ফাদাকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
  • শিরোনাম: ফাদাকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 15:18:26 1-9-1403

ফাদাক একটি আবাদ ও উর্বর অঞ্চলের নাম যা খাইবরের কাছে অবস্থিত (ছিল)। মদীনা থেকে এ অঞ্চলের দূরত্ব ছিল প্রায় ১৪০ কি.মি.। খাইবরের দুর্গগুলোর পরই এ অঞ্চলটি হিজাযের ইহুদীদের বসবাসকেন্দ্র বলে গণ্য হতো। এটি আল্লাহর রাসূল (সা.) তার মেয়ে ফাতেমাকে (সা.আ.) হেবা করেছিলেন ।

ফাদাক একটি আবাদ ও উর্বর অঞ্চলের নাম যা খাইবরের কাছে অবস্থিত (ছিল)। মদীনা থেকে এ অঞ্চলের দূরত্ব ছিল প্রায় ১৪০ কি.মি.। খাইবরের দুর্গগুলোর পরই এ অঞ্চলটি হিজাযের ইহুদীদের বসবাসকেন্দ্র বলে গণ্য হতো।

মদীনার উত্তর দিক থেকে নিরাপত্তাজনিত যে শূন্যতা অনুভূত হতো, মুসলিম বাহিনী কর্তৃক খাইবর, ওয়াদিউল কুরা ও তাইমা অঞ্চলের ইহুদীদের দমন করার পর সামরিক শক্তির মাধ্যমে তা পূরণ করা হয়েছিল। এ ভূখণ্ডের ইহুদীদের সামরিক শক্তির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে-যারা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি বলে গণ্য হতো-মুহীত নামক দূতকে (মহানবীর পক্ষ থেকে) ফাদাক অঞ্চলের ইহুদী নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করা হয়। ইউশা’ ইবনে নূন যিনি এ অঞ্চলের ইহুদীদের প্রধান ছিলেন, যুদ্ধ করার চেয়ে সন্ধি ও আত্মসমর্পণের বিষয়কে অগ্রাধিকার দেন এবং প্রতি বছর ফাদাকের মোট উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক মহানবী (সা.)-এর হাতে অর্পণ এবং ইসলামের পতাকাতলে (ইসলামী রাষ্ট্রের ছায়ায়) বসবাস করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। আর ঠিক একইভাবে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করার এবং এর বিপরীতে ইসলামী রাষ্ট্র ঐ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।

যেসব ভূখণ্ড সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ও যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকার করা হয় সেগুলো সর্বসাধারণ মুসলিম উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ঐসব বিজিত অঞ্চলের সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব ইসলাম ও মুসলমানদের শাসনকর্তার (মহানবী বা তাঁর পরে তাঁর খলীফা) হাতে ন্যস্ত। তবে যে অঞ্চল সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং সেনাবাহিনী প্রেরণ না করে (বিনা যুদ্ধে) মুসলমানদের হস্তগত হয়, তা স্বয়ং মহানবী (সা.) এবং তাঁর পরে তাঁর স্থলবর্তী ইমামের সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ভূখণ্ডের সর্বময় ক্ষমতা ও এখতিয়ার কেবল তাঁর হাতেই ন্যস্ত থাকে। তিনি তা দান করে দিতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে ভাড়াও দিতে পারেন। এ সংক্রান্ত আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তিনি এ ধরনের সম্পদ থেকে তাঁর নিকটাত্মীয়দের বৈধ প্রয়োজনাদি সম্মানজনকভাবেও মেটাতে পারেন।

মহানবী (সা.) শরীয়তের এ বিধানের ভিত্তিতে ফাদাক তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে হিবা করেছিলেন। বিদ্যমান সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুসারে এ সম্পত্তি হিবা করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল দু’টি বিষয় :

১. মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের সার্বিক বিষয়াদি পরিচালনার দায়িত্ব এবং নেতৃত্বভার হযরত আলীর ওপর অর্পিত ছিল; আর এ বিষয়টি বহুবার মহানবী স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এক বিরাট ব্যয়েরও প্রয়োজন আছে। হযরত আলী (আ.) এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ ও পালন করার জন্য ফাদাক থেকে লব্ধ আয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারতেন। (মহানবীর ওফাতের পর) খিলাফত-প্রশাসন এ ধরনের পূর্বাভাসের ব্যাপারে অবগত ছিল বিধায় তাঁর ওফাতের পর প্রথম দিনগুলোতেই তাঁর আহলে বাইতের হাত থেকে ‘ফাদাক’ নিজ কর্তৃত্বে নিয়ে যায়।

