কারবালার মহাবিপ্লব ইসলাম ও মানব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠ গৌরব
  • শিরোনাম: কারবালার মহাবিপ্লব ইসলাম ও মানব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠ গৌরব
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:43:45 4-9-1403

 

হোক্ দুশমন অগণন তবু হে সেনানী! আজ দাও হুকুম

মৃত্যু সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মোরা ভাঙ্গবো ক্লান্ত প্রাণের ঘুম!

 

মহান আল্লাহকে অশেষ শুকুর যিনি আবারও বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য বিপ্লব তথা আশুরা বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ দিয়েছেন। এমন দিনে কারবালার মহা-বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সঙ্গীদের শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ। একইসঙ্গে সবাই জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম এবং অশেষ শোক ও সমবেদনা।

নানা বাধা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সা.) একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে চরম সৌভাগ্যের সোপানে উন্নীত করেছিলেন। অবশ্য তাঁর তিরোধানের পরও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে। ফলে একটি বিশেষ পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছিল কয়েকটি গৃহযুদ্ধ। অবশেষে কুচক্রী ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের ষড়যন্ত্রে বিশ্বনবী (সা.)’র হিজরতের প্রায় ৪০ বছর পরই ইসলামের নামে চালু হয় রাজতন্ত্র। ভোগবাদ ও গোত্রবাদসহ জাহিলি যুগের নানা বৈশিষ্ট্য আবারও কর্তৃত্ব ফিরে পায়। পরিস্থিতি এত শোচনীয় হয়ে ওঠে যে একজন মদ্যপায়ী,ব্যভিচারী,জুয়াড়ি ও পুরোপুরি ফাসিক চরিত্রের অধিকারী ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইসলামী খেলাফতের দাবিদার হয়ে বসে।

কিন্তু ইয়াজিদ ও তার দলবলের প্রকাশ্য পাপাচার দেখেও একমাত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ছাড়া কেউ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বা প্রকাশ্যে কথা বলতেও সাহসী হননি।

আসলে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা ইসলামের লেবাস পরেই ইসলামের বারোটা বাজানোর আয়োজন পাকাপোক্ত করছিল। ইসলামের এমন মহাসংকটে যিনি স্বাধীনতা,ন্যায়বিচার,মানবিকতা ও সত্যের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে প্রকৃত ইসলামকে আবারও জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)। ফলে ইসলাম তাঁর কাছে চির-ঋণী। এ জন্যই বিশ্বনবী (সা.) বলেছিলেন,'হুসাইন আমা থেকে আমি হুসাইন থেকে'।

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে,কোনো এক সময় মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে,বনী উমাইয়্যা তাঁর মিম্বরে বানরের মত নাচানাচি করছে। এ স্বপ্ন দেখে তিনি এমনই শোকাহত হলেন যে,এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি আর হাসেননি। তাঁর এই স্বপ্ন দেখার পর পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াত নাজেল হয়েছিল।

“এবং (স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাকে বলেছিলাম যে,নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন এবং আমরা তোমাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম তা কেবল মানুষের জন্য পরীক্ষার মাধ্যম ছিল এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও। আমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকি,কিন্তু তা তাদের চরম ঔদ্ধত্যকেই কেবল বৃদ্ধি করে।”

তাফসিরে তাবারিসহ কয়েকটি সুন্নি সূত্রমতে,কুরআনের ওই আয়াতে উল্লিখিত “অভিশপ্ত বৃক্ষ” বলতে আবু সুফিয়ানের বংশধর তথা উমাইয়াদের বোঝানো হয়েছে এবং রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁর মিম্বরে বানরদের নাচানাচির অর্থ উমাইয়াদের মাধ্যমে খেলাফত দখল করা হবে।

যাই হোক,হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) লক্ষ্য করেন যে,ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বিলুপ্তির ব্যবস্থা করছে উমাইয়া রাষ্ট্রযন্ত্র। তাই ইসলামকে রক্ষার ও মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসেন এই মহান ইমাম। তিনি নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন:

“আপনারা জেনে রাখুন যে এরা (বনি উমাইয়ারা) সব সময়ই শয়তানের সঙ্গী। তারা আল্লাহর নির্দেশ ত্যাগ করেছে এবং প্রকাশ্যে ফ্যাসাদ বা দুর্নীতি ও অনাচার করে যাচ্ছে। তারা আল্লাহর বিধানকে নিষিদ্ধ করেছে এবং জনগণের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছে। তারা আল্লাহ যা নিষিদ্ধ বা হারাম করেছেন সেসবকে হালাল বা বৈধ করেছে এবং আল্লাহ যেসবকে হালাল করেছেন সেসবকে হারাম করেছে।”

ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালা বিপ্লবের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছিলেন,“হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন,আমাদের পক্ষ থেকে যা হচ্ছে তা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলও আমাদের লক্ষ্য নয়। বরং তোমার দ্বীনকে বাঁচিয়ে রাখা,তোমার ভূখণ্ডে সংস্কার আনা ও নির্যাতিত ব্যক্তিদের স্বস্তি দেয়ার জন্যই আমরা কিয়াম করেছি যাতে ধর্মের ফরজগুলো পালিত হয়।”

সে যুগে বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সমর্থকদের এক বিপুল অংশ বসবাস করতেন কুফায়। ইরাকের এই শহর থেকে তারা চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)’র কাছে যাতে তিনি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার স্বেচ্ছাচারী ও পাশবিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করেন। ইমাম এই আহ্বানে সাড়া দেন। এই মহাবিপ্লব সাধনের লক্ষ্যে মক্কা ও মদিনা থেকে স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনসহ তিনি যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে কয়েক হাজার উৎসাহী ব্যক্তি তাঁর সফর-সঙ্গী হয়েছিল। অবশ্য তাদের মধ্যে প্রায় একশত ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা গণিমত ও পদ-মর্যাদা লাভকেই টার্গেট করেছিল। কিন্তু ইমাম যখন এটা জানিয়ে দেন যে এই মহা-অভিযান সফল হবে না,বরং এ বিপ্লবে শরিকদেরকে শহীদ হতে হবে তখন দুনিয়া-লোভীরা তাঁকে চরম স্বার্থপরের মতই ত্যাগ করে।

কুফায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র প্রতিনিধি হযরত মুসলিম বিন আকিলের (আ.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেখানকার প্রায় ১৮-১৯ হাজার ব্যক্তি ইমামের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। কিন্তু এ খবর জানার পর কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের গভর্নর ব্যাপক ধরপাকড় চালায় এবং শহরটির সর্বত্র গুপ্তচর লেলিয়ে দেয় ও ইমাম শিবিরের পরাজয়ের অনিবার্যতার কথা প্রচার করতে থাকে। ফলে কুফার আতঙ্কগ্রস্ত ও দুর্বল ঈমানের অধিকারীরা তাদের সব বিপ্লবী শ্লোগান ও বাইয়াতের কথা ভুলে গিয়ে আত্মগোপন করে। এ অবস্থায় শহীদ হন হযরত মুসলিম ইবনে আকিল এবং শেষ পর্যন্ত কারবালায় সংঘটিত হয় ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ১০০ জন সঙ্গীর অনন্য ত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ ট্র্যাজেডিতে গাঁথা মহাবিপ্লব। এ বিপ্লব ইসলামকে দিয়েছে অনন্য সম্মান ও নব-জীবন। সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণে এ বিপ্লবের মাঝি ও মাল্লারা গোটা মানব জাতির জন্য গর্ব আর চরম আত্মত্যাগ,আনুগত্য এবং খোদাপ্রেমের কারণে মহান আল্লাহরও অহংকার।

দুঃখজনক বিষয় হল মুসলিম বিশ্বের অনেকেই আজো কারবালা বিপ্লবের প্রকৃত ঘটনা,লক্ষ্য,গুরুত্ব এবং ইসলামের প্রকৃত নেতৃবৃন্দ ও অযোগ্য নেতৃবৃন্দের পরিচয় ভালভাবে জানেন না। ইসলামের ইতিহাসের অনেক বাস্তবতাকেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে হাজার হাজার বা লাখ লাখ মিথ্যা হাদীস ও বিকৃত ইতিহাস প্রচারের মাধ্যমে।

ফলে অনেকেই মনে করেন মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক যদি জালিমও হয় তবুও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা নাজায়েজ। তাই ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার সঙ্গীরা যে অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয়েছেন তার জন্য তাঁরাই দায়ী! বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ইরাকের কুফার দিকে যেতে অনেক সাহাবীই নিষেধ করেছিলেন,কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কেন তাদের নিষেধ না শুনে সেদিকে গেলেন? কিংবা রাজা-বাদশাহরা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি তা তারা যত অযোগ্য বা ফাসেকও হন না কেন! কিংবা কেউ বলেন,আল্লাহ অশেষ ক্ষমাশীল ও দয়ালু তাই ইয়াজিদের মত জালিমকেও ক্ষমা করে দিতে পারেন। অথবা ইয়াজিদের প্রতি অসম্মান করা যাবে না,কারণ তাতে তার পিতাসহ যেসব সাহাবী ইয়াজিদকে সমর্থন জানিয়ে ‘ভুল’ করেছেন বা কথিত ইজতিহাদে ‘ভুল’ করেছেন তাদেরও অসম্মান করা হবে!  

