আমাদের লোকায়ত সমাজ ও বিনোদন সংস্কৃতি
  • শিরোনাম: আমাদের লোকায়ত সমাজ ও বিনোদন সংস্কৃতি
  • লেখক: মাসুদ মজুমদার (বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক)
  • উৎস: জ্যোতি ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা
  • মুক্তির তারিখ: 17:24:51 1-10-1403

আকৃতিতে মানুষের ভেতর প্রভেদ আছে,কিন্তু প্রকৃতিতে নেই। হাসি-কান্না,ব্যথা-বেদনার পার্থক্য নেই,যা আছে তা ধরনে। মানবতা,মানবিক বোধ,মানসিক সাযুজ্য মানবীয় বৈশিষ্ট্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। যাবতীয় উপায়-উপকরণ,উৎসব,আয়োজন-প্রয়োজন সবটুকু মানুষের জন্য।

পৃথিবীকে যদি নাট্যমঞ্চ ভাবা যায়,তাহলে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মানুষ। সকল বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও মানুষ এমন এক সত্তা যার সাথে তুল্য বিবেচনা অর্থহীন।

এজন্যই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ আর মানুষের ভেতর বিভাজনকে স্বাভাবিক ভাবা হয় না। অর্থ-বিত্ত ও কৌলিন্য নিয়ে যে ভাগ-বিভক্তি সেটি মানুষের নিজস্ব সৃষ্টি। ধর্মাচার,জীবনাচার,লোকাচার,পরিবেশ-প্রতিবেশ মিলিয়ে বর্ণগোত্র অঞ্চলে বিভক্তিটি স্বীকৃত,কিন্তু মানবিক বিবেচনায় দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। ভাষা প্রশ্নে বিভাজনটিও গৌণ নয়,কিন্তু মানবিক ভাবনায় ভিন্ন প্রসঙ্গ।

স্রষ্টার কাছেও প্রথম মানুষ এবং মুখ্য। এরপর বিশ্বাসের ভাঁজে মানুষকে পরিমাপ করা হয়েছে। বিশ্বাস মানুষকে ভিন্ন মাত্রিক বোধসম্পন্ন করে;কিন্তু মানুষের মানসিক ও মানবিক বোধকে বিকলাঙ্গ করে না কিংবা বিকৃত করে না।

এই কারণেই পৃথিবীর তাবৎ মানুষ বৈশিষ্ট্যগতভাবে এক এবং অভিন্ন। আদিতে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কল্পনা করা হয়,কিন্তু সেই ‘আদি’ কত আদি এর কোন ব্যাখ্যা মেলে না,বরং সৃষ্টির শুরু সম্পর্কে সকল আসমানী কিতাব অভিন্ন কথা বলে। বিকৃতি নিয়েও বাইবেলের পুরাতন ও নতুন সংস্করণ মানুষ ও মানবিক সভ্যতার উদ্ভব,বিকাশ,উত্থান বিকাশ ও পতন সম্পর্কে প্রায় অভিন্ন ধারণা দেয়। পৃথিবীর নিরঙ্কুশ সংখ্যক মানুষ আহলে কিতাব এবং বিশ্বাসী। বিশ্বাসের তারতম্য নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে আলোকপাত করতে যাব না। শুধু এতটুকু প্রাসঙ্গিক ভাবা যেতে পারে যে,বেহেশ্ত-দোযখ,আখেরাত,মানুষ সৃষ্টি,স্রষ্টা,আদম,হাওয়াসহ বিশ্বাসের মৌলিক স্তরে ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর মানুষের অবস্থান প্রায় একই সমতলে। পাপ-পুণ্য আর ভালো-মন্দের চিরায়ত সংজ্ঞাটায় তেমন কোন ফারাক নেই। সত্য এবং মিথ্যা বিবেচনায়-মানুষ নিজের মত করে একটি ধারণা গ্রহণ করে। তাই বলে সততার সংজ্ঞাটি পাল্টায় না,যা পাল্টায় তা নৈতিকতার মানদণ্ডে,নীতি-নিষ্ঠার মাপকাঠিতে। তাও আবার মৌলিক মানবীয় গুণাবলীকে কেউ অস্বীকার করে না।