২. মহানবীর বংশধরগণ, যাঁদের পূর্ণাঙ্গ নমুনা হচ্ছেন হযরত ফাতিমা, হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন, তাঁরা যাতে মহানবীর ওফাতের পর সম্মানজনকভাবে জীবন যাপন করতে পারেন এবং মহানবীর মান-মর্যাদাও যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেজন্য তিনি ফাদাক ভূখণ্ড নিজ কন্যা ফাতিমা (আ.)-এর কাছে হিবা করেছিলেন।

মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ লিখেছেন : যখন

و آت ذا القربى حقّه و المسكين و ابن السّبيل

‘আর আপনি (আপনার) নিকটাত্মীয়, দরিদ্র এবং মুসাফিরকে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করুন’-এ আয়াত অবতীর্ণ হয়, তখন মহানবী (সা.) নিজ কন্যাসন্তান হযরত ফাতিমাকে ডেকে এনে তাঁর কাছে ফাদাকের স্বত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। এ ঘটনার বর্ণনাকারী হচ্ছেন আবু সাঈদ খুদরী, যিনি মহানবী (সা.)-এর অন্যতম সম্মানিত সাহাবী ছিলেন।

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুফাসসির বিশ্বাস করেন, এ আয়াত মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়দের অধিকার প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাঁর কন্যা ‘যিলকুবরা’ অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের সবচেয়ে স্পষ্ট বাস্তব নমুনা। এমনকি সন্ধ্যাবেলা যখন ঐ শামদেশীয় লোকটি ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যাইনুল আবেদীন (আ.)-কে বলেছিল : “তুমি তোমার নিজের পরিচয় দাও”, তখন তিনি নিজ পরিচয় তুলে ধরার জন্য উপরিউক্ত আয়াত (সূরা ইসরা : ২৬) তেলাওয়াত করেছিলেন। আর এ বিষয়টি মুসলমানদের মধ্যে এতটা স্পষ্ট ছিল, শামদেশীয় ঐ লোকটি ইমাম যাইনুল আবেদীনের বক্তব্য সত্যায়ন স্বরূপ মাথা নেড়ে তাঁকে এভাবে বলেছিল : “রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে আপনার নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণে মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে আপনাদের অধিকার প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন।”

সারসংক্ষেপ : এ আয়াত যে হযরত ফাতিমা যাহরা এবং তাঁর বংশধরগণের শানে অবতীর্ণ হয়েছে, সে ব্যাপারে মুসলিম জ্ঞানীদের মধ্যে ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে। তবে এ আয়াত অবতীর্ণ হবার সময় মহানবী (সা.) ফাদাক ভূখণ্ডটি যে হযরত ফাতিমার উদ্দেশ্যে হিবা করেছিলেন, সে ব্যাপারে শিয়া মুসলিম আলেমদের মধ্যে ঐকমত্য বিদ্যমান আছে এবং কতিপয় সুন্নী আলেমও এ ব্যাপারে শিয়া আলেমদের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন।

আব্বাসী খলীফা (যে কারণেই হোক না কেন) হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর বংশধরগণের কাছে ফাদাক ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মূসা নামক এক বিখ্যাত ঐতিহাসিকের কাছে একটি পত্রে তাঁকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি (ঐতিহাসিক) উপরিউক্ত হাদীস- যা ছিল ঐ আয়াতের শানে নুযূল- খলীফার কাছে লিখে পাঠিয়েছিলেন। আর খলীফা মামুনও হযরত ফাতিমার বংশধরগণের কাছে ফাদাক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

আব্বাসী খলীফা (মামুন) মদীনার শাসনকর্তার কাছে লিখেছিলেন : “মহানবী (সা.) ফাদাক গ্রামটি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে হিবা করেছিলেন এবং এটি একটি সন্দোহতীত বিষয়। আর হযরত ফাতিমার বংশধরগণের মধ্যেও এ ব্যাপারে কোন মতভিন্নতা নেই।”

