হজের সময় মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা ও এর সুফল
  • শিরোনাম: হজের সময় মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা ও এর সুফল
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 0:38:22 2-9-1403

হিজরতের নবম বর্ষের শেষের দিকে ওহীর ফেরেশতা সূরা তাওবার কয়েকখানা আয়াত নিয়ে এসে মহানবী (সা.)-কে দায়িত্ব প্রদান করলেন, তিনি যেন হজ্বের মৌসুমে ৪ ধারা সম্বলিত ঘোষণাপত্রসহ এ আয়াতগুলো পাঠ করার জন্য এক ব্যক্তিকে পবিত্র মক্কায় পাঠান। এ সব আয়াতে মুশরিকদের যে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয় এবং (চুক্তি সম্পাদনকারীরা যে সব চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে এবং কার্যত লঙ্ঘন করেনি, কেবল সে সব চুক্তি ছাড়া) সব চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয় এবং মুশরিক নেতারা ও তাদের অনুসারীদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়, চার মাসের মধ্যে তাওহীদী আদর্শে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমতের সাথে যেন নিজেদের সম্পর্ক ও দায়িত্বটা সুস্পষ্ট করে নেয় এবং তারা যদি এ চার মাস সময়সীমার মধ্যে শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ না করে, তা হলে তাদের থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হবে।

প্রাচ্যবিদরা যখনই ইসলামের ইতিহাসের এ পর্যায়ে উপনীত হন, তখনই তারা ইসলামের প্রতি তাদের তীক্ষ্ম আক্রমণগুলো চালনা করতে থাকেন এবং (মুশরিকদের প্রতি ইসলাম ও মহানবীর) এ চূড়ান্ত কঠোর আচরণকে আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বিবেচনা করেন। তবে তারা যদি সব ধরনের গোঁড়ামি পরিহার করে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করতেন এবং এ বিষয়, যা সূরা তাওবা এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে বর্ণিত হয়েছে, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করতেন, তা হলে সম্ভবত তারা কম ভ্রান্তির শিকার হতেন এবং এ স্বীকৃতি দিতেন যে, এ পদক্ষেপ কখনই আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, যা বিশ্বের সকল বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সম্মানার্হ। এ ঘোষণাপত্র জারির মূল উদ্দেশ্যগুলো ছিল নিম্নরূপ :

১. জাহিলীয়াতের যুগে আরবদের প্রথা ছিল এই যে, পবিত্র কাবা তাওয়াফ ও যিয়ারতকারী প্রত্যেক ব্যক্তি যে পোশাক পরে কাবা তাওয়াফ করত, তা দরিদ্রকে দান করত এবং তার একটির বেশি পোশাক না থাকলে পোশাক ধার করে তা পরে তাওয়াফ করত, যাতে সে দরিদ্রকে তার পোশাক দান করতে বাধ্য না হয়। আর ধার করা সম্ভব না হলে তাকে পোশাকবিহীন অবস্থায় তাওয়াফ করতে হতো।

একদিন এক সুন্দরী মহিলা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলে তার একটির বেশি পোশাক না থাকায় তখনকার কুসংস্কারমূলক প্রথা অনুসারে সে বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করতে বাধ্য হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানে এ ধরনের তাওয়াফ, তাও আবার বিবস্ত্র হয়ে, কতই না মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে!

২. সূরা তাওবা অবতীর্ণ হওয়ার সময় মহানবী (সা.)-এর বে’সাত অর্থাৎ নবুওয়াতের মাকামে আনুষ্ঠানিক সমুন্নতির পর থেকে বিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল এবং এ সময় আরব উপদ্বীপের মুশরিক ও মূর্তিপূজকদের কানে পৌত্তলিকতাবাদ ও মূর্তিপূজায় বাধাদান সংক্রান্ত ইসলামের শক্তিশালী যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ পৌঁছে গিয়েছিল; আর তখনও মুষ্টিমেয় যে গোষ্ঠী শিরক্, পৌত্তলিকতা ও মূর্তি পূজা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে জবরদস্তি করতো তার একমাত্র কারণ ছিল অন্ধ গোঁড়ামি ও আক্রোশ। এ কারণেই তখন সমাজ সংস্কারের জন্য সর্বশেষ ঔষধ প্রয়োগ তথা শক্তি ব্যবহার করে মূর্তিপূজা, শিরক ও পৌত্তলিকতার সকল রূপ ও নিদর্শন গুঁড়িয়ে ফেলা, এ মূর্তিপূজাকে মহান আল্লাহ্ ও মানুষের সমুদয় অধিকার লঙ্ঘন বলে গণ্য করা এবং এভাবে মানব সমাজে শত শত মন্দ প্রথার মূলোৎপাটনের সময় এসে গিয়েছিল।

