গাদিরে খুম
  • শিরোনাম: গাদিরে খুম
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:31:11 1-9-1403

গাদিরে খুমের বার্তা:
সর্বশেষ নবী মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) ২৩ বছর ধরে নবুওয়তের দায়িত্ব পালনের পর বলেছেন, 'নবুওয়তের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আর কোনো নবী আমার মতো এত কঠিন ও কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়েনি।' তিনি তার নবুওয়তের শেষ বছরে বিদায় হজ্বের সময় গাদিরে খুম নামক স্থানে আল্লাহর নির্দেশে নিজের স্থলাভিষিক্তের নাম ঘোষণা করেন। তিনি এমন একজনকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্ধারণ করেন, যিনি এর আগে বহুবার কাজ-কর্ম, সাহসিকতা, নিষ্ঠা ও ঈমানদারিতার ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। রাসূলের পর মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন যোগ্যতম।
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) মোনাফিকদের শক্তি ও ক্ষমতা এবং আলী (আ.)-র প্রতি তাদের ঈর্ষার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণে তিনি আলী (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত ঘোষণার বিষয়ে শংকার মধ্যে ছিলেন। কুরানের কয়েকটি আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহতায়ালা শেষ পর্যন্ত রাসূলকে এ বিষয়ে ঘোষণা দিতে বাধ্য করেন এবং এ কাজটি না করলে রাসূলের নবুওয়তের দায়িত্ব পরিপূর্ণ হবে না বলে জানিয়ে দেন।
এ অবস্থায় রাসূলে খোদা দশম হিজরির ১৮ জিলহজ্ব গাদিরে খুম নামক স্থানে আলী (আ.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন থেকেই ১৮ই জিলহজ্ব পবিত্র গাদির দিবস হিসেবে পরিচিত।
সেদিন রাসূল (সা.) হজ্ব শেষে মদিনায় ফেরার পথে গাদির এলাকায় তার সফরসঙ্গীদের থামতে বললেন। যেসব হাজী ওই স্থান থেকে কিছু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন তিনি এবং যারা পেছনে ছিলেন, তাদেরকেও সেখানে এসে সমবেত হতে বললেন। পাশাপাশি তিনি লেখকদেরকেও উপস্থিত হতে বললেন। বেশিরভাগ হাজি সেখানে এসে উপস্থিত হওয়ার পর তিনি উটের জিনকে মঞ্চের মতো করে তাতে আরোহণ করেন এবং ভাষণ দেন। ভাষণের পর হজরত আলী (আ.)-র হাত ওপরে তুলে ধরে তাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। তিনি রাসূলের আহলে বাইতকে পবিত্র কুরানের সমতুল্য হিসেবে ঘোষণা করেন। কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র কুরান ও আহলে বাইত যে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না, তিনি সবাইকে সে কথা জানিয়ে দেন। রাসূলের এ বার্তাটি বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে দেয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবো, এ প্রত্যাশা রইলো। পাশাপাশি সবার প্রতি থাকলো পবিত্র ঈদে গাদিরের শুভেচ্ছা।

গাদিরে খুমের ঘটনার বর্ণনা:
দশম হিজরীতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-র আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখো মুসলমান মক্কায় হজ্বব্রত পালন করতে যান। মদিনায় হিজরতের পর এটিই ছিল রাসূলের প্রথম হজ্ব। শুধু প্রথম নয়, তাঁর শেষ হজ্বও এটি। ওই হজ্বের কিছু দিন পরই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ(সা.) ইন্তেকাল করেন। মক্কার পথে রাসূলেখোদা (সা.)-র সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য বিপুল সংখ্যক মুসলমান মদিনায় জড়ো হন। রাসূলের এ হজ্বকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। এর মধ্যে হুজ্জাতুল বিদা, হুজ্জাতুল ইসলাম, হুজ্জাতুল বালাগ, হুজ্জাতুল কামাল ও হুজ্জাতুত তামাম অন্যতম।
রাসূল (সা.) হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে গোসল করে পুত-পবিত্র হয়ে খুব সাধারণ দুই টুকরো কাপড় পরিধান করেন। এর এক টুকরো কাপড় কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত পরেন ও অপর টুকরো ঘাড়ে ঝুলিয়ে নেন। মহানবী(সা.) ২৪ অথবা ২৫ শে জ্বিলকাদ শনিবার হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে পায়ে হেঁটে মক্কার পথে রওনা হন। তিনি তার পরিবারের সব সদস্যকেও সঙ্গে নেন। নারী ও শিশুরা উটের পিঠে আর রাসূল চলেছেন পায়ে হেটে। রাসূলের নেতৃত্বাধীন ওই কাফেলায় সেদিন মুহাজির ও আনসাররাসহ বহু মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। হজ্ব শেষে মদিনায় ফেরার পথে রাসূল (সা.) যখন জুহফা'র কাছাকাছি গ্বাদিরে খুম নামক স্থানে পৌঁছান, ঠিক তখনি রাসূলের কাছে ওহি নাজিল হয়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'হে রাসুল ! তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তুমি সবার কাছে পৌঁছে দাও ,যদি তা না কর তাহলে তো তুমি তার বার্তা প্রচার করলে না ।' (সূরা মায়েদা: আয়াত ৬৭)
মদিনা, মিশর ও ইরাকের অধিবাসীদের সবাইকে জুহফা এলাকা হয়েই নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই রাসূল (সা.)-ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে সেই পথ দিয়েই মদিনায় ফিরছিলেন। রাসূল (সা.) ও তার সফরসঙ্গীরা ১৮ই জ্বিলহজ্ব বৃহস্পতিবার জুহফা অঞ্চলে পৌঁছান। সেখানেই ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) ওই ওহি নিয়ে আসেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা.)-কে এ নির্দেশও দেয়া হয় যে, হজরত আলী (আ.)-কে যেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত তথা পরবর্তী নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং আলী (আ.)-কে মেনে চলার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়।
রাসুলে খোদা (সা.) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর দায়িত্বের এই বোঝা থেকে মুক্ত হতে উদ্যোগী হলেন। তিনি সবাইকে সমবেত হতে বললেন। চলার পথে যারা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা পেছনে ফিরে আসেন। আর যারা পেছনে ছিলেন তারা এগিয়ে এসে ওই স্থানে থেমে যান। রৌদ্রস্নাত উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় সবাই তখন ক্লান্ত অবসন্ন । তারপরও সবাই খুবই মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন রাসূলের বক্তব্য শুনার জন্য। তারা বুঝতে পারলেন, রাসূল (সা.) মুসলমানদের জন্যে নতুন কোনো বিধান বা দিক নির্দেশনা দেবেন ।
ওই স্থানে পাঁচটি পুরনো গাছ ছিল। রাসূলের নির্দেশে গাছের নিচের জায়গাটুকু পরিস্কার করা হলো। এরপর সাহাবিরা সেখানে চাদোয়া টানিয়ে দিলেন। জোহরের আজান দেয়ার পর মহানবী সবাইকে নিয়ে সেখানে নামাজ আদায় করলেন। এরপর উটের জিনকে মঞ্চের মত করে তাতে আরোহণ করলেন এবং সমবেত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,'সব প্রশংসা আল্লাহর। আমরা তারই সাহায্য চাই ও তার ওপরই ঈমান এনেছি। তার ওপরই আমাদের ভরসা। কেবল তিনিই বিভ্রান্তদেরকে সৎ পথে পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেন। আর আল্লাহ যাকে দিকনির্দেশনা দেন, তিনি যেন বিভ্রান্তকারীতে পরিণত না হন। আমি এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি ছাড়া আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয় এবং মুহাম্মদ হচ্ছে তার বান্দা ও প্রতিনিধি। দয়াময় ও মহাজ্ঞানী আল্লাহই আমাকে এ সংবাদ দিয়েছেন যে, আমার ইহকালীন জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, অচিরেই আমার জীবনের অবসান ঘটবে, মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগত ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। আমার ও আপনাদের ওপর যেসব বিষয় অর্পিত হয়েছে, সেসব বিষয়ে আমরা সবাই দায়িত্বশীল। আপনাদের কি অভিমত?'
এ সময় সবাই উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, 'আমরা এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, বার্তা পৌঁছে দেয়া, কল্যাণকামিতা তথা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আপনি কোনো ধরনের অবহেলা করেননি। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।'
এ সময় রাসূল (সা.) বলেন, 'আপনারা কি এ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে-আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং বেহেশত, দোজখ, মৃত্যু ও কিয়ামতের বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া, আল্লাহ মৃতদেরকে পুণরায় জীবিত করবেন?'
উত্তরে সবাই সমস্বরে বলেন-'হ্যা আমরা এ সত্যের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি।' এরপর রাসূল (সা.) সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে বলেন, 'হে আল্লাহ আপনিতো দেখতেই পাচ্ছেন।'
এরপর রাসূল (সা.) বলেন, 'আমি আপনাদের আগে হাউজে কাউসারে প্রবেশ করবো। এরপর আপনারা সেখানে প্রবেশ করবেন এবং আমার পাশে অবস্থান নেবেন। সানা ও বসরার মধ্যে যে দূরত্ব,আমার হাউজে কাউসের প্রশস্ত হবে সে পরিমাণ। সেখানে থাকবে তারকারাজি এবং রুপার পাত্র।'

এরপর বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সবার উদ্দেশে বলেন, 'মূল্যবান ও সম্মানিত যে দুটি জিনিস আপনাদের কাছে রেখে যাচ্ছি, আপনারা কীভাবে তা মেনে চলেন, তা আমি দেখতে চাই।' এ সময় সবাই সমস্বরে বলে ওঠেন, 'হে রাসূলুল্লাহ, ওই দু'টি মূল্যবান ও সম্মানিত জিনিস কী?'

এর জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, 'এর একটি হচ্ছে পবিত্র কুরান,যা আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যম। কাজেই বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পেতে কুরানকে সঠিকভাবে মেনে চলবেন। আর অন্যটি হলো, আমার আহলে বাইত। আল্লাহতায়ালা আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন যে, এ দু'টি জিনিস কখনোই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। কুরান ও আমার আহলে বাইত যাতে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, সে জন্য আমি সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। আপনারা কখনোই এ দুটি বিষয়ে অবাধ্য হবেন না এবং তা মেনে চলার বিষয়ে অবহেলা করবেন না।'

এরপর আল্লাহর রাসুল ( সা.) আলী (আ.)-র হাত উত্তোলন করেন। এ সময় তাদের বগলের নিচ থেকে এক ঝলক শুভ্রতা ফুটে ওঠে এবং সবাই তা দেখতে পায়। এরপর রাসূল (সা.) বলেন, 'মহান আল্লাহ হচ্ছেন আমার ওলি এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী । আমি হচ্ছি মুমিন-বিশ্বাসীদের ওলি ও অভিভাবক,আর আমি যার নেতা ও অভিভাবক, আলীও তার নেতা ও অভিভাবক।' এরপর তিনি দোয়া করেন। রাসূল (সা.) বলেন, 'হে আল্লাহ ! যে আলীকে বন্ধু মনে করে তুমি তাকে দয়া ও অনুগ্রহ করো, আর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে, তুমি তার প্রতি একই মনোভাব পোষণ করো ।'

বিশ্বনবী এসব বার্তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে উপস্থিত সবার প্রতি নির্দেশ দেন। তখনও সমবেত হাজীরা ওই স্থান ত্যাগ করেননি। এরইমধ্যে হজরত জিব্রাইল ( আ.) আবার ওহি বা প্রত্যাদেশ বাণী নিয়ে হাজির হলেন। রাসূল (সা.) যে তাঁর দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি সে বিষয়টি রাসূলকে জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ বললেন, 'আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।' ( সূরা মায়েদা; আয়াত-৩)

আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর রাসূল (সা.)বলেন, 'আল্লাহু আকবার। তিনি ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন, অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন এবং আমার রেসালাত ও আমার পরে আলীর নেতৃত্বের ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট।' এর পরপরই সবাই আলী(আ.)-কে অভিনন্দন জানাতে থাকেন।
সবার আগে আবু বকর ও ওমর এগিয়ে এসে বললেন, 'হে আবি তালিবের সন্তান, তোমাকে অভিনন্দন। আজ তোমার ওপর দায়িত্ব এসেছে। তুমি আমাদের এমনকি সব নারী ও পুরুষের অভিভাবক।'
ইবনে আব্বাস বললেন, 'আল্লাহর কসম। আলীর নেতৃত্ব মেনে নেয়া সবার জন্য ওয়াজিব।' এ অবস্থায় বিশিষ্ট কবি হিসান বিন সাবেত রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'হে রাসূলুল্লাহ। আলীর শানে একটি কবিতা বলার অনুমতি চাচ্ছি।' রাসূলের অনুমতি পাওয়ার পর হিসান তার কবিতা শুরু করেন। তার কবিতার মূল বক্তব্য ছিলো এ রকম:

'গাদির দিবসে মহানবী ডেকে বললেন সব মুসলমানকে
বলোতো,তোমাদের মওলা ও নবী কে?
সমস্বরে এলো উত্তর-তোমার রবই আমাদের মওলা,তুমিই নবী নি:সন্দেহে। তোমার কথার বরখেলাপ করবে না কেউ এ জগতে।
রাসূল বললেন-হে আলী ,আমার পরে তুমিই হবে সৃষ্টিকূলের নেতা, জাতিকে দেবে নির্দেশনা।
আমি যাদের নেতা আলীও তাদেরই নেতা। আমার নির্দেশ সবার প্রতি-সবার ভেতর থাকে যেন আলী-প্রীতি।
খোদা,তোমার কাছে আর্জি আমার
আলী যাদের ভালোবাসা,তুমিও তাদের ভালোবেসো
যারা তাকে শত্রু ভাবে,তুমিও তাদের শত্রু হইও। '

গাদিরে খুমের ঘটনা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন। ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি। গাদিরে খুমের ঘটনা মুসলিম জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। গাদিরে খুমে রাসূল যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা মেনে চললে বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা অনেকাংশে কমে যায়।
বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ শেখ মুফিদ তাঁর আল-ইরশাদ বইয়ে লিখেছেন, নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে মোবাহেলার বেশ কিছু দিন পর বিদায় হজ্বের ঘটনা ঘটে। বিদায় হজ্বের কিছু দিন আগে রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে ইয়েমেনে পাঠান নাজরানের খ্রিষ্টানদের প্রতিশ্রুত অর্থ ও উপহার সামগ্রী সংগ্রহ করার জন্য। রাসূল (সা.) এ কাজে আলী(আ.)-কে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করেননি এবং অন্য কাউকে এ কাজের জন্য যোগ্য মনে করেননি।
আলী (আ.) তখনও ইয়েমেনে অবস্থান করছিলেন। এরইমধ্যে হজ্বের সময় হয়ে গেলো। রাসূলে খোদা হজ্বব্রত পালনের জন্য ২৫শে জিলক্বাদ মদিনা ত্যাগ করেন। তিনি আলী(আ.)-র কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাকে ইয়েমেন থেকে সরাসরি মক্কায় চলে আসতে বলেন।
আলী (আ.) তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ইয়েমেন থেকে মক্কার দিকে রওনা হন। তিনি এত দ্রুত ইয়েমেন থেকে মক্কার দিকে ছুটে আসেন যে, রাসূল (সা.) মক্কায় প্রবেশের আগেই তিনি রাসূলের হজ্ব কাফেলায় যোগ দিতে সক্ষম হন। আলী (আ.)-কে দেখে রাসূল খুশি হন এবং জিজ্ঞেস করেন-আলী, তুমি কী নিয়তে ইহরাম বেধেছ? আলী (আ.) জবাবে বললেন, যেহেতু আমি জানতাম না আপনি কী নিয়ত করেছেন, সে কারণে ইহরাম বাধার সময় বলেছি, হে আল্লাহ, আপনার রাসূল যে নিয়তে ইহরাম বেধেছেন, আমিও ওই একই নিয়ত করছি। রাসূল (সা.) বললেন, 'আল্লাহু আকবার। প্রিয় আলী, তুমি হজ্ব পালন ও কুরবানি করার ক্ষেত্রে আমার অংশীদার।' এটি ছিলো রাসূলের সর্বশেষ হজ্ব।
সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব একটি অপরিহার্য বিষয়। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের মধ্যে অন্যতম সেরা নেয়ামত হলো- নেতৃত্বের যোগ্যতা।এই যোগ্যতা, গুণ ও ক্ষমতা সীমিত সংখ্যক লোকের মধ্যেই আল্লাহ দিয়ে থাকেন। বাকীরা তাদের অনুসরণ করেন। মানব ইতিহাসের কিছু নেতা সরাসরি আল্লাহর মাধ্যমে মনোনীত। এঁরা হলেন, নবী, রাসূল ও আহলে বাইতের ইমামগণ, যারা সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ফলে তাদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণ সব মানুষের জন্য যথাযথভাবে অনুসরণীয়। মানব সমাজের নেতৃত্বের বিষয়টি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, সে বিষয়টি পবিত্র কুরানেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র কুরানের সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্তীর্ন হলো। এরপর আল্লাহ বলেছিলেন "আমি তোমাকে সব মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।" ইবরাহীম আবেদন করেছিলেন- আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও ( ইমাম বা নেতা করুন)। আল্লাহ জবাব দিলেনঃ "আমার এ অঙ্গীকার জালেমদের ব্যাপারে প্রযোজন্য হবে না (কেবলমাত্র তোমার যেসব বংশধর নিষ্পাপ ও পবিত্র থাকবে,তারাই এ পদের যোগ্য হিসেবে গণ্য হবে)।
হজরত মূসা (আ.)তার ভাই হারুনকে নিজের সহযোগী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য আল্লাহর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এরপর আল্লাহ তা কবুল করেন। সূরা ত্বাহার ৩৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: আল্লাহ বললেন, "হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।'
সূরা সা'দের ২৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা, হজরত দাউদ (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'হে দাউদ ! আমি অবশ্যই তোমাকে পৃথিবীতে সৃষ্টিকূলের প্রতিনিধি করেছি। সুতারাং মানুষের মধ্যে সত্য ও [ ন্যায়ের ] ভিত্তিতে বিচার -মীমাংসা কর।'
এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,তিনিই মানব জাতির নেতা ও ইমাম নির্ধারণ করেন। ইসলাম ধর্মে নেতৃত্ব ও ইমামত কেবলমাত্র মানুষের দৈনন্দিন ও প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার জন্য নয়। ইসলাম ধর্মে একজন ইমাম বা নেতা, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক-উভয় ক্ষেত্রের নেতা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, ইসলাম ধর্মে একজন নেতা, জনগণ থেকে আলাদা নয়। গাদিরের ঘটনাকে তিনি জনগণের নেতৃত্ব ও নীতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হিসেবে গণ্য করেন।
রাসূল (সা.)-র ওফাতের পর শান্ত মুসলিম সমাজ যাতে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে এবং স্বার্থান্বেষীরা ওই শোকাবহ ঘটনাকে যাতে অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য রাসূল (সা.)-কে এ দায়িত্ব দেয়া হয় যে, তিনি যাতে তার পরবর্তী নেতার নাম ঘোষণা করেন। রাসূলে খোদা বিদায় হজ্বের পর এক সমাবেশে আলী(আ.)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। তিনি আলী (আ.)-এর যোগ্যতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, হে জনগণ, এমন কোনো জ্ঞান নেই, যা আল্লাহ আমাকে দেননি এবং আমিও পরহেজগারদের নেতা আলী (আ.)-কে সেই জ্ঞান শিখিয়েছি। আপনারা কেউই আলী (আ.)-র পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। তার পথ থেকে দূরে সরে যাবেন না। তার নেতৃত্বকে অমান্য করবেন না। কারণ সে সবাইকে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করে। সে অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটায় এবং নিজে অন্যায় থেকে দূরে থাকে। আলী (আ.) আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে কোনো কিছুকেই ভয় করে না।
আলী (আ.) হচ্ছে প্রথম মুসলমান। রাসূলে খোদার জন্য সে তার প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সে সর্বদা রাসূলের পাশে ছিল ও আছে এবং আর কেউই তার মতো রাসূলের নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে এতো বেশি আন্তরিক নয়।
হে মুসলমানগণ, আলী (আ.) হচ্ছে আমার ভাই, স্থলাভিষিক্ত ও আমার শিক্ষায় শিক্ষিত। সে আমার উম্মতের নেতা-কোরানের তাফসির যার জানা। সে কোরানের দিকে আহ্বানকারী এবং কুরানের নির্দেশ বাস্তবায়নকারী। সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। সে আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে আল্লাহ বিরোধীদের শত্রু এবং আল্লাহপ্রেমীদের বন্ধু। সে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে জনগণকে বিরত রাখে।
রাসূলে খোদা (সা.) এর আগেও বহুবার আলী (আ.)-র বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথা ঘোষণা করেছেন। ইবনে আব্বাসসহ আরো অনেকের বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলের পরে আলী (আ.)-ই ছিলেন সবচেয়ে মোত্তাকি ও সাহসী ব্যক্তি। জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারি বলেছেন, একবার রাসূল (সা.)-র কাছে আলী (আ.) এলেন। রাসূল বললেন, আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা কিয়ামতে পরিত্রাণপ্রাপ্ত। এ সময় সূরা বাইয়ানার ৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে এবং সতকাজ করেছে, তারা আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। এরপর থেকে রাসূলের সাহাবিরা আলী (আ.)-কে দেখলেই বলতেন, ওই যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
আল্লাহর নির্দেশে ১৮ই জ্বিলহজ্ব রাসূল (সা.), হজরত আলী (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করায় দিনটি হয়েছে মহিমান্বিত। এ দিনেই আল্লাহ ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুগ্রহ সম্পন্ন করেছেন। এই মহা অনুগ্রহের জন্য সব মুসলমানের উচিত আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এ কারণে যখনি ঈদে গাদির উপস্থিত হয় তখনি সব মুসলমানের উচিত এ দেয়া করা:
'আলহামদুল্লিল্লাযি জায়ালনা মিনাল মুতামাস্সিকিনা বিবিলায়াতি আমিরিল মুমিনিন।'
অর্থাত- আমিরুল মুমেমিন হজরত আলী (আ.)-এর নেতৃত্বের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হিসেবে সৃষ্টি করার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করছি।(সংগৃহীত)