ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
  • শিরোনাম: ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 18:45:52 1-9-1403

ভূমিকা:

কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে,তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম রক্ষাকারী,অভিভাবক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সূরা বাকারা : ২৫৭,সূরা আলে ইমরান : ১৫০)। বর্তমান বিশ্বে ইসলাম অবরুদ্ধ অবস্থায় নিপতিত। অবরোধ একটি যুদ্ধ কৌশল-এক ধরনের অপরাধ ও আক্রমণ। যুদ্ধের মঞ্চে কৌশল ও কর্মপন্থার দিক থেকে অবরোধের অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ বন্দীদশা। এটি এমন একটি শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থা যেখানে সবকিছু প্রবেশের বা বহির্গমনের পথ রুদ্ধ। আর এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রুর ধ্বংস সাধন যতক্ষণ পর্যন্ত তার সমরনায়ক বা ঘেরাওকৃত এলাকা বা তার জনসাধারণ আত্মসমর্পণে প্রস্তুত না হয়। সেক্ষেত্রে হয় তাদেরকে দাসে পরিণত করা হয় অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। আর অবরুদ্ধ অধিবাসীদের জন্য একমাত্র যে বিকল্প পথ খোলা থাকে তা হচ্ছে প্রতি আক্রমণ। সেটি একটি ভয়ানক পরিস্থিতি।

আপাতদৃষ্টিতে দুর্দমনীয় একটি শক্তি অবরুদ্ধ করে রাখার কাজটি করে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শত্রু একাধিক হয়ে থাকে এবং তারা একত্র হয়ে বিভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্র বা এ সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীগুলো তাদের একক শত্রু বিনাশ অথবা সেই শক্তিকে প্রশমিত ও তার বিপদাশংকা হ্রাসের আকাঙ্ক্ষায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাই ষড়যন্ত্র হচ্ছে একটি কৌশল; কোন ভূখণ্ডে বাস্তবায়নের জন্য একটি পূর্বধারণকৃত পরিকল্পনা,যা যুদ্ধকে বাস্তব রূপদানের একটি কর্মপন্থা। সুতরাং যদি কোন যুদ্ধক্ষেত্রে অবরোধের ঘটনা ঘটে,সেক্ষেত্রে তা একটি কর্মপন্থা (Tactics) এবং অবরোধকারী সেনাবাহিনীর সদর দফতর কর্তৃক প্রণীত পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রটি হচ্ছে কৌশল (Strategy)। Clausewitzian ঐতিহ্য অনুসারে ‘সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে যুদ্ধের কোলে জন্ম নেয়া প্রথম সন্তান যা শত্রুবাহিনীর ধ্বংস সাধনের প্রচেষ্টায় সংকটের রক্তস্নাত সমাধান’ (O Sullivan and Miller jr. 198 : 52)।

এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ হচ্ছে Clausewitzian এর নিজের ভাষায় : ‘রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপায় অবলম্বন।’

কৌশলগত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ ধরনের আকস্মিক পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমস্যার গুরুত্বকে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করা। আমরা যদি সম্মত হই যে,ইসলাম এখন অবরুদ্ধ তাহলে আমাদের এ ব্যাপারেও সম্মতি জ্ঞাপন করতে হয় যে,আমরা এক ধরনের যুদ্ধের পরিস্থিতির ভিতর অবস্থান করছি। আর যদি এক্ষেত্রে কোন ষড়যন্ত্র কার্যকর থাকে,তার অর্থ হচ্ছে আমাদের শত্রু এক নয়,একাধিক এবং তাদের পন্থাও হবে বহুমুখি।

এক্ষেত্রে পরবর্তী যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তা হচ্ছে এ শত্রুরা কারা? ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকারীরা কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? ইসলাম কোন স্বার্থ অথবা স্বার্থসমূহের ক্ষেত্রে আশংকার সৃষ্টি যা এ ধরনের জোটবদ্ধতার সৃষ্টি করে? এ ধরনের ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে কী উপায় অবলম্বন করা হয় এবং কীরূপে তারা তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটায়? এ অবরোধের তাৎপর্যই বা কী? ইসলাম কি এ অবরোধ অপসারণে সক্ষম? এক কথায়,যদি ইসলাম আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে,তাহলে এর অর্থ হচ্ছে ইসলাম সেক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে। তাহলে এ অবরোধ (আক্রমণ) অপসারণে কোন্ যুদ্ধকৌশল প্রয়োজন? ইসলাম কি সঠিক কাজটি সঠিক উপায়ে সম্পাদন করছে? ইসলাম কি এ অনিশ্চিত অবস্থাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে? এ অবস্থায় সমকালীন প্রজন্ম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ কারা? এ বিষয়গুলোই এখানে আমাদের আলোচ্য।

১.পরিস্থিতি

ফ্রেঞ্চ জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এক সময় বলেছিলেন,স্রষ্টা উন্নত সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেন। আজকে ইসলামের অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার বিষয়টি আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? ঐতিহাসিকভাবে,কুরআন যেভাবে ঘোষণা করেছে-‘ইসলামের আগমনে সত্য প্রকাশিত হয়েছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে,যেমনটিই হওয়ার কথা ছিল’ (কুরআন ৩ : ৮০)। বিভিন্ন দেশ ও ভূখণ্ডে ইসলামের অভাবিত বিজয় সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন এলাকায় এমন এক শত্রুর নিকট পরাজয়ে পর্যবসিত হয় যারা ইতিপূর্বে মুসলমানদের শৌর্য ও সাহসিকতার সম্মুখে নতি স্বীকার করেছিল। নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পরপরই মধ্য ৭ম শতাব্দীতে যখন আরবের মুসলমানরা বড় বড় দলে সামরিক অভিযানে বেরিয়ে পড়ে,তখন তা সমগ্র বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বড় বড় সাম্রাজ্য মুসলমান সৈন্যবাহিনীর তোড়ে একের পর এক ধসে পড়তে লাগল পারস্যে (কাদিসিয়া ৬৩৫,মেসিকন ৬৩৭),ক্যালডী এবং মেসোপটেমিয়ায় ৬৩৫),মিশরে (আলেকজান্দ্রিয়া ৬৪১) এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় (কায়রাওয়ান ৬৭০,পশ্চিম আফ্রিকা ৭০৪-৭১১,স্পেন,৭১১)। এ সকল ও অন্যান্য স্থানে ইসলামের বিজয় মুসলিম শাসন ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রফেসর গিব এর ভাষায়,ইসলামের সম্প্রসারণ জনগোষ্ঠীসমূহ এবং তাদের সংস্কৃতিকে নতুন এক একত্রীকরণের দিকে পরিচালিত করে (Gibb 1975 : 3)।

অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইসলামী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে ফাটল পরিদৃষ্ট হয়। সিফ্ফিনের যুদ্ধ শুরুর মধ্য দিয়ে (মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে যে সামরিক উপমা রয়েছে তা এড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর)। সিফ্ফিন দ্বন্দ্বের একটি প্রতীকীরূপ (যেমনটি মালেক বেন্নাবী বলেছেন,এর একদিকে কুরআনী চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী ইমাম আলী (আ.) অপরদিকে নবী (সা.)-এর প্রধান শত্রু আবু সুফিয়ানের পুত্র,জাহেলীয়াতের প্রতিনিধিত্বকারী আমীর মুয়াবিয়া। যা-ই হোক না কেন,যখন মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে ইসলামী সভ্যতা বিকাশ লাভ করছিল,একই সময়ে প্রায় অদৃশ্য এক অভ্যন্তরীণ ক্ষত বিস্তার লাভ করছিল। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। পারস্পরিক বিরোধ,শত্রুতা এবং অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বেড়ে উঠতে লাগল।

যে গতিশীল আহ্বানের প্রতি সাড়া প্রদান অন্যদের ওপর বিজয় এনে দিয়েছিল,মুসলমানদের দৃষ্টিসীমা থেকে তা অপসৃত হল। মুসলমানরা যেন তাদের কাজে কিছু দিনের জন্য ইস্তফা দিল। সমুদ্র যাত্রা মন্থর হয়ে এল,তারা তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ল এবং তাদের শত্রুদের মেনে নিল।

সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুনের ভাষায়,মুসলমানদের অবস্থা ছিল নিজেদের অর্জন উপভোগের বিলাসিতায় মগ্ন নিঃশেষিত শহুরে অধিবাসীদের মত,যতদিন না প্রাচীন উপজাতীয় সৈন্যবাহিনী তাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। বহু শতাব্দী ধরে ইসলামকে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ১১শ’ শতকের শেষভাগে খ্রিস্টীয় জগতের (পশ্চিমা খ্রিস্টান) ক্রসেড্ মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিস্থাপনে প্রচণ্ড আক্রমণের সূচনা ঘটায়। তা ছিল হামলা ও অবরোধ যা সমগ্র খ্রিস্টীয় জগৎ দলবদ্ধ হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কার্যকর করে। একজন মুসলিম সুলতান ও জেনারেলের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেই আমরা কেবল এ সংকটের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। পশ্চিমা হুমকি মোকাবিলায় মুসলমান জনসাধারণের তাদের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে যে সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি লাভের প্রয়োজন ছিল তার সবটুকুই এ একজন মুসলমান নেতৃত্বের ভিতর খুঁজে পাওয়া যায়। লেন-পুল,সালাহ্উদ্দিন আল-আইউবির (Saladdin to the Christian West) কর্ম প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পশ্চিমের দুঃসাহসিক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিবিধানের গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। নিম্নোক্ত উদ্ধৃতাংশটি এ বিষয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলবে : ‘১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ক্রুসেড তার পূর্বমুখি অভিযান শুরু করে,১০৯৮তে এডেসা ও অ্যান্টিওক এবং আরও অনেক দুর্গ বিজিত হয়; ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানরা স্বয়ং জেরুজালেমের অধিকার ফিরে পায়। পরবর্তী অল্প কয়েক বছরে ফিলিস্তিনের বৃহৎ অংশ এবং সিরিয়া,টরটোসা,আক্কা,ত্রিপোলি এবং সিডন (১১১০) এর উপকূলসমূহ ক্রুসেডারদের হস্তগত হয়,১১২৪ খ্রিস্টাব্দে তায়রে বিজয় তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ সাফল্যের সূচনা ঘটায়। এটি ছিল সেই বিশেষ মুহূর্ত যখন ইউরোপ থেকে সফল আক্রমণ সম্ভবপর ছিল। এক প্রজন্ম পূর্বে সেলজুকদের ক্ষমতা ছিল দুর্ভেদ্য। পরবর্তী প্রজন্মে সিরিয়ায় জংগী অথবা নুরুদ্দীনের সেলজুকের স্থান দখল সম্ভবত আক্রমণকারীদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছিল। কোন এক শুভক্ষণে প্রথম ক্রুসেডের  প্রচারকরা এমন এক সুযোগ হস্তগত করতে সক্ষম হয় যার গুরুত্ব সম্পর্কে তারা নিজেরাই সেসময় অবগত ছিল না। পিটার,আরমিট এবং দ্বিতীয় আরবান যদি এশীয় রাজনীতির যথাযথ পাঠ নিতে পারতেন তাহলে তারা সে মাহেন্দ্রক্ষণকে বিচক্ষণতার সাথে সুনিশ্চিত বিজয় হিসাবে মনোনীত করতেন। কীলক যেমন নতুন ও পুরাতন কাঠ ফুঁড়ে ঢুকে যায়,ক্রুসেডও তেমনি করে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে,তা ইসলামী রাজত্বকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলবার ফাটলের সূচনা ঘটাবে।’ (Lane-Poole 1968 : 163-164)

 

সালাহ্উদ্দিন আল-আইউবী থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন সাহসী অনুসারীদের দ্বারা খ্রিস্টীয় সফলতার হিসাব উল্টে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ক্রুসেড (১১৩০) পরাজিত হয়,তৃতীয়টির (১১৮৯) পরাজয় আখ্যায়িত হয়েছিল অবরোধকারীদের ওপর অবরোধ হিসাবে,চিলড্রেন ক্রুসেড (১২১২) বিধ্বস্ত অবস্থায় শেষ হয়। হাঙ্গেরিয়ানদের পরিচালিত ক্রুসেড (১২১৭) ব্যর্থ হয়,এমনকি মহান ফ্রেডেরিকের ক্রুসেডটিও (১২২৪) ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাভারের রাজার নেতৃত্বের ক্রুসেডটি পরাজিত হয় এবং একইভাবে ফ্রান্সের রাজা নবম লুই এর ক্রুসেডেরও বিপর্যস্ত অবস্থায় পরিসমাপ্তি ঘটে (Lane-Poole 1968 : 163-165, 173,174, 209, 211, 218, 225-231, 239, 256)|

মুসলমানরা সাহিত্য,সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে সুগভীর ও দৃঢ় সাফল্য অর্জন করেছিল খ্রিস্টীয় জগৎ কর্তৃক তা উপলব্ধি করতে পারা ছিল ক্রুসেডের এ ব্যাপক পতনের একটি কারণ। তারা মুসলমানদের কাছ থেকে ধার করা বিদ্যা শিক্ষাগ্রহণ করেছিল। পূর্বের সাথে পশ্চিমাদের যোগাযোগ খ্রিস্টীয় জগতকে তাদের নিজেদের উৎকর্ষ সাধনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। রেনেসাঁর মত এত বড় ঘটনাও ইসলাম ও ইউরোপের সংযোগ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল (Izetbegovic 1999 : 143)|

এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে,খ্রিস্টীয় জগৎ ইসলামের পতনের আশা পরিত্যাগ করছিল না। পশ্চিমা ক্রুসেডের পরাজয় পরবর্তী সময়ে ইসলাম একটি নির্জীব অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও ক্রুসেডারদের শেষ পরাজয়ের শতাব্দীতে অটোমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় (১২৯৯)। পরবর্তী শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য প্রচণ্ড এক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কন্স্টান্টিনোপল বিজয়ের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপে ১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের ভিতরে তার অবস্থান সুদৃঢ় করে। প্রকৃতপক্ষে,অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরবর্তী তিন শতাব্দীকালে (১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দী) তা ‘ইউরোপের আতংক এবং সে সময়ের বিশ্বের বিদ্যমান সন্ত্রাস’ হিসাবে আবির্ভূত হয় (Lewis 1974 : 198-199)|

ইউরোপের কাছে তুর্কীরা ‘অবিশ্বাসী তুর্কী’ হিসাবে পরিগণিত হয় এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে শত্রুতার অগ্নি প্রজ্বলিত হতে থাকে। ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে পূর্বেও যেমনটি ঘটেছিল তেমনিভাবে অটোমান সাম্রাজ্যও শীঘ্রই তাদের কাজে কর্মে অবসর গ্রহণ করল। ভিতরে ভিতরে ক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তী তিন শতাব্দীতে (১৭শ থেকে ১৯শ শতক) মহান অটোমান সাম্রাজ্য একেবারেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এ পতনই চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ শতকের প্রারম্ভে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার পরাজয় ডেকে আনে। সুতরাং আন্তঃক্ষয় বহিঃআক্রমণ ডেকে এনেছিল (Oluwatoki 2001 : 29)|

এটা অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার যে,পাশ্চাত্য ইসলামের কাছে হেরে শিক্ষাগ্রহণ করেছিল। ইসলামের অর্জনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা আত্মসচেতন হয়ে ওঠে এবং রেনেসাঁ ও আলোকপ্রাপ্তির সময়ের উন্মেষ ঘটায়। ধর্মের কর্তৃত্ব পরিত্যাগ এবং যুক্তিকে গ্রহণ করে নেয়ার যুগে (Age of Reasoning) এ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়।

এটা ছিল সেই পাশ্চাত্য ও সেই খ্রিস্টজগৎ যারা বিশ্বজয়ের জন্য সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। আর ১৯শ’ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য তার অধঃপতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ১৮৩০ সালের মধ্যে উপনিবেশবাদী ফ্রান্স আলজিয়ার্স দখল করে নেয় (Abun-Nasr 1973 : 311) এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল বেলফোর ঘোষণা যা ইউরোপীয় ইহুদীদের (অথবা আরও যথার্থভাবে বর্ণবাদী যায়নবাদীদের) একটি জাতীয় আবাসন ব্যবস্থার জন্য ফিলিস্তিনকে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দান করে। ১৯৪৮ সালে অবৈধ যায়নবাদী ইসরাইলের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তখন থেকেই ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ আরব-ইসরাইল সংকটে রূপ নেয়। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ,উপনিবেশবাদ এবং পরবর্তীকালে নব্য উপনিবেশবাদের মাধ্যমে ইসলামি বিশ্বকে খ্রিস্টীয় জগৎ কর্তৃক অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এসেছে। এ সকল কিছুর সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে,মুসলমানরা এমন এক অবস্থায় নিপতিত হয়েছে যা তাদেরকে ভঙ্গুর এক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। মালেক বেন্নাবি যাকে ‘Colonisibility’ আখ্যা দিয়েছেন। অন্যভাবে বলা যায়,কোন জনসাধারণকে শুধু তখনই উপনিবেশ কবলিত করা সম্ভব যখন তারা নিজেরাই নিজেদের তেমন অবস্থানে নিয়ে যায়।

২. ষড়যন্ত্র এবং তার পারস্পরিক সম্পর্ক

আমি নিশ্চিত যে,আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। যা বাকি রয়ে গেছে তা হল,এ ষড়যন্ত্রের বিবিধ রূপের পরিস্ফুটন। শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ সামরিক প্রচেষ্টা ছাড়াও ষড়যন্ত্রের আর যেসব প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় তা নিম্নরূপ :

