নবুওয়াতের শুরুতেই ইসলামের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল তার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। তন্মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথী ও সমর্থকদের দৃঢ়তা। আপনারা ইতোমধ্যে মুসলমানদের নেতৃবর্গের ধৈর্য ও সহনশীলতার কতিপয় উদাহরণের সাথে পরিচিত হয়েছেন। পবিত্র মক্কায় (যা ছিল শিরক ও মূর্তিপূজার কেন্দ্রবিন্দু) তাঁর যে সব সমর্থক জীবনযাপন করতেন তাঁদের ধৈর্য ও সহনশীলতাও ছিল বেশ প্রশংসনীয়। এখন পবিত্র মক্কার অসহায় পরিবেশে মহানবী (সা.)-এর যে কয়জন ত্যাগী সঙ্গী অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন অথবা নির্যাতন ভোগ করার পর ধর্ম প্রচারের জন্য পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করেছেন তাঁদের জীবনী আমরা বিশ্লেষণ করব :
১. বিলাল হাবাশী : তাঁর পিতামাতা ঐ ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাঁদেরকে হাবাশাহ্ (আবিসিনিয়া) থেকে জাযীরাতুল আরব অর্থাৎ আরব উপদ্বীপে বন্দী করে আনা হয়েছিল। বিলাল যিনি পরে মহানবী (সা.)-এর মুয়াযযিন হয়েছিলেন তিনি উমাইয়্যা বিন খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন। উমাইয়্যা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খুব বড় ভয়ঙ্কর শত্রু ছিল। যেহেতু বনি হাশিম মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তা ও রক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল,তাই সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তার সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ক্রীতদাসকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করত। সে তাঁকে সবচেয়ে তপ্ত দিনগুলোতে খালি শরীরে তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে তাঁর বুকের ওপর একটি প্রকাণ্ড তপ্ত পাথর চাপা দিয়ে রাখত এবং তাকে নিম্নোক্ত কথাগুলো বলত :
لا تزالُ هكذا حتّى تموت أوْ تكفرَ بمُحمّدٍ و تعبدَ اللّاتَ و العُزّى
“তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত অথবা মুহাম্মদের স্রষ্টায় অবিশ্বাস অথবা লাত ও উজ্জার ইবাদাত না করা পর্যন্ত তুমি এ অবস্থায় থাকবে।”
কিন্তু বিলাল এতসব উৎপীড়ন ও নির্যাতন সত্ত্বেও দু’টি কথার মাধ্যমে উত্তর দিয়েছিলেন যা ছিল তাঁর দৃঢ় ঈমানী শক্তি ও প্রবল প্রতিরোধের পরিচায়ক। তিনি বলতেন,أحدٌ أحدٌ “আহাদ! আহাদ (অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়)! আমি কখনই শিরক ও মূর্তিপূজার দিকে প্রত্যাবর্তন করব না।” এ কৃষ্ণাঙ্গ দাস যিনি পাষণ্ড হৃদয় উমাইয়্যার হাতে বন্দী ছিলেন তাঁর দৃঢ়তা ও তীব্র প্রতিরোধ অন্যদেরকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল,এমনকি ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল তাঁর অতি দুরবস্থা দর্শন করে কেঁদেছিলেন এবং উমাইয়্যাকে বলেছিলেন,“মহান আল্লাহর শপথ,যদি তুমি তাকে (বিলাল) এ অবস্থায় হত্যা করে ফেল তাহলে আমি তার সমাধিকে যিয়ারত গাহে (মাযার) পরিণত করব।”১
কখনো কখনো উমাইয়্যা অতি নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করত। সে বিলালের ঘাড়ে মোটা রশি বেঁধে তাকে বালকদের হাতে তুলে দিত। আর ঐসব বালক তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাত।২
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে উমাইয়্যা তার পুত্রসহ বন্দী হয়েছিল। কতিপয় মুসলমান উমাইয়্যার হত্যার পক্ষে মত না দিলে বিলাল বলেছিলেন,সে কুফর ও কাফিরদের নেতা। তাই তাকে হত্যা করা উচিত। আর তাঁর পীড়াপীড়ি করার কারণে উমাইয়্যা ও তৎপুত্রকে তাদের নিজেদের অত্যাচারমূলক কার্যকলাপের শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা হয়।
২. আম্মার ইবনে ইয়াসির ও তাঁর পিতা-মাতা : আম্মার ও তাঁর পিতামাতা (ইয়াসির ও সুমাইয়া) ইসলাম গ্রহণকারী অগ্রবর্তীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দীন প্রচার কেন্দ্র যখন আরকাম ইবনে আবি আরকামের বাড়িতে ছিল তখন তাঁরা (আম্মার ও তাঁর পিতা-মাতা) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মুশরিকরা যেদিন তাঁদের ঈমান আনয়ন ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বিষয়টি জানতে পারল তখন তারা তাঁদের ওপর নির্যাতন ও উৎপীড়ন চালাতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করল না। ইবনে আসীর লিখেছেন,“মুশরিকরা এ তিন ব্যক্তিকে দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত মুহূর্তে তাঁদের নিজেদের বাড়ী ঘর ছেড়ে মরুভূমির তপ্ত উষ্ণ বাতাস ও প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে অবস্থান করতে বাধ্য করত। এ সব শারীরিক নির্যাতনের এতটা পুনরাবৃত্তি করা হতো যে,এর ফলে ইয়াসির প্রাণত্যাগ করেন। একদিন ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়া এ ব্যাপারে আবু জাহলের সাথে ঝগড়া করেছিলেন। তখন ঐ পাষণ্ড হৃদয় ব্যক্তিটি বর্শা নিয়ে সুমাইয়ার বক্ষে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে। এ নারী ও পুরুষের অতি শোচনীয় এ অবস্থা মহানবীকে তীব্রভাবে দুঃখভারাক্রান্ত করেছিল। একদিন মহানবী (সা.) এ দৃশ্য দেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,“হে ইয়াসির পরিবার! ধৈর্যধারণ কর। কারণ তোমাদের স্থান হচ্ছে বেহেশত।”
ইয়াসির ও তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আম্মারের সাথে তারা অত্যন্ত কঠোর আচরণ করে এবং তাঁকেও বিলালের মত নির্যাতন করতে থাকে। তিনি তাঁর প্রাণ রক্ষা করার জন্য বাহ্যত ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু সাথে সাথে তিনি অনুতপ্ত হন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে মহানবী (সা.)-এর কাছে ছুঁটে আসেন। ঐ সময় তিনি অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। তিনি মহানবীর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁকে তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন,“তখন তোমার অভ্যন্তরীণ (আত্মিক) ঈমানে কি সামান্যতম দ্বিধা দেখা দিয়েছিল?” তিনি বললেন,“আমার হৃদয় তখন ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল।” রাসূল বললেন,“একটুও ভয় পেয়ো না। আর তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তোমার ঈমান গোপন রেখ।” তখন এ আয়াতটি আম্মারের ঈমান প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল,
)إلّا مَنْ أُكرِهَ و قلبُهُ مطمئنٌ بالأيمان(
“তবে যাকে বাধ্য করা হয়েছে,অথচ যার অন্তর ঈমানে পূর্ণ ছিল সে ব্যতীত।”(সূরা নাহল : ১০৬)
এটিই প্রসিদ্ধ যে,ইয়াসির পরিবার যাঁরা ছিলেন সবচেয়ে অসহায় তাঁদের ব্যাপারে আবু জাহল নির্যাতন ও উৎপীড়ন করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কারণে সে আগুন ও চাবুক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিল। তখন ইয়াসির,সুমাইয়া ও আম্মারকে টেনে-হিঁচড়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং খঞ্জরের আঘাত দিয়ে,প্রজ্বলিত আগুনে পুড়িয়ে এবং চাবুক মেরে তাঁদেরকে শাস্তি দেয়া হলো। এ ঘটনার এতবার পুনরাবৃত্তি করা হয় যে,এর ফলে সুমাইয়া ও ইয়াসির প্রাণত্যাগ করেন।
কুরাইশ যুবকগণ যারা এ ধরনের ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল তারা ইসলাম ধর্মের ধ্বংস সাধন করার ব্যাপারে তাদের যত অভিন্ন স্বার্থ ছিল তা সত্ত্বেও আম্মারকে ক্ষত-বিক্ষত দেহে আবু জাহলের নির্যাতন ও শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিল যাতে করে তিনি তাঁর নিহত পিতা-মাতার মৃতদেহ দাফন করতে পারেন।
৩. আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ : যে সব মুসলমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা পরস্পর আলাপ-আলোচনা করছিল যে,কুরাইশরা পবিত্র কোরআন সম্পর্কে শোনে নি। যদি আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি মসজিদুল হারামে গিয়ে যত উচ্চকণ্ঠে সম্ভব পবিত্র কোরআনের গুটিকতক আয়াত তেলাওয়াত করে তাহলে সেটি খুব ভালো হবে। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ অত্যন্ত সুললিত ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে (সূরা আর রাহমানের) নিম্নোক্ত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন,
)بسم اللهِ الرَّحمان الرَّحيم، الرَّحْمانُ علَّمَ الْقُرْآنَ خَلَقَ الإنْسانَ علَّمهُ البَيانَ( ...
“পরম করুণাময় ও পরম দাতা মহান আল্লাহর নামে। পরম করুণাময় (মহান আল্লাহ্) পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তিনি ভাষা ও কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন ...।”
এ সূরার বলিষ্ঠ ও সাবলীল বাক্যগুলো কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক ভীতির সঞ্চার করল। একজন অসহায় ব্যক্তির মাধ্যমে যে আসমানী আহবান তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছেছিল তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করার জন্য সকলে তাদের স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে এতটা প্রহার করল যে,তাঁর সমগ্র দেহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল এবং তিনি খুব মর্মান্তিক অবস্থার মধ্য দিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের কাছে ফিরে গেলেন। তবে তাঁরা সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন এ কারণে যে,অবশেষে পবিত্র কোরআনের জীবনসঞ্জীবনী আহবান শত্রুদের কর্ণে প্রবেশ করল।৩
ইসলাম ধর্মের যে সব ত্যাগী সৈনিক নবুওয়াতের সূচনালগ্নে অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে থেকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা আসলে এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সংক্ষেপে এতটুকুই যথেষ্ট।
৪. আবু যার : আবু যার ছিলেন চতুর্থ অথবা পঞ্চম মুসলমান।৪ অতএব,তিনি ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের প্রথম দিনগুলোতেই ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তীদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয়েছেন।
পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনা অনুসারে,মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের সূচনালগ্নে যাঁরা ঈমান এনেছেন ইসলামে তাঁদের বিরাট মর্যাদা রয়েছে।৫ আর যাঁরা পবিত্র মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন,আধ্যাত্মিক ফজীলত,মর্তবা ও মর্যাদার দিক থেকে তাঁরা যে সব ব্যক্তি ইসলামের প্রসার ও শক্তি অর্জনের পরে অর্থাৎ পবিত্র মক্কা বিজয়ের পরে ঈমান এনেছে তারা এক নয়। পবিত্র কোরআন এ সত্যটি বর্ণনা করেছে নিম্নোক্ত এ আয়াতে:
)لا يستوي منكم من انفق من قبل الفتح وقاتل أولئك أعظم درجة من الذين انفقوا من بعدُ وقاتلوا(
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা মক্কা বিজয়ের আগে (মহান আল্লাহর পথে) দান করেছে এবং জিহাদ করেছে তারা ঐ সব ব্যক্তি অপেক্ষা অধিকতর উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যারা মক্কা বিজয়ের পরে দান করেছে এবং জিহাদ করেছে।”(সূরা হাদীদ : ১০)
তথ্যসূচী ও টিকা :
১. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড পৃ. ৩১৮।
২. তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩৩; হযরত বিলালের ধৈর্য ও সাহসিকতার ব্যাপারে অধিক তথ্য পাওয়ার জন্য মাকতাবে ইসলাম, ৯ম বর্ষ, ৫ম থেকে ৭ম সংখ্যায় মহানবী (সা.)-এর মুয়াযযিন বিলাল হাবাশী প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
৩. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৪।
২১. উসদুল গাবাহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০১; আল ইসাবাহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪; আল ইস্তিয়াব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬২।
৪. السّابقون السّابقون أُولئك المقرَّبون “যারা অগ্রগামী-অগ্রবর্তী এবং প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী তারাই (মহান আল্লাহর) নিকটবর্তী।”-সূরা ওয়াকিয়াহ্ : ১০-১১;
)و السّابقون الأوّلون من المهاجرين و الأنصار و الّذين اتبعوهم بإحسان رضي الله عنهم و رضوا عنه و أعدّلهم جنّات تجري من تحتها الأنهار خالدين فيها أبدا ذالك الفوز العظيم(
“আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে অগ্রবর্তী ও সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী এবং যারা তাদেরকে ইহ্সানের সাথে অনুসরণ করেছে তাদের প্রতি মহান আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য এমন সব জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নহর ও ঝরনাসমূহ প্রবাহিত সেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। আর এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাফল্য।”-সূরা তওবা : ১০০।