মুসলিম দুনিয়ার অধঃপতন কেন
  • শিরোনাম: মুসলিম দুনিয়ার অধঃপতন কেন
  • লেখক: ড. মনজুর আলম
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:8:2 1-9-1403

পাশ্চাত্যের লোকেরা যখন গাছের ডালে আর পর্বতের গুহায় বাস করতো তখন মুসলমানরা জাগতিক,আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে শুধু শীর্ষেই আবস্থান করছিল না,বরং তাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের বলয়ে সবাইকে আহ্বান করছিল উন্মুক্ত হাতে। যখন মুসলমানদের সুদিন ছিল তখন তারা যেখানে গেছে সেখানেই সভ্যতার মশাল জ্বালিয়েছে।

মুসলমানরা ইরাক জয় করে গড়ে তুলেছে বাগদাদের স্বপ্নপুরী,স্পেন জয় করে সেখানে গড়ে তুলেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ,ভারত,তুরস্ক,মিসর,ফিলিস্তিন,সিরিয়ায় গড়ে তুলেছে সমৃদ্ধ নগর,বন্দর ও অট্টালিকা। মুসলমানরা মানুষকে তাদের সেবাদাসে পরিণত করার জন্য কোথাও রাজ্য জয় করে নি। মুসলমানদের সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল মানুষকে অন্য মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অন্যদিকে ইউরোপীয়ানরা যখন গাছের শাখা থেকে নেমে এসে মুসলমানদের স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখে শক্তি সঞ্চয় করলো তখন তারা যে বিজয় অভিযানে বের হলো সেটি মানুষকে শুধু পরাজিত ও পরাধীন করে রাখার জন্যই। তারা যেখানে গিয়েছে সেখানেই স্থাপন করেছে উপনিবেশ। স্থানীয় অধিবাসী বা নেটীভদের তারা পরিণত করেছে সেবাদাসে। এশিয়া,আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে উন্নতি লাভ না করে শুধু দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষেরই শিকার হয়নি,বরং মানসিকভাবেও হয়ে পড়েছে হীনতর ও সংকীর্ণতর সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী।

মুসলমানদের ও ইউরোপীয়ানদের বিজয়াভিযানের উপরোক্ত পার্থক্য যদি আমরা মেনে নেই,তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়ায় যে,মুসলমানরা কেন পরাজিত হলো? পাশ্চাত্যের কাছে মুসলমানরা আজ যে পদে পদে মার খাচ্ছে তা থেকে উত্তরণের জন্য মুসলমানরা আজ যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো কি আসলেই মুসলমানদেরকে এই অবমাননা- এই অধীনতা থেকে মুক্তি দেবে? এ দু’টি প্রশ্ন ছাড়াও অনেক প্রশ্ন এসে যায় কিন্তু এগুলোর জবাব এ লেখার পরিধিভুক্ত নয়।

মুসলমানরা এত উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের সংকীর্ণ বস্তুবাদী সভ্যতার আক্রমণে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হওয়ার কারণটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ইসলামপন্থীদের কাছে এ প্রশ্নের একটি গৎবাঁধা উত্তর রয়েছে। এ প্রশ্নটি করা মাত্র ইসলামপন্থীরা কোন কিছু না ভেবে যে উত্তরটি মুখস্থ করা নোট বইয়ের উত্তরের মতো আউড়ে দেয় সেটি হলো ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাবার কারণেই মুসলমানরা দুর্দশায় নিপতিত হয়েছে। ইসলামের মূল শিক্ষাটি কি এ প্রশ্ন নিয়ে যদিও অনেক মতভেদ রয়েছে,তবুও যদি আমরা এ মতভেদ উপেক্ষা করি,তারপরও দেখা যাবে,ইসলামপন্থীদের কাছে আসলে এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট উত্তর নেই। কারণ তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়,কবে থেকে মুসলমানরা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসা শুরু করেছে,তাহলে তাদের বেশির ভাগই উত্তর দেবে,খুলাফায়ে রাশেদীন অর্থাৎ খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই মুসলমানরা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসা শুরু করেছে। এটি যদি সত্য হয় তাহলে ইউরোপ,এশিয়া ও আফ্রিকায় মুসলমানদের বড় বড় বিজয়াভিযান এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিকাশ কিন্তু হয়েছে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাবার পরেই। পাশ্চাত্যের কাছে মুসলমানদের ব্যাপক পরাজয় শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের পরে যার পরিপূর্ণতা ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কী খেলাফতের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে। উপরোক্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করার পর স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্ন জাগে সেটি হলো,ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরে যাবার পরও মুসলমানরা কোন্ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দীর্ঘ এক সহস্র বছর ধরে পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিল,আর কোন্ শক্তি বলেইবা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা মুসলমানদের পরাজিত করে আজ পর্যন্ত পরাভূত করে রেখেছে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়া অত্যন্ত দুরূহ এবং উচ্চ মানের পণ্ডিত না হয়ে এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করাও এক ধরনের ধৃষ্টতা মনে হতে পারে। কিন্তু একজন সাধারণ মুসলমানের এ প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়,বিশেষ করে যখন টেলিভিশনের পর্দায়,খবরের পাতায় প্রতিদিন মুসলমানদের মার খাওয়ার ছবি চেতনায় চপেটাঘাত করে তখন একজন মুসলমান,সে যত অজ্ঞ-মূর্খই হোক,ঐসব প্রশ্নের উত্তর দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।

বিবেকতাড়িত একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবে ঐসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমে যে ইতিহাসের এক বিশাল বৈপরীত্য এসে মনকে নাড়া দেয় সেটি হচ্ছে মুক্তি ও স্বাধীনতা ও বাণীর হাইজ্যাক। মুসলমানরা যখন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য বিজয় করে তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ স্বল্প সংখ্যক মুসলিম বাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল তাদের মুক্তিদাতা হিসেবে,এমন কি বাংলাদেশেও বখতিয়ার খিলজী মাত্র আঠারো জন সৈনিক নিয়ে যখন লক্ষণ সেনের রাজপ্রাসাদ হামলা করলেন তখন তাকে তেমন কোন বাধারই সম্মুখীন হতে হয় নি। ভারতবর্ষের হিন্দু জনগোষ্ঠী,যারা জাতি-ভেদ প্রথার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তারা মুসলিম শাসনকে স্বাগত না জানালে এ বিশাল জনগোষ্ঠীর উপমহাদেশ নির্বিঘ্নে শাসন করা সম্ভব হতো না।

কিন্তু মুসলমানদের এই মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণী মুসলমানরাই ভুলে যেতে থাকে। মুসলমান শাসকরাও স্বৈরাচার ও বিলাস ব্যসনে এতটাই ব্যাপৃত হয়ে পড়ে যে,অধীনস্থ জনগোষ্ঠীকে সে মুসলমান হোক আর অমুসলমানই হোক,নিজেদের ভাই মনে না করে শাসিত সেবাদাস হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,আজ থেকে ঠিক চারশ’ দু’ বছর আগে (১৬০০ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসে) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স যখন আগ্রাতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে এসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন সম্রাট জাহাঙ্গীর ঐ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে শুধু বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার জন্য সুরাট বন্দরে বাণিজ্য দপ্তর খোলার অনুমোদনই দান করলেন না,রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে তাকে উপহার দিলেন তার হারেমের সবচেয়ে সুন্দরী রমণী। সম্রাট জাহাঙ্গীরের এ আচরণ থেকে বোঝা যায়,অধীনস্থ মানুষের প্রতি তখনকার যুগের রাজা-বাদশাহদের মনোভাব কেমন ছিল! সম্রাট শাহজাহান যখন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য সমাধিসৌধ তৈরি করলেন,তিনি একবারও ভাবেন নি সাধারণ মানুষ তাজমহল নির্মাণের অর্থ যোগানের জন্য অতিরিক্ত করভার নির্বাহ করতে গিয়ে দুর্ভিক্ষে পঙ্গপালের মত মৃত্যুবরণ করছে।

সমগ্র প্রাচ্য জুড়ে মুসলিম শাসকবর্গ যখন মানুষের অধিকার অবলীলায় পদদলিত করে গড়ে তুলেছিল হারেম আর দৃষ্টিনন্দন কিছু অট্টালিকা,পাশ্চাত্যের নের্তৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা তখন ভাবছিলেন কিভাবে এমন সমাজ গড়ে তোলা যায় যেখানে মানুষ বস্তুগত দিক থেকে প্রাচুর্য ও সুখ লাভ করবে। তারা অনুভব করলেন,মানুষকে রাজা-বাদশাহদের গোলামী থেকে মুক্ত করে মানবিক মুক্তি ও মানবাধিকারের ঘোষণা দিতে হবে এবং প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে নতুন ধরনের রাষ্ট্র।

কোরআন যে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বোচ্চ মাত্রার মানবাধিকারের ঘোষণা দিয়েছে পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ঘোষণা তার থেকে অনেক অপূর্ণাঙ্গ ও নিম্নমানের হলেও পাশ্চাত্যের জন্য তা ছিল অসাধারণ ও বৈপ্লবিক। ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে পরিচিতি একটি দলিল যেখানে পাশ্চাত্যে মানবাধিকারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা প্রত্যেক পাশ্চাত্যবাসীর কাছে মহাপবিত্র ও অসাধারণ দলিল মনে হলেও কোরআনের সাথে পরিচিত কোন মুসলমানের কাছে ঐ দলিলের কথাগুলো সাধারণ মাপের কথাবার্তা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। পাশ্চাত্যবাসীর কাছে মানবাধিকারের কথা অসাধারণ মনে হবার মূলে ছিল রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করে তার কথাকেই আইন মনে করে চলার সুদীর্ঘ ইউরোপীয় ঐতিহ্য,যারা রাজাকেই বস্তুত খোদা মনে করত,তাদের কাছে "All men are created equa”-এ কথা অসাধারণ ও অতিবিপ্লবী মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক।

বস্তুবাদী দর্শনভিত্তিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা প্রতিষ্ঠিত করে,সেখানে কেবল গুটিকতক অভিজাত শ্রেণীর মানুষের বদলে জনসাধারণের মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষা ও জ্ঞান যা ছিল কেবল নগণ্য মানুষের চর্চার ব্যাপার,তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চৌদ্দ শতকের গোড়া থেকে ব্যাপক সংখ্যায় প্রতিষ্ঠা করা হয় স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়। গণনির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয়,প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে শাসক নির্বাচিত হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে। এ ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ব্যক্তিমানুষের হাতকেই শক্তিশালী করা;কেননা সাধারণ ব্যক্তিমানুষ যত শক্তিশালী হবে সমাজও তত শক্তিশালী হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের যে মতাদর্শ ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যকে জাগতিক উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল সে মতাদর্শ কিন্তু তারা তাদের বিজিত রাজ্যগুলোতে তথা উপনিবেশগুলোতে মোটেও প্রয়োগ করে নি। রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের মত অত্যন্ত জনপ্রিয় নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকের বক্তব্য ছিল,“ইংরেজরা সৃষ্টি হয়েছে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে,যাদের দায়িত্ব হচ্ছে,হীনতর জাতি-যাদের নিজস্ব কোন আইন ব্যবস্থা নেই তাদের ওপর শাসন চালানো।” মুসলিম বিজেতা ও ইউরোপীয় বিজেতাদের মানসিকতার পার্থক্যটি এখানেই- ইউরোপীয়রা যেখানে নিজেদেরকে জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠতর মনে করেছে এবং বিজিত জাতিকে ভেবেছে হীনতর সেখানে মুসলিম শাসকদের মধ্যে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বা হীনতার কোন ধারণা না থাকলেও শাসনকার্যে তার কোনই প্রতিফলন ছিলো না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মুসলিম শাসকগোষ্ঠী যখন মানুষকে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে শক্তিশালী করার পরিবর্তে নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে মেতে ছিলো তখনই ইউরোপীয়রা রাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে সীমিত করে ব্যক্তিক্ষমতায়নে মনোযোগী হয়েছে। একটি স্বাধীন পরিবেশেই প্রতিভা বিকশিত হয় এবং সে কারণে ইউরোপে ব্যাপকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ হতে থাকে। ব্যক্তির বিকাশ ও জ্ঞানের বিকাশের ফলে জাতিগতভাবে ইউরোপীয়রা হয়ে ওঠে শক্তিশালী আর শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারের কারণে মুসলমান সমাজে ব্যক্তি হয়ে পড়ে দুর্বল,জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ হয়ে পড়ে রুদ্ধ।

ইউরোপীয়রা স্ব-জাতির জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও উপনিবেশগুলোর জন্য কখনো তাদের সেই তথাকথিত ‘ম্যাগনা কার্টা’র বাণী বাস্তবায়ন করে নি। ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রদানের কৃতিত্ব যারা দাবী করে তারা ভারতবর্ষকে দু’শ বছর নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত রাখার পরও এখানকার মানুষকে প্রজাই বলেছে কিন্তু নাগরিকত্ব দেয় নি। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে দু’ দু’টি বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে যাবার ফলে ইউরোপ তার উপনিবেশগুলোকে হাতছাড়া করতে বাধ্য হলেও যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা তারা সৃষ্টি করেছিল তা রেখে গিয়েছে। মুসলিম দেশগুলো থেকে ইউরোপীয়দের শারীরিক বিতাড়ন সম্ভব হলেও তাদের রেখে যাওয়া শাসন কাঠামোর দখলকারী হয়েছে যেসব মুসলমান তারা সেই একই উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয়দের প্রেতাত্মার মত। এসব প্রেতাত্মা জনগণকে স্বাধীনতা বা স্বাধিকার দেয়ার বদলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী শক্তিরই হুকুম তামিলে ব্যস্ত,এমন কি যারা বাহ্যত অন্তত উপনিবেশবাদী শক্তিকে বিতাড়িত করেছে তারাও স্বৈরাচারী ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ইসলামের মূল বাণীতেই যেখানে রয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা (অর্থাৎ কোন উপাস্য নেই প্রকৃত স্রষ্টা ছাড়া এবং ধর্মাচরণে কোন জববদস্তির অবকাশ নেই) সেখানে শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে জনগণের স্বাধীনতা হরণে ব্যস্ত। সংকীর্ণমনা এসব শাসকগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের ঠুনকো ক্ষমতাকে সংহত করাটিই মুখ্য এবং নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা জনগণের সৃষ্টিশীলতাকে খর্ব করতে,জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশকে রুখে দিতে,এমন কি স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে অস্বীকার করতে এতটুকু পিছপা হয় না। কিন্তু যে বিষয়ে তারা ভয়াবহভাবে উদাসীন সেটি হচ্ছে শক্তিশালী ব্যক্তি গড়ে না তোলা। ফলে শেষ পর্যন্ত গোটা জাতিই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং জাতিগতভাবেই বিশ্ব জুড়ে আমরা মার খাচ্ছি;শোষণ,বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছি।

উপরোক্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অবশ্য বড় একটি জটিলতা রয়েছে। সেটি হচ্ছে পাশ্চাত্য যে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত তা একেবারেই আত্মিক পরিশুদ্ধি ও ঐশী ধ্যান-ধারণা বিবর্জিত। পাশ্চাত্যের আইন-কানুনের পেছনে মূল দর্শন হচ্ছে একজন মানুষ তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখ লাভের জন্য যা খুশী তা করার ব্যাপারে স্বাধীন,যতক্ষণ তা অপরের ঐ একই স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক না হচ্ছে। ইসলামের দর্শনে ব্যক্তির স্বাধীনতা শুধু জাগতিক সুখ সন্ধানে সীমিত নয়,বরং আত্মিক উৎকর্ষ লাভের ক্ষেত্রেই বেশী প্রযোজ্য। অতএব,ব্যক্তির কোন আচরণ যদি সমাজের অপরের আত্মিক উৎকর্ষ লাভের স্বাধীনতাকে খর্ব করে তাহলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন সেই স্বাধীনতা সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে,কে এই স্বাধীনতার পরিধি ব্যাখ্যা করবে? কে ব্যাখ্যা করবে স্বাধীনতা খর্বের জন্য উপযুক্ত বিধি-নিষেধ ও শাস্তির সীমানা? এসব প্রশ্ন অত্যন্ত জটিল এবং এগুলো দাবী করে অপরিসীম জ্ঞান ও বিচক্ষণতা। মুসলিম সমাজে জ্ঞান ও বিচক্ষণতার অভাবও আরেকটি মারাত্মক বিষফোঁড়া। অজ্ঞতার আঁধার থেকে বেরিয়ে এসে মুসলমানদের যদি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতায় বলীয়ান না করা যায়,আমরা যদি ব্যস্ত থাকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সংকীর্ণ চিন্তায়,তবে মুসলমানদের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়া এক রোমান্টিক স্বপ্নই থেকে যাবে।

জ্যোতি বর্ষ ১ সংখ্যা ২