মদীনা সনদ - ইতিহাসের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র
  • শিরোনাম: মদীনা সনদ - ইতিহাসের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 14:51:54 4-9-1403

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পরপরই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। গোত্রীয় শাসনে অভ্যস্ত আরব গোত্রগুলোকে সুসভ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম তিনি একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র যা পরবর্তীতে ‘মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত হয়। এটি মহানবীর মদীনায় হিজরতের প্রথম বর্ষে (৬২৪ খ্রিস্টাব্দে) সম্পাদিত হয়েছিল।

মহানবী (সা.) মদীনায় বসবাসরত মুসলমান, ইহুদী ও পৌত্তলিক নির্বিশেষে সকল নাগরিকের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি, সংহতি ও সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কতিপয় নীতিমালার ভিত্তিতে এ চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন।

যেহেতু এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তিনামা যাতে শৃঙ্খলা, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের মূলনীতির প্রতি মহানবীর মহান দৃষ্টিভঙ্গির উত্তম প্রতিফলন ঘটেছে এবং এ বিষয়গুলোর প্রতি তাঁর সম্মান প্রদান, ইসলামী রাষ্ট্রকে সুসংহত ও সমুন্নত করা এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁর প্রয়াস প্রভৃতি দিক ভালোভাবে ফুটে উঠেছে, সেহেতু এ চুক্তিনামার উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

এ চুক্তিনামা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ ও মদীনার মুসলমান এবং তাদের অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পাদন করেন।

ধারা : ১

উপধারা ১ : এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষরকারিগণ এক জাতি হিসাবে পরিগণিত হবে। কুরাইশ মুহাজিরগণ তাদের ইসলামপূর্ব নিয়মানুযায়ী রক্তপণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। যদি তাদের কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে অথবা তাদের কেউ বন্দী হয় তবে এ ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমবেতভাবে ঐ রক্তপণ আদায় করবে ও বন্দীকে মুক্ত করতে হবে।

উপধারা ২ : বনি আওফ কুরাইশ মুহাজিরদের ন্যায় এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী আইন অনুসরণ করবে এবং তাদের গোত্রের বন্দীদেরকে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে। তেমনিভাবে আনসারদের মধ্যে যে সব গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে, যেমন বনি সায়েদা, বনি হারিস, বনি জুশাম, বনি নাজ্জার, বনি আমর ইবনে আওফ, বনি নাবিত ও বনি আওস, তারাও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তির রক্তপণ সমবেতভাবে প্রদান করবে এবং তাদের বন্দীদেরকে গোত্রের সকলে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে।

উপধারা ৩ : আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে মুসলমানগণ সমবেতভাবে সাহায্য করবে। কোন মুসলমান যদি রক্তপণ অথবা মুক্তিপণ প্রদানের কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তবে সকলকে তাকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ৪ : পরহেজগার মুমিনগণ তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তি অবাধ্য হলে এবং অনাচার করলে তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যদিও সে ব্যক্তি তাদের করো সন্তান হয়।

উপধারা ৫ : কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানের সন্তান অথবা দাসের সঙ্গে তাদের পিতা ও মনিবের অনুমতি ব্যতিরেকে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না।

উপধারা ৬ : কোন কাফিরকে হত্যা করার দায়ে কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করার অধিকার কোন মুমিনের নেই। কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সহযোগিতা করা যাবে না।

উপধারা ৭ : চুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মুসলমান সমান। এ দৃষ্টিতে উচ্চ-নিচ সকল মুসলমানই সমানভাবে কাফিরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে।

উপধারা ৮ : মুসলমানগণ একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী।

উপধারা ৯ : ইহুদীদের মধ্য হতে যে আমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণ করে সে আমাদের সহযোগিতা পাবে। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য মুসলমানের কোনই পার্থক্য নেই এবং তার প্রতি অবিচার করার অধিকার করো নেই। তার বিরুদ্ধে কাউকে ক্ষেপিয়ে তোলা ও তার শত্র“কে সাহায্য করা যাবে না।

উপধারা ১০ : সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অপর মুসলমানের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিদান না করে সন্ধি চুক্তি করা যাবে না।

উপধারা ১১ : মুসলমানদের বিভিন্ন দল পালাক্রমে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহণ করবে যাতে আল্লাহর পথে তাদের রক্ত সমভাবে উৎসর্গীকৃত হয়।

উপধারা ১২ : মুসলমানদের অনুসৃত পথ ও ধর্ম সর্বোত্তম পথ।

উপধারা ১৩ : কুরাইশ মুশরিকদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সহযোগিতা করার কোন অধিকার মদীনার মুশরিকদের নেই এবং তাদের সঙ্গে কোনরূপ চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। তাদেরকে মুসলমানদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

উপধারা ১৪ : যদি কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং তার এ অপরাধ শরীয়তগতভাবে প্রমাণিত হলে হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। তবে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তবে তাকে প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এ উভয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব হলো হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ।

উপধারা ১৫ : যে ব্যক্তিই এ চুক্তিনামার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করবে তার এ চুক্তিনামা লঙ্ঘনের ও কোন অপরাধীকে সহযোগিতা ও আশ্রয় দানের কোন অধিকার নেই। যে কেউই অপরাধীকে সহযোগিতা করলে কিংবা আশ্রয় দিলে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে সকল ক্ষতির দায়-দায়িত্ব তার।

উপধারা ১৬ : যে কোন বিভেদের ফয়সালার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল।

ধারা : ২

উপধারা ১৭ : মদীনাকে রক্ষার জন্য মুসলমানরা যুদ্ধ করলে ইহুদীদের অবশ্যই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে হবে।

উপধারা ১৮ : বনি আওফের ইহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে এক জাতি হিসাবে পরিগণিত এবং মুসলমান ও ইহুদীরা তাদের ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। তাদের দাসরা এ বিধানের অন্তর্গত অর্থাৎ তারাও এ ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে যে সকল অন্যায়কারী তার নিজ ও পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তারা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ব্যতিক্রমের ফলে ঐক্য কেবল শান্তিপ্রিয় মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়েছে।

উপধারা ১৯ : বনি নাজ্জার, বনি হারিস, বনি সায়েদা, বনি জুশাম, বনি আওস, বনি সায়ালাবা ও বনি শাতিবার ইয়াহুদীরাও বনি আওফ গোত্রের ইয়াহুদীদের ন্যায় উপরিউক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সায়ালাবা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত জাফনা গোত্র এবং বনি শাতিবার অন্তর্ভুক্ত সকল উপগোত্রও বনি আওফের ন্যায় অধিকার ভোগ করবে।

উপধারা ২০ : এ চুক্তির অধীন সকলকেই তাদের মন্দের ওপর ভালো বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিজয়ী করতে হবে।

উপধারা ২১ : বনি সায়ালাবার অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহ বনি সায়ালাবার জন্য প্রযোজ্য বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২২ : ইহুদীদের উপরিউক্ত গোত্রসমূহের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গ এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২৩ : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউই এ চুক্তিবদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

উপধারা ২৪ : এ চুক্তির অধীন প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত সম্মানিত। (অর্থাৎ আহত ও নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির রক্তের মর্যাদার বিধান রয়েছে।) যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তবে তার ওপর কিসাসের বিধান কার্যকরী হবে। এর (হত্যার) মাধ্যমে সে যেন নিজ ও স্বীয় পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। কিন্তু হত্যাকারী যদি অত্যাচারিত হয় তবে তার বিধান ভিন্ন।

উপধারা ২৫ : যদি মুসলমান ও ইহুদীরা সমবেতভাবে যুদ্ধ করে তবে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে যুদ্ধের খরচ বহন করবে। যদি কেউ চুক্তিবদ্ধ জোটের কোন এক অংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে জোটের অন্তর্ভুক্ত সকল পক্ষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

উপধারা ২৬ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহ কল্যাণের ভিত্তিতে পরস্পরের সহযোগী, অকল্যাণের ভিত্তিতে নয়।

উপধারা ২৭ : চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষই অন্য কোন পক্ষের ওপর অবিচার করার অধিকার রাখে না। কেউ এরূপ করলে সকলকে অবশ্যই অত্যাচারিত পক্ষকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ২৮ : চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষের জন্য মদীনা নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হলো।

উপধারা ২৯ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষের কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রতিবেশীকে আশ্রয় দান করে তবে তার জীবন অন্য সকলের জীবনের ন্যায় সম্মানার্হ এবং কোনক্রমেই তার ক্ষতি করা যাবে না।

উপধারা ৩০ : কোন নারীকেই তার নিকটাত্মীয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

উপধারা ৩১ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহের সকল ব্যক্তি ও গোত্র মুমিন হোক বা কাফের তাদের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীসাংসাকারী স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির সঙ্গে রয়েছেন যে ব্যক্তি এ চুক্তিনামার প্রতি সর্বাধিক প্রতিশ্র“তিবদ্ধ।

উপধারা ৩২ : কুরাইশ ও তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি ও গোত্রকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

ধারা : ৩

উপধারা ৩৩ : এ চুক্তি স্বাক্ষরকারী সকল পক্ষ সমবেতভাবে মদীনাকে রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

উপধারা ৩৪ : যদি মুসলমানরা ইহুদীদের কোন শত্র“র সঙ্গে সন্ধির আহ্বান জানায় তবে ইহুদীদের তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপ ইহুদীরা যদি মুসলমানদের কোন শত্র“পক্ষের সঙ্গে সন্ধির আহ্বান জানায় তবে মুসলমানগণ তা গ্রহণে বাধ্য। তবে যদি ঐ শত্র“পক্ষ ইসলামের শত্র“ ও ইসলাম প্রচারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে তবে তা গ্রহণীয় নয়।

উপধারা ৩৫ : আওস গোত্রের গোলাম-মনিব নির্বিশেষে সকল ইহুদী এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।

ধারা : ৪

উপধারা ৩৬ : এ চুক্তিনামা অত্যাচারী ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না।

উপধারা ৩৭ : মদীনায় অবস্থানকারী যে কোন ব্যক্তি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী এবং মদীনা থেকে যারা বাইরে যাবে তারাও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী, তবে এ বিধান অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

এ চুক্তিনামার শেষ বাক্যটি ছিল : إنّ الله جار لمن برّ واتّقى و محمد رسول الله “সৎকর্মপরায়ণ এবং পরহেজগার ব্যক্তির নিরাপত্তা দানকারী স্বয়ং আল্লাহ্ এবং মুহাম্মদ আল্লাহর নবী।”

ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজের প্রয়োজনে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি এতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। সর্বোপরি এ চুক্তিপত্রে নেতার দায়িত্ব ও ইখতিয়ার এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী সর্বসাধারণের দায়িত্বের বিষয়টি পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে।

(চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত)