,‘তাসাউফ’ অ-ইসলামী উৎস থেকে ধার করা একটি মতাদর্শ। বর্তমানে প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদদের খুব কম সংখ্যকই আছেন যারা মনে করেন যে,‘তাসাউফ’ ইসলামী শিক্ষার মর্মবাণী থেকে উৎসারিত হয়নি। নিকোলসন,মাসিনন ও হেনরি কোরবিন প্রমুখ খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদ অবশ্য ‘তাসাউফ’-এর উৎস সংক্রান্ত ইতোপূর্বেকার ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে,সকল ধর্মেরই একটি মরমী দিক রয়েছে যাকে ধর্মসমূহের সাধারণ উপাদান বা মূলমর্ম বলে অভিহিত করা যেতে পারে। ইসলাম তার নিজস্ব বিশেষ প্রকৃতির কারণে অন্যান্য ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বস্তুত ইসলামের পূর্বে মূল ইহুদী ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্মই পার্থিব ও পারলৌকিক আঙ্গিকের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেনি এবং মানুষের জীবন ও সমাজ পরিচালনার জন্য সামগ্রিক আইন-বিধান প্রদান করেনি। আর নৈতিকতাকে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই ইসলামের মূলমর্ম বলে গণ্য করা চলে। কারণ নৈতিকতার পরস্পর অবিচ্ছেদ্য দুটি দিক রয়েছে,তা হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক।

ইসলামের শিক্ষার তিনটি দিক রয়েছেঃ আকাইদ (বিশ্বাসসমূহ),ইবাদত (বন্দেগী-উপাসনা) ও মু’আমালাত (সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য)। ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ রাসূল (সা.)-এর ওপর ওহীযোগে নাযিল হয় এবং তা প্রচারের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে ‘ইবাদত-বন্দেগী’ সম্পর্কে যে সাধারণ আদেশ নাযিল করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার বিস্তারিত নিয়ম-কানুন ব্যাখ্যা ও প্রদর্শন করেন। এ কারণেই মুসলমানদের আকাইদ ও আমল সংক্রান্ত বিধি-বিধানের দু’টি উৎস হচ্ছে কোরআন ও হাদীস বা সুন্নাহ। বস্তুত ধার্মিকতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জনের পথ সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়। তাই একজন মুসলমানকে অন্যান্য মানুষের সাথে যথাযথ আচরণের মধ্য দিয়েই সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরে উপনীত হতে হবে।

সাধারণভাবে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদগণ (মুজতাহিদগণ) এবং বিশেষভাবে সূফিগণ মনে করেন যে,আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের অধিকার (হাক্কুল্লাহ্) সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষের দোষ ত্রুটি-ক্ষমা করে দিতে পারেন,কিন্তু কোন ব্যক্তি অন্য কোন মানুষের অধিকার (হাক্কুনাস্ বা হাক্কুল ইবাদ) আদায়ে ব্যর্থ হলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন না। তাই নৈতিকতার বিষয়টি -যা কেবল সমাজেই সম্ভবপর তা আকাইদ ও ইবাদতের ন্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে,ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ এবং ইবাদত বন্দেগীর উৎস হচ্ছে নৈতিকতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জন করা। হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও এরশাদ করেছেন :

إنّما بعثت لأتمّم الأخلاق

“অবশ্যই আমাকে চারিত্রিক উৎকর্ষের পূর্ণতা বিধানের জন্য (নবী হিসেবে) অভিষিক্ত করা হয়েছে।”

অতএব,এ থেকে উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে,‘তাসাউফ’ হচ্ছে নৈতিকতার মূল মর্ম বা নির্যাস। ‘তাসাউফ’-এর অন্য যে কোন সংজ্ঞার চেয়ে এ সংজ্ঞাটিই ইসলামের চেতনা ও ‘তাসাউফ’-এর বিষয়বস্তুর সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণেই ‘সূফী’ ও ‘তাসাউফ’ পরিভাষার শব্দ প্রকরণগত উৎপত্তি সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক বিতর্কে জড়িত না হয়ে যুগ যুগ ধরে সূফিগণ একজন ‘সূফী’র প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ‘সাফা’-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন।

কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে : قد أفلح من تزکّی “সেই ব্যক্তিই সফলকাম হয়েছে,যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।” (সূরা আল আলা : ১৪)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا، وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

“সে ব্যক্তিই সফলকাম যে নিজের সত্তাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং সেই ব্যর্থ যে নিজেকে কলুষিত করেছে।” (সূরা আশ শামস : ৯ ও ১০)

এর পূর্ববর্তী দু’আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا، فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا

“শপথ সেই নফসের (ব্যক্তি সত্তার) যাকে তিনি যথাযথ করেছেন,অতঃপর তাকে তার পাপ ও তাকওয়ার জ্ঞান প্রদান করেছেন।” (সূরা আশ শামস : ৭ ও ৮)

তবে হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন মূল লক্ষ্য নয়,বরং এ হচ্ছে ঐশী সন্তোষ লাভের মাধ্যম মাত্র,এটাই হচ্ছে একজন সূফীর চূড়ান্ত লক্ষ্য। আর পূর্ণতার পথ সামাজিক জীবনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা যায়,একাকিত্ব বা বৈরাগ্যের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। বস্তুত আধ্যাত্মিকতার ইসলামী ধারণা মানুষের সামাজিক জীবনে প্রোথিত এবং তা-ই তার জন্য ঐশী সন্তোষে উপনীত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

কোরআন মাজীদে বা হাদীসে ‘সূফী’ পরিভাষা দেখা যায় না। তবে কোরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন আঙ্গিকে ‘রেযা’ (সন্তোষ) পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে :

يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ، ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً ، فَادْخُلِي فِي عِبَادِي ، وَادْخُلِي جَنَّتِي

“হে প্রশান্ত ব্যক্তি সত্তা! তুমি তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর সন্তুষ্ট ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত অবস্থায়,অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ কর এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” (সূরা আল ফজর : ২৭-৩০)

বস্তুত মানুষ তার প্রভুকে সন্তুষ্ট করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যে স্তরে উন্নীত হতে পারে তা হচ্ছে তার ইচ্ছা তার প্রভুর ইচ্ছার সাথে অভিন্ন হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّـهِ  وَاللَّـهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ

“আর লোকদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছে,যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে বিক্রি করে দেয়,আর আল্লাহ এ (ধরনের) বান্দাদের প্রতি বড়ই দয়ালু।’’ (সূরা আল বাকারা : ২০৭)  

আমাদের মতে উপরোল্লিখিত সূরা আল ফজরের ২৭-৩০ ও সূরা আল বাকারার ২০৭ আয়াতে একজন সূফীর সঠিক সংজ্ঞা নিহিত রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের এ মতের ভিত্তি হচ্ছে উপরিউক্ত সূরা আল বাকারার ২০৭ আয়াতের শানে নুযূল সংক্রান্ত সর্বসম্মত মত। তা হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর হিজরতের রাতে হযরত আলী (আ.) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসূলের বিছানায় শুয়ে থাকেন যাতে তিনি শুয়ে আছেন মনে করে কাফেররা তাঁর বের হবার অপেক্ষায় থাকে ও সেই অবকাশে তিনি সহজে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারেন,কার্যত তা-ই হয়েছিল। হযরত আলী (আ.)-এর এভাবে প্রাণের ঝুঁকি গ্রহণ উপলক্ষেই উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে,একটি তরীকা বাদে ‘তাসাউফ’-এর সকল তরীকাই হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে তাদের সিলসিলার সূচনাস্থল বা উৎস বলে গণ্য করে। যে একটি তরীকা (নকশাবন্দীয়া তরীকা) তাঁকে স্বীয় তরীকার সূচনাস্থল মনে করে না,তারাও প্রথম তিন খলিফার পরে তাঁকে তাদের সিলসিলার চতুর্থ ব্যক্তি বলে মনে করে। তাছাড়া হযরত আলী (আ.)-কে ‘সাইয়্যেদুল আউলিয়া’ (ওলী বা সূফিগণের নেতা) বলা হয়।

এভাবে আল্লাহ তায়ালার নিকট স্বীয় মন ও প্রাণ সমর্পণ করাই হচ্ছে তাঁর সন্তুষ্টির একমাত্র পথ। তেমনি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার হাতিয়ারে পরিণত হবার উপায়ও এটি। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা হচ্ছে কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত।

অনেক মুফাস্সির মনে করেন যে,ওপরে সূরা আল ফজরের যে আয়াতগুলো (২৭-৩০) উদ্ধৃত করা হয়েছে,তাতে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে,হযরত আলী (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনা যেমনি ইসলামের ইতিহাসে,তেমনি সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে বিরাট সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের অধিকারী। কোন সৎ ও নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের পক্ষেই হযরত আলী (আ.) ও হযরত হুসাইন (আ.)-এর অতি উচ্চ আধ্যাত্মিক মর্যাদার কথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