তবে যে সব প্রাচ্যবিদ এ ধরনের পদক্ষেপকে আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও আধুনিক সভ্যতার মূল ভিত্ বলে গণ্য, তার সাথে সাংঘর্ষিক ও পরিপন্থী বলে বিবেচনা করেন, তাঁরা একটি বিষয়ে অমনোযোগী থেকে গেছেন। কারণ আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে পর্যন্ত ব্যক্তি ও সমাজের সৌভাগ্যের ক্ষতি সাধন না করবে, সে পর্যন্ত তা সম্মানার্হ। এর অন্যথা হলে যুক্তি-বুদ্ধির আলোকে এবং বিশ্বের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তির অনুসৃত রীতি অনুসারে এ ধরনের স্বাধীনতার শতকরা এক শ’ ভাগ অর্থাৎ পুরোপুরি বিরোধিতা করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে যাবে।

উদাহরণস্বরূপ, আজ ইউরোপে মুষ্টিমেয় ইন্দ্রিয়পরায়ণ যুবক কতকগুলো ভ্রান্ত চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে সমাজে নগ্নতাবাদের সমর্থক হয়ে যাচ্ছে এবং দেহের কিয়দংশ আবৃত করাই হচ্ছে (যৌন কামনা-বাসনা কেন্দ্রিক) উত্তেজনা এবং চারিত্রিক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও অনাচারের মূল কারণ- এ ধরনের শতকরা এক শ’ ভাগ বালসুলভ যুক্তি ও ধারণার ভিত্তিতে গোপন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিবস্ত্র অবস্থায় আবির্ভূত হচ্ছে। সুস্থ মানব বিবেক ও মন কি অনুমতি দেয় যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার শিরোনামে এ সব তরুণদের হাত আমরা উন্মুক্ত রাখব এবং বলব যে, মতামত, চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাসের প্রতি অবশ্যই সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, নাকি এ সব তরুণের ও সমাজের কল্যাণের জন্য আমাদের অবশ্যই এ ধরনের বোকামিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত? এটা শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসৃত পন্থাই নয়, বরং বিশ্বের সকল জ্ঞানী যে সব ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড মানব সমাজের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেন। আর এ সংগ্রাম আসলে অধঃপতিত দলগুলোর বোকামিপূর্ণ বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

মূর্তিপূজা কতকগুলো অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অলীক চিন্তা-ভাবনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। উল্লেখ্য, এ সব অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অলীক চিন্তা-ভাবনা শত শত মন্দ অভ্যাস ও প্রথার প্রবর্তন করে। আর মহানবী (সা.) মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের পথ প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন এবং বিশ বছর গত হবার পর এই ফ্যাসাদ ও অনাচারের মূলোৎপাটন করার জন্য সর্বশেষ মাধ্যম হিসেবে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার সময় হয়ে গিয়েছিল।

৩. অপর দিকে হজ্ব হচ্ছে সর্ববৃহৎ ইসলামী ইবাদত, সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নিদর্শন। আর এ সূরা অবতীর্ণ হবার দিন পর্যন্ত শিরকের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে তিনি মুসলমানদের পবিত্র হজ্বের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান যথাযথভাবে ও সব ধরনের জাহিলী রীতি-নীতির বাইরে শিক্ষা দিতে পারেন নি। এ কারণে অত্যাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল যে, এ বিশাল ইসলামী জনসমাবেশে মহানবী (সা.) স্বয়ং অংশগ্রহণ করে ব্যবহারিকভাবে মুসলমানদের এ মহৎ ইবাদত অনুষ্ঠানের শিক্ষা দেবেন। তবে তিনি ঐ অবস্থায় কেবল এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন, যখন মহান আল্লাহর হারাম শরীফ এবং এর চারপাশের অঞ্চল মুশরিকদের- যারা ইবাদত-বন্দেগীর মাকাম কতকগুলো প্রস্তর ও কাঠের তৈরি মূর্তির কাছে সোপর্দ করেছিল, থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে যাবে এবং মহান আল্লাহর হারাম তাঁর প্রকৃত বান্দা ও ইবাদতকারীদের জন্য একান্তভাবে নির্দিষ্ট হবে।

৪. মহানবী (সা.)-এর সংগ্রাম বিশ্বাসের স্বাধীনতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। আকীদা-বিশ্বাস এমন এক বিষয় যা বলপ্রয়োগ করে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। আকীদা-বিশ্বাসের কেন্দ্র হচ্ছে মানুষের হৃদয়, যা অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এবং সহজে বশীভূত হয় না। আর আকীদা-বিশ্বাসের উদ্ভব কতকগুলো মূল ভিত ও পূর্ব পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল। এ সব মূল ভিত ও পূর্ব পদক্ষেপ আকীদা-বিশ্বাসের উৎপত্তির প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মূল ভিত ও নীতিমালার অনুপস্থিতিতে আকীদা-বিশ্বাসের উদ্ভব একেবারে অসম্ভব। সুতরাং আকীদা-বিশ্বাস আসলে বল প্রয়োগের বিষয় নয়। বরং মহানবী (সা.)-এর সংগ্রাম ছিল এই শিরকি আকীদা-বিশ্বাসের বাহ্য অবয়বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর মূর্তিপূজা ছিল এ শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের বাহ্য রূপ ও নিদর্শনস্বরূপ। এ কারণেই মহানবী (সা.) প্রতিমালয়গুলো ধ্বংস করেছিলেন এবং সকল প্রতিমা ও মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই তিনি আকীদা-বিশ্বাসের জগৎ ও হৃদয়গুলোর মধ্যেকার বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তনের বিষয়কে কালের আবর্তনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যা আপনাআপনি এ ধরনের বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন আনয়ন করবে।

উল্লিখিত চার কারণের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) আবূ বকরকে (প্রথম খলিফা) ডেকে এনে সূরা তাওবার প্রথম কয়েক আয়াত শিক্ষা দেন এবং চল্লিশ জন মুসলমানকে সাথে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা এবং যে সব আয়াতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা উল্লিখিত আছে, ঈদুল আযহার দিনে সেসব (মিনায় হাজীগণের সমাবেশে) পাঠ করার নির্দেশ দেন।

প্রথম খলিফা আবূ বকর মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। এর কিছুক্ষণ পরই ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে (বিশেষ নির্দেশ সম্বলিত) এক বাণী (মহানবীর ওপর) অর্পণ করলেন। তা ছিল এই যে, মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি স্বয়ং মহানবী বা তাঁর আহলে বাইতভুক্ত কোন ব্যক্তিকে জনগণের কাছে ঘোষণা করতে হবে। এ কারণেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে ডেকে এনে পুরো বিষয়টি তাঁকে জানালেন ও তাঁর বিশেষ সওয়ারী পশুটি তাঁকে দিলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যত শীঘ্র সম্ভব মদীনা ত্যাগ করেন, যাতে তিনি পথিমধ্যে আবূ বকরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর কাছ থেকে আয়াতসমূহ নিয়ে নেন এবং ঈদুল আযহার দিন মিনার বিশাল হজ্ব সমাবেশ, যেখানে আরব উপদ্বীপের সকল অঞ্চল থেকে জনগণ অংশগ্রহণ করবে, সেখানে একটি ঘোষণাপত্র সমেত মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত (সূরা তাওবার) আয়াতসমূহ পাঠ করেন।

এ ঘোষণাপত্রের ধারাসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

ক. মহান আল্লাহর ঘরে (কাবা শরীফ) মূর্তিপূজকদের প্রবেশাধিকার নেই;

খ. উলঙ্গাবস্থায় তাওয়াফ নিষিদ্ধ;

গ. এরপর থেকে কোন মূর্তিপূজকই আর হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে না;

ঘ. যারা মহানবী (সা.)-এর সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল এবং পুরো সময় ধরে নিজেদের চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে (চুক্তি রক্ষা করেছে), তাদের চুক্তি এবং চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রাণ ও সম্পদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। তবে যে সব মুশরিক মুসলমানদের সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি বা কার্যত চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তাদেরকে এ তারিখ (১০ যিলহজ্ব) থেকে ৪ মাসের সময় দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা ইসলামী হুকুমতের সাথে তাদের অবস্থান ও দায়িত্ব স্পষ্ট করে নেয় অর্থাৎ হয় তারা তাওহীদপন্থীদের কাতারভুক্ত হবে এবং শিরক ও দ্বিত্ববাদের সকল নিদর্শন ও বহিঃপ্রকাশের ধ্বংস সাধন করবে অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) একটি কাফেলাকে সাথে নিয়ে মহানবীর বিশেষ সওয়ারী পশুর উপর আরোহণ করে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ কাফেলায় জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারীও ছিলেন। ‘জুহ্ফাহ্’ নামক স্থানে হযরত আলী (আ.) প্রথম খলিফা আবূ বকরের সাথে মিলিত হয়ে মহানবী (সা.)-এর বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে দিলেন; আর তিনিও হযরত আলীর কাছে আয়াতসমূহ হস্তান্তর করলেন।

শিয়া এবং সুন্নী মুহাদ্দিসদের কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী (আ.) বললেন: “মহানবী (সা.) আপনাকে আমার সাথে মক্কা গমন বা এখান থেকে মদীনায় ফিরে যাবার ব্যাপারে ইখতিয়ার দিয়েছেন।” প্রথম খলিফা আবূ বকর মক্কাভিমুখে যাত্রা অব্যাহত রাখার চেয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন : “আপনি আমাকে এমন এক কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন, যা সম্পন্ন করার জন্য অন্যরাও আগ্রহী ছিল এবং সবাই মনে মনে তা সম্পন্ন করার গৌরব অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করত। যখন আমি খানিকটা পথ অতিক্রম করেছি, তখনই আপনি আমাকে এ দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছেন। তা হলে কি আমার ব্যাপারে মহান আল্লাহর ওহী অবতীর্ণ হয়েছে?” মহানবী (সা.) তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন : “হযরত জিবরীল (আ.) এসে আমার কাছে মহান আল্লাহর নির্দেশবাণী পৌঁছে দিয়ে বলেছেন : আমি এবং যে ব্যক্তি আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত, সে ব্যতীত আর কেউ এ কাজ সম্পন্ন করার যোগ্য নয়।” তবে আহলে সুন্নাত বর্ণিত কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ্ব অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দায়িত্ব হযরত আবূ বকরের উপর ন্যস্ত ছিল এবং হযরত আলী (আ.) কেবল মিনা দিবসে জনসমক্ষে মহানবীর ঘোষণাপত্র এবং (মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের) আয়াতসমূহ পাঠ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন। ১০ যিলহজ্ব তিনি জামরা-ই-আকাবার উপর দাঁড়িয়ে সূরা তাওবার প্রথম ১৩ আয়াত পাঠ করলেন। এরপর তিনি দৃঢ় মনোবল সহকারে উচ্চকণ্ঠে মহানবীর ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন, যেন তা সবাই শুনতে পায়।

হযরত আলী (আ.) জামারায়ে উকবা-এর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে লোক সকল! আমি রাসূলের প্রেরিত,’ এবং নির্ভয়ে আয়াতগুলো পাঠ করে শোনালেন। (তাফসীরে দুররে মানসুর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৯ দ্রষ্টব্য)। এ ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন। আল্লামা ইবনে আবিল হাদীদ শারহে নাহজুল বালাগা গ্রন্থে হযরত আলীর মর্যাদা বর্ণনা করতে এ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। তাফসীরে মায়ালিমুত তানযিল, দুররে মানসুর, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল, সহীহ তিরমিযি, সহীহ নাসায়ী, দারে কুতনী, বায়হাকী প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে রেওয়ায়েতটি (হাদিসটি) উল্লিখিত হয়েছে।

মুসলমানদের সাথে যেসব মুশরিকের কোন চুক্তি ছিল না, তিনি তাদের সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে, তাদেরকে কেবল চার মাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের উচিত নিজেদের আবাসস্থল ও চারপাশের পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিরক ও মূর্তিপূজার সকল নিদর্শন থেকে মুক্ত ও পবিত্র করা। এর অন্যথা হলে তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা উঠিয়ে নেয়া হবে।

এ সব আয়াত ও এ ঘোষণাপত্রের ফলাফল এই হয়েছিল যে, চার মাস অতিবাহিত হতে না হতেই মুশরিক ও মূর্তিপূজকরা দলে দলে একত্ববাদ অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং হিজরতের দশম বর্ষের মাঝামাঝিতে সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে মূর্তিপূজা মূলোৎপাটিত হয়ে যায়।

এ ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অন্যায্য ও পক্ষপাতদুষ্ট গোঁড়ামি

মহান আল্লাহর আদেশে সম্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত আয়াতসমূহ পাঠ ও ঘোষণা দানের দায়িত্ব থেকে প্রথম খলিফা আবূ বকরকে অপসারণ ও সেস্থলে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর নিযুক্তি নিঃসন্দেহে হযরত আলীর একটি অকাট্য ও অনস্বীকার্য শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু একদল গোঁড়া লেখক এ ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। আলূসী বাগদাদী তাঁর নিজ তাফসীর গ্রন্থে  এ ঘটনা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন :

“হযরত আবূ বকর স্নেহ, দয়া ও নম্রতার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। হযরত আলী আত্মিক সাহস ও দৃঢ় মনোবলের ক্ষেত্রে তাঁর ঠিক বিপরীত ছিলেন। যেহেতু সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহ পাঠ ও মুশরিকদেরকে হুমকি প্রদানের ক্ষেত্রে আত্মিক সাহস ও দৃঢ় মনোবলের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি এবং আবূ বকরের চেয়ে আলীর মধ্যে এ সব বিষয় অধিক বিদ্যমান ছিল, সেহেতু তাঁর স্থলে আলী দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

এ ধরনের ব্যাখ্যা- যার উৎসই হচ্ছে অন্ধ গোঁড়ামি, মহানবীর বক্তব্যের সাথে মোটেই খাপ খায় না। কারণ তিনি আবূ বকরের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন : “মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন যে, এ আয়াতসমূহ হয় আমি পাঠ করব অথবা আমার আত্মীয় কেউ পাঠ করবে।” এ দু’ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ এসব প্রচার করার যোগ্যতা রাখেন না। মহানবীর এ জবাবে স্নেহ, দয়া ও সাহসিকতার বিষয় মোটেই উত্থাপিত হয়নি।

অধিকন্তু স্বয়ং মহানবী (সা.) ছিলেন স্নেহ, করুণা ও মমতার পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবীরও সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহের ঘোষণা ও প্রচারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়া ছিল অনুচিত। অথচ ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশ ছিল এই যে, সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহ অবশ্যই মহানবী নিজে অথবা তাঁর আহলে বাইতভুক্ত কোন ব্যক্তি প্রচার করবেন।

কেউ কেউ এ ব্যাপারটি আরেকভাবে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, যে কোন চুক্তি বাতিল ও প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে আরবদের প্রথা ছিল এই যে, অবশ্যই চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি নিজে বা তাঁর কোন নিকটাত্মীয় চুক্তি ভঙ্গ ও বাতিলের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আর তা না হলে চুক্তি বলবৎ থাকবে। যেহেতু হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়গণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সেহেতু এসব আয়াত পাঠ করার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। তবে এ ব্যাখ্যাও সন্তোষজনক নয়। কারণ মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়গণের মধ্যে তাঁর চাচা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবও ছিলেন, মহানবীর সাথে যাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক আলী (আ.)-এর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। তাই তাঁকে কেন এ দায়িত্ব প্রদান করা হয় নি?

যদি আমরা নিরপেক্ষ মন নিয়ে এ ঐতিহাসিক ঘটনা বিচার করি, তা হলে আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, এই অপসারণ ও নিযুক্তি না ছিল ক্ষমতালিপ্সা, আর না ছিল তা মহানবীর সাথে হযরত আলীর আত্মীয়তার সম্পর্ক থেকে উদ্ভুত। বরং এ পরিবর্তনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এই যে, কার্যত যেন ইসলামী হুকুমত ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রে হযরত আলীর যোগ্যতা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং জনগণও বুঝতে সক্ষম হয় যে, তিনি যোগ্যতা ও মনোবলের দিক থেকে মহানবীর সঙ্গী ও অংশীদার।

আর কিছুকাল পরে যদি রিসালতের সূর্য্য অস্তমিত হয়, তা হলে খিলাফত, প্রশাসন ও রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় তাঁর (আলী) হাতে ন্যস্ত হবে। তিনি ছাড়া আর কোন ব্যক্তি এ কাজের যোগ্য নন এবং মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর এ সব বিষয়কে কেন্দ্র করে কখনোই মুসলমানদের সংকট ও দ্বিধা-বিভক্তির শিকার হওয়া উচিত নয়। কারণ তারা স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে যে, চুক্তিসমূহ বাতিল ও রহিতকরণ সংক্রান্ত খোদায়ী নির্দেশ মোতাবেক মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে হযরত আলী (আ.) দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর চুক্তি বাতিল ও রহিতকরণ হচ্ছে শাসনকর্তা ও পরিচালনাকারীর একান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিরই অন্তর্ভুক্ত।

মিনা ঘোষণা বা কাফির-মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দানের সুফল

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যে কড়া সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা মিনায় পাঠ করেছিলেন, তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল প্রতিমা পূজারী-মুশরিকদের প্রতি অসন্তুষ্ট (এবং তাদের সাথে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কোন সম্পর্ক নেই) এবং তাদেরকে চার মাসের মধ্যে তাদের অবস্থা চূড়ান্ত করতে হবে; হয় তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করবে, নতুবা তাদেরকে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ঘোষণা ব্যাপক ও ত্বরিত প্রভাব ফেলেছিল। কারণ আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব গোত্র শত্রুতা, আক্রোশ ও জেদের কারণে পবিত্র কুরআনের যুক্তি ও তাওহীদী ধর্মের কাছে মাথা নত করছিল না এবং নিজেদের মন্দ ও অবৈধ অভ্যাস এবং অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও পাথর-কাদামাটি নির্মিত প্রতিমার পূজা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে গোয়ার্তুমি করে যাচ্ছিল, তারা নিজেদের প্রয়োজনেই ইসলাম ধর্মের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মদীনা নগরীতে প্রতিনিধি প্রেরণ করতে থাকে। এইসব প্রতিনিধি দল মহানবী (সা.)-এর সাথে আলোচনা করেছিল। ইবনে সা’দ আত তাবাক্বাত গ্রন্থে ৭২ জন প্রতিনিধির বৈশিষ্ট্য উদ্ধৃত ও বর্ণনা করেছেন। মীনায় ঘোষণাপত্র পাঠ করার পরপর মদীনায় প্রতিনিধি দলগুলোর আগমন স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, হিজরতের দশম বর্ষের সূচনাকালেই আরবের মুশরিকদের আর কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও সুরক্ষিত দুর্গ অবশিষ্ট ছিল না। তা থাকলে তারা সেখানেই আশ্রয় নিত এবং একে অপরের সহযোগিতা নিয়ে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করত।

(মিনায় ঘোষণা দানের) চার মাসের মধ্যেই হিজাযের সকল অধিবাসী ইসলাম ধর্ম ও তাওহীদের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং হিজাযের কোন এলাকায়ই প্রকাশ্যে কোন প্রতিমালয় এবং মূর্তিপূজা রইল না। এমনকি ইয়েমেন, বাহরাইন এবং ইয়ামামার কতিপয় অধিবাসীও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

এবারে এবারে সুরা তওবার সেই ঐতিহাসিক আয়াতগুলোর (১-১৪) অর্থ তুলে ধরছি:

‘সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা (মুসলমানরা) চুক্তিবদ্ধ (সন্ধিতে আবদ্ধ) হয়েছিলে।

অতঃপর তোমরা (নিরাপদে) পরিভ্রমণ কর এ দেশে (নিষিদ্ধ মাসগুলোর) চার মাসকাল। আর জেনে রেখো, তোমরা আল্লাহকে পরাভূত করতে পারবে না, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদিগকে লাঞ্ছিত করে থাকেন।

আর মহান হজ্বের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরেকদের থেকে দায়িত্ব মুক্ত এবং তাঁর রসূলও। অবশ্য যদি তোমরা তওবা কর, তবে তা, তোমাদের জন্যেও কল্যাণকর, আর যদি মুখ ফেরাও, তবে জেনে রেখো, আল্লাহকে তোমরা পরাভূত করতে পারবে না। আর কাফেরদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।

তবে যে মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তি বদ্ধ, অতপরঃ যারা তোমাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি পালনে কোন ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি, তাদের সাথে কৃত চুক্তিকে তাদের দেয়া মেয়াদ পর্যন্ত পূরণ কর। অবশ্যই আল্লাহ সাবধানীদের পছন্দ করেন।

অতঃপর নিষিদ্ধ মাসগুলো (চারমাস) অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর (নির্দ্বিধায়) যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও (মুক্তি দাও)। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। এটি এজন্যে যে এরা জ্ঞান রাখে না।

(চুক্তি ভঙ্গকারী) মুশরিকদের চুক্তি আল্লাহর নিকট ও তাঁর রসূলের কাছে কিরূপে বলবৎ থাকবে? তবে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি সম্পাদন করেছ মসজিদুল-হারামের কাছে। অতএব, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের জন্যে চুক্তিতে অটল থাকে, তোমরাও তাদের জন্য চুক্তিতে অটল থাক। নিঃসন্দেহের আল্লাহ সাবধানীদের পছন্দ করেন। কিরূপে (চুক্তি ভঙ্গকারীদের চুক্তি রক্ষা করা হবে)? তারা তোমাদের উপর জয়ী হলে তোমাদের আত্নীয়তার ও অঙ্গীকারের কোনো মর্যাদা দেবে না। তারা মুখে  (মিষ্টি কথা বলে) তোমাদের সন্তুষ্ট করে, কিন্তু তাদের অন্তরসমূহ তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী।

তারা আল্লাহর আয়াত সমূহ নগন্য মুল্যে বিক্রয় করে, অতঃপর লোকদের নিবৃত রাখে তাঁর পথ থেকে, তারা যা করে চলছে, তা অতি নিকৃষ্ট।

তারা মর্যাদা দেয় না কোন মুসলমানের ক্ষেত্রে আত্নীয়তার, আর না অঙ্গীকারের। আর তারাই সীমালংঘনকারী।

অবশ্য তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে আর যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। আর আমি বিধানসমূহে জ্ঞানী লোকদের জন্যে সর্বস্তরে র্বণনা করে থাকি।

আর যদি ভঙ্গ করে তারা তাদের শপথ প্রতিশ্রুতির পর এবং বিদ্রুপ করে তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে, তবে অবিশ্বাসী প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ, এদের কেন শপথ নেই যাতে তারা ফিরে আসে।

তোমরা কি সেই দলের সাথে যুদ্ধ করবে না; যারা ভঙ্গ করেছে নিজেদের শপথ এবং সঙ্কল্প নিয়েছে রসূলকে বহিস্কারের? আর এরাই প্রথম তোমাদের সাথে যুদ্ধ সূত্রপাত করেছে। তোমরা কি তাদের ভয় কর? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও।

যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হস্তে তাদের শাস্তি দেবেন। তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন এবং (এর মাধ্যমে) মুসলমানদের অন্তরসমূহ শান্ত করবেন।

আর( অবিশ্বাসীদের প্রতি) তাদের মনের ক্ষোভ দূর করবেন। আর আল্লাহ যার প্রতি ইচ্ছা (যাকে উপযুক্ত মনে করেন) ক্ষমাশীল হবেন, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।'

[সূত্র:  আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানির লেখা ‘চিরভাস্বর মহানবী-(সা)’, দ্বিতীয় খণ্ড]