এই মানদণ্ড ও মাপকাঠিতে গিয়েই মানুষের ভেতর লোকাচার-ধর্মাচার ও বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রভাব পড়ে। সেটি আচরণবিধিতে তারতম্য ঘটায়। এর সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশ যুক্ত হয়,ভৌগোলিক মাত্রা যোগ হয়ে একটি ‘সংকর’ অবয়ব তৈরি করে। এটি স্থানিক প্রভাবে,অঞ্চলের টানে একটি লোকজ রূপ পায়। এটিই মানুষের ভেতর একটি সাধারণ পার্থক্য সৃষ্টি করে। জাত, গোষ্ঠী ধর্মভেদের মাধ্যমে এর প্রকাশটি মূর্ত হয়ে ওঠে। লক্ষণীয় বিষয়,বিশ্বাস মানুষকে একটি কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়,এর ওপরে মানবিকবোধ একবার সাযুজ্য সৃষ্টি করে দেয় বটে,কিন্তু সেটি বিশ্বাসের স্তরে এসে প্রবল শক্তিতে টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীর সকল খ্রিস্টান ধর্ম-বিশ্বাসে একই ভাবনায় অবস্থান করে,যেমনটি বিশ্বাসের ভিত্তিতে মুসলমানরা অভিন্ন,কিন্তু মৌলিক বিশ্বাসকে অটুট রেখে অঞ্চল,ভাষা ও লোকাচার-এর ভিত্তিতে মানুষ কতগুলো আয়োজন-প্রয়োজনকে নিজের মত করে নেয়। এর ভেতর দিয়ে মানবিক বৈশিষ্ট্যের মৌল স্রোতধারায় কোন ব্যত্যয় ঘটে না, কিন্তু একটি লোকজ রূপ দাঁড়িয়ে যায়। যেমন আমরা একটি কৃষিভিত্তিক সমাজের মানুষ। হাজার বছরে আমাদের মাঝে এমন কতগুলো বিষয় এসে ভর করেছে যার প্রকাশটি অন্য যে কোন অঞ্চল থেকে আলাদা। এটি আমাদের পোশাকে-আশাকে,চলনে-বলনে,খাদ্যাভ্যাসে প্রকাশ পাচ্ছে। আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এর পরিশীলিত রূপটির নামই লোকজ সংস্কৃতি। এখানে ধর্মাচার-লোকাচার একাকার হয়ে যাচ্ছে। এর কোনটি ধর্মাশ্রয়ী,কোনটি লোকাশ্রয়ী সংস্কৃতির হাত ধরে গণমানুষের বিনোদন প্রকাশের উপায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এখানে যা অবৈধ নয় তাই বৈধ। যা হারাম নয় তাই হালাল। যা দূষণীয় নয় তাই নির্দোষ। যা অশ্লীল নয় তাই শ্লীল-এমন একটি পরিশীলিত অবয়ব নিয়ে জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি রূপ-সৌকর্য ফুটে ওঠে।

প্রসঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের মাপকাঠিতে বিনোদন ও সংস্কৃতিকে একটু টেনে আনা যায়। বিশ্বাসের নির্যাসকে আমরা ইসলাম হিসেবে ধরে নিতে চাই। উল্টোভাবে বলা যায়,ইসলামই আমাদের বিশ্বাসের নিয়ামক।

তাহলে ইসলামী জীবন দর্শনের ভেতর বিনোদন ও সংস্কৃতির একটি সর্বজনীন অবয়ব প্রথমেই খুঁজে নেয়া যেতে পারে।

ইসলামী জীবনদর্শনে মানুষ হচ্ছে বিবেক সম্পন্ন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলীফা। প্রতিনিধি শব্দের সাথে দায়-দায়িত্ব বর্তায়। এই দায়িত্ব স্রষ্টার প্রতি,সৃষ্টির প্রতি,নিজের জন্য,মানুষের জন্য। সমাজের জন্য,পশু-পাখিসহ জীবজগতের সব কিছুর প্রতি তো বটেই,অধিকন্তু প্রকৃতি,আসমান,যমিন ও সকল কিছুর ওপর মানুষের এই দায়িত্ব বর্তায়। এই দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ থেকেই মানুষের কর্মধারা প্রণীত হয়। এর সাথেই ভাবতে হবে মানুষ আল্লাহর বান্দা বা দাস। অপর পক্ষে আল্লাহ্ হচ্ছেন মানুষের রব এবং প্রভু। দাসত্বের নিয়ম বা আচরণ বিধি কিংবা দাসত্ব পদ্ধতি স্রষ্টাই ঠিক করে দিয়েছেন। এর কিছু আছে মৌলিক,যেখানে যোগ-বিয়োগ একেবারেই অসম্ভব। আর কিছু বিষয় আছে নীতিগত,তার পরিধি ব্যাপক। আচরণ বিধি লঙ্ঘন না করে মানুষ নিছক আকল দিয়ে এর চারপাশ স্পর্শ করতে পারে।

সহজ ভাষায় আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন। প্রতিনিধি হিসেবে দাসত্বের মাত্রা ও মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছেন। আচরণ বিধি বলে দিয়েছেন। জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার পূর্বশর্ত জানিয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা সঙ্গত যে,ইসলাম একটি আদর্শের নাম-এটি প্রযুক্তি নয়। আমদানী-রফতানীযোগ্য পণ্যও নয়। সর্বোপরি এটি মানুষের জন্য এবং মানুষের ওপর প্রতিফলিত হয়।

পবিত্র কোরআনে যখন বিধৃত হয়,‘আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রম দিয়ে সৃষ্টি করেছি,’ তখন ধরে নিতে হবে অখণ্ড বিনোদন আর অনাবিল শান্তি ও স্বস্তির স্থান পৃথিবী নয়। অন্যভাবে বলা যায়,পৃথিবীর জীবনে জান্নাতী সুখ ও শান্তি সম্ভব নয়। এর অর্থ সুখ ও বিনোদনের আয়োজন প্রয়োজন সীমিত,কিংবা এর ধরনটি ভিন্নতর। প্রচলিত ধারণাপুষ্ট নয়।

একজন ঈমানদার পরজন্মে ‘রাধা’ হতে চায় না,কিংবা হতে চায় না ‘শঙ্খ চিল’। ইসলামের পরকাল বিশ্বাসটির ভেতর কোন ধুম্রজাল নেই,ধোঁয়াটে ভাব নেই। একেবারে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ধারণা পেশ করে।

সোজা বলে দেয় পরকাল হচ্ছে সফল ও সার্থক মানুষের সুখ,শান্তি ও বিনোদনের স্থান। যাকে ‘জান্নাত’ বলা হয়েছে। আর ব্যর্থ মানুষটির জন্য রয়েছে অনন্তকালের দুঃখ-কষ্ট-যাকে বলা হয় ‘জাহান্নাম’। এই দু’টি পরিনাম ও প্রতিফল প্রাপ্তির জন্য পূর্বশর্ত পূরণ ও লঙ্ঘনের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

তাই সীমিত পরিসরে প্রচলিত সুখ ও বিনোদন প্রাপ্তির জন্য ‘প্রতিনিধিত্বের দায়’ এবং ‘বান্দার অনুভূতি’ ভুলে থাকার সুযোগ রাখা হয় নি।

জীবনের একটি বেষ্টনী ও বাগডোর ঠিক করে দেয়ার পরও আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রকৃতিজাত স্বভাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে অজস্র রহমতের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। অধিকন্তু পাঁচটি বিশেষ রহমতকে বিনোদন,চক্ষু স্বস্তিদায়ক ও পরিতৃপ্তির উপকরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক,সন্তান-সন্ততি বিশেষত শিশু সন্তান,পরিমিতবোধসহ ভোগের জন্য অর্থ-বিত্ত-স্বর্ণ-রৌপ্য,নানা ধরনের যানবাহন,পশু-পাখি,ফসল-ফলমূল,সুন্দর প্রকৃতি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য দৃষ্টি নন্দন উপায়-উপকরণ।

একটি স্বস্তিদায়ক পরিবার,নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এমন একটি সমাজ,নিরাপদ ও দূষণমুক্ত প্রকৃতি তখনই পাওয়া সম্ভব যেখানে বান্দা নিষ্ঠার সাথে খলীফার দায়িত্ব পালন করে। এর বিপরীতে ভীতি-ক্ষতি ও লোভের মাধ্যমে পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। ক্ষুধা,অর্থকষ্ট,অপ্রত্যাশিত মৃত্যু,রোগবালাই,দূষিত পরিবেশ,ফসল হানির মাধ্যমে মানুষকে সমস্যা সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।

পৃথিবীর জীবনকে দায়ভারমুক্ত তো করাই হয়নি,অধিকন্তু রাসূল (সা.)-এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরপরও বলে দেয়া হয়েছে,এই পৃথিবীতে তোমার অবস্থান হবে ক্ষণস্থায়ী যেন তুমি প্রবাসী,অথবা পথ অতিক্রমকারী। এই ক্ষেত্রে সূরা কাসাসে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে :

‘‘তুমি আল্লাহর দান দিয়ে পরকালের আবাসটি তালাশ কর,তবে পৃথিবীতে তোমার অংশটিও ভুলে যেও না।’’

ইসলাম দারিদ্রকে ভালো বলে নি,আবার বিলাসী জীবন অনুমোদনযোগ্য ভাবে নি। জীবন ঘনিষ্ঠ প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনদর্শন হিসেবে ইসলামের কোন খণ্ডিত রূপ নেই। এটি কোন প্রতিক্রিয়ার ফসলও নয়। স্বাভাবিক একটি জীবনদর্শন। এর ভেতরে মানুষটির প্রকৃতি,মানবিক ফিতরাত,মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লাগসইভাবে উপস্থাপন হবে না এটি ভাবা যায় না।

সাহিত্য যদি জীবনের নান্দনিক প্রকাশের নাম হয়। শিল্পবোধ যদি হয় পরিশীলিত সৌন্দর্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যদি জীবনের প্রকাশটা অর্থবহ হয়ে ধরা পড়ে তাহলে এখানে হালাল-হারাম অর্থহীন। সৌন্দর্যবোধকে ইসলাম শুধু লালনই করতে বলে নি,বিকশিত করতে উৎসাহিত করে। পৌত্তলিকতা কিংবা শিরক যদি ঠাঁই না পায়,অশ্লীলতা যদি জায়গা না পায়,দেশীয় লোকাচার-লোকজ অনুষ্ঠান ভাষা,সাহিত্য-সংস্কৃতি অনায়াসে হাত ধরাধরি করে চলতে পারে।

কোরআন চর্চা ও তেলাওয়াত উন্নত সংস্কৃতি হতে পারে। সুরের মূর্ছনায়,সাহিত্যের আসরে,বিজ্ঞানের গবেষণায়ও সংস্কৃতি খুঁজে নেয়া সম্ভব,সম্ভব বিনোদনের উপকরণ খুঁজে পাওয়া। শারীরিক প্রয়োজনে সামরিক শিক্ষা প্রয়োজন,এটি আবার বিনোদনও। এর সাথে দেশপ্রেম যেমন জড়িয়ে যায়,এর মাধ্যমে ইবাদতের প্রহর গোণাও সম্ভব।

নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় কিছু মৌলিক প্রসঙ্গ টানার প্রয়োজন ছিলো। এর কিছু নীতি কথা। কিছু গভীরে প্রবেশের ভূমিকামাত্র। এখানে আমরা বিনোদনের কোন সাধারণ সংজ্ঞা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। কারণ এটি এত আপেক্ষিক যে,এর বোধ উপলব্ধি ও প্রকাশ একান্ত ভাবে ব্যক্তির মনস্তাত্তিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যখন সফর করে তৃপ্তি পাই তখন গান ভালো নাও লাগতে পারে। গান যখন উদ্বেলিত করে তখন অন্য কোন আনুষ্ঠানিকতা মনের ওপর প্রভাব নাও ফেলতে পারে। জিকির যখন তৃপ্তিদায়ক তখন সাহিত্যের বই কিংবা থ্রিলার উপন্যাস ভালো লাগার কথা নয়।

এ মুহূর্তে ইরানের সিনেমা নিয়ে ভাবনার যে গরজ বোধ বসনীয় কিংবা ফিলিস্তিনীর কাছে এক টুকরো পাথর অনেক বেশি জরুরী। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই মুহুর্তে একটি কাওয়ালীর যে আবেদন,ইরাকী মানুষের কাছে যুদ্ধের প্রহর গুণে সময় যাপনটা অধিকতর জরুরী।

আপেক্ষিক এই বিবেচনাবোধ সামনে রেখেও আমরা মানবিক ফিতরাতের সাধারণ ভাবনাগুলোকে নিয়ে ভাবতে পারি। সুখে আমরা আনন্দিত হই,দুঃখে কাতরতা প্রকাশ করি। সুখের উচ্ছ্বাস,দুঃখের মাতম তাহলে বাহুল্য হতে যাবে কেন! এর ভেতর শরিয়ত সন্ধান না করলে কি নয়! বিরহ গাথা আর বিজয় গাথা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মাধ্যমে বাক্সমময় হয়ে উঠলে ক্ষতি কি?

আমরা বলবো না সংস্কৃতি ও আদর্শ-বিশ্বাস আলাদা কিছু। কিন্তু দৈনন্দিন ইবাদত আর সংস্কৃতি যেমন এক জিনিস নয়,তেমনি লোকজ সংস্কৃতি ও আচরণের ভেতর আকিদা খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। কোন আচরণ এবং আনুষ্ঠানিকতার ভেতর যদি শুধু সৌন্দর্যবোধ এবং নির্মল আনন্দ খোঁজার সুযোগ থাকে,সেখানে যা অবৈধ নয় তাই এমন বৈধ এমন একটি পরিধির ভেতর জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে পারলে শরীয়ত,আকীদা আর হারাম-হালালের বিতর্ক জুড়ে দেয়া সমীচীন মনে করি না।

একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে,ইসলামের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা সন্ধান করলে বিবাহ-ঈদ প্রভৃতিকে সামনে রাখতে পারি। মেয়েরা ঘরের ভেতর হলুদ বাটার গান গাইলে,নাচলে আর মেহেদী রাঙিয়ে উৎসাহ বোধ করলে ক্ষতিটি কোথায়? বেলেল্লাপনা আর পশ্চিমা ধাঁচে নর্তন-কুর্তন তো অরুচিকর। নারী-পুরুষের অবাধ মিশ্রণ রীতিসিদ্ধ নয়। এটি তো মৌলিক প্রশ্ন। মৌলিক দিকটি দৃষ্টিতে রেখে সীমা লঙ্ঘন না করে বিবাহের উৎসব মুখর পরিবেশ কারো ভালো না লাগতে পারে;কিন্তু অবৈধতার লেভেল এঁটে দেয়া হবে কেন?

খুশী হলে শিশু লাফিয়ে উঠে,দুঃখে নেতিয়ে যায়-শিশু মনের এই প্রকাশটি আবার বয়োজ্যেষ্ঠদের বেলায় সংযম এনে দেয়। যেখানে বয়সও বিনোদনের উপলব্ধিকে বাড়িয়ে-কমিয়ে দেয় সেখানে আমরা নান্দনিকতার ভেতর আকীদা আনতে যাবো কেন?

গ্রামে মেলা বসে,মেলা আর খেলা জুড়ে একটি খুশীর আবহ-আবর্ত সৃষ্টি করলে এর সাথে জুয়ার আসরকে একাকার করে না দেয়াই উত্তম। জুয়ার ক্ষতি থেকে পাহারা দিয়ে মেলা-খেলার নির্মল উপভোগ্য আসরকে জমিয়ে তুললে বিনোদন হতে দোষ কি?

এক সময় লাঠি খেলা হতো,নানাবিধ শারীরিক কসরত হতো,পূঁথির আসর বসতো,জারী,শারী,পালা গানের আসর বসতো,কবিতা ও গজল সন্ধ্যার আয়োজন হতো,এইতো সেদিনও শীতকালে পালাগান আর কবিয়ালের লড়াই দেখেছি,এইগুলো মানুষের মানবিক বোধকে জাগিয়ে তোলে। বিনোদন হিসেবে তুষ্ট ও সমৃদ্ধি করে,সামাজিক বন্ধনকে করে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। অবকাশ যাপনের স্বস্তি এনে দেয়,জীবন যাপনের গ্লানিটিকে হালকা করে।

আকাশ সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্য চেতনার চৈতন্য বোধকে যেমন ধ্বসিয়ে দিয়েছে,তেমনি কিছু অতি ধার্মিকতার প্রলেপ মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে অসহিষ্ণু করেছে। এর একটি আরোপিত,অন্যটি অজ্ঞতার খেসারত।

শারীরিক কসরত জরুরী বিষয়। খেলাধূলা আর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে এটি অর্জন সম্ভব। এর সাথে ধর্মের তাগিদটিও ছোট নয়। কিন্তু আমাদের অহেতুক কড়াকড়ি এবং কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ভীতিকে ধর্ম দিয়ে আড়াল করতে চাই,এর ফলটি নতুন প্রজন্মকে শেকড় থেকে আলাদা করে দিচ্ছে।

আমাদের কেউ কেউ প্রেক্ষিত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না এনে উম্মাপ্রীতি প্রদর্শন করেন। ফলে লোকজ ও দেশজ অনেক কিছু চাপা পড়ে যায়। এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা এমন একটি গোষ্ঠী ও শ্রেণীর পক্ষ থেকে আসে তাতে জঞ্জাল জমে,বিকৃতি আসে,গরিষ্ঠ মানুষের জীবনবোধ প্রতিফলিত না হয়ে ভিন্ন আগ্রাসী সংস্কৃতি প্রাধান্য পায়। এরপরও আমরা নিজেদের মত করে উপস্থাপন করি না। নিজেরা প্রতিনিধিত্ব করি না।

প্রতিপক্ষকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে,তাই বলে প্রতিক্রিয়াশীল হবো কেন? বিকল্প সুস্থ চিন্তাই সুন্নাহ্। প্রিয় নবী ইহুদীদের আচার-আচরণ বর্জন করতে বলেছিলেন। অনুকরণ হয়ে যাবে তাই নির্দোষ কিছু বিষয়ও বর্জন করতে বলেছেন,কিন্তু তিনি বিকল্প অনুষ্ঠান প্রথা ও রীতি চালু করেছেন। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি কোনদিন প্রতিক্রিয়াশীল হয় না,স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সৃষ্টিশীল জীবন ঘনিষ্ঠ হয়। গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে জাহেলিয়াত পরিবেষ্টিত আরবীয় সমাজ থেকে আল্লাহ্-রাসূলের রীতি একেবারে খোলামেলা। যা কিছু ভালো,কল্যাণকর,তাওহীদকে চ্যালেঞ্জ করে নি,আখেরাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় নি,‘রেসালতের সমান্তরাল হয় নি,বরং সাযুজ্যপূর্ণ হয়েছে-তার সবটুকুই আরবীয় মুসলমানরা আত্মস্থ করেছেন। এই ক্ষেত্রে পোশাক-আশাক থেকে খাদ্যরীতি আচার-আচরণ সব মিলিয়ে সবটুকু লোকজ আরবীয় সংস্কৃতি ইসলামের সমার্থক বিবেচিত হয়ে যায়।