এ আলোচনা থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে চাই যে,‘তাসাউফ’-এর কোন দীর্ঘ সংজ্ঞা না দিয়ে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি,ইসলামে সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর সৃষ্টিনিচয়ের প্রতি ব্যক্তির মনোভাবের সর্বোত্তম অবস্থারূপ নৈতিকতা। ‘তাসাউফ’-এর সংজ্ঞা যা-ই দেয়া হোক না কেন,তাকে কোনভাবেই এ চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছি যে,অন্য সব রকমের মরমীবাদ-যা দুনিয়া ত্যাগ করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় বা কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে একত্বে উপনীত হতে চায় সে সব মরমীবাদ থেকে ইসলামী ‘তাসাউফ’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অন্যান্য মরমীবাদের বিপরীতে ইসলাম বৈরাগ্যবাদের নিন্দা করে এবং সামাজিক জীবন যাপন করতে বলে। তাই বলা হয়েছে : لا رهبانیّة فی الاسلام (ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নাই)।

‘তাসাউফ’কে অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মীয় দর্শনের মরমী দিক থেকে যে বৈশিষ্ট্যটি আলাদা করেছে তা হচ্ছে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য। রাসূল (সা.) স্বয়ং লোকদের মাঝে বসবাস করেছেন এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনা করেছেন। সকল মুসলমানের দৃষ্টিতে তিনিই হচ্ছেন পূর্ণ মানব (ইনসানে কামিল)। কোন সূফীর পক্ষেই তাঁর চেয়ে উচ্চতর আধ্যাত্মিক মর্যাদা দাবি করা সম্ভব নয়। তেমনি তাঁর আহলে বাইতের ইমামগণও সব সময় মুসলমানদেরকে পথনির্দেশ দিতেন এবং তাদেরকে নৈতিক ও সামাজিকভাবে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। সকল ধারার সকল সূফীই তাঁদের খুব সম্মান করতেন। প্রথম যুগের অনেক সূফীই কোন না কোনভাবে ইমামের প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন।

প্রাচ্যবিদরা সাধারণত সূফী ধারার উৎপত্তি ও বিকাশে আহলে বাইতের ইমামগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে এড়িয়ে গেছেন বা না জানার ভান করেছেন। কিন্তু সূফীবাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক অনুধাবন করতে হলে সুফীদের ও সূফী তত্ত্বের সাথে তাঁদের সম্পর্ক সম্বন্ধে জানা অপরিহার্য।

এ প্রসঙ্গে হেনরী কোরবিনের মতামত বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে এবং আমাদের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে সুন্নী সমাজে যে ভাবে শরীয়ত ও তরীকতের মাঝে পার্থক্য করা হয়েছে শিয়া সমাজে তা করা হয়নি;সুন্নী সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বকে পৃথক করা হয়েছিল,কিন্তু শিয়া মাজহাবে ইমামতের আকীদায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব উভয়কে একীভূত করা হয়। হিজরী তৃতীয় (খ্রিস্টীয় নবম) শতাব্দীতে সুন্নী সমাজে যখন সূফীবাদ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে তখন সমকালীন সুন্নী ওলামায়ে কেরাম ও মুজতাহিদগণ এর ঘোরতর বিরোধিতা করেন। কিন্তু তখন শিয়াদের মধ্য থেকে এর কোন বিরোধিতা হয়নি। কারণ শিয়া মাজহাবের অনুসারিগণ মাসুম ইমামগণের ইমামতের আকীদা পোষণ করে যাঁরা (ইমামগণ) স্বীয় ব্যক্তিত্বে ইসলামের প্রকাশ্য ও গূঢ় উভয় দিককেই একত্র করেছিলেন।

হেনরি কোরবিন এবং ‘তাশাইয়ু ওয়া তাসাউফ’ গ্রন্থের রচিয়তা কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী এ ব্যাপারে একমত যে,সূফিগণ তাঁদের ‘কুতুব’ (قطب) বা ‘গাউছ’ (غوث)-এর ধারণাকে শিয়া মাজহাবের ইমামতের আকীদা থেকে গ্রহণ করেছেন।

সূফিগণের আকীদা এই যে,কোন কুতুব ব্যতীত এ বিশ্ব টিকে থাকতে পারে না,মানুষের ঈমান ও হেদায়েতের হেফাজত তাঁরই ওপর নির্ভরশীল। তিনি আল্লাহর নৈকট্যের অধিকারী ও ঈমানের হেফাজতের অধিকারী এবং সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে ইলহামের মাধ্যমে নির্দেশ লাভ করেন।

কুমাইল ইবনে যিয়াদ ছিলেন হযরত আলী (আ.)-এর শিষ্য এবং প্রথম যুগের সূফীদের অন্যতম। ‘তাসাউফ’-এর অনেক সিলসিলা তাঁর মাধ্যমে হযরত আলী (আ.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। হযরত আলী (আ.) কুমাইলকে সম্বোধন করে বলেন,“এ ধরণি কখনও অকাট্য প্রমাণ (হুজ্জাত)সহ আল্লাহর জন্য দণ্ডায়মান ব্যক্তি থেকে শূন্য হবে না। এরূপ ব্যক্তি হয় প্রকাশ্য ও বিখ্যাত হবে অথবা ভীত-শঙ্কিত ও আত্মগোপনকারী হবে,যাতে আল্লাহর হুজ্জাতসমূহ ও সুস্পষ্ট নির্দশনসমূহ (বাইয়্যেনাত) বাতিল হয়ে না যায়। তারা সংখ্যায় কতজন এবং কোথায়? আল্লাহর শপথ! তাদের সংখ্যা খুবই কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট মর্যাদায় তারা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ স্বীয় হুজ্জাত ও বাইয়্যেনাতসহ তাদেরকে রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের অনুরূপ লোকদের হাতে এ দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাদের মতো লোকদের অন্তরে এর বীজ বপন করেন। অন্তর্দৃষ্টিজাত প্রকৃত সত্য (হাকীকত) ভিত্তিক জ্ঞান তাঁদের মধ্যে স্থিতি লাভ করে এবং তাঁরা প্রত্যয়ী চেতনার অধিকারী হন। বিলাসী-আরামপ্রিয়দের নিকট যা কিছু কঠিন প্রতিভাত হয় তাঁদের নিকট তা সহজ হয়ে যায়। আর অজ্ঞ লোকেরা যা কিছুকে ভয় পায়,তাঁদের নিকট তা প্রিয় হয়ে যায়। তাঁদের দেহ পার্থিব জগতে থাকে,কিন্তু তাঁদের আত্মা সমুন্নতলোকে অবস্থান করে। তাঁরা আল্লাহর ধরণির বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! আহা! তাঁদেরকে দেখতে আমার কতই না ইচ্ছা হয়! হে কুমাইল! (আমি যা বলতে চেয়েছি তা বলেছি) এবার তুমি যখন ইচ্ছা যেতে পার।”

হযরত আলী (আ.)-এর এ উক্তিতে সূফীর যে পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে তার চেয়ে উত্তমরূপে সূফীর পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে,হযরত আলী (আ.) ‘নাহজুল বালাগাহ্’ গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর মতামতে এমন একজন লোকের কথা বলেছেন যিনি এ জগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং এ জগতকে ঘৃণা করেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তার বিপরীত। হযরত আলী (আ.) ইউরোপের যুক্তিবাদী দার্শনিক লেইবনিৎস এ জগত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাতে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়। লেইবনিৎস বলেন,“আমাদের এ জগৎ সম্ভাব্য সকল জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” উল্লেখ্য যে,এক ব্যক্তি দুনিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে জানতে পেরে হযরত আলী (আ.) মন্তব্য করেছিলেন :

“নিশ্চয় এ দুনিয়া তার জন্য সত্যের গৃহ যে তার সাথে যথাযথ আচরণ করেছে,তার জন্য সুস্থতা ও সাফল্যের গৃহ যে তা থেকে (এর পথ-পদ্ধতিসমূহ) বুঝতে পেরেছে,তার জন্য সম্পদশালী হবার জায়গা যে থেকে (সম্পদ) বৃদ্ধি করেছে,তার জন্য সদুপদেশের জায়গা যে তা থেকে সদুপদেশ গ্রহণ করেছে। এটি হচ্ছে আল্লাহর প্রিয়জনদের সিজদার জায়গা (মসজিদ) এবং আল্লাহর ফেরেশ্তাদের নামায আদায়ের স্থান,আল্লাহর ওহী নাযিলের জায়গা,আল্লাহর বন্ধুদের (আউলিয়া) ব্যবসা করার জায়গা,এখানে তাঁরা রহমত উপার্জন করেন এবং লেনদেনের মাধ্যমে লাভ হিসাবে জান্নাতের অধিকারী হন। এমতাবস্থায় কে আছে তাকে (দুনিয়া) নিন্দা করতে পারে?”

উপরিউক্ত উক্তিতে এ দুনিয়ার বুকে একজন সূফীর কাজকর্ম ও ভূমিকা কি হবে তা স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে,যদিও সূফীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সাধারণত যে ধারণা পোষণ করা হয় তা থেকে এ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

এ প্রেক্ষিতে আমরা সূফীবাদের ইতিহাসের আলোকে ‘ইমামত’ সংক্রান্ত শিয়া মাজহাবের আকীদা এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে সূফীবাদের যে ধারণা এতদুভয়ের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর সংক্ষেপে দৃষ্টিপাত করতে চাই।

হেনরী কোরবিন তাঁর ‘মুসলিম দর্শনের ইতিহাস’ বিষয়ক গ্রন্থে,মুস্তাফা কামাল আশ শায়বী তাঁর ‘তাশাইউ ওয়া তাসাউফ’ গ্রন্থে শাহ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘হামাআত’ গ্রন্থে এবং আই.পি পেত্রোশভেনস্কী তার ‘ইরান দার ইসলাম’ গ্রন্থে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,সূফীবাদ কোরআনী শিক্ষার এক স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। তাঁদের মতে প্রথম যুগের মুসলমানদের দীনী আমল থেকেই এর উৎপত্তি হয়।

রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর খুব শীঘ্রই বাইরে থেকে আরবে,বিশেষ করে আরবের শহরগুলোতে বিপুল ধন-সম্পদের অব্যাহত প্রবাহ এবং আরবের বাইরের উর্বর কৃষি ভূমি মুসলমানদের হস্তগত হওয়ায় মুসলিম সমাজের ওপর যে প্রভাব পড়ে তার ফলে সমাজে অনৈতিকতার বিস্তার ঘটে এবং সমাজ থেকে ন্যায়-নীতি,ন্যায়বিচার ও সহজ-সরল জীবন যাপনের অভ্যাস তিরোহিত হয়ে যায়। এ কারণে প্রথম যুগের মুসলিমগণ নিজেদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদেরকে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল করে ফেলেন। তৃতীয় খলীফার শাসনামল থেকে এ প্রবণতার উৎপত্তি হয় এবং কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা,মদীনার স্বাধীনতা ঘোষণা ও মক্কার নৃশংস ঘটনার পরে তা অধিকতর শক্তিশালী হয়। হাসান বসরী প্রথম যুগের যাহেদ,আবেদ ও মুতাকাল্লিমগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘হামাআত’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। তবে তিনি মনে করেন যে,রাসূল (সা.)-এর সাহাবিগণ ও তাঁদের পরবর্তীদের (তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈন) মধ্যকার যাহেদ ও আবেদগণের মধ্য থেকেই সূফীবাদের উৎপত্তি ঘটে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের সকলেই ছিলেন আরব। সূফীবাদ ইরানী চিন্তা-চেতনার প্রতিক্রিয়ায় অস্তিত্ব লাভ করে বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে তার ভিত্তিহীনতা প্রমাণের জন্য শাহ ওয়ালীউল্লাহর এ অভিমতই যথেষ্ট।

হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফত ত্যাগের মধ্য দিয়ে উমাইয়্যা রাজতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয় ও ক্রমান্বয়ে তা সংহত ও শক্তিশালী হতে থাকে। বস্তুত এ রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল ইসলামের ন্যায়বিচার ও ন্যায়-নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পর আহলে বাইতের ইমামগণ সক্রিয় রাজনীতি থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং ইসলাম ও এর চেতনার সংরক্ষণের জন্য দীনী শিক্ষা প্রদান এবং দীনী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) যিনি ইমাম যয়নুল আবেদীন ও ইমাম সাজ্জাদ নামে সমধিক পরিচিত,তাঁর দোয়া ও মুনাজাতসমূহের সংকলন ‘আস সাহিফাতুল কামিলাহ্’ হিজরী প্রথম শতাব্দীতে ইসলামের মরমী দিকের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য একটি উৎস। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,হযরত আলী (আ.)-এর বিখ্যাত ভাষণ ও উক্তিসমূহ ইসলামী আধ্যাত্মিক ও মরমী সাহিত্যের এক বিরাট ও সমৃদ্ধ ধনভাণ্ডার যাতে পরবর্তীকালে মুসলিম চিন্তাধারায় গুরুত্ব লাভ করেছিল এমন বেশিরভাগ বিষয় নিয়েই আলোকপাত করা হয়েছে এবং ইলমে কালাম,ইরফান ও ইসলামের সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শনের মূলনীতিসমূহের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। হযরত আলী (আ.)-এর এ সব ভাষণ ও উক্তির পর ‘আস সাহিফাতুল কামিলাহ্’ মুসলিম মরমী চিন্তা ও চর্চার প্রথম সংকলন।

ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.)-এর পুত্র ইমাম মুহাম্মদ আল বাকের (আ.) নিয়মিত তাফসীর,ফিকাহ্ ও ইরফান শিক্ষা প্রদানের কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর পুত্র ইমাম জাফর আস সাদেক (আ.) ফিকাহ্শাস্ত্রের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন এবং পরবর্তীতে তা ‘জাফরী ফিকাহ্’ নামে সুপরিচিত হয়। বলা হয় যে,তিনি ফিকাহ্,উসূলে ফিকাহ্,কালাম ও ইরফানের ওপর তিন সহস্রাধিক ছাত্রকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। উমাইয়্যা শাসনের পতনের পর আবু মুসলিম খোরাসানী তাঁকে খিলাফত গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান,কিন্তু ইমাম জাফর আস সাদেক (আ.) রাজনীতিতে জড়িত হতে অস্বীকৃতি জানান। এভাবে তিনি তাঁর দাদার ঐহিত্যে স্থির থাকেন ও তা অব্যাহত রাখেন এবং অন্তত প্রকাশ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিহার করে চলেন। বারো ইমামী (ইসনা আশারিয়া) শিয়াদের দ্বারা অনুসৃত অন্যান্য ইমামগণও এ ঐতিহ্য অনুসরণ করেন এবং তাঁদের সকলেই গভীর ইলম ও তাকওয়া-পরহেজগারীর জন্য সুপরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন।

শিয়া মাজহাবের অনুসারিগণ তাদের ইমামগণকে নিষ্পাপ (মাসুম) ও নির্ভুল বলে মনে করে। নিষ্পাপ ও নির্ভুলতার এ ধারণা নবী-রাসূলগণকে কোরআন মাজীদে যেভাবে নিষ্পাপ ও নির্ভুলরূপে তুলে ধরা হয়েছে তা থেকেই উদ্ভূত এবং ডোনাল্ডসনের ভাষায়,রাজা-বাদশাহদের ঐশী উৎস সংক্রান্ত ইসলাম-পূর্ব যুগের ইরানীদের বিশ্বাস এবং ইসরাঈলী ঐতিহ্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

উক্ত ইমামগণকে তাঁদের সমসাময়িক কতিপয় সূফী তাদের নিজেদের আধ্যাত্মিক পথ-প্রদর্শক (হাদী) বলে গ্রহণ করেন। এ সুবিখ্যাত সূফিগণের মধ্যে আল হারিস আল মুসাহিবী,বায়েজিদ বাস্তামী, হাসান বসরী ও সূফীয়ান সাওরী অন্যতম। আহলে বাইতের মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন সূফীবাদে ‘ইশক’ (প্রেম) তরীকার উপস্থাপক ও ব্যাখ্যাতা হিসেবে বিখ্যাত। এদের মধ্যে হযরত ইমাম সাদেক (আ.)-এর কন্যা আয়েশা যিনি রাবেয়া বসরীর সমসাময়িক,নাফিসা (হি. ২য় শতক/খ্রি. ৮ম শতক) এবং ফাতেমা (ওফাত হি. ২৪৪/খ্রি. ৮৩৮) সর্বাধিক বিখ্যাত।

যদিও শিয়া ও আলাভিগণ সাধারণত নিজেদেরকে সূফী বলে উল্লেখ করে না,তথাপি সূফীদের সংক্রান্ত ‘তাযকিরা’সমূহে১৯ রাসূল (সা.)-এর বংশধরদের মধ্য থেকে কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন যায়েদী মাজহাবের নেতা ইমাম ইবরাহীম ইবনে আবদুল্লাহ্,ইবনে হাসান (আ.)-এর নাতি আবদুল্লাহ্ (আশ শিরানী কর্তৃক ‘তাবাকাতুল কুবরা’য় উল্লিখিত),আবুল হাসান আল আলাভী (মৃত্যু : হিজরী ২৯১/খ্রিস্টীয় ৯০৪) (আল হুজভিরী কর্তৃক ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থে এবং আবদুল্লাহ্ আল আনসারী কর্তৃক ‘তাবাকাতুস সুফিয়া’ গ্রন্থে উল্লিখিত),আবু হামযা আল খোরাসানী (মৃত্যু : হিজরী ২৯০/খ্রিস্টীয় ৯০৩) (খাজা আবদুল্লাহ্ আল আনসারী কর্তৃক ‘তাবাকাত’-এ) উল্লিখিত,মানসুর আল হাল্লাজ কুফায় অবস্থানকালে যাঁর গৃহে অবস্থান করেন (আল হুজভিরী কর্তৃক ‘কাশফুল মাহজুব’এ উল্লিখিত),আবুল খায়ের তিনাতীর শিষ্য হামযা ইবনে আবদুল্লাহ আল আলাভী,হামযা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (‘শারহি মানাযিলুস সায়েরীন’ গ্রন্থে উল্লিখিত),ইবরাহীম ইবনে সা’দ আল আলাভী (‘আস সাইয়্যেদুয যাহেদ’ নামে সমধিক পরিচিত),আবু সাঈদ আল খাযরায তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন (সূত্র : ‘কাশফুল মাহজুব’),যায়েদ ইবনে রিফাআহ আশ শিবলীর অন্যতম বন্ধু এবং ধারণা করা হয় যে,তিনি ‘রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফা’ গ্রন্থের প্রণেতাদের অন্যতম,(‘তারিখে বাগদাদ’ ও আল বায়হাকী লিখিত,‘তাতিম্মাতু সাওয়ানিল হিকমাহ্’ গ্রন্থদ্বয়ে উল্লিখিত এবং মুহাম্মদ ইবনে আবি ইসমাঈল আলী আল আলাভী [মৃত্যু : হিজরী ৩৯৫/খ্রিস্টীয় ১০০৪ (‘তারিখে বাগদাদ’)]।

যদিও খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারী প্রমুখ অনেক শিয়া বুযূর্গান মনে করেন যে,হযরত আলী (আ.)-এর আধ্যাত্মিক প্রবণতা সূফীদের সাথে সঙ্গতিশীল নয় এবং শিয়াদের নিজেদেরকে সূফী বলে উল্লেখ করতে অনাগ্রহী দেখা যায়,তথাপি এটি অনস্বীকার্য যে,সূফীবাদ এবং শিয়া ও আলাভীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সূফিগণ (সমস্ত সিলসিলা নির্বিশেষে) স্বীয় সিলসিলাকে আহলে বাইতের প্রথম থেকে একাদশতম ইমামের মধ্যে কারো না কারো পর্যন্ত পৌঁছিয়ে থাকেন। শিয়া মাজহাবের অনুসারীরা গত শতাব্দী পর্যন্ত কোন সূফীবাদী সিলসিলা প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালের প্রভাবে তাদের মধ্যেও কতক খাঁটি ইমামী শিয়া সিলসিলা গড়ে ওঠে। এ সব সিলসিলার মধ্যে ‘তাইফুরিয়াহ্’,‘বেকতাশিয়াহ্’,‘সাফাভিয়াহ্’,‘হায়দারিয়াহ্’,‘নেমাতুলাহিয়াহ্’,‘জালালিয়াহ্’,‘নূর বাখশিয়াহ্’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সব সিলসিলা শিয়াদের পাশাপাশি শত শত সুন্নী অনুসারীকেও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে শিয়া আরেফগণ কদাচিৎ ‘সূফী’ পরিভাষা ব্যবহার করেন,বরং সাধারণত নিজেদেরকে ‘আরেফ’ বলেন এবং তাঁদের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে ‘ইরফান’ বলে অভিহিত করেন,তাঁরা ইমাম গাযযালী ও ইবনুল আরাবীর সূফীবাদী শিক্ষাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন। শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী তাঁর ‘ইরফান’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন :

“আরেফগণ ও সূফিগণ ইসলামের কোন স্বতন্ত্র মাজহাব বা ফের্কা তৈরি করেছেন বলে মনে করা হয় না বা তাঁরা নিজেদের জন্য সেরূপ দাবিও করেননি। ইসলামের প্রতিটি মাজহাব ও ফের্কায় এ ধরনের লোক পাওয়া যায়। তথাপি একই সাথে তাঁরা একটি সামাজিক গোষ্ঠীরূপে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছেন। যে সব উপাদান তাঁদেরকে ইসলামী সমাজের বাকী অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছে তা হচ্ছে তাঁদের কতক ধারণা ও মতামত,তাঁদের সামাজিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ নিয়ম-বিধি,পোশাক-পরিচ্ছদ এবং এমনকি তাঁদের চুল ও দাড়ি রাখার বিশেষ ধরন ও খানকাসমূহে তাঁদের সংঘবদ্ধ বসবাস। অবশ্য এমন অনেক আরেফ আছেন-বিশেষ করে শিয়াদের মধ্যে-যাঁরা এ ধরনের বিশেষ কোন চিহ্ন ধারণ বা বহন করেন না যার ফলে সামাজিকভাবে তাঁদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনা যেতে পারে,তথাপি তাঁরা ইরফানের আধ্যাত্মিক জ্ঞানতত্ত্বে সায়ির ও সুলূকে গভীরভাবে সদা নিমজ্জিত।”

আল্লামা মুতাহ্হারী নীতিশাস্ত্র বা চারিত্রিক বিধি-বিধান ও ‘সায়ির ও সুলূক’ (আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণ)-এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। কারণ তাঁর মতে,চারিত্রিক বিধি-বিধান অপরিবর্তনীয়,কিন্তু ইরফান হচ্ছে আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে উন্নতর নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের লক্ষ্যে গতিশীল ও প্রগতিশীল অগ্রযাত্রা। মুতাহ্হারী শরীয়ত,তরীকত ও হাকীকতের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে তাঁর ধারণার ভিত্তিতে চারিত্রিক বিধান এবং সায়ির ও সুলূকের মধ্যে এ পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,মুতাহ্হারী হাদীস,তাফসীর,ফিকাহ্,কালাম ও উসূলে ফিকহে ইরফানের উৎস সন্ধান করেছেন। তিনি তাঁর এ অভিমত শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্ত করেছেন। কারণ সুন্নিগণ সূফীবাদকে শরীয়ত থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করে এবং তাসাউফের বিকাশে যুক্তি ও দর্শনের ভূমিকা স্বীকার করে না। ইমাম গাযযালী যখন সূফীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন তখন তিনি দর্শনকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেন। অন্যদিকে আমরা এমন কয়েকজন বিখ্যাত শিয়া দার্শনিক ও ফকীহের (মুজতাহিদের) সাক্ষাৎ পাই যাঁরা ইরফান,দর্শন এবং কালামশাস্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। যদিও শিয়া মাজহাবের অনুসারী আরেফগণ গাযযালীকে খুব সম্মান করেন,তথাপি তিনি যে দর্শনকে,বিশেষত ইবনে সিনার দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন-তাঁর এ ভূমিকাকে তাঁরা কখনই গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। মোল্লা সাদরার পরে ‘আল হিকমাতুল মুতালিয়া’ নামে সুপরিচিত শিয়া ধারার দার্শনিক মরমীবাদ যুক্তিবাদী ও অধ্যাত্মবাদী প্রবণতার চমৎকার সমন্বয়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠে এবং সাবযেভারীর অধ্যাত্মবাদের মধ্যে এর চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।

ইতোপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে,শিয়া মাজহারের অনুসারীদের দৃষ্টিতে কখনই ইরফান ও শরীয়তের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। তেমনি শিয়া মাজহাবের অনুসারী আরেফগণ ও আলেমগণকে কখনই দু’টি পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো না। এমনকি সাফাভী শাসনামলে যখন আল্লামা বাকের মাজলিসী শিয়া মাজহাবের অনুসারী ইরানে তাসাউফ ও ইরফানের বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালান,তখনও তাঁর সমসাময়িক ওলামা কেরামের মধ্যে বেশ কয়েকজনের তাসাউফের প্রতি ঝোঁক ছিল। এদের মধ্যে মোল্লা মোহসেন ফায়েয কাশানীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অতঃপর শিয়া অধ্যুষিত ইরানে কাজার বংশের শাসনামলে ইরফান তার মজবুত ভিত্তি ফিরে পায়। এখানে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে,ভারত থেকে ‘নেমাতুল্লাহী’ ধারার পীরগণের ইরানে প্রত্যাবর্তনের পর সেখানে শিয়া উৎসজাত ও সুন্নী উৎসজাত নির্বিশেষে অন্যান্য সূফী তরীকারও পুনরুজ্জীবন ঘটে। আল্লামা মুতাহ্হারী তাঁর ‘অশেনায়ী বা উলূমে ইসলামী’ (ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয়) শীর্ষক সিরিজ গ্রন্থাবলীতে শিয়া ও সুন্নী মাজহাবের মুহাদ্দিস,ফকীহ্ (মুজতাহিদ),মুতাকাল্লিম ও মুফাস্সিরগণকে মাজহাবের ভিত্তিতে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছেন,কিন্তু তিনি সূফী বা আরেফগণকে শিয়া বা সুন্নী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে চিহ্নিত করেননি।

এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে,সূফীবাদে এসে মুসলমানদের মধ্যকার মাজহাবী ও ফের্কাগত পার্থক্য দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে। ভারত ও পাকিস্থানে ‘শহীদে সালেছ’ (তৃতীয় শহীদ) নামে সুপরিচিত কাজী নুরুল্লাহ্ শুশতারী শিয়া মাজহাবের নিষ্ঠাবান অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি শিয়া মাজহাবের অনুসারী সূফীদের যে তালিকা প্রণয়ন করেছেন তাতে কুমাইল ইবনে যিয়াদ,বোহলুল আল আকেল,শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী আল মাকতুল,সাইয়্যেদ হায়দার আত তুনী ও সাইয়্যেদ হায়দার আল অমোলী প্রমুখ কয়েকজন সুপরিচিত শিয়া আরেফের পাশাপাশি বিশর আল হাফী,বায়েজিদ বাস্তামী,শাফীক আল বালখী,ইবরাহীম বিন আদহাম,ইয়াহ্ইয়া ইবনে মু’য়ায আর রাযী,আবু সারী মানসুব বিন আমের,সারী আস সাকাতী,জুনায়েদ বাগদাদী,আশ শিবলী,মুহাম্মদ সাওয়ার,সাহল বিন আবদুল্লাহ্ আত তুসতারী,হুসাইন বিন মানসুর আল হাল্লাজ,শায়খ আহমাদ জামী,ইবনুল ফারিদ মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী,সাদরুদ্দীন কুনাভী,নাজমুদ্দিন কুবরা,সা’দুদ্দীন আল হামাভী,ফারিদুদ্দিন আত্তার,জালালুদ্দীন রুমী,শায়খ সাদী শিরাজী,হাফিয,আওহাদুদ্দীন আল মারাগ্বী,আলাউদ্দাওলাহ্ আস সিমনানী এবং আরো অনেক সূফী কবি ও দরবেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে,গোঁড়া শিয়া আকীদার সমর্থক হওয়ার অভিযোগে কাজী নুরুল্লাহ্ শুশতারীকে হত্যা করা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘মাজালিসুল মুমিনীন’ ও ‘ইহকাকুল হাক্ক’-এর সর্বত্র তাঁর এ আকীদা স্পষ্টভাবে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু সূফীদের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি অন্যান্য মাজহাব ও ফের্কার বিরুদ্ধে তাঁর আপত্তিগুলোকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। তাসাউফ ও ইরফান কিভাবে ইসলামের বিভিন্ন মাজহাব ও ফের্কার মিলনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে,এ থেকে তারই আভাস মিলে।

মুসলমানদের মধ্যকার অন্যান্য মাজহাব ও ফের্কাহ সম্বন্ধে বলতে গেলে উদাহরণস্বরূপ ‘ইসমাঈলীয়া’ ও ‘যায়েদীয়া’ মাজহাবের কথা বলা যেতে পারে যে,এ ক্ষেত্রে অনেক দিক দিয়েই তাদের আবেদন শিয়া ইসনা আশারিয়া আবেদনের অনুরূপ,কিন্তু যায়েদীয়া মাজহাবের অনুসারীরা ইমামত প্রশ্নে ইসনা আশারিয়া মাজহাবের আকীদার সাথে একমত পোষণ করে না। কারণ তারা প্রথম দু’জন খলীফাকে বৈধ খলীফা হিসেবে গণ্য করে,অন্যদিকে শিয়া ইসনা আশারিয়া মাজহাবের বারো জন ইমামের মধ্যকার শেষ আট জন ইমামকে তারা (যায়েদীয়াগণ) মানে না। অন্যদিকে ইসমাঈলীয়াগণ ইসনা আশারিয়া শিয়াদের মতোই ইমামতের মূল ধারণাকে গ্রহণ করে নিয়েছে, কিন্তু তারা কোরআন মাজীদের গূঢ় তাৎপর্যের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ কারণেই তারা ‘বাতেনিয়া’ নামে পরিচিত।

আলী আবু ইবনে সিনার ইসমাঈলীয়া মাজহাবের প্রতি ঝোঁক ছিল বলে মনে করা হয়। ইখওয়ানুস সাফারও ইসমাঈলীয়া প্রবণতা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরানের বিখ্যাত কবি দার্শনিক নাসের খসরুও একই মাজহাবের অনুসারী ও প্রচারক ছিলেন। ইরফান প্রশ্নে ইসমাঈলীয়া ও ইমামীয়া (ইসনা আশারিয়া) মাজহাবের আবেদন প্রায় অভিন্ন। কারণ উভয় মাজহাবই কালামশাস্ত্র ও দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তির উৎস বিচারবুদ্ধি তথা যুক্তি প্রয়োগ এবং মানবীয় অস্তিত্বের সমগ্রতার আত্মিক অভিজ্ঞতার মাঝে সমন্বয় সাধন করেছে।

আল্লাহ তায়ালা ও মানবাত্মা সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে সাধারণ সূফী অভিমত থেকে শিয়া ইরফানের অভিমতের পার্থক্য এখানে যে,শিয়া ইরফান অস্তিত্ববাদী মরমী জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির ভূমিকাকে গ্রহণ করে নেয়। এটা সত্য যে,ইমাম গাযযালী কাশফকে বিচারবুদ্ধি (আকল)-এর উচ্চতর পর্যায় বলে গণ্য করেছেন এবং কাশফকে এর সাথেই সংযুক্ত করেছেন,কিন্তু তিনি তাঁর মরমী অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বিচার-বুদ্ধিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে মনে হয়। ইমাম গাযযালীর আরেকটি স্ববিরোধিতা হচ্ছে এই যে,তিনি মরমী অভিজ্ঞতা উপস্থাপন এবং দর্শন প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে দার্শনিক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী যর্থাথভাবেই উল্লেখ করেছেন যে,শিয়াগণ কালামশাস্ত্র থেকে শুরু করে দর্শনের অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাত্ত্বিক সূফীবাদে উপনীত হয়েছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

এমনকি হিজরী চতুর্থ/খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্যন্ত শিয়াদের মধ্যে তাসাউফ চর্চার প্রচলন ছিল। কারণ ইবনে বাবাভাইহ্ আল কুমী এ সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে ‘ফুতুওয়াহ্’ (মহানুভবতা) বিষয়ক ঐতিহ্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। সাইয়্যেদ মুর্তাজা (ওফাত হিজরী ৪৩৬/খ্রিস্টীয় ১০৪৪) তাঁর ‘আল আমালী’ গ্রন্থে,আবু আলী আত তাবারসী (ওফাত হিজরী ৫৪৮/খ্রিস্টীয় ১১৫৩) এবং শিয়া ইমামী মাজহাবের আরো কয়েকজন আলেম সূফীবাদের কথা অত্যন্ত সমবেদনার সাথে (ইতিবাচকভাবে) উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে,তাঁরা মনে করতেন,শিয়া মাজহাবের পক্ষে সূফীবাদের সাথে খাপ খাওয়ানো সম্ভব।২৯ মানসুর হাল্লাজ যে,‘আনাল হক’ উচ্চারণ করেছিলেন খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী তাকে সঠিক বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। আল খুনসারীর মতে,খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী ছিলেন সেই ব্যক্তিদের অন্যতম যাঁরা ইরফান ও যুক্তি প্রয়োগের মধ্যে সম্বন্বয় সাধন করেছিলেন।

অন্য যে সব খ্যাতনামা শিয়া আলেমের ইরফানের সাথে গভীর সম্পৃক্ততা ছিল তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন কামালুদ্দীন মাইসাম ইবনে আলী ইবনে মাইসাম আল বাহরামী (ওফাত হিজরী ৬৭৯/ খ্রিস্টীয় ১২৮০) তিনি তাঁর ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ্’ গ্রন্থে সূফীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আলী (আ.)-এর বক্তব্য ও উক্তির ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তুত তিনিই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি ইরফানী তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘নাহজুল বালাগা’র প্রতি মুসলমানদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন। তিনি হযরত আলী (আ.)-কে সূফীদের নেতা ও অভিভাবক বলে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম গাযযালী শিয়াদের সমালোচনা করা সত্ত্বেও আল বাহরানী তাঁকে ইরফানী বিষয়াদিতে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘নাহজুল বালাগা’র ব্যাখ্যায় ইবনে আবিল হাদীদের সমালোচনা করেন। কারণ ইবনে আবিল হাদীদ দার্শনিকগণ ও সূফিগণের প্রতি খুবই কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন।

হিল্লার ইমামী ওলামায়ে কেরামের মধ্যে তাউস পরিবারের মনীষিগণ অর্থাৎ শারাফুদ্দীন মুহাম্মদ তাউস,মাজদ্দ্দুীন তাউস ও রাযীউদ্দীন তাউস-এদের তিন জনেরই,বিশেষ করে রাযীউদ্দীন তাউসের মরমীবাদের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। তিনি তাঁর তাকওয়া ও যুহ্দের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ছিলেন। এ পরিবারের ওলামায়ে কেরামের সকলেরই অতি প্রাকৃত ক্ষমতা ছিল বলে মনে করা হয় এবং তাঁরা সূফীবাদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন।

শিয়া মাজহাবের সর্বাধিক বিখ্যাত মুজতাহিদগণের মধ্যে যিনি সূফী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন তিনি হলেন হাসান বিন মুতাহ্হার আল হিল্লী যিনি আল্লামা হিল্লী নামে সমধিক পরিচিত (হিজরী ৬৪৮-৭২৮/ খ্রিস্টীয় ১২৫০-১৩২৬)। তিনি সমকালীন সুন্নী ওলামা ও মুজতাহিদগণকে যুক্তি-তর্কে পরাজিত করে খোদা-বান্দাহ্কে শিয়া মাজহাবে দীক্ষিত করেন। এ কারণে ইবনে তাইমিয়া তাঁর নিন্দা করেন। কিন্তু আল্লামা হিল্লী একটি দ্বিপদী কবিতা (বায়েত) রচনা করে অত্যন্ত ভদ্র-নম্রভাবে তার জবাব দেন। তিনি ছিলেন ইশকের পথের একজন নিষ্ঠাবান সন্ধানী। তিনি হযরত আলী (আ.)-কে সূফীবাদ শিক্ষার উৎস এবং সূফী সিলসিলাসমূহের নেতা বলে মনে করতেন। তিনি ইবনুল আরাবীর খুবই ভক্ত ছিলেন,তবে তাঁর ‘ওয়াহ্দাতুল ওজুদ’ (অস্তিত্বের একত্ব) তত্ত্বের সাথে একমত ছিলেন না। তাঁর পুত্র মুহাম্মদ-যিনি মুহাক্কিক হিল্লী নামে সমধিক পরিচিত (হিজরী ৬৮২-৭৭১/খ্রিস্টীয় ১২৮৩-১৩৬৯) এমন এক ব্যক্তির শিক্ষক ছিলেন যিনি শেষ পর্যন্ত শিয়া মাজহাব ও তাসাউফের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনায় সক্ষম হন। এই শেষোক্ত মহান মনীষী হলেন শায়খ বাহাউদ্দিন হায়দার ইবনে আলী আল উবাইদ আল অমোলী (মৃত্যু: হিজরী ৭৯৩/ খ্রিস্টীয় ১৩৯-এর পর)।

সাইয়্যেদ হায়দার ছিলেন একজন আলাভী এবং শিয়া জগতে মারজাইয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকেও নিজেকে সূফী সিলসিলার সাথে যুক্তকারী প্রথম ইমামী মনীষী। তিনি যে সিলসিলার সাথে যুক্ত হন তা বায়েজিদ বাস্তামীর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। তিনি ‘নাসসুন নুসূস’ নামে ইবনুল আরাবীর ‘ফুসুসুল হিকাম’ গ্রন্থের যে ভাষ্য রচনা করেন তাতে তিনি তাঁর সূফীবাদী ঝোঁকের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনুল জুমহুর আল আহসাঈ তাঁকে ‘জ্ঞানের শীর্ষ চূড়া ও কাশফ্-এর শক্তির অধিকারী’ বলে অভিহিত করেছেন। ইরফান সম্পর্কে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘জামিউল আসরার ওয়া মানাবিউল আনওয়ার’। এ গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেন যে,সূফীদের তাত্ত্বিক মতামত ইমামী আকীদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এর ফলে তিনি সুন্নী মাজহাব সম্পর্কে ইতোপূর্বে যে বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন তা পরিত্যাগ করেন এবং আরেফগণের উদার আকীদা গ্রহণ করেন। তিনি ‘ওয়াহ্দাতুল ওজুদ’ (অস্তিত্বের একত্ব) তত্ত্বের অনুসারীদেরকে ‘আরবাবুত তাওহীদ’ (তাওহীদের অধিকারী) বলে অভিহিত করেন। তাঁর প্রভাবের কারণেই শিয়া মুজতাহিদগণ ইবনুল আরাবীর তাওহীদ সম্পর্কিত মত খণ্ডনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। তাঁর মতে,আহলে বাইতের ইমামগণ শিয়াদের ও সূফীদের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত।

তিনি বলেন যে,শিয়াগণ ও সূফিগণ পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত,কিন্তু তারা এ সত্য সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন নয়। তিনি তাঁর এ মত প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সূফীদের সম্পর্কে শিয়া সূত্রে যে সব অনুকূল মতামত রয়েছে এবং শিয়াদের সম্পর্কে সূফীদের যে সব অনুকূল মতামত রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করেছেন। তিনি ইবনে মাইসাম আল বাহরানীর ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ্’,আল্লামা হিল্লীর ‘মিনহাজুল কারামা’ এবং ‘শারহুত তাজরীদ’ গ্রন্থে উল্লিখিত খাজা নাসিরুদ্দীন তুসীর মতামত এবং সুন্নীদের মধ্য থেকে ইমাম গাযযালী ও ইবনুল আরবীর গ্রন্থাবলী থেকে উদ্ধৃত করে এ অভিমত উপস্থাপন করেন যে,হযরত আলী (আ.) ছাড়া আর কেউই অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত সত্যের ঐশী জ্ঞানের অধিকারী নয়। তিনি নিজেকে ‘মোহাম্মদী শিয়া’ বলে অভিহিত করেন। এ হচ্ছে এমন একটি পরিভাষা যা সাম্প্রতিককালে কিছুটা পরিমার্জিতরূপে ড. আলী শরীয়তী কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। শহীদ শরীয়তী বলেন,শিয়া,আলাভী ও মোহাম্মাদী সুন্নী অভিন্ন এবং একই বিষয়। সুন্নীদের শিয়াদের সাথে ঘনিষ্ঠতর করার লক্ষ্যে ইবনুল মাইসাম আল বাহরানীর অনুসরণে সাইয়্যেদ হায়দার অমোলী বলেন যে,‘তাবাররা’ মানে প্রথম তিন খলীফার নিন্দা করা নয়,বরং তাবাররা মানে নিজেকে স্বীয় নফ্স্ (প্রবৃত্তি)-এর বন্ধন থেকে মুক্ত করা এবং পার্থিব সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করা। অনুরূপভাবে তিনি ‘তাকিয়া’ পরিভাষার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে,সাধারণ মানুষের নিকট ঐশী গূঢ় রহস্যাবলী প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা। তিনি হযরত আলী (আ.)-এর অনেক তত্ত্বকে বিশেষ করে তাওহীদ সংক্রান্ত তাঁর মতামতসমূহের নতুন ব্যাখ্যা পেশ করে শিয়া ইরফানী সাহিত্যে বিরাট অবদান রাখেন।৩৯

সাইয়্যেদ হায়দার অমোলীর প্রভাব এমন একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠার পথ উন্মুক্ত করে দেয় যে ঐতিহ্যবাহী শিয়া ও সুন্নী ধারার বিভিন্ন ফের্কার লোকদেরকে নিজের মধ্যে শামিল করে নেয়।

পরবর্তীকালে সূফী ভাবাপন্ন শিয়া ওলামায়ে কেরাম এ প্রবণতাকে সম্প্রসারিত করেন। ইবনে তাইমিয়া আল্লামা হিল্লীর বিরুদ্ধে যেভাবে দোষারোপ করেন তার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর সমসাময়িকগণ উদার সুন্নী মতের প্রতি আকৃষ্ট হন। উদাহরণস্বরূপ,শাফেয়ী আশআরী ফকীহ্ নাজমুদ্দীন আস সারসারী (ওফাত হি. ৭১৬/খ্রি. ১৩১৬) নিজেকে একজন ‘আলীর শিয়া’ বলে ঘোষণা করেন এবং আরেকজন ফকীহ্ কাজী জামালুদ্দিন ইবনে মুকাররাম আল আনসারী নিজেকে শিয়া বলে ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য যে,ঐ যুগে যে সব সুন্নী অন্যান্য সাহাবীর ওপর হযরত আলী (আ.)-এর আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেন তাঁদেরকে বুঝাবার জন্য ‘শিয়া’ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হতো,অন্যদিকে গতানুগতিক ধারার শিয়াদেরকে ‘রাফেযী’ বলা হতো।

ইলখানীদের পতন এবং তাইমূরের অভ্যুদয় ও তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়টিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে। এ আন্দোলনগুলোর সবকটিই শিয়া মাজহাবের অনুসারীদের মধ্য থেকে সূচিত হয়,তবে সূফীবাদের আবরণে। সূফীবাদ এ সব আন্দোলনকে বিজাতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি নিরাপদ ভিত্তি তৈরি করে দেয়। অন্যদিকে এ সব আন্দোলন সূফীদের মধ্যে শিয়া আকীদার বিস্তার ঘটানোর উপযোগী একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং একই সাথে সাধারণ শিয়া জনগণের মধ্যে সূফীবাদী শিক্ষা ও আচরণ প্রতিরোধের যে প্রবণতা ছিল তাকে দুর্বল করে দেয়। উল্লেখ্য যে,ইলখানী ও তাইমূরী যুগেই শিয়া মাজহাবের বিভিন্ন ফের্কার উদ্ভব ঘটে।

দৃশ্যত সূফীবাদ একটি রাজনীতি বর্জনকারী আন্দোলন হলেও প্রকৃতপক্ষে এ ছিল উমাইয়্যাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে দীনদার মুসলমানদের অসহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ। কারণ কোন শূন্যতার মাঝে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা বা প্রবণতা জাগ্রত হয় না। একটি তত্ত্বকে দৃশ্যত যতই না পার্থিব বাস্তবতাসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হোক;সমকালীন ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও তার দাবিসমূহের সাথে তার সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য। সূফিগণ সব সময়ই শাসকদের অনুগ্রহ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং ইসলাম প্রদত্ত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। উমাইয়্যাদের উৎখাত করার জন্য আব্বাসীয়রা যে আন্দোলন শুরু করে তাও একটি মরমী চরিত্র পরিগ্রহ করেছিল। ইসমাঈলীয়াগণ ‘দাঈ’গণ জনগণের মধ্যে কাজ করেন এবং গূঢ় তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গঠন করেন।

সূফীবাদের সামাজিক-রাজনৈতিক দিক সম্বন্ধে আলোচনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়,বরং এ জন্য স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। এখানে আমরা সূফীবাদ ও শিয়া মাজহাবের সামাজিক সুবিচারের ধারণার সংমিশ্রণের ফলে উদ্ভূত যে সব সূফীবাদী আন্দোলনের ফলে মুসলিম জাহানে বৈপ্লবিক উত্থান ও ওলট-পালটের সৃষ্টি হয়,সে সব আন্দোলনের ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করব।

এ সব সূফীবাদী আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে সফল আন্দোলনটি খোরাসানের ‘সারবেদারান’ বিদ্রোহে পর্যবসিত হয় এবং খুব শীঘ্রই অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কোন এক অজ্ঞাত সূফী ধারার শায়খ/পীর খলীফা এ আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের সংগঠিত করে তাইমূরের উত্তরাধিকারী তোগ্বা খান ও মীরান শাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করেন। তাইমূরের এ দু’উত্তরাধিকারীর শাসনামলে গ্রাম এলাকার ধ্বংস সাধন করা হয় এবং কৃষকদেরকে মোটা অঙ্কের কর দিতে বাধ্য করা হয়। ৭৩৬ হিজরীতে (খ্রি. ১৩৩৫) শাসকদের ভাড়াটে গুপ্তঘাতকদের হাতে শায়খ খলীফা নিহত হলে বিদ্রোহ শুরু হয়। তাঁর বিক্ষুব্ধ অনুসারীরা সর্বপ্রথম ৭৩৮ হিজরীতে (খ্রি. ১৩৩৭) শায়খ খলীফার উত্তরাধিকারী শায়খ হাসান জুরীর নেতৃত্বে খোরাসানে বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহ ৭৮৩ হিজরী (খ্রি. ১৩৮১) পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শায়খ হাসান জুরী নিজেকে একটি সূফী সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন যা বায়েজিদ বাস্তামী হয়ে হযরত ইমাম জাফর আস সাদেক (আ.) পর্যন্ত পৌঁছেছে।

খোরাসানে সূফী বিদ্রোহ দেখা দেয়ার (হি. ৭৩৮/খ্রি. ১৩৩৭) পর থেকে ৮২৫ হিজরীতে (খ্রি. ১৪২২)-এর মধ্যে সামারকান্দ,কেরমান ও মাজেন্দারানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে ও অব্যাহত থাকে। এ আন্দোলন ছিল একটি শিয়া-সূফী আন্দোলন যা ইসলামী ন্যায়বিচার ও সমতা-নীতির ভিত্তিতে স্বীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরে আন্দোলনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং এর ফলে আন্দোলনের মাঝপথে শায়খ হাসান জুরী নিহত হন। অবশ্য এ সত্ত্বেও আন্দোলন আরো কিছু দিন টিকে ছিল,কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালের প্রবাহে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়। অনুরূপ অন্য আন্দোলনগুলো কিছু দিন চলার পর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ব্যর্থ হয়।

এ ধরনের অন্যান্য আন্দোলনের মধ্যে ছিল হুরুফিয়াহ্ ও নোকতাভিয়াহ্ নামক দু’টি সূফীবাদী আন্দোলন। রাজতান্ত্রিক সরকার উভয় আন্দোলনের নেতাদেরকে হত্যা করে।

ইরানে সাফাভী ধারার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শায়খ সাফীউদ্দীন আর্দাবিলী নামে একজন সুন্নী সূফী। কিন্তু কয়েক পুরুষ পরে সাফাভী বংশ শিয়া মাজহাব গ্রহণ করে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তাঁরা তাঁদের রাজবংশের শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে অন্যান্য সূফী আন্দোলন ও সিলসিলাকে শক্ত হাতে দমন করার চেষ্টা করেন। সাফাভীদের এ নীতি গ্রহণের ফলে ইরানে ও ভারত উপমহাদেশে সূফীবাদের বিরুদ্ধে ঘোরতর বিরোধিতা গড়ে ওঠে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে,শিয়া মাজহাবের অনুসারী আওয়ায রাজবংশের শাসনামলে ভারতে প্রথম শিয়া মুজতাহিদ সাইয়্যেদ দিলদার আলী গোফরান মাআব ‘আশ শিহাবুস সাকেব’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি সাফাভী রাজবংশের শেষ দিককার অদূরদর্শী গোত্রবাদী শাসনের প্রভাবাধীন হওয়ার অভিযোগে সূফীদের নিন্দা করেন। এর ফলে ভারত উপমহাদেশে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে দূরত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এমনকি এখনো শিয়াদের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞতাবশত মনে করে যে,শিয়া মাজহাবের আকীদার সাথে সূফীবাদ খাপ খায় না। বস্তুত যে সব শক্তি মুসলমানদের বিভক্ত করতে চেয়েছিল তারাই মুসলিম উম্মাহর সংহতিকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে এভাবে ফাটল সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে সউদী আরবের ওহাবী সরকার এ ভিত্তিহীন সংশয় প্রচারের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে। মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তর থেকে উদ্ভূত এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র পথ হচ্ছে মাজহাব ও ফের্কা নির্বিশেষে মুসলমানদের সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন একটি কেন্দ্রে তাদেরকে একত্রিত করা। কারণ সূফীবাদ একদিকে ইসলামের ইতিহাসের গোটা অধ্যায়ে মুসলমানদের অন্যতম শক্তির উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে,অন্যদিকে তা কোন স্বতন্ত্র মাজহাব বা ফের্কায় পরিণত হয়নি অথবা কোন বিশেষ মাজহাব বা ফের্কার চিন্তাধারা রূপেও পরিগণিত হয়নি। বরং একনিষ্ঠ আল্লাহ প্রেমের চেতনা সকল মাজহাব ও ফের্কায়ই স্বীকৃত;আর এটিই হচ্ছে তাসাউফ বা সূফীবাদ।

এটি অনস্বীকার্য যে,বিভিন্ন মাজহাব ও ফের্কায় বিভক্ত মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হলে তাদেরকে ইসলামী সহনশীলতার প্রকৃত চেতনাকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরতে হবে। অর্থাৎ কেবল অভিন্ন ও তর্কাতীত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং মতপার্থক্যের বিষয়গুলোতে পরস্পরের প্রতি সহনশীল হতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে কেবল সূফীবাদী চিন্তাধারাই এ সহনশীলতার পরিচয় পুরোপুরি দিতে পেরেছে। সূফিগণ একটি স্বতন্ত্র ধারণা,চিন্তা-চেতনা ও বোধের অধিকারী ও অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য চিন্তা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে কখনই উগ্র নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেননি। তাই সন্দেহ নেই যে,সূফীবাদের পক্ষেই সকল মুসলমানকে নিজ বক্ষে ধারণ করা সম্ভব।

এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে,মুসলিম উম্মাহর প্রায় এক তৃতীয়াংশের বাস যে ভারতীয় উপমহাদেশে সেখানে সূফী ও আরেফগণের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল এবং উপমহাদেশের পরবর্তী পুরো ইতিহাসে সূফীবাদ ভাগ্য নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছে। এখনও তার সে ভূমিকা নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

বস্তুত সূফীবাদের সংস্কৃতি হচ্ছে এক সমন্বিত ইসলামী সংস্কৃতি। তাই পরস্পর দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত বিভিন্ন মাজহাব ও ফের্কার অনুসারী মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার সম্ভাবনা সূফীবাদেই রয়েছে। মাজহাবী ও ফের্কাগত সংকীর্ণ মনোভাব বর্জন ও আরেফসুলভ মনোভাব গ্রহণের মাধ্যমেই এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রেমে বিভোর যে আরেফ তিনি তো সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। আরেফের এ খোদাপ্রেম সম্পর্কেই আরেফ কবি বলেছেন :

“একজন আরেফ ইসলামেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হন,কুফরেও ধ্বংস হন

প্রজাপতির কাছে মসজিদ ও গীর্জার বাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।”

পাদটীকা:

১. হেনরী কোরবিন : ‘তারিখে ফালসাফেয়ে ইসলামী’;ফার্সী অনুবাদ : আসাদুল্লাহ্ মোবাশশারী (তেহরান: ইনতেশারাতে আমীর কাবীর,১৩৬১ হিজরী শামসী),পৃ. ৫০-৯৬,২৫২-২৫৭।

২. প্রাগুক্ত,পৃ. ২৫২-২৫৭,কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী : ‘তাশাইয়ু ওয়া তাসাউফ’;ফার্সী অনুবাদ : আলী রেযা যাকাভাতী গ্বারাগোযোলু (তেহরান : এনতেশারাতে আমীর কাবীর,১৩৫৯ হি.শা.)।

৩. নাহজুল বালাগাহ্ : হিকাম ১৪৭।

৪. প্রাগুক্ত : হিকাম ১৩১।

৫. হেনরী কোরবিন : পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থ,পৃ. ২৫২-২৫৫;কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী প্রাগুক্ত,পৃ. ৩০-৩৫; শাহ ওয়ালীউল্লাহ্ : ‘হামাআত’,উর্দূ অনুবাদ : মুহাম্মদ সারওয়ার (সিন্ধু সাগর একাডেমী),ভূমিকা ; এলিয়া পাওলোভিচ পেত্রোশভেনস্কী : ইসলাম দার ইরান (তেহরান : ইনতেশারাতে পায়াম,৭ম সংস্করণ,১৩৬৩ হি. শামসী),পৃ. ৩১৯-৩২৫।

৬. ইলমে কালাম বিশেষজ্ঞ বা কালামশাস্ত্রের বিশারদ। ইসলামী আকাইদের আলোচনায় আল্লাহ তায়ালার মানুষের নিকট পাঠানো বাণী ছাড়াও সত্তাগত কোন কথা (কালাম) আছে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক থেকে আকাইদের এ ধরনের শাস্ত্র ‘ইলমে কালাম’ এবং এর বিশেষজ্ঞগণ ‘মুতাকাল্লিম’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

৭. দেখুন : ‘তারিখে ফালসাফে দার ইরান’ রচনায় : হান্না আল ফাখুরী ও খালীলুজজার;ফার্সী অনুবাদ : আবদুল মুহাম্মদ আয়াতী (তেহরান : যামান,২য় সংস্করণ,১৩৫৮ হিজরী শামসী)

৮. স্মর্তব্য যে,ইমাম হাসান (আ.) ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর বৈধ খিলাফত ত্যাগ করেন। কারণ অন্যথায় দু’পক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হলে উভয় পক্ষেই প্রচুর প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটত,ফলে খুবই আশংকা ছিল যে,রোমান সম্রাট হামলা চালিয়ে তৎকালীন মুসলিম ভূ-খণ্ডের পুরোটাই দখল করে নিতে পারেন।-অনুবাদক

৯. ‘সহিফায়ে সাজ্জাদিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত।-অনুবাদক

১০. আল ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন : ‘আস-সাহীফাতুল কামিলাহ্’;ইংরেজি অনুবাদ : সাইয়্যেদ আহমদ মূহানী (তেহরান : ইসলামী প্রচার সংস্থা,১৯৮৪);ফার্সী অনুবাদ : জাভাদ ফাযিল (তেহরান : এনতেশারাতে আমীর কাবীর,চতুর্দশ সংস্করণ,১৩৬৩ হি. শা.)।

১১. দেখুন: আসাদ হায়দার রচিত ‘আল ইমাম আস সাদেক’ (দারুল কিতাব আল-গ্বারবিয়্যাহ্,২য় সংস্করণ, ১৯৭১);সাইয়্যেদ আহমাদ সাফাঈ রচিত ‘হিশাম ইবনুল হাকাম : মুদাফিয়ে হারীমে ভিলায়াত’ (তেহরান : নাশরে কাওকাব,২য় সংস্করণ,১৩৫৯ হি. শা.)।

১২. মূলত আবু মুসলিম খোরাসানীর বিদ্রোহের পরিণতিতেই উমাইয়্যা শাসনের পতন ঘটে। কিন্তু এর সুফল ভোগ করে আব্বাসী বংশ। আব্বাসীরা ক্ষমতা দখল করার পরে আবু মুসলিমের শক্তি ও জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মতানৈক্যের পরিণতিতে আবু মুসলিম আব্বাসী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আব্বাসীদের হাতে নিহত হন।-অনুবাদক

১৩. মূলত যে প্রশাসন আগাগোড়া এবং পুরোটাই স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক সরকারের খেদমতের উপযোগী সে প্রশাসনে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর পক্ষে একে যথার্থ ইসলামী হুকুমতে পরিণত করা সম্ভব ছিল না;বরং এর ফলে ইসলামী হুকুমতের যথার্থতা ও বাস্তবতা সম্বন্ধে সন্দেহ সৃষ্টি হতো। এ কারণেই তিনি খেলাফত গ্রহণ করেননি।-অনুবাদক

১৪. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ. ২৭।

১৫. বাংলাভাষীদের মধ্যে তিনি ‘বায়েজিদ বোস্তামী’ নামে পরিচিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম ‘বায়েজিদ বাস্তামী’।-অনুবাদক

১৬. তিনি হযরত মাসুমাহ্ নামে সুপরিচিত। তিনি হযরত ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর কন্যা এবং ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন। তাঁর মাযারকে কেন্দ্র করে কোম ধর্মীয় নগরী ও দীনী জ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

১৭. পেত্রোশভেনস্কী;প্রাগুক্ত,পৃ. ৩২৭।

১৮. ‘আলাভী’ নামটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথম অর্থে ‘আলাভী’ বলতে হযরত আলী (আ.)-এর বংশধর বুঝায়,কিন্তু হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বংশধর নন। এদেরকে ‘আলাভী সাইয়্যেদ’ও বলা হয়। দ্বিতীয় অর্থে আলাভী হচ্ছে শিয়া ইসনা আশারিয়া মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যে থেকে উত্থিত হয়ে বেরিয়ে একটি চরমপন্থী ফের্কা যারা আলী (আ.) সম্পর্কে ইসনা আশারিয়া থেকে ভিন্ন একটি আকীদা পোষণ করে যা চরমপন্থী ও বাড়াবাড়িমূলক। এখানে এ ফের্কার কথাই বলা হয়েছে।-অনুবাদক

১৯. ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া’ এবং এ জাতীয় গ্রন্থাবলী।-অনুবাদক

২০. বিস্তারিত জানার জন্য কামিল মুস্তাফা আশ শায়বীর প্রাগুক্ত গ্রন্থের পৃ. ৬৪-৬৫ দ্রষ্টব্য।

২১. শহীদ মুর্তাজা মুতাহ্হারীর ‘An Introduction to Irfan’; AL-Tawhid, Vol. IV, No. 1, pp. 74-75.’

২২. প্রাগুক্ত,পৃ. ৮২।

২৩. কাযী নুরূল্লাহ্ শুশতারী : ‘মাজালিসুল মু’মিনীন’ (তেহরান : কেতাব ফোরূশীয়ে ইসলামীয়ে,১৩৬৫ হি. শা,২য় খণ্ড,পৃ. ২-১৭৮)।

২৪. ইসমাঈলীয়ারা হযরত রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমামতের আকীদা পোষণ করে,কিন্তু ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর আস সাদেক (আ.)-এর পরবর্তী ইমামগণ সম্পর্কে ইসনা আশারিয়াদের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে। তারা ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর পরে তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণকারী তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাঈলকে ইমাম হিসেবে গণ্য করে। এ থেকেই তাদেরকে ‘ইসমাঈলিয়া’ বলা হয়। এ ছাড়া তারা কোরআন-হাদীসের রূপক ব্যাখ্যা ও গূঢ়তত্ত্বে বিশ্বাস করে।-অনুবাদক

২৫. দেখুন,হেনরী কোরবিন,প্রাগুক্ত,পৃ. ১০৪-১৩০।

২৬. বসরা কেন্দ্রিক একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী যাঁরা ইসলামী চিন্তাধারার সাথে গ্রীক দর্শনের সংযোগ ঘটান। তাঁরা সৃষ্টিজগতকে আল্লাহ তায়ালার ফয়েয ও তাঁর পর্যায়ক্রমিক ফয়েয বলে মনে করতেন।-অনুবাদক

২৭. অর্থাৎ দর্শনের ভিত্তি যে যুক্তির প্রয়োগ তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি যুক্তিরই আশ্রয় নিয়েছেন যা যুক্তি বা বিচার-বুদ্ধির গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে।-অনুবাদক

২৮. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ. ৬৯। আরো দেখুন,‘রাওযাতুল জান্নাত’ এবং ইবনে বাবাভাইয়ের ‘মা‘আনীল আখবার’।

২৯. প্রাগুক্ত,পৃ. ৭০-৭১।

৩০. প্রাগুক্ত,পৃ. ৯৩। আরো দেখুন,‘রাওযাতুল জান্নাত’।

৩১. প্রাগুক্ত,পৃ. ৯৫-১০২।

৩২. হিল্লা-বর্তমান ইরাকের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাচীন জনপদ। হিল্লার অধিবাসী ‘হিল্লী’।-অনুবাদক ৩৩. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ. ১০৪-১০৭।

৩৪. সমকালীন ইরানী শাসকদের উপাধি।-অনুবাদক

৩৫. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ.১০৭-১১০।

৩৬. প্রাগুক্ত,পৃ. ১১১।

৩৭. দীনী বিষয়ে সাধারণ মানুষ যাকে অনুসরণ করে তাঁকে মারজা (مرجع) বলা হয়। মারজার পদের জন্য যথাযথ ও ভারসাম্যপূর্ণ আমলসহ মুজতাহিদ হওয়া অপরিহার্য।-অনুবাদক।

৩৮. আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,তিনি ছিলেন ‘আলাভী’। আলাভীরা হযরত আলী (আ)-এর জ্ঞান ও মর্যাদা সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা পোষণ করে। অন্য দিকে ইসনা আশারিয়াহ্ আকীদা অনুযায়ী হযরত আলী (আ.) হচ্ছেন হযরত নবী কারীম (সা.)-এর প্রতিনিধি (ওয়াছী) ও স্থলাভিষিক্ত (খলীফা)। হযরত আলী (আ.) হযরত নবী কারীম (সা.) থেকে জ্ঞান লাভ করেছেন এবং পরে তাকে আরো বিকশিত করেছেন।-অনুবাদক

৩৯. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ. ১১২-১২৫।

৪০. সাইয়্যেদ হায়দার অমোলী আলাভী হলেও ইরফান ও তাসাউফে এবং শিয়া-সুন্নী ঐক্যের পটভূমি নির্মাণে তার অবদান অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। এ কারণেই প্রবন্ধকার তাঁর সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।-অনুবাদক

৪১. কামিল মুস্তাফা আশ শায়বী,প্রাগুক্ত,পৃ. ১৪২-১৪৩। আরো দেখুন ‘শাযারাতুয যাহাব’,চতুর্থ খণ্ড,পৃ. ৩৯।

৪২. পেত্রোশভেনস্কী,প্রাগুক্ত,পৃ. ৩৬৩।

৪৪. (داعی) আহ্বানকারী,প্রচারক।-অনুবাদক

৪৫. ‘সারবেদারান’-এর অর্থ ‘যারা ফাঁসীর রশির ফাঁসের মধ্যে মাথা প্রবেশ করিয়ে রেখেছেন।’ জীবন বাজী রেখে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার কারণে তাঁরা নিজেদেরকে এ নামে অভিহিত করেন।-অনুবাদক

জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ২