প্রত্যেক জাতিরই সাহিত্যের ইতিহাস প্রমাণ করে যে এই পৃথিবীর বুকে কথাশিল্প হচ্ছে মানব জীবনের সুপ্রাচীন একটি দৃষ্টান্ত। কথাশিল্প মানে গল্পবলা বা রচনা করার শিল্প মানবতার অস্তিত্বের সাথে সমান্তরাল। মানুষের বিকাশের সাথে সাথে গল্পও মানব জীবনের চড়াই-উৎরাইকে অনুষঙ্গী করে এগিয়েছে। মানুষের আভ্যন্তরীণ সত্ত্বা ও জীবনবোধের মূল উপাদান-উপকরণ নিয়েই গল্পের কাজ। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ-সবাই গভীর আগ্রহ-উদ্দীপনা ও কৌতূহলী মন নিয়ে গল্প শুনতে ভালোবাসে।
এই কৌতূহল ও ভালোবাসাকে পুঁজি করেই গল্পকার বা কথাশিল্পীগণ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনকে গল্পের ভেতর ব্যক্ত করার সুযোগকে কাজে লাগান। অনেকেই জানেন যে গল্পের কাঠামো বা আঙ্গিকে নৈতিক বিষয়-আশয় কিংবা কখনো আরো জটিল বিষয়ের বর্ণনা করা অনেক বেশি সুসঙ্গত। কবি-কথাশিল্পী তথা লেখক-সাহিত্যিকগণ এই আঙ্গিকটিকে তাই ব্যাপকভাবে কাজে লাগান।
একজন গল্পকার গল্পের উপজীব্যকে যতোটা সাবলীল ও সুন্দর বর্ণনার মাধ্যমে বর্ণনা করবেন গল্প ঠিক ততোটাই প্রাঞ্জল ও মোহনীয় হবে। গল্পের মাধ্যমে দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের,মহান ব্যক্তিত্বদের,ধর্মীয় মনীষীদের কথা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। গল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিও বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রাচীনকাল থেকেই গল্প শিল্প-সাহিত্যের একটি প্রভাবশালী শাখা ছিল এবং এখনো তাই আছে। মানুষ স্বভাবতই গল্পপ্রিয়। বিচিত্র কাহিনী,ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে বিস্ময়কর কোনো দুর্ঘটনা কিংবা টানা গল্পের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। ধর্মীয় সাহিত্যে গল্পের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। বিভিন্ন ধর্ম মানুষের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে কিংবা মানুষকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে গল্পকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছে। যদিও দুঃখজনকভাবে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টের মতো বহু আসমানী কিতাব কালক্রমে বিকৃতির সম্মুখিন হয়েছে,তবু গল্পশূণ্য হয় নি।
পবিত্র কোরআনেও শিক্ষনীয় বহু গল্পের অবতারণা করা হয়েছে,সুন্দর এবং মার্জিতভাবে। এইসব গল্পের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ,নবী-রাসূলদের নবুয়্যতির প্রমাণ, আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতার প্রমাণপঞ্জী চমৎকার আঙ্গিক ও শৈলিতে সুন্দর বর্ণনায় শব্দরূপ দেওয়া হয়েছে। কোরআনের গল্পগুলো অনেক উন্নত মানের শিল্পসুষমায় ভরা। কোরআন শব্দের অলৌকিক সৌকুমার্যের পাশাপাশি কখনোই মানুষকে হেদায়েত করার প্রয়োজনীয় অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু ও বাস্তব সত্যটিকে তুলে ধরতে ভোলে নি। এই গল্পগুলো একদিকে গল্প,শিল্পগুণে সমৃদ্ধ গল্প, অপরদিকে সত্যের সুস্পষ্ট বার্তাবাহী। কোরআনের গল্পগুলো সত্য ও বাস্তবতাকে এমন আলঙ্কারিকভাবেভাবে বর্ণনা করেছে যে,একজন পাঠককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
কোরআনের গল্পগুলো কিন্তু নিছক কল্পনাপ্রসূত কথা সাহিত্য নয়। এই কাহিনীগুলোর সবই মানব জীবনেতিহাসে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা। কোরআনের গল্পগুলোতে মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করার লক্ষ্যে এবং সঠিক হেদায়েতের পথ প্রদর্শনের জন্যে বিভিন্ন চরিত্রকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
কোরআন হচ্ছে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণীর সংকলন। এ কারণে কোরআনের গল্পগুলোও যে কোরআনের স্রষ্টার সেই সামগ্রিক সত্ত্বার সাথে যথোপযুক্ত ও ওজস্বী হবে-সেটাই স্বাভাবিক। কোরআনের গল্পগুলোতে আমরা যদি গভীর মনোযোগ দেই তাহলে দেখতে পাবো,আরবদের মাঝে রূপকথা বা কল্প-মিশ্রিত পৌরাণিক কাহিনীর যে ধারা প্রচলিত ছিল কোরআনের গল্পে সেসব অনুপস্থিত। কোরআন আদর্শ প্রচারে এবং চিন্তাশীলতার বর্ণনায় এমন এক সংস্কৃতি বা ঘটনার উপস্থাপন করেছে,নিকট-অতীতে যেগুলোর বহির্বাস্তবতা ছিল এবং সেইসব ঘটনা বা বাস্তবতা থেকে মানুষের জন্যে শেখার রয়েছে অনেক কিছু।
তৎকালীন জাহেলি সমাজে কোরআন যে ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে,সেই ভাষা ছিল বিস্ময়কর এবং আরবদের ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে অনেক উন্নত। একটা বিশেষ ভঙ্গিতে কোরআন মানুষের সাথে কথা বলেছে। জাহেলি সমাজের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করতো যে পদ্ধতিতে রাসূলে কারিম (সা) কোরআন বর্ণনা করেন তা মানুষের ভাষাভঙ্গি নয়। এ কারণে যে বা যারা কোরআন পড়ে এবং শোনে তাদের সবাই ঐ ভাষাভঙ্গির বিস্ময়করতা অনুভব করে। তবে কোরআনের অসাধারণ শৈল্পিক এবং বিস্ময়কর ছন্দময়তাকে ব্যাখ্যা করার শক্তি-সামর্থ তাদের অনেকেরই ছিল না। কেননা কোরআনে যে শৈল্পিক চিত্র আঁকা হয়েছে তার একটা বিশেষ সাঙ্গিতিক ও ছন্দোবন্ধ বৈশিষ্ট রয়েছে।
কোরআনে কারীমের আয়াতের প্রতি যদি সামগ্রিক দৃষ্টিতে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে কোরআনের সকল আয়াত এবং কোরআনের গল্পগুলো সবই মানুষের হেদায়েতের জন্যে বর্ণিত হয়েছে। কোরআনে গল্পের আশ্রয় নেওয়ার একটা কারণ হলো মানুষকে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গল্প ব্যাপক প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী (আ) বলেছেন-যেখানেই শিক্ষণীয় উপাদান-উপকরণ আছে সেখান থেকে উপদেশ গ্রহণ করো,সময়ের আবর্তন থেকে শিক্ষা নাও। তো কোরআন প্রাচীনকালের বিভিন্ন সময়ের বিচিত্র জাতি-গোষ্ঠির ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে যে গল্পের অবতারণা করেছে তা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। আর ঐশী ঐতিহ্য সবসময়ই ইতিহাসে বিরাজমান।
কোরআনে কারীমের মূল বিষয়বস্তুকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। আকীদা-বিশ্বাসগত মূলনীতি,ফিকাহর হুকুম-আহকাম,সামাজিক ও নৈতিক দর্শন বর্ণনা,নবী-রাসূলদের কাহিনী এবং পূর্ববর্তীদের গল্প।কোরআনে অন্তত ২৫ জন নবীর নাম এসেছে যাঁদের ব্যাপারে বহু গল্প রয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন-আদম, নূহ, ইদ্রিস, হুদ, সালেহ, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইউসূফ, সোলায়মান, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ। কোরআনে বর্ণিত গল্পের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু ইসহাক নিশাবুরির মতো অনেকেই বলেছেন কোরআনে বর্ণিত গল্পের সংখ্যা হলো ১১৬।
গবেষকগণ কোরআনের গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন ধরণ বা পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাঁদের অনেকেই গল্পগুলোকে নবীদের আবির্ভাবকালের দিক থেকে বর্ণনা করেছেন। তাই গল্পগুলো হযরত আদম (আ) থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনকাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। কোরআনের গল্পগুলোর আরেকটি পদ্ধতি হলো কোরআনে বর্ণিত অক্ষুন্ন ধারা যা বিভিন্ন সূরার সন্নিবেশ অনুযায়ী বর্ণিত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে কোরআনের আয়াত এবং সূরার শানে নুযুলের ভিত্তিতে গল্পগুলো পর্যালোচিত হয়।
আকার-আকৃতির দিক থেকে কোরআনের গল্পগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে বড়ো বা দীর্ঘ গল্প। যেমন হযরত ইউসূফ (আ), হযরত মূসা (আ) এর গল্প। বড়ো গল্পগুলোর মধ্যে বহু দৃশ্য এবং বৃত্তের সমাহার রয়েছে। পুরো সূরা ইউসূফেই এই নবীর জীবনের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো কথা বা বক্তব্যই এই কাহিনী বৃত্তের বাইরে যায় নি। একইভাবে সূরা কাসাসেও হযরত মূসা (আ) এর জীবনের কাহিনী সময়ের দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে। আরেক রকম গল্প আছে যেগুলোকে নাতিদীর্ঘ গল্প বলা যেতে পারে। হযরত আদম (আ) এর গল্প,হযরত নূহ (আ) এর গল্প, হযরত দাউদ (আ) এর গল্প ইত্যাদি। এসব গল্পে দৃশ্যান্তর খুব বেশি নয়। তাঁদের রেসালাতের শুরু দিয়ে গল্পের অবতারণা হয়েছে,আর একত্ববাদের দাওয়াত প্রদান এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়ের মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে পরিসমাপ্তির দিকে। এই শ্রেণীর গল্পে নবীদের শৈশব,কৈশোরকাল বা তাঁদের বেড়ে ওঠার কোনো বর্ণনা নেই।
তৃতীয় শ্রেণীর গল্প হলো ছোট গল্প। যেমন সালেহ (আ) এর গল্প কিংবা যাকারিয়া (আ) এর গল্প। এসব গল্পে প্রসঙ্গত তাঁদের নবুয়্যতি কালের একটা সময়ের বর্ণনা রয়েছে এবং খুব সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত প্রদানের মধ্য দিয়ে এই গল্পগুলোর সমাপ্তি ঘটেছে।(রেডিও তেহরান)
এই কৌতূহল ও ভালোবাসাকে পুঁজি করেই গল্পকার বা কথাশিল্পীগণ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনকে গল্পের ভেতর ব্যক্ত করার সুযোগকে কাজে লাগান। অনেকেই জানেন যে গল্পের কাঠামো বা আঙ্গিকে নৈতিক বিষয়-আশয় কিংবা কখনো আরো জটিল বিষয়ের বর্ণনা করা অনেক বেশি সুসঙ্গত। কবি-কথাশিল্পী তথা লেখক-সাহিত্যিকগণ এই আঙ্গিকটিকে তাই ব্যাপকভাবে কাজে লাগান।
একজন গল্পকার গল্পের উপজীব্যকে যতোটা সাবলীল ও সুন্দর বর্ণনার মাধ্যমে বর্ণনা করবেন গল্প ঠিক ততোটাই প্রাঞ্জল ও মোহনীয় হবে। গল্পের মাধ্যমে দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের,মহান ব্যক্তিত্বদের,ধর্মীয় মনীষীদের কথা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। গল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিও বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রাচীনকাল থেকেই গল্প শিল্প-সাহিত্যের একটি প্রভাবশালী শাখা ছিল এবং এখনো তাই আছে। মানুষ স্বভাবতই গল্পপ্রিয়। বিচিত্র কাহিনী,ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে বিস্ময়কর কোনো দুর্ঘটনা কিংবা টানা গল্পের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। ধর্মীয় সাহিত্যে গল্পের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। বিভিন্ন ধর্ম মানুষের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে কিংবা মানুষকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে গল্পকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছে। যদিও দুঃখজনকভাবে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টের মতো বহু আসমানী কিতাব কালক্রমে বিকৃতির সম্মুখিন হয়েছে,তবু গল্পশূণ্য হয় নি।
পবিত্র কোরআনেও শিক্ষনীয় বহু গল্পের অবতারণা করা হয়েছে,সুন্দর এবং মার্জিতভাবে। এইসব গল্পের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ,নবী-রাসূলদের নবুয়্যতির প্রমাণ, আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতার প্রমাণপঞ্জী চমৎকার আঙ্গিক ও শৈলিতে সুন্দর বর্ণনায় শব্দরূপ দেওয়া হয়েছে। কোরআনের গল্পগুলো অনেক উন্নত মানের শিল্পসুষমায় ভরা। কোরআন শব্দের অলৌকিক সৌকুমার্যের পাশাপাশি কখনোই মানুষকে হেদায়েত করার প্রয়োজনীয় অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু ও বাস্তব সত্যটিকে তুলে ধরতে ভোলে নি। এই গল্পগুলো একদিকে গল্প,শিল্পগুণে সমৃদ্ধ গল্প, অপরদিকে সত্যের সুস্পষ্ট বার্তাবাহী। কোরআনের গল্পগুলো সত্য ও বাস্তবতাকে এমন আলঙ্কারিকভাবেভাবে বর্ণনা করেছে যে,একজন পাঠককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
কোরআনের গল্পগুলো কিন্তু নিছক কল্পনাপ্রসূত কথা সাহিত্য নয়। এই কাহিনীগুলোর সবই মানব জীবনেতিহাসে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা। কোরআনের গল্পগুলোতে মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করার লক্ষ্যে এবং সঠিক হেদায়েতের পথ প্রদর্শনের জন্যে বিভিন্ন চরিত্রকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
কোরআন হচ্ছে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণীর সংকলন। এ কারণে কোরআনের গল্পগুলোও যে কোরআনের স্রষ্টার সেই সামগ্রিক সত্ত্বার সাথে যথোপযুক্ত ও ওজস্বী হবে-সেটাই স্বাভাবিক। কোরআনের গল্পগুলোতে আমরা যদি গভীর মনোযোগ দেই তাহলে দেখতে পাবো,আরবদের মাঝে রূপকথা বা কল্প-মিশ্রিত পৌরাণিক কাহিনীর যে ধারা প্রচলিত ছিল কোরআনের গল্পে সেসব অনুপস্থিত। কোরআন আদর্শ প্রচারে এবং চিন্তাশীলতার বর্ণনায় এমন এক সংস্কৃতি বা ঘটনার উপস্থাপন করেছে,নিকট-অতীতে যেগুলোর বহির্বাস্তবতা ছিল এবং সেইসব ঘটনা বা বাস্তবতা থেকে মানুষের জন্যে শেখার রয়েছে অনেক কিছু।
তৎকালীন জাহেলি সমাজে কোরআন যে ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে,সেই ভাষা ছিল বিস্ময়কর এবং আরবদের ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে অনেক উন্নত। একটা বিশেষ ভঙ্গিতে কোরআন মানুষের সাথে কথা বলেছে। জাহেলি সমাজের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করতো যে পদ্ধতিতে রাসূলে কারিম (সা) কোরআন বর্ণনা করেন তা মানুষের ভাষাভঙ্গি নয়। এ কারণে যে বা যারা কোরআন পড়ে এবং শোনে তাদের সবাই ঐ ভাষাভঙ্গির বিস্ময়করতা অনুভব করে। তবে কোরআনের অসাধারণ শৈল্পিক এবং বিস্ময়কর ছন্দময়তাকে ব্যাখ্যা করার শক্তি-সামর্থ তাদের অনেকেরই ছিল না। কেননা কোরআনে যে শৈল্পিক চিত্র আঁকা হয়েছে তার একটা বিশেষ সাঙ্গিতিক ও ছন্দোবন্ধ বৈশিষ্ট রয়েছে।
কোরআনে কারীমের আয়াতের প্রতি যদি সামগ্রিক দৃষ্টিতে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে কোরআনের সকল আয়াত এবং কোরআনের গল্পগুলো সবই মানুষের হেদায়েতের জন্যে বর্ণিত হয়েছে। কোরআনে গল্পের আশ্রয় নেওয়ার একটা কারণ হলো মানুষকে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গল্প ব্যাপক প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী (আ) বলেছেন-যেখানেই শিক্ষণীয় উপাদান-উপকরণ আছে সেখান থেকে উপদেশ গ্রহণ করো,সময়ের আবর্তন থেকে শিক্ষা নাও। তো কোরআন প্রাচীনকালের বিভিন্ন সময়ের বিচিত্র জাতি-গোষ্ঠির ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে যে গল্পের অবতারণা করেছে তা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। আর ঐশী ঐতিহ্য সবসময়ই ইতিহাসে বিরাজমান।
কোরআনে কারীমের মূল বিষয়বস্তুকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। আকীদা-বিশ্বাসগত মূলনীতি,ফিকাহর হুকুম-আহকাম,সামাজিক ও নৈতিক দর্শন বর্ণনা,নবী-রাসূলদের কাহিনী এবং পূর্ববর্তীদের গল্প।কোরআনে অন্তত ২৫ জন নবীর নাম এসেছে যাঁদের ব্যাপারে বহু গল্প রয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন-আদম, নূহ, ইদ্রিস, হুদ, সালেহ, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইউসূফ, সোলায়মান, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ। কোরআনে বর্ণিত গল্পের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু ইসহাক নিশাবুরির মতো অনেকেই বলেছেন কোরআনে বর্ণিত গল্পের সংখ্যা হলো ১১৬।
গবেষকগণ কোরআনের গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন ধরণ বা পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাঁদের অনেকেই গল্পগুলোকে নবীদের আবির্ভাবকালের দিক থেকে বর্ণনা করেছেন। তাই গল্পগুলো হযরত আদম (আ) থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনকাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। কোরআনের গল্পগুলোর আরেকটি পদ্ধতি হলো কোরআনে বর্ণিত অক্ষুন্ন ধারা যা বিভিন্ন সূরার সন্নিবেশ অনুযায়ী বর্ণিত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে কোরআনের আয়াত এবং সূরার শানে নুযুলের ভিত্তিতে গল্পগুলো পর্যালোচিত হয়।
আকার-আকৃতির দিক থেকে কোরআনের গল্পগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে বড়ো বা দীর্ঘ গল্প। যেমন হযরত ইউসূফ (আ), হযরত মূসা (আ) এর গল্প। বড়ো গল্পগুলোর মধ্যে বহু দৃশ্য এবং বৃত্তের সমাহার রয়েছে। পুরো সূরা ইউসূফেই এই নবীর জীবনের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো কথা বা বক্তব্যই এই কাহিনী বৃত্তের বাইরে যায় নি। একইভাবে সূরা কাসাসেও হযরত মূসা (আ) এর জীবনের কাহিনী সময়ের দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে। আরেক রকম গল্প আছে যেগুলোকে নাতিদীর্ঘ গল্প বলা যেতে পারে। হযরত আদম (আ) এর গল্প,হযরত নূহ (আ) এর গল্প, হযরত দাউদ (আ) এর গল্প ইত্যাদি। এসব গল্পে দৃশ্যান্তর খুব বেশি নয়। তাঁদের রেসালাতের শুরু দিয়ে গল্পের অবতারণা হয়েছে,আর একত্ববাদের দাওয়াত প্রদান এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়ের মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে পরিসমাপ্তির দিকে। এই শ্রেণীর গল্পে নবীদের শৈশব,কৈশোরকাল বা তাঁদের বেড়ে ওঠার কোনো বর্ণনা নেই।
তৃতীয় শ্রেণীর গল্প হলো ছোট গল্প। যেমন সালেহ (আ) এর গল্প কিংবা যাকারিয়া (আ) এর গল্প। এসব গল্পে প্রসঙ্গত তাঁদের নবুয়্যতি কালের একটা সময়ের বর্ণনা রয়েছে এবং খুব সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত প্রদানের মধ্য দিয়ে এই গল্পগুলোর সমাপ্তি ঘটেছে।(রেডিও তেহরান)