নরম যুদ্ধ বাহ্যত একটি অহিংস পন্থা। এখানে কারো ওপর কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রকে টার্গেট করে সেখানকার মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে আঘাত করা হয় এবং কৌশলে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনা হয়। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, মিডিয়া যুদ্ধ, নরম বিপ্লব, রঙিন বিপ্লব- এসব হচ্ছে সফ্ট ওয়ার বা নরম যুদ্ধের অংশ।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নরম যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। সাইবার যুদ্ধও এর বাইরে নয়। নতুন নতুন প্রযুক্তিকে এ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নরম যুদ্ধে রাইফেল, ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গি বিমানের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় ইন্টারনেট, মোবাইল, স্যাটেলাইট, পত্র-পত্রিকা, বার্তা সংস্থা, বইপত্র, রেডিও-টিভি এবং সিনেমা। নরম যুদ্ধকে অনেকেই মনস্তাত্ত্বিক ও শীতল যুদ্ধের সমার্থক হিসেবে গণ্য করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে শীতল যুদ্ধ বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ হচ্ছে নরম যুদ্ধের একটি অংশ। যেমন ধরা যাক- কোনো একটি পক্ষ ভাইরাসের সাহায্যে হামলা চালিয়ে অপর পক্ষের ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল করে দিল। এ ধরনের তৎপরতাতো কোনোভাবেই শীতল যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হবে না। এ ধরনের তৎপরতাও এক ধরনের নরম যুদ্ধ।
তবে পাশ্চাত্যের নরম যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো মুসলিম সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল ভিত্তিগুলোতে পরিবর্তন সাধন করা। গণমাধ্যম হচ্ছে নরম যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মুসলমানদের শত্রুরা নরম যুদ্ধের অংশ হিসেবে ইসলামি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও পরিচিতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভার্চুয়াল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কৌশলে নিজেদের সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নরম যুদ্ধের অংশ হিসেবে মুসলমানদের চিন্তা-বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয় এবং অমুসলিমদের মাঝে ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা তাদের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি বিশ্বব্যাপী চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এটি একটি অহিংস পন্থা হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং পরোক্ষভাবে সহিংসতা উস্কে দেয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুদের চলমান ‘নরম যুদ্ধ’ প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, মানুষের বিশ্বাসে পরিবর্তন আনাই হচ্ছে জটিল এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। দেশের জনগণ বিশেষকরে প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও তরুণ সমাজকে এ যুদ্ধের টার্গেটে পরিণত করা হয়। এর মাধ্যমে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে চায় শত্রুরা।
নরম যুদ্ধের শিকার হওয়ার পরও মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে না। মানুষ ভাবতে থাকে, এটাতো যুক্তিরই পথ। কিন্তু যুক্তির পথটিই এক সময় নিজের অজান্তে তাকে ভুল পথে নিয়ে যায় এবং সাম্রাজ্যবাদীদের কর্মীতে পরিণত করে। বর্তমানে শত্রুরা নরম যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে ফেইসবুক, টুইটার ও ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগের নানা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।
পাশ্চাত্য শক্তি নরম যুদ্ধ সফল করতে মানুষের আবেগকে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কারণ আবেগ-উত্তেজনাকে প্রভাবিত করে সংকট সৃষ্টি করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। শত্রুপক্ষ কোনো দেশ ও সমাজকে অস্থিতিশীল করতেও নরম যুদ্ধের আশ্রয় নেয়। এর মাধ্যমে তারা একটি দেশ ও সমাজের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে সেখানে নিজেদের অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। গণমাধ্যম নরম যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হওয়ায় এ খাতে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। তারা মানুষের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলতে একের পর এক উন্নত প্রযুক্তি আবিস্কার করছে এবং বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উপায় অনুসন্ধান করছে। নরম যুদ্ধ মোকাবিলার জন্যও উন্নত প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের অধিকারী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।