[বক্ষমান নিবন্ধটি ড. সাইয়্যেদ জাফর শাহীদী রচিত বিখ্যাত ‘কেয়ামে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম’(ইমাম হুসাইনের অভ্যুত্থান)-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ফার্সী ভাষায় রচিত এ বিখ্যাত গ্রন্থটি কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের পর পরই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভক্ত-অনুরক্তদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। লেখক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবত এ বিষয়ে যে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন এ মূল্যবান গ্রন্থে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার কারণেই তিনি ইতিহাসের এ বিয়োগান্ত ঘটনার এমন কতক অন্ধকার দিক অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন যার প্রতি এ বিষয়ে লিখিত অন্যান্য ইতিহাসবিদদের রচনায় কদাচিৎ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। তেহরান থেকে প্রকাশিত আল তাওহীদ সাময়িকীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজী অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে]
‘কারবালা’নামক জায়গাটির এ নাম কেন হলো সে সম্পর্কে যেসব মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে বাস্তবতার অধিকতর নিকটবর্তী অভিমত হচ্ছে এই যে,এ নামটি ‘র্কাব’ও ‘আল’শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে। আরামী ভাষায় ‘র্কাব’মানে ‘কৃষিক্ষেত্র’এবং ‘আল’মানে ‘খোদা’। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার শত শত বছর পূর্ব থেকেই ‘কারবালা’নামের তাৎপর্য সম্পর্কে এ ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে হিজরী ৬১ সালে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা সংঘটিত হবার পর থেকে এ নামটির ওপর আরবী তাৎপর্য আরোপ করা হয় এবং এটিকে আরবী শব্দ ‘র্কাব’(দুঃখ) ও ‘বালা’(বিপদ-মুসিবত)-এর সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে উদ্ঘাটিত এ ঘটনা সংক্রান্ত কতক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে,হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাফেলা যখন ঐ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তখন তিনি এর নাম জিজ্ঞাসা করলে ঐ ভূখণ্ডের সাথে পরিচিত লোকেরা জবাব দেন : “এ হচ্ছে কারবালা।”তখন তিনি বলেন : “হে আল্লাহ্! আমি ‘র্কাব’(দুঃখ) ও ‘বালা’(মুসিবত) থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
মক্কার পরে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ভূমি
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাফেলার কারবালায় প্রবেশ ও অবস্থান গ্রহণ করার পর থেকে এ ভূখণ্ডটি ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ করে শিয়াদের নিকট এতই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে,আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে,ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র মক্কা নগরীর পরে অন্য কোন ভূখণ্ডই এত বিখ্যাত হয়ে ওঠে নি। কারবালায় ইমাম হুসাইনের কবরের ওপর নির্মিত মাযার যিয়ারতের জন্য নিয়মিত মুসলমানদের আগমন ঘটছে। বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যার অন্তর এ পবিত্র স্থান যিয়ারতের জন্য অদম্য আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ নয়।
অতীতে শিয়া মুসলমানদেরকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে কারবালায় যিয়ারতে যেতে হতো। তৎকালে সফর করা সহজ ছিল না। তখন চলার পথে অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু সফর এত কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও শিয়া মুসলমানরা দীর্ঘ সড়ক পথে রওয়ানা হয়ে কারবালায় উপনীত হতো এবং তাদের প্রিয় ইমামের মাযারে অশ্রুপাত করত। তাদের অশ্রুপাত যেন ইমামকে প্রদত্ত উপহার অথবা ইমামের সাথে কৃত অঙ্গীকারের নিদর্শন যার সাহায্যে তারা সেই পবিত্র শহীদের সাথে স্বীয় আন্তরিক মুহব্বতের সম্পর্ককে নবায়ন করে যার মস্তকবিহীন দেহ এ সমাধির নিচে শায়িত আছে।
অসংখ্য মানুষ এ পবিত্র মাযারের পাশে ঘণ্টাখানেক কাটাবার লক্ষ্যে দীর্ঘ কষ্টকর সফরে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে অথবা এর জন্য তাদের ধন-সম্পদের একটা বিরাট অংশকে উৎসর্গ করেছে। অনেক নারী-পুরুষ কারবালায় গমনের পথে মৃত্যুবরণ করেছে এবং এ জীবনে কারবালার মাটি চুম্বনের স্বপ্ন পূরণের জন্য আরো কিছুদিন বেঁচে থাকে নি,বরং অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। ইরাকের কারবালা নগরী ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাযারের উন্নয়ন ও দেখাশোনা এবং পরিচর্যার জন্য বিশ্বের সর্বত্র শিয়া মুসলমানদের পক্ষ থেকে বিরাট বিরাট কৃষিক্ষেত্র ও বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের রচিত সাহিত্যে এমন ধর্মীয় কবিতা ও শোকগাথা কদাচিৎ চোখে পড়ে যাতে কারবালা ও সেখানকার শহীদানের কথা উল্লিখিত হয় নি।