ক. শিক্ষা

উপনিবেশ স্থাপন করে পাশ্চাত্য তার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানদের তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধারণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে-যা কাজ করছে ইসলামি মূলনীতিকে গুরুত্বহীন এবং ইউরো-আমেরিকান ভাবধারার চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। আর এ পথেই তারা মুসলিম দেশগুলোতে পাশ্চাত্যপন্থী কিছু এলিট গড়ে তুলেছে যারা মুসলিম ভূমিগুলোতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করছে। যেমনটি বহু উপনিবেশে ঘটেছে। (এ শিক্ষা শুরু এবং শেষ হয়েছে তিনটি R দিয়ে : Writing, reading and arithmatic)

খ. আইনি ব্যবস্থা

পশ্চিমাদের অধীন মুসলিম ভূখণ্ডসমূহে ইসলামী বিধানসম্মত বিচার ও দণ্ডের বিলোপ এবং নিজস্ব ফৌজদারী বিধি আরোপের মাধ্যমে তারা ইসলামের আইনগত নীতিমালার বিনাশ ঘটাতে থাকে। তারা সর্বদাই অনিচ্ছাভরে দেওয়ানি ক্ষেত্রে ইসলামি বিধি প্রয়োগের অনুমতি প্রদান করেছে। মুসলমানদের জীবনে ইসলামের ব্যাপক প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করতেই পদ্ধতিগতভাবে ইসলামি বিধিবিধানের এ বিনাশ সাধন করা হয়। পাশ্চাত্য তার শিক্ষা ও সভ্যতার ক্রমাগত চর্চা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের যে কোন কিছুকে সর্বোত্তম হিসাবে উপস্থাপন করে। তাদের মানব-রচিত আইনকেই সকল অনিবার্য ত্রুটিসহই উচ্চমানসম্পন্ন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। ইসলামি আইনের ওপর সাধারণ আইনকে তার সকল বৈপরীত্য এবং ক্ষমতার নির্লজ্জ সুরক্ষা বিধানের বৈশিষ্ট্যসহ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চাপিয়ে দেওয়াতে যেসব সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে অনেক মুসলিম ভূখণ্ডে আজ তা দ্বন্দ্ব ও বিবাদের উৎস হিসাবে কাজ করছে।

গ. আর্থিক অবস্থা

যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের পরম লক্ষ্যই হচ্ছে পুঁজিবাদের বিকাশ উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা,তাই উপনিবেশিকরণ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত পর্যায়। এর মুখ্য চালিকাশক্তি হল বিশ্বের বিভিন্ন অংশকে বিশ্বপুঁজিবাদের অধীনে একত্র করা। সুদি কারবার এবং মুনাফাখোরি হল পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য যা ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থায় অস্বীকৃত।

অলিগোপলিভিত্তিক (একাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক একত্র হয়ে একচেটিয়া ব্যবসা) একচেটিয়া ব্যবসায় যুগের পর আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে অবস্থান করছি। যেখানে রাষ্ট্রসমূহের সীমান্তগুলোকে আন্তঃদেশীয় পুঁজির অনুপ্রবেশে সম্মতি প্রদানে বাধ্য করা হচ্ছে। আর এটি হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম অংশের সম্পদ ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত করার পশ্চিমা এলিট ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের একটি ষড়যন্ত্র।

AB Robinson দেখিয়েছেন যে,neo-liberalism এবং Polyarchi এর (আমেরিকার গণতন্ত্রের brand) দ্বন্দ্ব কীভাবে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটি স্থায়ী ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। ১৯৯২ সালের Human Development Report যথাযথভাবেই তা পরিস্ফুটিত করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে রিপোর্টটি দেখিয়েছে যে,বিশ্বের মাত্র ২০% জনগোষ্ঠী বিশ্বের সর্বমোট আয়ের ৮২.৭% লাভ করে এবং বিশ্বের দরিদ্রতম ২০% জনগোষ্ঠী বিশ্বের সর্বমোট আয়ের মাত্র ১.৪% পেয়ে থাকে। এ বিষয়টির প্রকটতা আবার যুক্ত হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে নিজস্ব বর্ধনশীল যে বৈষম্য রয়েছে তার সাথে। কোন কিছুই ইসলামি সামাজিক সংগঠনকে এর চেয়ে অধিক অস্বীকৃতি জানায় না (Robinson 1996 : 340-341)।

অন্যদের মত মুসলমানরাও ক্ষতির শিকারে পরিণত হয়েছে। এটা বলা যথেষ্ট যে,এ অর্থনৈতিক নির্দেশনা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে জানান দেয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্ব জুড়ে পাশ্চাত্য World Bank, International Monitory Fund এর মত Breton Wood  সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন তাদের চূড়ান্ত সাফল্য।

 

ঘ. তথ্য

রেডিও থেকে শুরু করে টেলিভিশন,সিনেমা,কম্পিউটার এবং এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি তথাকথিত বিশ্বপল্লীকে (Global Village) সফলতার সাথেই বিশ্বকক্ষে রূপান্তরিত করেছে। বিশ্বের দূর-দূরান্তের ঘটনা টেলিভিশনের মাধ্যমে মুহূর্তেই পরিবেশিত হচ্ছে। একইভাবে সকল ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক প্রভাব আপনার ও আপনার পরিবারের কাছে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাচ্ছে এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা মূল্যবোধ এবং প্রথাকে হুমকির সম্মুখীন করছে। আর গুরুত্বপূর্ণ রীতি-নীতি ও বিধানসমূহকে বিপন্ন করে তুলছে। এসব উপকরণের একটি বড় লক্ষ্যস্থল হল পোশাক-পরিচ্ছদ (বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে) এবং আরও অসংখ্য সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ যে বিষয়ে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। যে হারে পাশ্চাত্য তরুণদের মাঝে,এমনকি সবার মাঝে অনৈতিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। ট্যবলয়েডের পাঠক এবং টেলিভিশন ও সিনেমার দর্শক এবং ইন্টারনেটে বিচরণকারীরা বিনা বাধায় তাদের এমন এক ব্যবস্থার শিকারে পরিণত হচ্ছে যা সহিংসতা,পর্নোগ্রাফি,মদপান,জুয়ার মত আরও নানারকম ভয়ংকর সব নেতিবাচক প্রভাবের আধার। এসব কিছুই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যম তার গ্রাহককে এ ব্যাপারে অসহায় করে তুলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পাশ্চাত্যকে ইসলামের বিরুদ্ধে সংবাদ-যুদ্ধকে সম্ভবপর করেছে। বিশেষ করে বিশ্বাসের ওপর নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রচারের ক্ষেত্রে। আমরা মৌলবাদ শব্দটিকে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহারের বিষয়ে অবগত।

ঙ. নব্য উপনিবেশবাদ

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুসলিম দেশসমূহে যেভাবে সম্ভব,তাদের নীতিমালার ক্ষেত্রে,উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবং মুসলিম জনগণের জীবনযাত্রায় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে চলেছে। সৌদি-আমেরিকান সম্পর্ক এ বিষয়টিকে প্রতিভাত করে। যে কোন মুসলিম রাষ্ট্র যেখানে এ ইউরো-আমেরিকান কর্তৃত্বকে প্রতিরোধ করা হয়েছে,সেখানেই আক্রমণ,সামরিক বোমাবাজি,সরকার পরিবর্তন এবং অন্যান্য উপায়ে তার মোকাবিলা করা হয়েছে। অথবা সেসব রাষ্ট্র নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণার শিকারে পরিণত হয়েছে। ইরান,ইরাক,মিশর,লিবিয়া,আফগানিস্তান তেমনই অল্প কিছু উদাহরণ যা বিষয়টিকে প্রতীয়মান করে।

চ. ফিলিস্তিন

পাশ্চাত্যের ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ফিলিস্তিন একটি অপরিহার্য বিষয় এবং তার দ্বিচারিতার ক্ষেত্রে একটি চিরস্থায়ী অজুহাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটেন (তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাধর) তাদের অতিরিক্ত বোঝা অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধের শর্তে আরবদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। সে প্রতিশ্রুতি ফিলিস্তিনি আরবদের (মুসলমান ও খ্রিস্টান) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। একই সময়ে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ব্রিটেন ইউরোপীয় ইহুদীদের ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় ইহুদী আবাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা ছিল ১৯১৭ সালের ঘটনা (এ কারণে ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণা দেওয়া হয়)। এটা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,এ প্রতিশ্রুতি ছিল ইহুদীদের প্রতি ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের অমানবিক আচরণের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদী আন্দোলনের ফলে আন্তর্জাতিক যায়নবাদীদের চাপের ফসল। তাই জুদীয়-খ্রিস্টীয় সভ্যতার অযোগ্যতা,খ্রিস্টীয় জগতের তার ভাইয়ের তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রতিবিধান নিশ্চিতরূপেই ইসলাম,মুসলমান জনগণ ও তাদের অধিকার অস্বীকারের মাধ্যমে করা হয়েছে।

৩. ফলাফল ও কারণ

মুসলমান জনগণ ও তাদের ভূমির ওপর দু’শতাব্দীকালে কর্তৃত্ব এবং তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ এক সুস্পষ্ট পরিণতি লাভ করে। মুসলমানরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। তারা পাশ্চাত্যের সাফল্যকে ভুলক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফল হিসাবে চিহ্নিত করে। তারা বস্তুবাদিতার প্রলোভন ও ফাঁদে আটকা পড়ে আছে,যা পাশ্চাত্য সভ্যতা বিনির্মাণের মূল দর্শন। তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দ্বারা সুরক্ষিত অবাধ স্বাধীনতা ও উদার গণতন্ত্রের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে,যা উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে পুঁজিবাদী উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দান করে। মুসলমানরা তাদের ইসলামি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিজ্ঞান,সাহিত্য,রাজনীতি,সামরিক কৌশল,পারিবারিক সম্পর্ক,সামাজিক সংহতি এবং সামষ্টিক প্রচেষ্টার ব্যাপারে ইসলামি সভ্যতার ব্যাপক অর্জনগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করে। আরও বিপর্যয়কর হল,ইসলামের বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্য-প্রচারিত জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাছে তাদের অসহায় সম্মতি জ্ঞাপন। এ এক চরম পরিণতি এবং তা মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে তাদের শক্তির উৎসকে এমনভাবে নিঃশেষিত করেছে যে,তাদের কী করা উচিত তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না।

এতদসত্ত্বেও অবস্থা এতটাই গুরুতর যে,মুসলমানদের তাদের নিজেদের স্বার্থেই মহান আল্লাহর রাহে জাগ্রত হতে হবে। মুসলমানদের তাদের দায়িত্ব পালনে জেগে উঠতে হবে যাতে তারা তাদের নিজেদের আশ্রয়গুলো ভয়ানক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। আর এ উদ্দেশ্যে সকল ক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল হওয়া উচিত। সকল মুসলিম ভূ-খণ্ডে তার ব্যবস্থা এমন নীতিমালা দ্বারা সচেতনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত যা সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত মুসলিম নাগরিক গড়ে তুলবে যারা মহান আল্লাহর প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক আচরণ শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তা খুবই মৌলিক একটি উপাদান। শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তার পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। যে জাতি শিক্ষাকে অবহেলা করে এবং সমাজে যে কোন ধরনের মতের প্রচার অনুমোদন করে তারা আসলে এক মহাবিপদে পতিত হয়। মুসলমানরা নিজেদের জন্য হতাশার অনুমোদন দিতে পারে না। ইসলাম সবসময়ই শিক্ষাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আমাদের যুব সম্প্রদায়ের শিক্ষার বিষয়টি আমাদের শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে আমরা অসতর্ক ও অমনোযোগী হিসাবে গড়ে তুলছি।

সকল মুসলিম ভূ-খণ্ডে মুসলিম আইনকে সর্বোচ্চ আইন হিসাবে দৃঢ় করা উচিত। তবে,এক্ষেত্রে নাইজেরিয়ার মত দেশসমূহ যেখানে জনগণের বৃহদাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টান সদস্যদের মাঝে কঠোর ইসলাম বিরোধী মনোভাব বিদ্যমান সেক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা যতক্ষণ পর্যন্ত না সংবিধানের সীমারেখার মধ্যে থেকেই তাদের নিজেদের আইনি ব্যবস্থার অধিকার অর্জন করছে,আমরা আমাদের সংগ্রামে ক্ষান্তি দিতে পারি না।

মুসলমানদের তাদের নিজস্ব ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাদের সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনার উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। ইসলাম ও মুসলমানদের তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাসমূহ অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। প্রত্যেক মুসলমানকেই কম্পিউটারের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে তথ্যপ্রযুক্তির গতিশীল জগতে অংশগ্রহণ করতে হবে। সাইবার জগৎ সকলের জন্যই উন্মুক্ত। মুসলমানদের উচিত ইসলামি উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়া। ইসলামি ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ প্রচার এবং ইসলামি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রসারে এর সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।

মুসলমানদের বুদ্ধিদীপ্ত ও সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত। আর তা করা উচিত জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন এবং ইসলামি বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা যে সম্ভবপর তা সকলের সামনে উপস্থাপনের মানসিকতা নিয়ে। যে কোন পরিস্থিতিতেই মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে যাতে নব্য উপনিবেশবাদের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোকে এবং বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশনে পরিণত হওয়া প্রশ্নোবোধক Promotion of Democracy কে রুখে দেওয়া যায়। এ কথা বলে কোন লাভ নেই যে,যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে তার তথাকথিত গণতন্ত্রের সংবর্ধনে বহুমতের (Polyarchy) প্রসার ঘটিয়ে যাচ্ছে (Robinson : 1996) ।

ফিলিস্তিনি আরবদের পৃষ্ঠপোষকতা দানে মুসলমানদের অপরিহার্য এক দায় রয়ে গেছে-যারা পাশ্চাত্য সমর্থিত এবং পাশ্চাত্য-মদদপুষ্ট যায়নবাদীদের অধীনে ১৯১৭ সাল থেকে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এটি এমন এক সমস্যা যা আমরা কেবল আমাদের আরব ভাইদের ওপর ছেড়ে দিতে পারি না। তারা ইতোমধ্যেই বহু ধারায় বিভক্ত। পাশ্চাত্য এক্ষেত্রে আরব প্রতিরোধের ওপর একটি শক্ত পেরেক গেঁথে দিয়েছে। এতদ্ব্যতীত এক উম্মাহ্ হিসাবে বিশ্বের সকল মুসলমানেরই ফিলিস্তিন প্রশ্নে কিছু করার দায়িত্ব রয়েছে। আর তা অবশ্যই করতে হবে। যদি সকল মুসলিম ভূ-খণ্ডের সকল মুসলমান তাদের স্ব-স্ব সরকারকে অবহিত করে যে,ফিলিস্তিন প্রশ্নে তারা প্রকৃত অর্থেই গুরুত্বারোপ করছে তাহলে এসব সরকারও এ বিষয়কে তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে বিবেচনায় আনবে।

উপসংহার

আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের সামরিক শিক্ষা,আইনগত,আর্থিক,তথ্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মুসলমান হিসাবে আমাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং যে অবরোধ আমাদের সকল দিক বেষ্টন করে চেপে বসে আছে তার অবসান কল্পে এসব সমস্যার সমাধানও উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। আমাদের পূর্বে সালাহ্উদ্দিন আল-আইউবির মত আমাদেরও যা প্রয়োজন তা হল ‘অবরোধকারীদের ওপর অবরোধ’। এর মাধ্যমেই আমরা বিজয় অর্জন করব এবং আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পাব। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন আন্তরিক প্রচেষ্টা,দৃঢ় সংকল্প এবং অধ্যবসায়। আমাদের মনে রাখা উচিত যে,‘আল্লাহ্ ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে’। একইভাবে ‘আল্লাহ্ কোন জাতির প্রতি তিনি যে অনুগহ করেছেন তা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তা পরিবর্তন করে।’ (কুরআন ৮ : ৫৩)

 

তথ্যসূত্র :

১.Abun-Nasr, Jamal. A History of the Maghrib. Cambridge: Cambridge University Press, 1973.

২.Ali, Abdallah Yousuf. The Glorious Kur’an: Text, Translation and Commentary. Beirut, Dar al-Fikr, n.d.

৩. Asad Muhammad. Islam andWestern Civilization. n.p,n.p,n.d.

৪. Bennabi, Malek. Islam in History and Society (Trans. from French and Annotated by Asma Rashid). Islamabad, Islamic Research Institute, 1988.

৫. Clausewitz, Otto von. On War. In Hutchins, Robert M. and Adler, Mortimer J; (Eds.) Gateway to the Great Books. vol 7., Man and Society. Chicago, William Benton, 1963.

৬. Gibb, H.A.R. Islam: A Historical Survey (2nd Edition). Oxford, Oxford University Press, 1975.

৭. Hitti, Philip K. History of the Arabs from the Ancient Times tothe Present (10th Edition). London: Longman, 1973.

৮. lzetbegovic, A.A. Islam Between East and West. Indianapolis, American Trust Publications, 1999.

৯. Lane-Poole, Stanley. A History of Egypt in the Middle Ages. London, Frank Cass, 1968.

১০. Lewis, Bemard, War and Politics in Schacht, Joseph with Bosworth, C.E. (Ed.), The Legacy of Islam. Oxford, The Clarendon Press, 1974.

১১. Lewis, Bemard. The Arabs in History. London. Hutchison University Library, 1966.

১২. Oluwatoki, Abu Sayf J.A. Islam, the West and Terrorism. Ado-Ekiti, Idris Oluwatoki Islamic Foundation, 2001.

১৩. Oluwatoki, J.A., “Institutions and State Building: An Overview of the Asiatic Ottoman Civilization.” In AI-Hadarah: LASU Journal of Arabic and Islamic Studies. vol. 4, June, 2001.

১৪. O’Sullivan, Patrick and Miller Jr., Jesse W. The Geography of Warfare. London, Croom Helm, 1983.

১৫. Robinson, William I. Promoting polyarchy: Globalization, US Intervention, and Hegemony. Cambridge, Cambridge University Press, 1996.

 (সূত্র:প্রত্যাশা-বর্ষ-১,সংখ্যা-২)