মহানবী (সা.) কুরাইশ গোত্রপতিদেরকে তাঁর প্রসিদ্ধ উক্তির মাধ্যমে তাদের কোন প্রস্তাব গ্রহণ করার ব্যাপারে হতাশ করে দিলেন। তাঁর সেই প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উক্তি,“খোদার শপথ,যদি সূর্যকে আমার ডান হাতে এবং চন্দ্রকে আমার বাম হাতে বসানো হয় এ শর্তে যে,আমি ইসলাম প্রচার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকব,তাহলে মহান আল্লাহ্ যে পর্যন্ত আমার ধর্ম ইসলামকে জয়যুক্ত ও প্রচারিত না করবেন অথবা এ পথে আমার জীবন নিঃশেষ না হবে সে পর্যন্ত আমি এ কাজ থেকে বিরত থাকব না।” আর এরই সাথে তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় শুরু হয়ে যায়। কারণ ঐ দিন পর্যন্ত কুরাইশ গোত্র তাদের সকল আচার-আচরণে মহানবী (সা.)-এর সম্মান বজায় রাখত এবং তখনও তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নি। কিন্তু যখন তারা দেখলো যে,তাদের সংশোধন পরিকল্পনাসমূহ ভেস্তে গেছে তখন তারা তাদের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলে এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্মের প্রভাব ও বিস্তারকে যেভাবেই হোক বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। তারা এ পথে যে কোন ধরনের উপায় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে নি। এ কারণেই কুরাইশ গোত্রপতিগণ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে,তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ,নির্যাতন ও উৎপীড়ন এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁকে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে,সংস্কারক নেতা যিনি বিশ্ববাসীকে পথ-প্রদর্শন করার চিন্তা-ভাবনা করছেন তিনি অবশ্যই সকল অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রম ও আচরণ,শারীরিক ও মানসিক আঘাত ও ক্ষতির বরাবরে ধৈর্যাবলম্বন করবেন যাতে করে তিনি ধীরে ধীরে সকল সমস্যা ও জটিলতা সমাধান করতে সক্ষম হন। আর অন্যান্য সকল সংস্কারকের কর্মপদ্ধতিও ঠিক এমনই ছিল। আমরা এ কয়টি পাতায় কুরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কিছু ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনা করব। আর এর ফলে আমাদের সামনে মহানবী (সা.)-এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মহানবী (সা.) এক আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি (অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস,ধৈর্য,দৃঢ়তা এবং অবিচলতা) যা তাঁকে ভেতর থেকে সাহায্য করত তা ছাড়াও এক বাহ্য শক্তির অধিকারী ছিলেন যা তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করত। আর সে শক্তি ছিল বনি হাশিমের সাহায্য ও সমর্থন যার শীর্ষে ছিলেন হযরত আবু তালিব। কারণ আবু তালিব যখন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে কষ্ট ও যাতনা দেয়া সংক্রান্ত মারাত্মক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন তখন তিনি বনি হাশিম গোত্রের সকল ব্যক্তিকে ডেকে হযরত মুহাম্মদকে রক্ষা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে একদল ঈমানদার হওয়ার কারণে,আবার কেউ কেউ আত্মীয়তা ও রক্তসম্পর্ক থাকার কারণে হযরত মুহাম্মদকে রক্ষা ও সমর্থনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে কেবল আবু লাহাব এবং আরো দু’ব্যক্তি যারা মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রুদের মধ্যে গণ্য হয়েছে তারাই আবু তালিবের এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু বনি হাশিম গোত্রের এ প্রতিরক্ষা ব্যূহ মহানবী (সা.)-কে কতিপয় অনভিপ্রেত ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে নি। কারণ কুরাইশরা যেখানেই মহানবীকে একাকী পেত সেখানেই তারা তাঁর অনিষ্ট সাধন করা থেকে বিরত থাকত না। এখানে কুরাইশদের নির্যাতন ও যন্ত্রণা দেয়ার কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা হলো :
ক. আবু জাহল একদিন মহানবী (সা.)-কে সাফা পর্বতে দেখে অশালীন ও কটুক্তি করল এবং তাঁকে নির্যাতন ও কষ্ট দিল। মহানবী (সা.) তার সাথে কোন কথা বললেন না এবং সোজা বাড়ির দিকে গমন করলেন। আবু জাহল পবিত্র কাবার পাশে কুরাইশদের সভায় রওয়ানা হলো। হামযাহ্,যিনি রাসূলের চাচা ও দুধ ভ্রাতা ছিলেন,তিনি ঐ দিনই যখন শিকার থেকে ধনুক কাঁধে ঝুলিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন তিনি তাঁর পুরানো অভ্যাসবশত মক্কায় প্রবেশ করার পর নিজ সন্তান ও পরিবার-পরিজনের সাথে সাক্ষাৎ করার পূর্বেই পবিত্র কাবা তাওয়াফ ও যিয়ারত করতে গেলেন। এরপর কাবার চারপাশে কুরাইশদের যে বিভিন্ন সভা বসত সেখানে গেলেন এবং তাদের সাথে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করলেন।
তিনি এ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর নিজ ঘরের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাদআনের দাসী যে আবু জাহল কর্তৃক মহানবী (সা.)-কে নির্যাতন করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছিল সে হযরত হামযাকে বলল,“হে আবু আম্মারাহ্ (হযরত হামযার কুনিয়াহ্)! হায় যদি কয়েক মিনিট পূর্বে এ স্থান থেকে আমি যেমনভাবে ঘটনাটি ঘটতে দেখেছি ঠিক তেমনভাবে আপনি দেখতেন যে,আবু জাহল কিভাবে আপানার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গালিগালাজ ও কটুক্তি করেছে এবং তাকে কষ্ট ও যাতনা দিয়েছে!” ঐ দাসীর কথাগুলো হযরত হামযার মনে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলেছিল এবং তিনি পরিণতির কথা চিন্তা-ভাবনা না করে আবু জাহল থেকে নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
এ কারণেই যে পথে তিনি এসেছিলেন সেপথেই ফিরে গেলেন। আবু জাহলকে তিনি কুরাইশ গোত্রের মিলনায়তনে দেখতে পেলেন এবং তার কাছে গেলেন। কারো সাথে কোন কথা বলার পূর্বেই তিনি তাঁর ধনুক উঠিয়ে আবু জাহলের মাথার ওপর এমনভাবে আঘাত করতে লাগলেন যার ফলে তার মাথা ফেটে গেল। তিনি বললেন,“তুমি মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কটুক্তি ও কুৎসা করছ,অথচ আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং যে পথে তিনি গিয়েছেন সে পথে আমিও যাব। যদি তোমার কোন কিছু করার ক্ষমতা থাকে তাহলে আমার সাথে লড়াই করে দেখ।”১
ঐ সময় বনি মাখযূম গোত্রের একদল ব্যক্তি আবু জাহলের সাহায্যার্থে অগ্রসর হলো। কিন্তু যেহেতু সে একজন সুযোগ-সন্ধানী ও রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ ছিল তাই সে সব ধরনের যুদ্ধ ও সংঘর্ষ এড়িয়ে গেল এবং বলল,“আমি মুহাম্মদের সাথে খারাপ আচরণ করেছি এবং হামযারও অধিকার রয়েছে অসন্তুষ্ট হওয়ার।”২
অকাট্য সত্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,হামযার মতো সাহসী বীর পুরুষের অস্তিত্ব মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা এবং মুসলমানদের আত্মিক মনোবলের ওপর যথোপযুক্ত প্রভাব ফেলেছিল। উল্লেখ্য যে,হযরত হামযাহ্ পরবর্তীকালে ইসলামের অন্যতম প্রধান সেনাপতি ও সমরবিদ ছিলেন। ইবনে আসীর এতদ্প্রসঙ্গে লিখেছেন : “কুরাইশগণ হযরত হামযার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়কে মুসলমানদের উন্নতি ও মনোবল বৃদ্ধির কারণ বলে বিবেচনা করত।”৩
ইবনে কাসীর শামীর মতো কতিপয় ঐতিহাসিক৪ জোর দিয়ে বলেছেন,“হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের প্রভাবের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। এ দুই খলীফার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মুসলমানদের মান-মর্যাদা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির উপায় হয়েছিল।” তবে নিঃসন্দেহে প্রতিটি ব্যক্তি তাঁর যোগ্যতা অনুসারে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তবে কখনই এ কথা বলা সম্ভব নয় যে,হযরত হামযার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব ও ফলাফল যে মাত্রায় দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ঠিক সেই মাত্রায় এ দু’খলীফার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ হামযাহ্ ছিলেন ঐ ব্যক্তি যখন তিনি জানতে পারলেন যে,কুরাইশ নেতা আবু জাহল মহানবী সম্পর্কে অশালীন উক্তি করেছে তখন তিনি কোন ব্যক্তিকে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবহিত না করেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আঘাতকারী ব্যক্তির কাছে সরাসরি গিয়েছেন এবং তীব্র প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তখন কোন ব্যক্তি তাঁর সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সাহস পর্যন্ত করে নি। কিন্তু ইবনে হিশামের মতো বড় বড় সীরাত রচয়িতাগণ আবু বকর সম্বন্ধে এমন বিষয়ও বর্ণনা করেছেন যে,যে দিন হযরত আবু বকর মুসলমানদের পরামর্শস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন না তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন,না তিনি মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। নিম্নে আমরা ঘটনাটি বর্ণনা করব :
একদিন মহানবী (সা.) কুরাইশদের সমাবেশের পাশ দিয়ে গমন করছিলেন। হঠাৎ একত্রে কুরাইশগণ চতুর্দিকে থেকে তাঁকে ঘিরে ধরল এবং সবাই ব্যঙ্গচ্ছলে মহানবীর সাথে প্রতিমা ও কিয়ামত দিবসের ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে এবং বলতে থাকে,“তুমিই কি এরকম কথা বল?” মহানবী (সা.) তাদের কথার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন,نعم أنا الّذي أقول ذلك “হ্যাঁ,আমিই এসব কথা বলি।” যেহেতু কুরাইশগণ দেখতে পেল যে,মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করবে এমন কোন ব্যক্তি ময়দানে নেই তখন তারা মহানবীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি সামনে এসে মহানবীর পোশাকের প্রান্ত ধরলে পাশে দণ্ডায়মান আবু বকর মহানবীর সাহায্যার্থে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন এবং তিনি বলেছিলেন,
أ تقتلون رجلا أن يقول ربّي الله “তোমরা কি এমন এক ব্যক্তিকে ‘আমার প্রভু আল্লাহ্’-এ কথা বলার জন্য হত্যা করতে চাও?” এরপর (বিভিন্ন কারণবশত) তারা মহানবীকে হত্যার পরিকল্পনা বাদ দেয়। মহানবী (সা.) নিজ পথে গমন করলেন এবং হযরত আবু বকর ঐ অবস্থায় নিজ গৃহমুখে রওয়ানা হলেন যখন তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল।৫
এ ঐতিহাসিক বর্ণনা যতটা মহানবীর প্রতি খলীফা আবু বকরের ভক্তি,ভালোবাসা ও আবেগের সাক্ষ্য দেয় তার চেয়ে ঢের বেশি খলীফা আবু বকরের অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে। এ ঘটনা থেকে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হলো : ঐ দিন খলীফা আবু বকর না শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন,আর না তিনি তেমন কোন সামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আবার যেহেতু মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের পরিণতি খুব খারাপ ছিল এ কারণেই কুরাইশগণ তাঁকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সহযোগীকে তীব্রভাবে মারধর করেছিল এবং তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। যখনই আপনারা হযরত হামযাহ্ ও তাঁর সাহস,বিক্রম ও বীরত্বের ঘটনাটি এ ঘটনার পাশাপাশি তুলনা করবেন তখন আপনারাই ফায়সালা করতে পারবেন যে,ইসলামের প্রাথমিক যুগে আসলে এ দু’ব্যক্তির মধ্যে কার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে ইসলাম ধর্মের সম্মান ও শক্তি এবং কাফিরদের ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল।
মহানবী (সা.)-এর পিছনে আবু জাহলের ওঁৎ পেতে থাকা
ইসলাম ধর্মের উত্তরোত্তর প্রসার ও উন্নতি কুরাইশদেরকে তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট করেছিল। প্রতিদিনই কুরাইশ বংশীয় কোন না কোন ব্যক্তির ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছত। এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মক্কা নগরীর ফিরআউন বলে খ্যাত আবু জাহল একদিন কুরাইশদের সমাবেশে বলেই ফেলল,
إنّ محمّدا قد أتى ما ترون من عيب ديننا و شتم أبائنا و تسفيه أحلامنا و شتم آلهتنا
“(হে কুরাইশগণ!) তোমরা কি দেখছ না যে,মুহাম্মদ কিভাবে আমাদের ধর্মকে মন্দ বলে বিবেচনা করছে। আমাদের বাপ-দাদা অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের ধর্ম এবং তাদের দেবতাদেরকে মন্দ বলছে এবং আমাদেরকে নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন বলে গণ্য করছে। মহান আল্লাহর শপথ,আমি আগামীকালই তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকব এবং আমার পাশে একটি পাথর রাখব। মুহাম্মদ যখন সিজদাহ্ করবে তখন ঐ পাথরটি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেব।”৬
পরের দিন মহানবী (সা.) নামায পড়ার জন্য মসজিদুল হারামে আসলেন এবং রুকনে ইয়েমেনী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানে নামাযে দাঁড়ালেন। একদল কুরাইশ আবু জাহলের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। আবু জাহল কি এ প্রতিরোধ সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত সফল ও বিজয়ী হতে পারবে-এ ব্যাপারে তারা চিন্তামগ্ন হয়েছিল। মহানবী সিজদাহ্ করার জন্য মাটির ওপর মাথা রাখলেন। ঐ পুরানো শত্রু লুকিয়ে ওঁৎ পেতে থাকার স্থান থেকে বেরিয়ে আসল এবং মহানবীর দিকে এগিয়ে গেল। তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার অন্তরের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক ভীতির সঞ্চার হলো। সে ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাংশুটে মুখ নিয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। সবাই দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞাসা করল,“হে আবুল হাকাম! কী খবর?” সে খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল,“এমন এক দৃশ্য আমার সামনে ফুটে উঠেছিল যা আমি আমার সমগ্র জীবনেও দেখি নি। এ কারণে আমি আমার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছি।” আবু জাহলের এ উক্তিটি থেকে প্রমাণিত হয় যে,সে এ ক্ষেত্রে কতটা ভীত ও আতংকগ্রস্ত হয়েছিল!
এ ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে,মহান আল্লাহর আদেশে একটি গায়েবী শক্তি মহানবীর সাহায্যার্থে অগ্রসর হয়ে এ ধরনের ভীতিকর দৃশ্যের অবতারণা করেছিল এবং মহানবী (সা.)-এর অস্তিত্বকে মহান আল্লাহরই প্রদত্ত অকাট্য ঐশী অঙ্গীকার অনুযায়ী শত্রুদের দংশন থেকে হেফাজত করেছিল। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ওয়াদাটি أنّا كفيناك المستهزئين ‘আমরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকারীদের অনিষ্ট থেকে তোমাকে রক্ষা করব’-এ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।
কুরাইশদের অকথ্য উৎপীড়ন ও নির্যাতনের কাহিনীর নমুনাগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। ইবনে আসীর৭ এ প্রসঙ্গে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মক্কায় মহানবীর ভীষণ একগুঁয়ে শত্রুদের নাম এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের উৎপীড়ন ও নির্যাতনপদ্ধতির একটি বর্ণনা দিয়েছেন। যা কিছু ওপরে উল্লিখিত হয়েছে তা ছিল আসলে কয়েকটি নমুনা মাত্র। তবে মহানবী (সা.) প্রতিদিনই নতুন করে বিশেষ ধরনের উৎপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতেন। যেমন একদিন উকবা ইবনে আবু মুঈত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাওয়াফরত অবস্থায় দেখে বেশ গালিগালাজ করল। তাঁর মাথার পাগড়ি তাঁর গর্দানে পেঁচিয়ে তাঁকে মসজিদুল হারামের বাইরে আনলে বনি হাশিমের ভয়ে একদল লোক মহানবী (সা.)-কে তার হাত থেকে মুক্ত করেছিল।৮
মহানবী (সা.) তাঁর নিজ চাচা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীলের পক্ষ থেকে যে উৎপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা ছিল সত্যিই বেদনাদায়ক। মহানবী (সা.)-এর বাড়ি তাদের বাড়ির পাশেই ছিল। তারা মহানবীর পবিত্র মাথা ও বদনমণ্ডলে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে দ্বিধাবোধ করত না। একদিন তারা তাঁর মাথার ওপর একটি দুম্বার জরায়ু নিক্ষেপ করেছিল। অবশেষে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে,হযরত হামযাহ্ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ঠিক ঐ জিনিসই আবু লাহাবের মাথার ওপর ফেলেছিল।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রুগণ
হিজরতোত্তর যে সব ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সে সব ঘটনার মধ্যে গুটিকতক ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর কতিপয় শত্রুর পরিচিতি গুরুত্বহীন হবে না। আমরা এখানে সংক্ষেপে কতিপয় শত্রুর নাম ও বিশেষত্বগুলো তুলে ধরব :
১. আবু লাহাব : মহানবী (সা.)-এর প্রতিবেশী ছিল। সে কখনই মহানবী ও মুসলমানদের প্রত্যাখ্যান ও নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকত না।
২. আসওয়াদ ইবনে আবদ ইয়াঘূস : সে ছিল একজন ভাঁড়। যখনই সে কোন নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন মুসলমানকে দেখতে পেত তখনই সে ভাঁড়ামিবশত বলত,“এসব নিঃস্ব সহায়-সম্বলহীন নিজেদেরকে পৃথিবীর বুকে বাদশাহ্ বলে মনে করে এবং ভাবছে যে,তারা শীঘ্রই ইরানের শাহের রাজমুকুট ও সিংহাসন দখল করে নেবে।” তবে মৃত্যু তাকে দেখার সুযোগ দেয় নি যে,মুসলমানরা কিভাবে কায়সার (রোমসম্রাট) ও কিসরার (পারস্যসম্রাট) রাজত্ব ও সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছে!
৩. ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ্ : সে ছিল কুরাইশ বংশীয় বৃদ্ধ ধনাঢ্য ব্যক্তি যার ছিল অঢেল সম্পত্তি। মহানবী (সা.)-এর সাথে তার আলোচনা আগামী অধ্যায়ে আমরা বর্ণনা করব।
৪. উমাইয়্যা ইবনে খালাফ এবং উবাই ইবনে খালাফ : একদিন উবাই নরম ও পঁচে যাওয়া হাড্ডিগুলো হাতে নিয়ে মহানবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল,إنَّ ربَّك يُحيي هذه العظامَ “তোমার প্রভু কি এ সব অস্থি পুনরুজ্জীবিত করবেন?” তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো :
)قل يحييها الّذي أنشأها أوّل مرّةٍ(
“আপনি বলে দিন,প্রথমবার যিনি তা সৃষ্টি করেছেন তিনিই তা পুনরুজ্জীবিত করবেন।”(সূরা ইয়াসীন : ৭৮-৭৯)
৫. আবুল হাকাম বিন হিশাম : ইসলাম ধর্মের প্রতি তার অযৌক্তিক শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণে মুসলমানরা আবুল হাকাম ইবনে হিশামকে আবু জাহল (মূর্খের পিতা) বলে অভিহিত করেছিল। সেও বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।
৬. আস ইবনে ওয়ায়েল : সে আমর ইবনে আসের পিতা যে মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলেছিল।
৭. উকবাহ্ ইবনে আবি মুঈত : সে মহানবী (সা.)-এর ভয়ঙ্কর শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিল। সে মহানবী ও মুসলমানদের ওপর জুলুম করা থেকে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকত না।৯
আবু সুফিয়ানের মতো আরো একদল ব্যক্তি রয়েছে যাদের সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিকগণ লিপিবদ্ধ করেছেন। আর আমরা বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য তা এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।
তথ্যসূচী ও টিকা :
১. فضربه بها فشجه شحة منكرة ثمّ قال أ تشتمه فأنا على دينه أقول ما يقول فردّ ذلك عليّ إن استطعت
২. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৩; তারিখে তাবারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২।
৩. আল কামিল ফীত তারিখ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৯।
৪. আল বিদায়াহ্ ওয়ান নেহায়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৬।
৫. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১; তাবারী খলীফা আবু বকরের মাথা ফেটে যাবার পুরো ঘটনা তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৭২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন।
৬. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮-২৯৯।
৭. আল কামিল ফীত তারীখ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭।
৮. বিহারুল আনওয়ার, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ২০৪।
৯. আল কামিল ফীত তারীখ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭-৫১; উসদুল গাবাহ্; আল ইসাবাহ্; আল ইসতিয়াব।