এই সবকটি পারস্যবাসী ছাড়া অন্যরা তেমনটি অনুসরণ করতে সক্ষম হন নি। ফলে স্পেন থেকে ইসলাম নির্বাসিত হয়েছে,কিন্তু ইরান থেকে শাহের মত গণদুশমনরাও ইসলামী সংস্কৃতিজাত জীবনবোধ ও লোকজ ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জীবনাচার ও বিনোদন সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে ফেলতে পারে নি।

আমাদের লোকায়ত সমাজ ও লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে আলেম সমাজ বেশি ভাবতে চান নি। তাতে দু’টি ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত ধর্মাচারভিত্তিক গণশ্রেণীর নির্দোষ বিকল্প বিনোদন সংস্কৃতি উপস্থাপিত হয় নি। পাল-সেন-পাঠান মোঘল ইংরেজ-পাকিস্তানী মিলে আমাদের ভেতর কতকগুলো সংকর ও মিশ্র ধারণার প্রসার ঘটিয়েছে। যা আদৌ সংস্কৃতি নয়,তাই সংস্কৃতি হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। যা ঐতিহ্য নয়,তাই ঐতিহ্য নামে ঠাঁই করে নিতে চাইছে। যে বিনোদন শুধু অনুকরণ ও পরগাছা বানায় সেগুলোই বারবার বিনোদন সংস্কৃতি হয়ে প্রতিভাত হতে চাচ্ছে।

আমাদের সমাজটা আদিতে শ্রেণী বিভক্ত ছিল। বিত্তবান শ্রেণী ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির যোগানদার ছিল,যে বাংলাদেশ আমাদের অহংকার,যে বাংলা গৌরবের,সেটি মুসলিম শাসনের আগে এককেন্দ্রিক ছিল না। রাজত্ব,রাজা,রাজবংশ নিয়ে এত খণ্ড বিখণ্ড ছিল যে,একটি সর্বজনীন সংস্কৃতির ভিত রচিত হতে পারে নি।

রাজা পূজা করতেন,প্রজারা দর্শক হতো। বিত্তবান শ্রেণী আসর বসিয়ে মদ্যপ হয়ে বাঈজী নাচের ব্যবস্থা করতেন,প্রজা ও গণশ্রেণী উঁকি দিয়ে উপভোগ করে ধন্য হতো। এর বাইরে কৃষি,কৃষক নিয়ে বচন থেকে ধান কাটার গান। মারফতি থেকে মুর্শিদী সব কিছু স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে স্বভাবজাত বিনোদন সংস্কৃতির আদলে বিকশিত হয়েছে।

আদি পর্বে মুহররম পালিত হতো। এক মুহররমকে কেন্দ্র করে হাজারো অনুষ্ঠান হতো। বসতো পুঁথির আসর,জমতো মেলা,মিছিল হতো,নজরুলের কবিতার মত জোশ নিয়ে লোকজন অংশ গ্রহণ করতো। বিষাদসিন্ধু কতটা ইতিহাস বিকৃত সেটা সাধারণের বোঝার বিষয় ছিল না,কিন্তু সেটাকে মৌল স্রোতধারায় পুষ্ট করে অবিকৃত উপস্থাপন না করে শরিয়ত টেনে ইতিবাচকটুকুও নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।

ঈদ আমাদের জাতীয় উৎসব। এটি এখন লোকজ সংস্কৃতিও। এর ধর্মীয় দিকটি কতটা নান্দনিক সুন্দর মহিমামণ্ডিত ও ত্যাগের অনুপম নিদর্শনসমৃদ্ধ জনগণের ভাবনার বিষয় নয়। আনন্দের আতিশয্যে বাঁধনহারা এক নতুন অবয়বে ঈদ উপস্থাপিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ঈদ আজ যতটা আবেগ ও উচ্ছ্বাসের,এক সময় মুহররম এই তল্লাটে তেমনটি সাড়া জাগাতো-ঈদকে ঘিরে বিচ্যুতি আর বিকৃতি ঈদ বর্জনের সবক দেয় না,এর পরিবর্তনশীল জীবন ঘনিষ্ঠ উপস্থাপনা দাবি করে। এর মধ্যেই আমাদের জবাব খুঁজে পেতে হবে,খুঁজে নিতে হবে।

আমাদের ঐতিহ্যে বিনোদন,উপায়-উপকরণ এবং লোকায়ত সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে,কিন্তু যারা এ দিকটায় বিচরণ করেছেন তারা সনাতনী কিছুই পান নি। আর্য সংস্কৃতির একটি ভারতীয় অপভ্রংশ ও সংস্করণ আবিষ্কার করেছেন,যেখানে গণমানুষ উপেক্ষিত। গণসম্পৃক্তির কাজটি চিহ্নিত হয়েছে মূলত মুসলিম শাসনের সূচনা পর্বে। তাওহীদভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কোন লাগাতার প্রক্রিয়া না থাকায় সংস্কৃতি,বিনোদন,আচরণ প্রভৃতির ভেতর মরমীবাদ-সূফীতত্ত্বসহ নানা ধরনের অতি জাগতিক কিংবা পারলৌকিক ধর্মাচারের প্রভাব যেমন আছে,তেমনি পৌত্তলিক ভাবনার একটা মিশ্রিত ধারাও চোখে পড়ে।

উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার প্রাক্কালে জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ ঘটতে থাকে। এর ভেতর জাতিসত্তার উত্থানও লক্ষ্যযোগ্য হতে থাকে। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের সাথে ভাষা ও ধর্ম মিলে সংস্কৃতির টানাপোড়েনের সময়টি কাটে বিংশ শতকের তিরিশের দশক নাগাদ। তারপর সহজ মেরুকরণ শুরু হয়। এর একটা বাস্তব প্রকাশ ঘটে একাত্তর সালে। এখন সরলরেখার মত আমাদের জাতিসত্তা চিহ্নিত। বাংলা-বাঙ্গালী,বাংলাদেশ,বাঙ্গালী মুসলমান মিলেমিশে আমরা নিজেদেরকে একটি মানচিত্রে একটি পতাকার ভেতর একটি জাতিসত্তার আদলে খুঁজে পেয়েছি। এর ভ্রূন জন্ম নিয়েছে হাজার বছর পূর্বে। দৈহিক আকৃতি পেয়েছে বঙ্গ-ভঙ্গের প্রাক্কালে,সীমানা চিহ্নিত হয়েছে সাতচল্লিশে। আর দৈহিক অবয়বের সাথে আত্মার মিলন ঘটেছে একাত্তরে।

এখন আমাদের বিশ্বাসকে খণ্ডিত না করে মানবিক ফিতরাতের সাথে সাযুজ্য রক্ষা করে লোকায়ত সংস্কৃতির নান্দনিক প্রকাশ ঘটাতে হবে।

আমরা অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকি। এর কোন কোনটি জাতীয় দিবস ও জাতীয় সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করেছে। এর প্রকাশ ও অবয়বটা এত বেশি সংস্কৃতিজাত যে,এর সাথে ধর্ম বিশ্বাস-সংস্কৃতিবোধ ও বিনোদন একাট্টা হয়ে গেছে।

ধর্মীয় নেতৃত্ব ও জাতীয় মনীষার উচিত এসবকে আত্মস্থ করে নিজেদের মত করে উপভোগ্য করে তোলা। আমরা ১লা বৈশাখের কথা টানতে পারি। এটি বাংলা সনের প্রথম দিন। একে ঘিরে পিঠা-পায়েস,লোকজ উৎসব,কারু শিল্পের মেলা,হালখাতা হলে জাত যাবে কেন?

এখানে জাতির নামে কোন বজ্জাতিতো দেখি না। এটি একটি নির্দোষ দিবস। আপনি যদি ঐ দিনে একটি ওয়াজ ও ধর্মীয় সভার আয়োজন করেন,আরেকজন যদি বাংলা একাডেমী চত্বরে মেলা বসিয়ে তাল পাখা,ডালা-কুলার আয়োজন করেন তাতে দোষের কি আছে? দোষটি তো দিনের নয়। বৈশাখের নয়। আয়োজন প্রয়োজন উপলব্ধির। এটাকে ঘিরে যারা রাক্ষস-খোক্ষসের মুখোশ নিয়ে রাস্তায় নামে তারা মানবিক শূন্যতাবোধের কারণেই সুযোগ নেয়। মানবের উপস্থিতি দানব হটিয়ে দেয়। তাওহীদভিত্তিক এই সমাজে পৌত্তলিকের প্রকাশটি এভাবে হবার নয়। কিন্তু তাওহীদবাদীরা ঘুমিয়ে কাটালে অসুর এসে জায়গা দখল করবেই। অসচতেন কৃষকের ফসলেই পরগাছা জন্মে,আমরা অসচেতন কৃষক হতে যাবো কেন?

বিজয় দিবস,স্বাধীনতা দিবসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সামাজিক জাতীয় দিবস সম্পর্কেও আমরা অগভীর মন-মানসিকতা লালন করি। একুশের মত অনুষ্ঠানকে আমরা নিজেদের মত করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে খুব আনন্দ অনুভব করি। সালাম,জব্বার,রফিকরা জান্নাতবাসী হলে কি আমাদের জান্নাত প্রাপ্তিতে টান পড়বে? বাংলা ভাষার উৎকর্ষ হলে সবচেয়ে লাভবান তো আমরাই হবো। বাংলা চর্চার সুবাদে দীন চর্চাকে ব্যাপকতর করার সুযোগ নিতে চাই না,উল্টো নিজেদেরকে আড়ষ্ট করে দিতে চাই।

একটি মহল আছেন তারা যেনো সেন্সর বোর্ডের কাঁচি হাতে একদল সুবিধাভোগী। সব সময় একটি বাটখারা নিয়ে হালাল-হারাম বলার অপেক্ষায় আছেন। জায়েয-নাজায়েয রায় দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।

এদের হাতে প্রযুক্তি যেমন নিরাপদ নয়,নেয়ামতও হতে পারে না। তেমনি আদর্শও মানোত্তীর্ণ হবার ভরসা পায় না,উপস্থাপিতও হতে পারে না। এদের মধ্যে যারা প্রাজ্ঞ এবং জাতীয় বিবেক হবার মত,তাদের একটি অংশ আজকাল লোকাচার,বিনোদন,সংস্কৃতি প্রভৃতি নিয়ে ভাবেন,রক্ষণভাবে বসে দীন চর্চার চেয়ে গণমানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে ভাবেন। প্রযুক্তি দেখলেই আঁতকে ওঠেন না,বরং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিকল্প বলিষ্ঠ ধারা সৃষ্টির উপমা বা নজির সৃষ্টি করতে আগ্রহী। প্রতিযোগিতার দৌড়ে খেলার মাঠেও তারা আক্রমণভাগে খেলতে চান। আসলে যারা জিততে চায় তারা কোনদিন রক্ষণভাগে খেলে না,তারা মাঠময় দাপটের সাথে উপস্থিত থাকে। সুন্দর খেলা উপহার দেয়,দর্শকদের আন্দোলিত করে। এর ভেতর দিয়ে একটি নির্মল আনন্দ বিনোদনের নামে মনকেও তুষ্ট করে।

সকল আনুষ্ঠানিকতা কি বিদআত? একটি প্রীতিভোজ,বনভোজন,আকিকার অনুষ্ঠান,বৌভাত সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিকূলে উৎকৃষ্ট লোকাচার। গ্রামে-গঞ্জে ক্ষতিকর হাউজির আসর বসে,যাত্রা হয়,এর নেতিবাচক প্রভাবটুকু শূন্যে নিয়ে আসা যায় ইতিবাচক গণসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে। একটি বইমেলা,বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিংবা বক্তৃতা প্রতিযোগিতা দিয়ে অনেক কিছু অর্জন সম্ভব। ঈদের আনুষ্ঠনিকতা যদি সর্বজনীন করা যায়,জুমাবারকে মসজিদকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চা ও আদি পর্বের সমাজ ব্যবস্থার পঞ্চায়েত প্রথার ঐতিহ্যের সাথে লাগসই করা যাবে না কেন? ঈদে-চাঁদে,মুহররমে,বিবাহ,আকিকা আর সোঁদা মাটির গন্ধ মাখা গণমানুষের জীবনাচারকে একাকার করে দেয়া সম্ভব। যদি ঐতিহ্যপ্রীতি আমাদের বর্তমানকে গীতিময় করে তুলতে পারে,তাহলে প্রতিক্রিয়াজাত অসম প্রতিযোগিতা কমে যাবে। গরিষ্ঠ মানুষের জীবনবোধ প্রতিফলিত হবে ফসল তোলার গানে। সমাজটি রাঙ্গিয়ে যাবে নতুন প্রাণে। সেই প্রাণে প্রকৃতির ধর্ম ইসলামের রূপ সৌন্দর্য ধরা পড়বে অনায়াসে।

ইসলাম প্রগতির ধর্ম,শুধু পেছন নিয়ে ভাবতে বলে না। প্রগতির চাকাকে ঘোরাতে বলে। তালের পাখা আর আলপনায় আমরা তুষ্ট নই। এর সাথে প্রগতির ছোঁয়া জরুরী। কিন্তু শেকড় কেটে নয়। ঐতিহ্য আর প্রগতির মেলবন্ধন জরুরী। অবারিত এই সুবিধা নিয়েও আমরা কুপমণ্ডুক হবো-এটি কিভাবে মানা যায়?#আল-হাসানাইন