ন্যায়নীতি বনাম স্বৈরতন্ত্রের সংঘাতের প্রতীক
কারবালা কেবল ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাযার বক্ষে ধারণকারী ভূখণ্ড নয়,বরং এ হচ্ছে এমন এক ভূখণ্ড যেখানে নিরঙ্কুশ ন্যায়নীতি নিরঙ্কুশ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করেছে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এ হচ্ছে এমন এক ভূখণ্ড যেখানে সেই সব মহান মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন যাঁরা লাঞ্ছনার জীবনের ওপরে মৃতুকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে ইবনে সা’দের বাহিনীতে শামিল হয়ে লড়াই করেছিল এমন এক ব্যক্তিকে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার বহু বছর পরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : “কি কারণে তোমরা এমন ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত করলে? কেন তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নাতিকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে এরূপ অমানুষিকভাবে শহীদ করলে এবং তাঁদের রক্তে মাটি রঞ্জিত করলে?”তখনো সে ঔদ্ধত্যের সাথে জবাব দিয়েছিল : “চুপ করো! তারা ছিল একটি জঙ্গী গোষ্ঠী যারা তলোয়ার হাতে আমাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিল। তারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে আসে। তারা না ক্ষমা ভিক্ষা করতে প্রস্তুত ছিল,না তারা পার্থিব সম্পদের দ্বারা প্রলুব্ধ হচ্ছিল। তাদের নিকট মাত্র দু’টি বিকল্প গ্রহণযোগ্য ছিল-হয় তারা আমাদেরকে হত্যা করত বা ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করে সরকারী ক্ষমতা দখল করত অথবা নিহত হতো। তোমার মা তোমার মৃত্যুতে শোকানুষ্ঠানে বিলাপ করুক;আমরা যা করেছি তা ছাড়া আর কি করতে পারতাম।”এ সংক্ষিপ্ত কথোপকথন থেকেই সে বিয়োগান্তক ঘটনার দিনের পরিস্থিতির চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এ কথোপকথন থেকে সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের সম্পর্কে তাঁদের বিরোধীদের একজনের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। এ কথোপকথন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর এ সংক্ষিপ্ত উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে,তিনি বলেছিলেন : “আমার নিকট মৃত্যু সুখ-শান্তি বৈ অন্য কিছু নয়,অন্যদিকে স্বৈরাচারীদের সাথে বসবাস চরম দুঃখ-দুর্দশা বৈ আর কিছুই নয়।”
যে রাতে হযরত হুসাইন (আ.)-এর সঙ্গীসাথীরা মুসলিম ইবনে আকীল ও হানী ইবনে ওরওয়ার শাহাদাতের সংবাদ এবং কুফার অধিবাসীদের তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আর অঙ্গীকার ভঙ্গ ও আনুগত্য পরিত্যাগের কথা তাঁকে অবহিত করলেন,তখন তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে এ ব্যাপারে পূর্ণ ইখতিয়ার দিলেন যে,তাঁরা চাইলে তাঁর সাথে থাকতে পারেন অথবা চাইলে তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তখন তাঁর কাফেলার অন্তর্ভুক্ত একদল লোক সে রাতেই তাঁকে পরিত্যাগ করে। কেবল তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং সেই সাথে তাঁর কতক পরহেজগার অনুসারী তাঁর সাথে থেকে যান। এরপর থেকে হুর ইবনে ইয়াযীদ আর রিয়াহী কর্তৃক কাফেলার গতিরোধ করার পূর্ব পর্যন্ত দু’জন ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাঁর কাফেলায় যোগদান করে নি;অবশ্য কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পূর্ব রাতে হুর ইবনে ইয়াযীদ সহ কয়েকজন লোক ইবনে সা’দের সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে ইমামের শিবিরে আগমন করেন ও তাঁর সাথে যোগদান করেন।
কিন্তু তাঁদের মধ্যে কত জন শেষ পর্যন্ত ইমামের সাথে ছিলেন? ঐতিহাসিকদের মতে,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শিবিরে যোদ্ধার সংখ্যা একশ’র বেশি ছিল না। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে উদ্ধৃত সংখ্যা হচ্ছে ৭০,৭২ ও ৭৫ জন যা বাস্তবতার অধিকতর নিকটবর্তী।
অনুরূপভাবে,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ইবনে সা’দের সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কেও মতপার্থক্য আছে। কারবালার ঘটনার পরবর্তী প্রাথমিক যুগের কতক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী ইবনে সা’দের সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল আশি হাজার থেকে এক লক্ষের মধ্যে। অন্যদিকে মাসউদী ও তাবারী প্রমুখ ইতিহাসবিদ ইয়াযীদের সপক্ষে ইবনে সা’দের বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের সংখ্যা চার হাজার বলে উল্লেখ করেছেন।
শিয়া মাযহাবের বিভিন্ন সূত্রে ইবনে সা’দের সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সম্বন্ধে যেসব বর্ণনা এসেছে তাতে তার বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমপক্ষে ২০ হাজার ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু সে সময় বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হয় বিধায় বহু সুবিধাবাদী লোক সেনাবাহিনীতে যোগদান করে,সেহেতু বিশ হাজার সংখ্যাটিতে অতিশয়োক্তি নেই বলে মনে করা যেতে পারে। তবে আমরা ইবনে সা’দের বাহিনীর সৈনসংখ্যা মোটামুটি ছয় থেকে আট হাজারের মধ্যে ছিল বলে ধরে নিতে পারি।
কুফার উমাইয়্যা আমীর ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নির্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাকারী ইবনে সা’দ ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের পুত্র। সা’দ ছিলেন কাদেসিয়ার যুদ্ধে বিজয়ী ইসলামী বাহিনীর সেনাপতি। বলা হয় যে,সা’দের তীর ছিল ইসলামের দুশমন বাহিনীর বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত ইসলামের প্রথম তীর। কিন্তু দুভার্গ্যজনক যে,মাত্র অর্ধ শতাব্দীর ব্যবধানে তাঁর পুত্র এক বিরাট দুর্ধর্ষ বাহিনী প্রস্তুত করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় নাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে,ইবনে সা’দের পিতা স্বীয় সৈন্যদেরকে উৎসাহিত করার জন্য যে উদ্দীপনাময় বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন ইবনে সা’দ তার সৈন্যদেরকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সেই একই বাক্য উচ্চারণ করে। সে বলে : “হে আল্লাহর সৈন্যরা! তোমরা তোমাদের অশ্বগুলোকে ধাবিত করো;আমি তোমাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছি।”এ বাক্যের দ্বারা সা’দ বুঝাতে চেয়েছিলেন যে,আল্লাহর দুশমনদের হত্যা করে বিজয়ী হওয়া বা এ পথে শহীদ হওয়া উভয়ই সৌভাগ্যের পরিচায়ক। অতএব,সুসংবাদ! ইবনে সা’দও স্বীয় যুদ্ধ সম্পর্কে একই দাবী করে যদিও প্রকৃত অবস্থা ছিল তার পিতার যুদ্ধের অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এখানে প্রশ্ন জাগে,ইয়াযীদ-বাহিনীর সেনাপতি যা বলেছিল সত্যিসত্যিই কি সে তা বিশ্বাস করত? নাকি সে ঔদ্ধত্যের এমন এক নজিরবিহীন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে,সে এ ধরনের জঘন্য মিথ্যাচার করতে মোটেই লজ্জাবোধ করে নি? তবে এর সম্ভাবনাই বেশি যে,সে এ ধরনের নির্লজ্জ ধৃষ্টতার পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল বলেই এ কথা বলেছিল। কারণ তার আচরণ ছিল তার কথার চেয়েও জঘন্যতর। অথবা এমনও হতে পারে যে,পরবর্তীকালে যেসব ইতিহাসবিদ এ ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন তাঁরা তার মুখে এ বাক্যটি যোগ করেছিলেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ই ভাল জানেন। তবে একটি বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি,তা হচ্ছে এই যে,হিজরী প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে মুসলিম সমাজ নৈতিক অধঃপতনের এমন অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল যে,এ ধরনের কথা উচ্চারণ ও এ ধরনের কাজ করা তাদের নিকট লজ্জাজনক মনে হতো না,বরং এ ছিল তাদের প্রাত্যহিক স্বাভাবিক আচরণের অংশ। তৎকালে মুসলিম উম্মাহর নেতাদের নিকট কেবল একটি বিষয়ই ছিল গুরুত্ববহ,তা হচ্ছে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদসমূহ দখল করা। আর যারা এসব নেতার অনুসরণ করত তাদের নিকটও কেবল একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে পরিগণিত হতো;আর তা হচ্ছে,যে কোন মূল্যে স্বীয় অধিনায়ক ও রাজনৈতিক নেতাকে সন্তুষ্ট করা। ইবনে সা’দ চাইলে এ জঘন্য দায়িত্ব গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারত। কিন্তু সে তা করলে কুফার আমীর ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ তাকে শাস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করত না। কারণ তখন এমন আরো অনেক সেনাধিনায়ক ছিল যারা স্বেচ্ছায় এ জঘন্য দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতো। অবশ্য কেবল অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরই এ দায়িত্ব লাভ সম্ভব ছিল,আর খুব কম সংখ্যক লোকের পক্ষেই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল। হতে পারে যে,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে অভিযানে বের হবার সময় এসব ব্যক্তি এর আসন্ন তিক্ততম পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে নি। তারা হয়তো খুব সাদামাটা হিসাব-নিকাশ করেছিল এবং মনে মনে আশা করেছিল যে,সব কিছুর শুভ সমাপ্তি হবে এবং এ অভিযানের মাধ্যমে সৃষ্ট চাপের পরিণতিতে ইমাম হুসাইন সন্ধি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদনে বাধ্য হবেন। কিন্তু এ ধরনের পূর্ব ধারণা পোষণ করার মাধ্যমে তারা শুধু আত্মপ্রতারণাই করেছিল। তবে ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ ইমাম হুসাইনকে ভালোভাবেই চিনত এবং জানত যে,এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে আপোস করার মতো লোক তিনি নন।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথে প্রথম দফা আলোচনা সমাপ্ত হওয়ার পর ইবনে সা’দ কুফার আমীর ইবনে যিয়াদকে চিঠি লিখে আলোচনার ফলাফল অবগত করে। এতে ইবনে সা’দ লিখেছিল : “আল্লাহর শোকর যে,বিজ্ঞজনোচিতভাবে সঙ্কটের সমাধান হয়েছে এবং যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয় নি। হুসাইন নিম্নোক্ত বিকল্পসমূহের যে কোন একটি গ্রহণ করতে প্রস্তুত :
১. মক্কায় প্রত্যাবর্তন ও একজন সাধারণ মুসলিম হিসাবে জীবন-যাপন;
২. হিজায ছাড়া,এমনকি ইরাক ছাড়া অন্য যে কোন ভূখণ্ডে হিজরত;অথবা
৩. দামেশকে গমন ও সেখানে ইয়াযীদের নিকট আনুগত্যের শপথ পাঠ।”
ইবনে সা’দের পত্রে উল্লিখিত বিকল্পসমূহের মধ্যে তৃতীয় বিকল্পটির দাবী সঠিক ছিল না,কারণ ইমাম হুসাইন (আ.) এ ধরনের কোন প্রস্তাব দেন নি। কতক ইতিহাসবিদ জোর দিয়ে বলেছেন যে,এ দায়িত্ব পালন করার জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো গুরুভার বহন ও অনেক বেশি ঝামেলা এড়ানোর লক্ষ্যে ইবনে সা’দ নিজের পক্ষ থেকে এই শেষোক্ত বিষয়টি জুড়ে দিয়েছিল। তবে এ ঘটনা সম্পর্কে তাবারী যে সব সম্ভাবনা অনুমান করেন তা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। তাবারী লিখেছেন যে,হযরত হুসাইন (আ.)-এর সাথে প্রথম দফা আলোচনা সমাপ্ত হবার পর ইবনে সা’দ কুফার আমীর ইবনে যিয়াদকে লিখেছিল : “আমি হুসাইনকে তাঁর এখানে আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি জবাব দিয়েছেন : কুফার অধিবাসীরা আমাকে তাদের সাথে এসে মিলিত হবার জন্য দাওয়াত করেছে। এখন তুমি যদি আমাকে সেখানে যেতে দিতে ইচ্ছুক না হও তাহলে আমি ফিরে যেতে প্রস্তুত।”১
ইবনে যিয়াদ জবাবে ইবনে সা’দকে লিখে পাঠায় : “এখন সে আমাদের মুঠোয় ধরা পড়েছে যা থেকে সে বেরিয়ে যেতে চায়,কিন্তু তা অসম্ভব।”অতঃপর সে ইমামের সাথে কঠোর আচরণ করার জন্য ইবনে সা’দকে নির্দেশ দেয় এবং ইমাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে ইয়াযীদের অনুকূলে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাদের জন্য ফোরাত নদী হতে পানি নিতে বাধা দেয়ারও নির্দেশ দেয়।
এখানে একটি বিষয় সুস্পষ্ট নয়। তা হচ্ছে শুরুতেই এ ধরনের কঠোর আচরণ,সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং শেষ পর্যন্ত তার নির্মম বাস্তবায়ন কি দামেশক থেকে জারীকৃত ইয়াযীদের হুকুমে কার্যকর করার লক্ষ্যেই করা হয়েছিল,নাকি কুফার শাসক ইবনে যিয়াদ নিজ উদ্যোগেই এরূপ করেছিল। হতে পারে যে,ইয়াযীদ ও ইবনে যিয়াদ উভয়ই এতে জড়িত ছিল। তবে রণাঙ্গণের কথোপকথন এবং কুফার জনগণের মধ্যে ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে ও পরবর্তীকালে ইয়াযীদের প্রাসাদে সংঘটিত আন্তঃক্রিয়া থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। তা হচ্ছে,শুরুতে কুফার জনগণ জানত যে,পরিণতি এ পর্যায়ে গড়াবে,এমনকি তারা এহেন নিষ্ঠুর পরিণতির প্রত্যক্ষদর্শী হতেও ইচ্ছুক ছিল না।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাকারী ইবনে সা’দের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে বীর হিসাবে খ্যাতি অর্জন ও রেই প্রদেশের গর্ভনর নিযুক্ত হওয়া,অন্যদিকে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যাকারী বাহিনীর সেনাপতি হওয়ার লজ্জা ও দুর্নামের ভয় করছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত সে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে নি ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে এ ভয় ছিল বলে আমরা মনে করতে পারি। কিন্তু এরপরে আমরা দেখতে পাই যে,সে যত না আল্লাহ্তায়ালার ক্রোধের ভয় করত তার চেয়ে বেশি ভয় করত জনগণের তিরস্কারকে। সে ভালোভাবেই জানত যে,মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এমন একদল লোক ছিলেন যাঁদের পক্ষে রাসূল (সা.)-এর নাতিকে হত্যার মতো অপরাধ করা সম্ভবপর ছিল না। (অবশ্য যেসব লোক ইবনে সা’দকে তার অপরাধের জন্য তিরস্কার করেছিল তাদেরকেই যদি ইয়াযীদ বা ইবনে সা’দের পক্ষ থেকে এই একই দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে তাদের মধ্যে কতজন সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাত বা তা পালন করা থেকে বিরত থাকত তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।)
সে যা-ই হোক,যুদ্ধের অগ্নি নির্বাপিত হওয়া ও তার ভষ্মরাশি শীতল হয়ে যাওয়ার পর ইবনে সা’দের পক্ষে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই এ ব্যাপারে সে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। এমনকি তার লেখা কতক কবিতায় তার এ উদ্বেগ ও মানসিক অশান্তি প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়,তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে এত বড় অপরাধ সংঘটন থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিয়েছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য যে,সে এসব উপদেশ কর্ণপাত করে নি।
ইবনে সা’দের অধীন সেনাপতিদেরও বেশিরভাগেরই মনের অবস্থা ছিল তারই অনুরূপ এবং তারা খুবই উদ্বেগ ও অশান্তির মধ্যে ছিল। তবে তাদের মধ্যে কতক অভিযাত্রিক মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তিও ছিল যাদের অন্তরে আল্লাহ্ বা মানুষের কারো ভয়ই ছিল না। এ ধরনের ব্যক্তিরাই ইমাম পরিবারের সদস্যদের ও অনুসারীদের তাঁবুগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। তারা যে কোন ব্যাপারেই শুধু তাদের পার্থিব স্বার্থের চিন্তা করত। এমনকি তাদের মধ্যে এমন কতক লোকও ছিল যারা তাদের পার্থিব স্বার্থের জন্যও কাজ করত না,বরং মানুষকে কষ্ট দেয়ার মধ্যেই ছিল তাদের আনন্দ। তারা একটি পরিবারকে,একটি শহর বা একটি দেশের নাগরিকদেরকে বা একটি বৃহৎ সমাজকে মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করে আনন্দ উপভোগ করত। ইমাম আলী (আ.)-এর এক বাণীতে এ ধরনের লোকদের চেহারা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন : “হতভাগ্য (পরকালীন বিচারে) সেই লোকেরা যাদেরকে তুমি কেবল সেই সব জায়গায় দেখতে পাবে যেখানে লোকেরা কষ্ট ও ঝামেলায় আছে।”এরা হচ্ছে এমন লোক যাদের দুর্ভাগ্যের জন্য ইমাম আলী আফসোস করেছেন এবং যাদের নোংরামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য ইমাম হাসান (আ.) জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহকোণে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারা ছিল সিব্ত বিন রাবি,শিম্র বিন যিল জাওশান ও আরো দু’একজন অত্যন্ত হীন চরিত্রের লোক। তারা অত্যন্ত নোংরা ও ঘৃণ্য নীতি গ্রহণের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংকটের অবসান ঘটাতে চাচ্ছিল। কিন্তু যারা অধিকতর দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিল তারা তেমন একটা তাড়াহুড়ো করে নি। এ কারণেই দু’বার যুদ্ধ করতে যেয়েও শুরু করা হয় নি,বরং তা পিছিয়ে দেয়া হয়।
স্বয়ং ইমাম হুসাইন (আ.) যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চান নি। তিনি যদি সামরিক সমাধান চাইতেন তাহলে প্রথম বারের মতো হুর ইবনে ইয়াযীদের বাহিনী যখন ইমামের গতিরোধ করে তখন তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য স্বীয় সঙ্গীদের দেয়া একজনের প্রস্তাব গ্রহণ করতেন। ইমামের উক্ত সঙ্গী হুর ও তার বাহিনীর লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের হাত থেকে নিস্কৃতি লাভের প্রস্তাবের সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ইমামকে এই বলে সতর্ক করেছিলেন : “অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদেরকে আরো বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।”কিন্তু ইমাম জবাবে বলেছিলেন : “কোন অবস্থাতেই চরম পন্থার আশ্রয় গ্রহণ আমার কর্তব্য নয়।”
সুতরাং কতক ইতিহাসবিদ এ মর্মে যে তথ্য উল্লেখ করেছেন যে,ইমামের কতক অনুসারী কুফা থেকে সৈন্যদেরকে নসিহত করেন এবং তারা যে লজ্জাজনক কাজ সম্পাদনের জন্য এসেছিল তা থেকে তাদেরকে বিরত রাখার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেন,তখন সে তথ্য যে পুরোপুরি সঠিক তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে পবিত্র কোরআনের হুকুম অত্যন্ত স্পষ্ট। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেন: “মুমিনদের দু’টি গোষ্ঠী যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়,তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি প্রতিষ্ঠা করে দাও। অতঃপর তাদের মধ্যে কোন এক পক্ষ যদি অপর পক্ষের ওপর চড়াও হয় তাহলে তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আল্লাহর আদেশের নিকট আত্মসমর্পণ করে।”-সূরা হুজুরাত : ৯
পবিত্র কোরআনের আদেশের অনুসরণের ক্ষেত্রে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা অন্য যে কারো চাইতে অগ্রগামী ছিলেন। তাই তিনি তাঁর এ ভূমিকার দ্বারা জাহেল লোকদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেন যে,তারা কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিল।
ইমামের সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে যারা জাহেল লোকদেরকে চিরন্তন দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে যাহর বিন কায়েস ছিলেন অন্যতম। তিনি তাঁর বাহনে চড়ে কুফা বাহিনীর অবস্থানস্থলের খুব কাছে চলে যান যেখান থেকে তিনি সে বাহিনীর সেনাপতি ও সৈন্যদেরকে দেখতে পাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন : “হে লোকেরা! সদুদ্দেশ্য পোষণ করা (এবং তার ভিত্তিতে দীনী ভাইদেরকে উপদেশ প্রদান করা) প্রত্যেক মুসলমানের অধিকার। ইতোপূর্বে (ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে) তলোয়ারের সাহায্যে সংকটের সমাধান করা হতো। আমরা যেন ভুলে না যাই যে,আমরা সকলে ভাই-ভাই,একই দীনের অনুসারী এবং একই জাতি। কিন্তু আমরা যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে তলোয়ার কোষমুক্ত করি (ব্যবহার করি) তখন আর কিছুই আমাদেরকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে পারবে না।”
একদিকে ছিল ইয়াযীদের পক্ষের সেনাপতি ও সৈন্যরা,অপরদিকে ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা;দুই পক্ষের মধ্যে এ ধরনের বহু কথাবার্তা ও যুক্তি উপস্থাপিত হয়। অবশ্য বিভিন্ন ইতিহাসবিদ বিভিন্নভাবে এসব কথা উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু সর্বাবস্থায়ই তাতে একটি সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ কর্তৃক এসব বক্তব্য উদ্ধৃত করা থেকে প্রমাণিত হয় যে,কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার প্রতিটি পর্যায়ে ও প্রতিটি সংবেদনশীল দৃশ্যে সতর্ক বর্ণনাকারীরা উপস্থিত ছিলেন যাঁরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
যে সব কাপুরুষ পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে তাদের দীন ও ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিল তাদের দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া বিবেককে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে ইমাম হুসাইন নিজেও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তার প্রতিটি বাক্যই ছিল সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত,শুভ কামনাময়,আলোক সম্পাতকারী ও সত্যে পরিপূর্ণ। এ বাক্যগুলো এমন এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল যিনি এসব অজ্ঞ মুসলমানদের নাজাতের জন্য চেষ্টারত ছিলেন। তিনি তাদেরকে বলেন যে,তারা স্বাধীনভাবে ও সম্মানজনক জীবন-যাপন করতে চাইলে এটাই হচ্ছে তার শেষ সুযোগ। তিনি তাদেরকে এই বলে সতর্ক করেন যে,তারা যদি এ সুযোগের যথাযথ ব্যবহার না করে তাহলে তারা ইহকালে বা পরকালে কখনোই মুক্তির স্বাদ লাভ করবে না। ইমাম বলেন যে,তারা যদি তাদের মর্যাদাকে বিসর্জন দেয় তাহলে তাদের জন্য দুঃখ-দুর্দশা ও দুভার্গ্যরে জীবন অপেক্ষা করবে।
এ কারণেই দশই মুহররমের হৃদয়বিদারক ঘটনার দিনের শুরুর দিকেও দুই শিবিরের মধ্যে দুই পক্ষের দূতদের আসা-যাওয়া চলছিল;তারা দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে বাণী বিনিময় করছিল। এ ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের অনেকে শত্রুপক্ষের শিবিরের উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন,এমনকি ভাষণ দিয়েছেন। সেই সংবেদনশীল ও বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলোতেই কয়েকটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেয়া হয় যা সৌভাগ্যবশত নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো এ বিয়োগান্তক ঘটনার মূল্যবান দলিল যাতে এসব ভাষণদাতার মহত্ত্ব,দীনদারী ও শৌর্যই শুধু ধরা পড়ে নি,বরং তাতে এও প্রতিফলিত হয়েছে যে,ইমাম হুসাইন স্বীয় শত্রুদেরও কতখানি ভালবাসতেন,তাদের জন্য কতখানি দুঃখ অনুভব করতেন এবং জাহেলীয়াতের অতল গহ্বরে পতিত হওয়া থেকে তাদেরকে নাজাত দিতে চাচ্ছিলেন। এহেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিস্থিতিতেও ইমাম হুসাইন যেসব সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এখানে তা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেন :
“হে লোকেরা! এত বেশি তাড়াহুড়ো করো না। আমার কথাগুলো শোন। আমি তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি তোমাদেরকে জানাচ্ছি কেন আমি তোমাদের ভূখণ্ডে এসেছি। তোমরা যদি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোন এবং নিজ মনে পর্যালোচনা কর,অতঃপর যদি মনে কর যে,আমি তোমাদেরকে সত্য বলছি তাহলে এ যুদ্ধ-যা যে কোন মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে,তা সংঘটিত হবে না। কিন্তু তোমরা যদি আমার কথা শ্রবণ না কর এবং অন্যায় ভূমিকা পালন কর তাহলে তোমরাই হবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত।
হে লোকেরা! তোমরা কি জান,আমি কে? তোমরা কি জান,আমার পিতা কে ছিলেন? তোমাদের জন্য কি আমাকে হত্যা করা সঠিক হবে? তোমাদের জন্য কি আমার মর্যাদা হানি করা উচিত হবে? আমি কি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান নই? আমার পিতা কি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উত্তরাধিকারী এবং সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি নন? তোমরা কি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এ বিখ্যাত বাণীটি শোন নি,যা আমার ও আমার ভ্রাতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন : হাসান ও হুসাইন হচ্ছে জান্নাতের যুবকদের নেতা।
তোমাদের যদি জানা থাকে যে,আমি সত্য কথা বলছি তাহলে তা খুবই উত্তম। আল্লাহর কসম,আমি যখন থেকে নিজের সম্পর্কে জানি তখন থেকে কখনোই মিথ্যা কথা বলি নি। আর কোন মুসলামান যদি মনে করে যে,আমি মিথ্যা বলছি,তাহলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কিছু সংখ্যক সাহাবী এখনো বেঁচে আছেন;তোমরা তাঁদের নিকট আমার এসব কথার সত্যতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে পার। তাঁরা হচ্ছেন জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আল আনসারী,আবু সাঈদ খুদরী,সাহল সায়েদী,যায়েদ ইবনে আরকাম ও আনাস ইবনে মালিক। তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন যে,আমি যা বলছি তা সত্য। হে লোকসকল! দীনের কোন্ বিধানের ভিত্তিতে তোমরা আমার রক্তপাত করতে চাচ্ছ?”
এ ব্যাপারে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে,ইমাম হুসাইন (আ.) নিজেকে অবরোধ থেকে মুক্ত করার জন্য বা মৃত্যুর ভয়ে এ কথাগুলো বলেন নি। তিনি যদি তা-ই চাইতেন তাহলে আরো দুইদিন পূর্বেই এবং খুব সহজেই তিনি তা হাসিল করতে পারতেন। বস্তুত যে কোন সুস্থ অন্তঃকরণই এসব মহিমান্বিত বক্তব্যে শান্তির সুবাস,সদুদ্দেশ্য ও লোক-হিতৈষণা অনুভব করবে। কারণ গোটা মানব জাতির ইতিহাসে এমন ব্যক্তির সংখ্যা একেবারেই নগণ্য যাঁরা এ ধরনের এক কঠিন পরিস্থিতিতে এরূপ শান্তভাবে এ ধরনের কথা উচ্চারণ করতে পারেন। কেবল আল্লাহ্তায়ালার খাঁটি বান্দারাই এ ধরনের কথা উচ্চারণ করতে পারেন। এ হচ্ছে তাঁর বক্তব্য যিনি অজ্ঞ-কাপুরুষদের দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া বিবেককে জাগ্রত করবেন,যিনি পথ পরিক্রমারত অজ্ঞ উচ্ছৃঙ্খল জনতার ক্রোধের অগ্নি শিখায় দগ্ধীভূত হচ্ছেন,কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে অন্তত তাদের দু’চারজনকে হলেও চিরন্তন অগ্নি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এবার এ ভাষণটি আপনারা আরেকবার পড়ে দেখুন। লক্ষ্য করুন,কেমন সাধারণভাবে এ বক্তব্যের শব্দগুলো একটির পর একটি সাজানো হয়েছে। এতে কোন ভাষাগত জটিলতা নেই। বক্তা কোনরূপ যুক্তিভিত্তিক উপসংহারে উপনীত হবার চেষ্টা করেন নি। বরং বক্তব্যটি খুবই সহজ-সরল এবং যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা সরাসরিই বলে দেয়া হয়েছে। আর তিনি তাঁর বক্তব্যে যে তথ্য সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন তা এ ভাষণ শ্রবণকারী সকল মানুষেরই সুপরিচিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা অজ্ঞতার ভান করে। অথচ সহজ-সরল লোকেরাও খুব সহজেই তাঁর বক্তব্যের গভীরতায় উপনীত হতে সক্ষম।
ইমাম বলেন : “হে লোকেরা! আমি তোমাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী,আমি তোমাদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করতে পারি না। তোমরা সকলেই আমাকে জান। তোমরা জান যে,আমি মিথ্যাবাদী নই। তাহলে কেন তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছ? কে তোমাদেরকে এ কাজের দায়িত্ব দিয়েছে?”
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভাষণ এ পর্যায়ে উপনীত হলে হতভাগা জঙ্গীবাদীরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। তাদের ভয় হলো যে,ইমামের আন্তরিক ও সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত বক্তব্য জনতার পাষাণ হৃদয়ে জাদুর মতো ক্রিয়া করবে। তাদের ভয় হলো যে,তাদের সেনাবাহিনী বা তাদের মধ্যকার একটি গোষ্ঠী ইমামের সত্য ভাষণের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়বে। যদি তাই ঘটে তাহলে কিভাবে তারা তাদের শয়তানী লক্ষ্য হাসিল করবে? এ কারণে সেই হতভাগ্য রক্তপিপাসু জানোয়ারটি ইমামের ভাষণে বাধা দিল। সে চিৎকার করে বলল : “আমি যদি তোমার ভাষণের একটি শব্দও বুঝতে পারি,তাহলে আমি বৃথাই তোমার রবের ইবাদত করেছি।”
এ কথাগুলো ছিল এমন এক ব্যক্তির কথা যে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে তার জীবনে সঠিকভাবে বা ভুলভাবেও মুহূর্তের জন্য আল্লাহ্তায়ালার ইবাদত করে নি। কারণ সে কখনোই আল্লাহ্তায়ালাকে সন্তুষ্টির পথ সন্ধান করে নি। আমরা এ লোকটির গোটা জীবন সম্পর্কে অবগত। যেদিন সে কুফায় ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষে থাকার ভান করেছিল তখন থেকে শুরু করে যেদিন সে কারবালায় ইমাম আলীর পুত্র ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তপাত ঘটাল,সেদিন পর্যন্ত তার জীবন এটাই প্রমাণ করে যে,সে কখনোই ঈমান আনে নি। সে হচ্ছে শিম্র বিন যিল জওশান।
শিম্র ছিল সেই ধরনের লোকদের অন্যতম যারা মুক্ত চেতনার অধিকারী লোকদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে আনন্দ পেত। এ ধরনের লোক পরহেজগার ও মহান ব্যক্তিদের জীবনবৃক্ষের মূলোৎপাটন করে নিজেদেরকে বড় বলে অনুভব করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানব জাতির ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায়ে মাঝে-মধ্যেই এ ধরনের লোকের সাক্ষাৎ মিলে। ফলে যা ঘটা উচিত নয়,শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটে।
কারবালার ঘটনার অর্ধ শতাব্দীকাল পূর্বে কোরআন মজীদে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় এসব লোকের আচরণে তারই প্রতিফলন ঘটে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :
“আর মুহাম্মদ তো রাসূল বৈ অন্য কিছু নন। তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন বা নিহত হন তাহলে কি তোমরা (ঈমান থেকে) তোমাদের পশ্চাৎ দিকে ফিরে যাবে?”-সূরা আলে ইমরান : ১৪৪
এ পবিত্র আয়াত নাযিল হবার অর্ধ শতাব্দী পরে এই লোকেরা মানসিকভাবে জাহেলীয়াতের যুগে ফিরে যায়। তারা ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্ববর্তী জাহেলীয়াতের যুগের আরবদের জীবনধারার অনুরূপ জীবনধারায় ফিরে গিয়েছিল। তাদের জীবনের একমাত্র চালিকা শক্তি ছিল তাদের প্রতিহিংসার মানসিকতা,সস্তা ভাবাবেগ ও পার্থিব লালসা। কোরআন মজীদের শিক্ষা,রাসূল (সা.)-এর হাদীস এবং মহান ব্যক্তিবর্গ ও রাসূলুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের শিক্ষাকে তারা পাশে সরিয়ে রেখেছিল। তাদের মধ্যে যে হিংস্র পশুপ্রকৃতি লুকায়িত ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হলো এবং তাদের অভ্যন্তরীণ পশুগুলো বেরিয়ে এলো। তাদের এ প্রকৃতিতে যে সামান্যতম ইসলামী বৈশিষ্ট্যও ছিল না শুধু তা-ই নয়,বরং তাদের মধ্যে ন্যূনতম মানবিক বৈশিষ্ট্যও ছিল না। যে কোন বিচারেই তাদের চরিত্র ও আচরণ ছিল মানবিক চরিত্র ও আচরণের বিপরীত।
দুই পক্ষের পরস্পর বিরোধী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এ ঘটনার দুইশ’বছর পরে লিখিত ইতিহাস থেকে সঠিক তথ্যাবলী বের করা বেশ কঠিন ব্যাপার। তবে সৌভাগ্যবশত এসব দলিলের মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং চাক্ষুষভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন ব্যক্তিদের দেয়া বেশ কিছু বিবরণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনার অত্যল্প পরবর্তীকালীন কতক লোকের প্রদত্ত বিবরণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকদের নিকট থেকে শুনে তা পরবর্তীকালীন লোকদের নিকট বর্ণনা করেছেন।
সুতরাং এ বিয়োগান্তক ঘটনার সমকালীন কয়েকজন বর্ণনাকারী যখন কোন বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে অভিন্ন বর্ণনা প্রদান করেন তখন আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে,প্রকৃতই ঘটনাটি এরূপই সংঘটিত হয়েছিল বা অন্তত এরূপ ঘটার খুবই সম্ভাবনা। এছাড়া একটি বিশেষ ঘটনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কতক ঘটনা থেকেও ঘটনাটি সংঘটিত হবার বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি। এসব পরস্পরবিরোধী কাহিনী এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনাবলীকে একত্রে পর্যালোচনা করে আমরা প্রতিটি বিষয়ে উপসংহারে উপনীত হতে পারি। উদাহরণস্বরূপ আমরা এ মর্মে উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে,দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ বাহাত্তর ঘণ্টা দীর্ঘায়িত হতে পারে না। ইয়াযীদের স্তাবক,পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে দীনকে বিক্রয়কারী বর্ণনাকারী যে দাবী করেছিল এ যুদ্ধ যে তত কম সময়েও সমাপ্ত হয় নি তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই।
যাহার ইবনে কায়েস যখন দামেশকে ইয়াযীদের প্রাসাদে প্রবেশ করল তখন সে বলল : “আমার কাছে খলীফার জন্য সুসংবাদ আছে। আল্লাহর বিজয় ও সাহায্যক্রমে আলীর পুত্র হুসাইন তার আঠার জন আত্মীয় ও ষাট জন অনুসারী সহ আমাদের নিকট এল। আমরা তাদেরকে আত্মসমর্পণ ও আমীর ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের আদেশ মেনে চলতে অথবা প্রস্তুত হতে ও আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে বলি। তারা যুদ্ধকেই বেছে নেয়। পৃথিবীর ওপর সূর্যের প্রথম রশ্মি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই আমরা তাদেরকে ঘিরে ফেলি। তারা বাজপাখির শক্তিশালী থাবা থেকে পলায়নপর আশ্রয়সন্ধানী ঘুঘু পাখির ন্যায় এদিক সেদিক পালাচ্ছিল,কিন্তু আমরা ভালোভাবে তাদেরকে ঘিরে ফেললাম। হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম,একটা উট জবেহ করতে যতখানি সময় লাগে ততখানি সময়ও লাগে নি,অন্যকথায়,ঊষার আলো ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আমরা আমাদের তলোয়ার দ্বারা তাদের সকলকেই হত্যা করলাম। এখন তাদের নগ্ন দেহগুলো কেবল তাদের রক্ত দ্বারা আবৃত এবং তাদের চেহারাগুলো ধুলিলিপ্ত। খর রৌদ্র তাদের চামড়াকে পোড়াচ্ছে এবং মরুভূমির প্রবল বায়ু তাদের দেহগুলোকে ধাক্কিয়ে এদিক-সেদিক নিয়ে যাচ্ছে। এখন ক্ষুধার্ত শকুন ছাড়া কেউ তাদের মৃত দেহগুলোকে দেখতে যাচ্ছে না।”২
এ নীচমনা মিথ্যাবাদী লোকটি তখনকার বিশেষ পরিস্থিতিতে তার নেতা ইয়াযীদকে খুশী করার জন্য যা বলেছিল তা যে সত্য হতে পারে না তাতে কোনই সন্দেহ নেই। যে ব্যক্তি এ কথা বলেছে এবং যে তা শুনে বিশ্বাস করেছে তাদের উভয়কেই যে কেউ অবজ্ঞা করতে বাধ্য। কারণ এ উদ্ধত ব্যক্তির প্রতিবেদনের এক অংশের সাথে অপর অংশের বিরোধিতা রয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন (এ ব্যক্তিও যা স্বীকার করেছে) ও লাঞ্ছনার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার ওপরে যুদ্ধকে অগ্রাধিকার দেন খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে পারেন না,বাজের হাত থেকে পলায়নপর ঘুঘুর মতো তো নয়ই।
মোদ্দা কথা,একটি বিষয় সন্দেহাতীতভাবে বলা যেতে পারে,আর তা হচ্ছে যাহার বিন কায়েস যেরূপ ইয়াযীদকে জানিয়েছে তদ্রূপ সহজভাবে এ যুদ্ধে তাদের বিজয় অর্জিত হয় নি।
চলবে…………….