মামুন যেদিন ফাদাক সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য আসনে উপবিষ্ট হলেন, তখন প্রথমে তাঁর হাতে একটি আবেদনপত্র আসে, যার লেখক নিজেকে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর পক্ষ সমর্থনকারী বলে পরিচয় প্রদান করেন। মামুন ঐ পত্রটি পড়ে একটু ক্রন্দন করেন এবং বলেন : “হযরত ফাতিমার পক্ষ সমর্থনকারী কে?” তখন এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে নিজেকে হযরত ফাতিমার পক্ষ সমর্থনকারী বলে তুলে ধরলেন।

বিচার অধিবেশনটি তাঁর ও মামুনের মধ্যে একটি বিতর্কসভার রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অবশেষে মামুন নিজেকে দোষী বলে দেখতে পেলেন এবং আদালতের প্রধান বিচারপতিকে হযরত ফাতিমার বংশধরগণের কাছে ফাদাক ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেয়ার জন্য একটি পত্র লেখার নির্দেশ দিলেন। উক্ত পত্র লেখা হলো এবং খলীফা মামুন তা অনুমোদন করলেন।

ফাদাক ভূখণ্ড যে হযরত ফাতিমার বৈধ সম্পত্তি ছিল, তা প্রমাণ করার জন্য যে সব দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল।  ইসলামের সর্বপ্রধান পরম সত্যবাদী (সিদ্দীকে আকবর) আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর (আ.) একটি পত্র যা বসরার গভর্নর উসমান ইবনে হুনাইফের কাছে লেখা এ পত্রে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ফাদাকের মালিকানা উল্লেখ করে বলেছেন :

بلي كانت فِى أيدينا فدك من كلّ ما أظلّته السّماء. فَشَحَّت عليها نفوسُ قومٍ، و سَخَتْ عنها نفوسُ قومٍ آخَرين و نعمَ الحَكَمُ اللهُ

“হ্যাঁ, যেসব কিছুর ওপর আকাশ ছায়া প্রদান করেছে, সেসবের মধ্যে ফাদাক গ্রামের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূসম্পত্তিও অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের হাতে (কর্তৃত্বে) ছিল। কিন্তু কোন কোন গোষ্ঠী এ ব্যাপারে কার্পণ্য করল। আর একদল উদার ও মহানুভব ব্যক্তি বিশেষ কতিপয় বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তবে মহান আল্লাহ্ই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।

তাই এ স্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান থাকা সত্বেও এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা কী করে সম্ভব হতে পারে?

মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে ফাদাকের ইতিহাস

মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরাকে তাঁর বৈধ ভূসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত এবং তাঁর নিযুক্ত কর্মচারী ও শ্রমিকদের সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাই তিনি আইনের আশ্রয় নিয়ে প্রশাসনের কাছ থেকে তাঁর বৈধ অধিকার আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রথম পর্যায়ে ফাদাক গ্রামটি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কর্তৃত্বাধীন ছিল। আর এ কর্তৃত্ব তাঁর স্বত্বাধিকারী হওয়ার প্রমাণ ছিল। এ সত্বেও ইসলাম ধর্মের বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় নীতির বিপক্ষে প্রশাসন তাঁর কাছে সাক্ষী উপস্থিত করার দাবী জানায়। অথচ বিশ্বের কোথাও কোন সম্পদ কারো কর্তৃত্বে বিদ্যমান থাকলে, যাকে পারিভাষিক অর্থে ‘যূল ইয়াদ’ (ذو اليد) বা ‘স্বত্বাধিকারী’ বলা হয়, তার কাছ থেকে কখনো সাক্ষী চাওয়া হয় না। হযরত ফাতিমা বাধ্য হয়ে হযরত আলী (আ.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব এবং উম্মে আইমানের মতো নারী, যাঁকে মহানবী (সা.) বেহেশতের নারীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁকে, এবং বালাযুরীর বর্ণনানুযায়ী, মহানবীর আযাদকৃত দাস রাবাহকে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য খলীফার কাছে নিয়ে যান। খিলাফত-প্রশাসন তাঁদের সাক্ষ্য প্রদানকে মোটেই গুরুত্ব দেন নি এবং এভাবে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যাকে যে ভূসম্পত্তি হিবা করেছিলেন, তা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়ে যায়।

আয়াতে তাতহীর১০ অনুসারে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.), হযরত আলী (আ.) এবং তাঁদের সন্তানদ্বয় (হাসান ও হুসাইন) সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র; আর যদি এ আয়াত মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণকে শামিল করে, তবুও তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমা নিশ্চিতভাবে এ আয়াতে বর্ণিত আহলে বাইতের বাস্তব নমুনা হবেন। তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, এ বিষয়টিও সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয় এবং তদানীন্তন খলীফা হযরত ফাতিমার এ দাবীকে স্বীকৃতি দেন নি।

খলীফা অবশেষে মহানবীর কন্যার দাবীর কাছে মাথা নত করেছিলেন এবং ফাদাক যে তাঁর বৈধ নিষ্কণ্টক ভূসম্পত্তি, সে ব্যাপারে একটি পত্র লিখে তাঁকে প্রদান করেছিলেন। পত্র নিয়ে ফেরার সময় পথিমধ্যে খলীফার পুরানো বন্ধুর সাথে মহানবীর কন্যা হযরত ফাতিমার সাক্ষাৎ হলে তিনি পত্র লেখার ঘটনা জানতে পারেন। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছ থেকে পত্রটি এনে খলীফার সামনে উপস্থিত করে তাঁকে বলেছিলেন : যেহেতু এ ঘটনার মধ্যে আলীর স্বার্থ আছে, তাই তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। আর উম্মে আইমান একজন মহিলা এবং একজন মহিলার সাক্ষ্যের কোন মূল্য নেই।” এরপর তিনি খলীফার সামনেই উক্ত পত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।১১

হালাবী তাঁর সীরাত গ্রন্থে এ ঘটনা একটু ভিন্নভাবে বর্ণনা করে বলেছেন : খলীফা হযরত ফাতিমার মালিকানার সত্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে তাঁর বন্ধু হযরত উমর এসে উপস্থিত হন এবং বলেন, এ পত্রটি আসলে কী? তখন খলীফা তাঁকে বলেছিলেন : “এ পত্রে আমি ফাতিমার মালিকানা সত্যায়ন করেছি।” তখন হযরত উমর বললেন : “আপনার জন্য (ভবিষ্যতে) ফাদাকের আয়ের প্রয়োজন হবে। কারণ আগামীকাল যদি আরবের মুশরিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এত খরচ কোথা থেকে আপনি মেটাবেন?” আর এরপর হযরত উমর উক্ত পত্র নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।১২

এ কারণেই এখান থেকে একজন প্রখ্যাত কালামবিদ আলেমের বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা উপলব্ধি করা যায়। তা হলো, ইবনে আবীল হাদীদ বলেছেন : “‘আমি আলী ইবনে নাকী’ নামক একজন  কালামবিদ আলেমকে বলেছিলাম, ফাদাক গ্রামটা এতটা বড় ছিল না এবং ঐ ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে গুটিকতক খেজুর গাছ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর ঐ সব খেজুর গাছ এতটা মূল্যবান ছিল না যে কারণে ফাতিমার বিরোধীরা এ ভূখণ্ডের ব্যাপারে লোভ করবে।”১৩

তিনি আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন : আপনি এ ব্যাপারে ভুল করছেন। সেখানকার খেজুর গাছগুলোর সংখ্যা কুফার বর্তমান খেজুর গাছগুলোর চেয়ে কম ছিল না। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ উর্বর ভূখণ্ড থেকে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত ও বংশধরগণের বঞ্চিত করার কারণ ছিল, আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) পাছে এ ভূখণ্ডের আয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ করার কাজে ব্যবহার করেন এমন আশংকার দিকটি বাস্তবায়নে সক্ষম না হন। এ কারণে শুধু হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-কেই ফাদাক থেকে বঞ্চিত করা হয় নি; বরং বনী হাশিম এবং আবদুল মুত্তালিবের বংশধরগণকে তাঁদের ন্যায্য অধিকার অর্থাৎ খলীফাদের শাসনামলে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্থাৎ মালে গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে যে গোষ্ঠীটি চরম অভাব, দারিদ্র্য ও দূরবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হবে এবং জীবনের চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত থাকবে, তারা কখনোই বিদ্যমান অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার চিন্তা তাদের মাথায় লালন করবে না।১৪

ইবনে আবীল হাদীদ শারহু নাহজিল বালাগাহ্ গ্রন্থের ২৮৪ পৃষ্ঠায় পশ্চিম বাগদাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন বিখ্যাত শিক্ষক (আলী ইবনুল ফারিকী) থেকে এ বাক্যটি উদ্ধৃত করে বলেছেন : “আমি তাঁকে বললাম : মহানবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) কি তাঁর দাবীর ক্ষেত্রে সত্যবাদী ছিলেন?” তিনি বলেছিলেন : “হ্যাঁ”। আমি তাকে বললাম, “খলীফা কি জানতেন যে, হযরত ফাতিমা সত্যবাদী?” তিনি বলেছিলেন : “হ্যাঁ।” তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম : “খলীফা কেন তাঁর নিশ্চিত বৈধ অধিকার তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেন নি?” এ সময় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক স্মিত হেসে ভাবগাম্ভীর্যের সাথে বলেছিলেন : “খলীফা যদি সত্যবাদী নারী হিসেবে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বক্তব্যসমূহ মেনে নিতেন এবং সাক্ষী না চেয়েই ফাদাক ভূখণ্ড তাঁর কাছে হস্তান্তর করতেন; তা হলে পরের দিন তিনি নিজ স্বামী আলী (আ.)-এর অনুকূলে এ অবস্থাকে কাজে লাগাতেন এবং বলতেন : খিলাফত আমার স্বামীর সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এ অবস্থায় খলীফা আলীর কাছে খিলাফত হস্তান্তর করতে বাধ্য হতেন। কারণ তিনি ফাতিমাকে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছেন এবং বিশ্বাস করেন। কিন্তু এ ধরনের দাবীর পথ রুদ্ধ করার জন্যই খলীফা হযরত ফাতিমাকে তাঁর বৈধ নিশ্চিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।”

ফাদাক ভূখণ্ড থেকে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর সন্তান ও বংশধরগণকে বঞ্চিত করার ভিত প্রথম খলীফার সময়েই রচিত হয়েছিল। আর হযরত আলী (আ.)-এর ইন্তেকালের পর মুয়াবিয়া খিলাফতের সার্বিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ফাদাক ভূখণ্ডকে তিন ব্যক্তির (মারওয়ান, আমর ইবনে উসমান ও নিজ পুত্র ইয়াযীদ) মধ্যে বণ্টন করে দেন। মারওয়ানের খিলাফতকালে ফাদাকের সকল অংশ তার হাতে চলে আসে এবং সে তা তার পুত্র আবদুল আযীযকে হিবা করে দেয়। আর সেও তা তার পুত্র উমর ইবনে আবদুল আযীযকে প্রদান করেছিল। বনী উমাইয়্যার খলীফার মধ্যে কেবল উমর ইবনে আবদুল আযীযই মধ্যপন্থী ছিলেন। তাই খলীফা হবার পর তিনি সর্বপ্রথম যে বিদআত বিলোপ করেন, তা ছিল, তিনি ফাদাক ভূখণ্ড হযরত ফাতিমার বংশধরগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পরবর্তী খলীফারা বনী হাশিমের হাত থেকে ফাদাক ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং বনী উমাইয়্যার খলীফাদের জীবন অবসান হওয়ার দিন পর্যন্ত ফাদাক তাদের কর্তৃত্বে থেকে গিয়েছিল।

বনী আব্বাসের খিলাফতকালে ফাদাক ভূখণ্ড সংক্রান্ত সমস্যা আরো আশ্চর্যজনক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। যেমন আবুল আব্বাস আস্ সাফফাহ্ (প্রথম আব্বাসী খলীফা) আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসানের কাছে ফাদাক হস্তান্তর করেছিল। তারপর দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা মানসূর আদ দাওয়ানিকী আবার তা কেড়ে নিয়েছিল। তবে তার পুত্র খলীফা মাহদী তা হযরত ফাতিমার বংশধরদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর (মাহদী) মৃত্যুর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থে আব্বাসী খলীফা মূসা ও খলীফা হারুনুর রশীদ হযরত ফাতিমার বংশধরদের হাত থেকে ফাদাক কেড়ে নিয়েছিলেন। আর এ অবস্থাটা মামুনের খলীফা হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ফাদাক সংক্রান্ত ন্যায্য অধিকার এর প্রকৃত স্বত্বাধিকারীগণের কাছে ফিরিয়ে দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ফাদাক আবারো অস্থিতিশীল অবস্থার শিকার হয় অর্থাৎ কখনো তা হযরত ফাতিমার বংশধরগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হতো, কখনো তা তাঁদের কাছে ফেরত দেয়া হতো। বনী উমাইয়্যা ও বনী আব্বাসের খিলাফতকালে অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে ফাদাকের রাজনৈতিক গুরুত্বই অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইসলামের প্রথম যুগের খলীফাগণ ফাদাকের আয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন। তবে পরবর্তী যুগগুলোতে খলীফা ও আমীর-অমাত্যগণ এতটা অর্থ ও ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছিল যে, তাদের আর ফাদাকের আয়ের প্রয়োজন হতো না। এ কারণেই যখন খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বংশধরগণের কাছে ফাদাক অর্পণ করেন, তখন বনী উমাইয়্যা তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেছিল : “আপনি এ কাজের দ্বারা ‘শায়খাইন’ অর্থাৎ হযরত আবু বকর ও হযরত উমরকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন।” আর এ কারণে তারা তাঁকে ফাদাকের মূল মালিকানা নিজ হাতে রেখে এ ভূসম্পত্তির আয় হযরত ফাতিমার সন্তান ও বংশধরগণের মধ্যে বণ্টন করতে বাধ্য করেছিল।১৫

আইনের মানদণ্ডে ফাদাক

ফাদাক সংক্রান্ত বিষয় অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে যায়, মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ছিল নেহায়েত একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। আর এ বিষয়টি তদানীন্তন শাসনকর্তার কাছে অধিক স্পষ্ট ছিল। এ কারণেই মহানবীর কন্যা হযরত ফাতিমা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও বাক-অলংকার সমৃদ্ধ এক অনলবর্ষী বক্তৃতায় বলেছিলেন :

هذا كتاب الله حكما و عدلا و ناطقا و فضلا يقول: يرثنِى و يرث من آل يعقوب و ورث سليمان داوود و بيّن عزّ و جلّ فِى ما وزع من الأقساط و شرع من الفرائض

“মহান আল্লাহর কিতাব কুরআন- যা হচ্ছে ফয়সালাকারী, স্পষ্টভাষী বিচারক এবং মীমাংসাকারী-বলছে : হযরত যাকারিয়া (আ.) মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, মহান আল্লাহ্ তাঁকে এমন এক সন্তান দিন, যে তাঁর ও ইয়াকুবের বংশধারার উত্তরাধিকারী হবে।১৬ এ কিতাবে আরো বলা হয়েছে : আর সুলাইমান দাউদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।১৭ মহান আল্লাহ্ (তাঁর) ইলাহী কিতাব কুরআনে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য অংশগুলো বর্ণনা করেছেন এবং ফারায়েযও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।”১৭

তথ্যসূত্র :

১. মারাসিদুল ইত্তেলা’ নামক গ্রন্থে فدك ‘ফাদাক’ ধাতু দেখুন।

২. সূরা হাশর ৬ ও ৭ নং আয়াত; এ বিষয়টি ফিক্হী গ্রন্থসমূহের জিহাদ অধ্যায়ে ‘ফাই ও আনফাল’ শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৩. সূরা ইসরা : ২৬

৪. মাজমাউল বায়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪১১ এবং শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ১৬তম খণ্ড, পৃ. ২৪৮

৫. আদ দুররুল মানসূর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৭৬

৬. মাজমাউল বায়ান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১১; ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৪৫

৭. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২১৭

৮. নাহজুল বালাগাহ্, পত্র ৪৫

৯. ফুতহুল বুলদান, পৃ. ৪৩

১০. “হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আপনাদের থেকে (সব ধরনের) পঙ্কিলতা দূর করে আপনাদের পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান” (إنّما يريد الله ليُذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يُطهّركم تطهيرا) সূরা আহযাব : ৩৩

১১. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ১৬তম খণ্ড, পৃ. ৩৭৪

১২. সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০০

১৩. আমরা এ অধ্যায়ের শুরুতে মারাসিদুল ইত্তেলা গ্রন্থ থেকে ফাদাক ভূখণ্ডের উর্বরতার বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি।

১৪. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ১৬তম খণ্ড, পৃ. ২৩৬

১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮

১৬. সূরা মারিয়াম : ৬

১৭. সূরা নামল : ১৬

(অত্র প্রবন্ধটি চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-২য় খণ্ড থেকে সংকলিত)