অথচ এই শ্রেণীর মানুষ ভুলে যান বুখারি ও মুসলিম শরীফের এই হাদীস যেখানে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : 

"কিয়ামতের দিন আমার সাহাবিদের মধ্যে হতে একটি দলকে (অথবা বলেছেন আমার উম্মতের মধ্য হতে একটি দলকে) আমার সামনে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর তাদেরকে হাউজে কাওসার হতে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে বা সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। তখন আমি বলব: হে আমার প্রভু! এরা আমার সাহাবি। মহান আল্লাহ উত্তরে বলবেন: আপনার পরে পরে এরা যা কিছু করেছে সে সম্পর্কে আপনি অবগত নন। তারা তাদের পূর্বাবস্থায় (অজ্ঞতা তথা জাহেলিয়াতের যুগে) প্রত্যাবর্তন করেছিল।” ( বুখারী,৪র্থ খণ্ড,পৃ-৯৪,১৫৬ পৃ,২য় খণ্ড,৩২ পৃ,মুসলিম শরীফ ৭ম খণ্ড,পৃ-৬৬) 

কেউ কেউ বলেন,ইয়াজিদ তো ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যাই করেননি,বরং তাঁকে হত্যার জন্য ইবনে জিয়াদকে তিরস্কার করেছেন এবং কেঁদেছেন!

এভাবে নানা পন্থায় কারবালার সত্য ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে এবং এই মহা-বিপ্লবের প্রকৃত মাহাত্ম্য,গুরুত্ব ও চেতনাকে খাটো করা হচ্ছে। মিথ্যা প্রচারণা ও ইসলামের বিকৃত ইতিহাসের প্রভাবের কথা তুলে ধরছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল:

ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্।..

তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে !

এসেছে সীমার,এসেছে কুফা'র বিশ্বাসঘাতকতা,

ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !

মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,

...কাঁদে আসমান জমিন,কাঁদিছে মহররমের চাঁদ।

একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,

আর দিকে যত তখত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।..

এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,

আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !

 এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়

হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।.. 

 

অথচ বিশ্বনবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতকে উম্মতের ‘নাজাতের তরী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি উম্মতকে তাঁর আহলে বাইতের চেয়ে আগ বাড়িয়ে না চলার কিংবা তাঁদের পথ বাদ দিয়ে অন্য কারো পথ অনুসরণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। 

হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) আমাদেরকে এটা শিখিয়ে গেছেন যে সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। ইয়াজিদের মত দুরাচারী ব্যক্তির শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন: তোমরা কি দেখছ না যে,আল্লাহর সঙ্গে করা অঙ্গীকারগুলো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু তোমরা নীরব রয়েছ ও আল্লাহকে ভয় করছ না। অথচ তোমাদের বাপদাদার সঙ্গে করা কিছু অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হলে তোমরা কান্নাকাটি কর। অন্যদিকে রাসূল (সা.)’র সঙ্গে করা অঙ্গীকারগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে দেখেও তোমরা এ বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছ না।” 

বিশ্বনবী (সা.)’র হাদিসে বলা হয়েছে,যারা জালেম শাসক ও যারা আল্লাহর ঘোষিত হারামকে হালাল করে তাদের ব্যাপারে কেউ যদি নীরব থাকে এবং কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে তারও স্থান হবে ওই জালেম শাসকের জায়গায় তথা জাহান্নামে।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর মহা-বিপ্লবের লক্ষ সম্পর্কে স্পষ্টভাবেই বলে গেছেন:

“আমি আমার নানার উম্মতের সংস্কারের জন্য বের হয়েছি। আমি সৎ কাজের আদেশ দিতে চাই এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে চাই এবং আমার নানার আচরণ ও সুন্নাত অনুযায়ী আচরণ করতে চাই।” 

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁর সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: হুসাইন আমার চোখের আলো,সে আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে। যা কিছু তাঁকে আনন্দিত করে তা আমাকেও আনন্দিত করে,যা কিছু তাঁকে কষ্ট দেয় তা আমাকেও কষ্ট দেয়। আর যা আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়। 

একবার রাসূল (সা.) শিশু হুসাইন (আ.)’র জন্য উটের মত হয়ে তাঁকে পিঠে নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে এক সাহাবী মন্তব্য করেছিলেন,হুসাইনের বাহনটি কতই না উত্তম! জবাবে রাসূল (সা.) বলেছিলেন,আমার সওয়ারি বা যাত্রীও কতই না উত্তম। বিশ্বনবী প্রায়ই শিশু হুসাইন (আ.)’র গলায় চুমো খেতেন। কারবালার অনাগত ঘটনার জন্য কাঁদতেন। 

আশুরা ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতির এমন এক মহাসাগর যার সমস্ত দিক তুলে ধরা দুঃসাধ্য এবং যার অসংখ্য কল্যাণময় দিক ও নতুনত্ব কখনও ফুরাবে না। আশুরা বিপ্লব যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে নানা মহান বিপ্লব ও সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। তাই বলা হয়,মু'মিনদের জন্য প্রতিটি দিনই আশুরা ও প্রতিটি ময়দানই কারবালা। আশুরা তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের আদর্শ। শাহাদতের সংস্কৃতিই যে স্বাধীনতা আর ইসলামকে রক্ষার ও সার্বিক সৌভাগ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষা-কবচ তা প্রমাণিত হয়েছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে,প্রমাণিত হয়েছে লেবানন,ইরাক ও ফিলিস্তিনের সংগ্রামে।

পৃথিবীতে বেশি দামী বিষয় অর্জনের জন্য বেশি শ্রম বা মূল্য দিতে হয়। খাঁটি ইসলাম প্রতিষ্ঠাও এই সত্যের ব্যতিক্রম নয়। বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেয়ে ইসলাম রক্ষা অনেক বেশী কঠিন। কারবালা বিপ্লবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো: অপূর্ণ ও দুর্বল ঈমান খাঁটি মুসলমান হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় এবং বিপ্লব করতে হবে যথাসময়ে। সব সময়ই জালিম ও খোদাদ্রোহী শক্তির সঙ্গে শত্রুতা চালিয়ে যেতে হবে এবং মূল সমস্যা বা সংকট থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। স্বাধীনতার মর্যাদাকে সবসময়ই গুরুত্ব দিতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমাম হুসাইন (আ.)’র আদর্শকে অনুসরণ করতে হবে ও সাফল্য আসুক বা না আসুক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যেতে হবে। একইসঙ্গে নবী-পরিবারের ওপর নেমে আসা অতুলনীয় বিপদ আর কষ্টের শোককে জিইয়ে রেখে পরিণত করতে হবে তাকে পরমাণু বোমার চেয়েও জোরালো অফুরন্ত শক্তির আধারে। এ ছাড়াও চিনতে হবে প্রতিটি যুগের ইয়াজিদ বা ইয়াজিদপন্থী,ইবনে জিয়াদ,ওমর সাদ ও শিমারদেরকে এবং চিনতে হবে হুসাইনপন্থীদেরকে। আর সতর্ক থাকতে হবে বন্ধু-বেশী শত্রু বা মুনাফিক ও কাফিরদের কুটিল এবং জটিল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যাতে সত্য-মিথ্যার ধূম্রজালেও চেনা যায় খাঁটি ইসলামের পথ। 

আজ যদি মুসলিম বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে আশুরার চেতনা শানিত হত তাহলে বিলুপ্ত হত মুসলমানদের প্রথম কেবলার দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল,রুখে দেয়া যেত আমেরিকার সমস্ত জুলুম ও অত্যাচার এবং বন্ধ হত আরাকান,শিনজিয়াং,কাশ্মির ও অন্যান্য স্থানে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা। আজ যদি মুসলমানরা ইসলামের হুসাইনি ধারার অনুসারী হতে পারেন তাহলে খুব সহজেই নির্মূল হবে ইসলামের নামে ইসলামের শত্রুদেরই চাপিয়ে দেয়া তাকফিরি আর ওয়াহাবি সন্ত্রাসীদের সমস্ত গ্রুপ। আজ যদি বিশ্বের সব মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামের শত্রুদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাহলেই মহান আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন ইমাম হুসাইন (আ.)'র প্রকৃত অনুসারী হওয়ার মর্যাদা। আর এই মহান সংগ্রামে অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক পবিত্রতা,তাকওয়া এবং যথাযথ জ্ঞান অর্জনও অপরিহার্য। 

 “উষ্ণীষ কোরানের,হাতে তেগ আরবীর

দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,-

তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা!

শমসের হাতে নাও,বাঁধো শিরে আমামা!

বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নকীবের তুর্য

হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য!

জাগো,ওঠো মুসলিম,হাঁকো হায়দরী হাঁক

শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক!”

(রেডিও তেহরান )