ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা ব্যাপকভাবে এদেশে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা সবাই তফসিলি হিন্দু বংশধর নয়। হিন্দুদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরও অনেকইে ছিলেন রাজ পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে, আরবরা এদেশে এসেছেন ব্যবসায়ী হিসেবে আর সে সময় ব্যবসায়ী অর্থাত্ সাওদাগররা ছিলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্মানিত ব্যক্তি।
মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন বিধান হিসেবে বিশ্বের সব দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলাদেশে (প্রাচীন বঙ্গদেশে) কবে সর্বপ্রথম ইসলামের অবির্ভাব ঘটেছিল, তা আজও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হয়তো বা কোনো সাহাবার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল। অবশ্য এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, আরব মুসলমানদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে এবং পরবর্তীকালে আউলিয়ায়ে কেরাম ও সুফিয়ানে ইজামদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের বহুকাল আগ থেকেই বাংলাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসায়ের সম্পর্ক ছিল। এমনকি হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পালতোলা জাহাজে করে এদেশে আসত। ওই সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাত্ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এদেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে। ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাক-ভারত ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের ব্যাপকভাবে প্রথম ইতিহাস লেখন মওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাদেশকে ‘বাররিন্দ’ বলেছেন। যা পরে ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘বাররিন্দ্র’ বলার কারণ ছিল এই যে, আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানীন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে অনন্দে নেচে উঠে চিত্কার করে বলত ‘বাররি হিন্দ’ অর্থাত্ হিন্দের মাটি, যা পরবর্তীকাল বাররিন্দ বা বরেন্দ্রতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ ছাড়া আরও বহু প্রমাণাদি পাওয়া যায় যাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যেনূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবির্ভাবপূর্ব যুগে বাংলাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসা ছিল এবং প্রথম হিজরি শতাব্দীর অর্থাত্ ‘ঈসায়ী’ ৭ম শতাব্দীর মধ্যেই তদানীন্তন হিন্দ তথা বাংলাদেশের সাথে আরব মুসলমানদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এবং তারা এদেশে ইসলামের আলো পৌঁছিয়েছেন।
নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগণের আবির্ভাবের মাধ্যমে হিজরি প্রথম শতাব্দীতে সুদূর চীনে ইসলামের আবির্ভাব প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা সাপেক্ষে বাংলাদেশেও নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাও তাবিয়ীগণের মাধ্যমেই ইসলামের আবির্ভাব হয়তো প্রমাণিত হবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের বহুকাল আগ থেকেই হিন্দ তথা বাংলাদেশের সাথে আরবদের সওদাগরি যোগাযোগ ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর ওই যোগাযোগ কমেনি, বরং বেড়েছে। সুতরাং নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তার ইন্তেকাল পর্যন্ত ২৩ বছরে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন সাহাবাও ইসলাম প্রচার অথবা সওদাগর হিসেবে ব্যবসায়ের কারণে এদেশে আসেননি, এটা কি করে চিন্তা করা যায়। অবশ্য কোনো সাহাবা বা তাবেয়ী এদেশে এসেছেন বা ইসলাম প্রচার করেছেন—এমন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়,নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের পর হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও সাহাবাগণ জীবিত ছিলেন। সুতরাং হজরতের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে সহাবাগণের জীবনকাল সমাপ্তি পর্যন্ত (নবুওয়াতের ১৩ বছর পর হিজরত, হিজরতের পরও ১০০ বছর পর্যন্ত সাহাবাগণের সম্ভাব্য জীবনকাল) ১০ + ১০০ + = ১১০ বছরের মধ্যে কোনো কারণে এদেশে একজন সাহাবারও আবির্ভাব ঘটেনি-এটাও চিন্তা করা যায় না। অথচ সুদূর স্পেনে যার দূরত্ব মদিনা থেকে বাংলাদেশের তুলনায় অনেকগুণ বেশি এবংনূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের আগে স্পেনের সাথে আরবদের কোনো যেগাযোগ ছিল না, সেখানে মুনাইজির (মৃত্যু আনু: ৮০ হি নামক সাহাবার অবির্ভাব প্রামাণিত হয়েছে। অন্যদিকে, হিন্দ থেকে লোক গিয়ে নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলেও জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বাবা রতন আল-হিন্দ অথবা রতন আবদুল্লাহ আল-হিন্দির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
তিনি হিন্দ অর্থাত্ ভারত থেকে মদিনায় গিয়েনূ রে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, মালাবারের অনুগত চেরদেশের রাজা চেরম নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলেও জানা যায়। প্রথম হিজরি শতাব্দী (সপ্তম ঈসায়ী শতাব্দী) ও দ্বিতীয় হি. শতাব্দী (অষ্টম ঈসায়ী শতাব্দী)-তে ব্যবসা ও ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। তারা ব্যাপকভাবে এদেশে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা সবাই তফসিলি হিন্দু বংশধর নয়। হিন্দুদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরও অনেকইে ছিলেন রাজ পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে, আরবরা এদেশে এসেছেন ব্যবসায়ী হিসেবে আর সে সময় ব্যবসায়ী অর্থাত্ সাওদাগররা ছিলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্মানিত ব্যক্তি। সে যুগের মুসলমান সওদাগররাই বাদশাহ, গভর্নর বা নাযিম হতেন এবং তা হতেন ধনাঢ্য হওয়ার কারণে। আর এ ধন-সম্পদ তারা অর্জন করতেন সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে সাগর ডিঙিয়ে ব্যবসা করে গরিব প্রজাদের থেকে চুষে নেয়া কর বা সুদ দিয়ে নয় (যা ইংরেজ ও তাদের পোষা জমিদাররা এদেশে করেছিল।)
তাই মুসলিম সওদাগরদের সম্পর্কও ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও রাজাদের সাথে। এমনকি আওলিয়ায়ে কিরাম ও সুফি-দরবেশগণেরও ইসলাম প্রচারের কারণে হিন্দু রাজা-মহারাজাদের সাথে সম্পর্ক ও সংঘর্ষ হয়েছে। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার থেকে আবিষ্কৃত বাদশাহ হারুনুর রশীদের শাসনকালের (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) মুদা ১ম/৭ম শতাব্দীতে বাংলাদেশে ব্যাপক মুসলিম বসতিরই ইঙ্গিত বহন করে। বস্তুত বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয় সাহাবা/তাবিয়ী/আরব মুসলিম সওদাগরদের মাধ্যমে আর এর প্রচার-প্রসার হয় সত্যের দিশারী গভীর আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন সুফি-দরবেশগণের মাধ্যমে। আর ব্যবসার কারণে সামুদ্রিক যোগাযোগের মাধ্যমেই তাদের আগমন সহজ হয়েছিল। ৩/৯ম শতাব্দীতে হজরত বায়েজিদ বেস্তামি (রহ.) (মৃত্যু: ২৬০/৮৭২) ও তার এক বিরাটসংখ্যক অনুসারী সুফির চট্টগ্রাম আগমন এদেশে বহুসংখ্যক মুসলিম দরবেশের আগমন প্রমাণ করে। চট্টগ্রামে তার স্মারক মাজার আজও স্মৃতি বহন করছে ৪/১০ম শতাব্দীতে শায়খ আহমাদ বিন মুহাম্মদ (মৃত্যু: ৩৪৯/৯৫২) এবং শায়ক ইসমাইল বিন নাজান্দ নিশাপুরী (মৃত্যু: ৩৬৬/৯৭৫) ঢাকায় ইসলাম প্রচার করেন।
৫ম/১১ম শতাব্দীর মধ্যভাগে শায়খ মীর সুলতান মাহমুদ যিনি সুলতান বলখি নামে পরিচিত, তার মুর্শিদের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের কাজে বাংলাদেশে বগুড়ার মহাস্থানগড় আগমন করেন। তার অস্বাভাবিক কারামত ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে তিনি এদেশের বহু লোককে ইসলামের মহা সত্যের বায়াত দান করতে সক্ষম হন। ওই একই সময়ে শায়খ মুহাম্মদ সুলতান রুমী তার শায়খ ও বেশ কিছুসংখ্যক মুরিদ দিয়ে স্থানীয় রাজ পরিবারের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর ৬/১২ শতাব্দীর প্রথম দিকে শায়খ বাবা আদম শহীদ তার সাথীদের সমন্বয়ে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেনের সাথে ইসলামের সত্যের বাণী প্রচারের কারণে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শায়খ বাবা আদম তার সব সাথী সমন্বয়ে মহান আল্লাহর রাহে জীবন দান করে শাহাদাত লাভ করেন। ৭/১৩ শতাব্দীর প্রথম দিকে শায়খ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকান এবং মাখদুম শাহ দৌলা ঢাকা ও পাবনা এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় ইখতিয়ারুদ্দীন বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর থেকে এদেশে ৫৬৫ বছরেরও অধিককাল অর্থাত্ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুসলিম শাসন বহাল থাকে। এ সময়ে প্রায় ৭৬ জন গভর্নর অথবা সুলতান অথবা নাযিম বাংলা শাসন করেন। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কিছুসংখ্যক সুফি-দরবেশ ও ওলামায়ে কেরামের আবির্ভাব হয়, যাদের মাধ্যমে এদেশে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয়। তাদের মধ্যে শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজি (মৃত্যু: ৬৪২/ ১২৪৩) বাংলাদেশে আগমন করেন। তিনি শায়খ আবু সাঈদ ও শায়খ হিশাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর খলিফা ছিলেন।(সবুজ বাংলা ব্লগ)
মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন বিধান হিসেবে বিশ্বের সব দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলাদেশে (প্রাচীন বঙ্গদেশে) কবে সর্বপ্রথম ইসলামের অবির্ভাব ঘটেছিল, তা আজও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হয়তো বা কোনো সাহাবার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল। অবশ্য এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, আরব মুসলমানদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে এবং পরবর্তীকালে আউলিয়ায়ে কেরাম ও সুফিয়ানে ইজামদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের বহুকাল আগ থেকেই বাংলাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসায়ের সম্পর্ক ছিল। এমনকি হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পালতোলা জাহাজে করে এদেশে আসত। ওই সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাত্ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এদেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে। ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাক-ভারত ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের ব্যাপকভাবে প্রথম ইতিহাস লেখন মওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাদেশকে ‘বাররিন্দ’ বলেছেন। যা পরে ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘বাররিন্দ্র’ বলার কারণ ছিল এই যে, আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানীন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে অনন্দে নেচে উঠে চিত্কার করে বলত ‘বাররি হিন্দ’ অর্থাত্ হিন্দের মাটি, যা পরবর্তীকাল বাররিন্দ বা বরেন্দ্রতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ ছাড়া আরও বহু প্রমাণাদি পাওয়া যায় যাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যেনূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবির্ভাবপূর্ব যুগে বাংলাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসা ছিল এবং প্রথম হিজরি শতাব্দীর অর্থাত্ ‘ঈসায়ী’ ৭ম শতাব্দীর মধ্যেই তদানীন্তন হিন্দ তথা বাংলাদেশের সাথে আরব মুসলমানদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এবং তারা এদেশে ইসলামের আলো পৌঁছিয়েছেন।
নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগণের আবির্ভাবের মাধ্যমে হিজরি প্রথম শতাব্দীতে সুদূর চীনে ইসলামের আবির্ভাব প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা সাপেক্ষে বাংলাদেশেও নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাও তাবিয়ীগণের মাধ্যমেই ইসলামের আবির্ভাব হয়তো প্রমাণিত হবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের বহুকাল আগ থেকেই হিন্দ তথা বাংলাদেশের সাথে আরবদের সওদাগরি যোগাযোগ ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর ওই যোগাযোগ কমেনি, বরং বেড়েছে। সুতরাং নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তার ইন্তেকাল পর্যন্ত ২৩ বছরে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন সাহাবাও ইসলাম প্রচার অথবা সওদাগর হিসেবে ব্যবসায়ের কারণে এদেশে আসেননি, এটা কি করে চিন্তা করা যায়। অবশ্য কোনো সাহাবা বা তাবেয়ী এদেশে এসেছেন বা ইসলাম প্রচার করেছেন—এমন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়,নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের পর হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও সাহাবাগণ জীবিত ছিলেন। সুতরাং হজরতের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে সহাবাগণের জীবনকাল সমাপ্তি পর্যন্ত (নবুওয়াতের ১৩ বছর পর হিজরত, হিজরতের পরও ১০০ বছর পর্যন্ত সাহাবাগণের সম্ভাব্য জীবনকাল) ১০ + ১০০ + = ১১০ বছরের মধ্যে কোনো কারণে এদেশে একজন সাহাবারও আবির্ভাব ঘটেনি-এটাও চিন্তা করা যায় না। অথচ সুদূর স্পেনে যার দূরত্ব মদিনা থেকে বাংলাদেশের তুলনায় অনেকগুণ বেশি এবংনূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের আগে স্পেনের সাথে আরবদের কোনো যেগাযোগ ছিল না, সেখানে মুনাইজির (মৃত্যু আনু: ৮০ হি নামক সাহাবার অবির্ভাব প্রামাণিত হয়েছে। অন্যদিকে, হিন্দ থেকে লোক গিয়ে নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলেও জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বাবা রতন আল-হিন্দ অথবা রতন আবদুল্লাহ আল-হিন্দির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
তিনি হিন্দ অর্থাত্ ভারত থেকে মদিনায় গিয়েনূ রে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, মালাবারের অনুগত চেরদেশের রাজা চেরম নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলেও জানা যায়। প্রথম হিজরি শতাব্দী (সপ্তম ঈসায়ী শতাব্দী) ও দ্বিতীয় হি. শতাব্দী (অষ্টম ঈসায়ী শতাব্দী)-তে ব্যবসা ও ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। তারা ব্যাপকভাবে এদেশে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা সবাই তফসিলি হিন্দু বংশধর নয়। হিন্দুদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরও অনেকইে ছিলেন রাজ পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে, আরবরা এদেশে এসেছেন ব্যবসায়ী হিসেবে আর সে সময় ব্যবসায়ী অর্থাত্ সাওদাগররা ছিলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্মানিত ব্যক্তি। সে যুগের মুসলমান সওদাগররাই বাদশাহ, গভর্নর বা নাযিম হতেন এবং তা হতেন ধনাঢ্য হওয়ার কারণে। আর এ ধন-সম্পদ তারা অর্জন করতেন সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে সাগর ডিঙিয়ে ব্যবসা করে গরিব প্রজাদের থেকে চুষে নেয়া কর বা সুদ দিয়ে নয় (যা ইংরেজ ও তাদের পোষা জমিদাররা এদেশে করেছিল।)
তাই মুসলিম সওদাগরদের সম্পর্কও ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও রাজাদের সাথে। এমনকি আওলিয়ায়ে কিরাম ও সুফি-দরবেশগণেরও ইসলাম প্রচারের কারণে হিন্দু রাজা-মহারাজাদের সাথে সম্পর্ক ও সংঘর্ষ হয়েছে। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার থেকে আবিষ্কৃত বাদশাহ হারুনুর রশীদের শাসনকালের (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) মুদা ১ম/৭ম শতাব্দীতে বাংলাদেশে ব্যাপক মুসলিম বসতিরই ইঙ্গিত বহন করে। বস্তুত বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব হয় সাহাবা/তাবিয়ী/আরব মুসলিম সওদাগরদের মাধ্যমে আর এর প্রচার-প্রসার হয় সত্যের দিশারী গভীর আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন সুফি-দরবেশগণের মাধ্যমে। আর ব্যবসার কারণে সামুদ্রিক যোগাযোগের মাধ্যমেই তাদের আগমন সহজ হয়েছিল। ৩/৯ম শতাব্দীতে হজরত বায়েজিদ বেস্তামি (রহ.) (মৃত্যু: ২৬০/৮৭২) ও তার এক বিরাটসংখ্যক অনুসারী সুফির চট্টগ্রাম আগমন এদেশে বহুসংখ্যক মুসলিম দরবেশের আগমন প্রমাণ করে। চট্টগ্রামে তার স্মারক মাজার আজও স্মৃতি বহন করছে ৪/১০ম শতাব্দীতে শায়খ আহমাদ বিন মুহাম্মদ (মৃত্যু: ৩৪৯/৯৫২) এবং শায়ক ইসমাইল বিন নাজান্দ নিশাপুরী (মৃত্যু: ৩৬৬/৯৭৫) ঢাকায় ইসলাম প্রচার করেন।
৫ম/১১ম শতাব্দীর মধ্যভাগে শায়খ মীর সুলতান মাহমুদ যিনি সুলতান বলখি নামে পরিচিত, তার মুর্শিদের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের কাজে বাংলাদেশে বগুড়ার মহাস্থানগড় আগমন করেন। তার অস্বাভাবিক কারামত ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে তিনি এদেশের বহু লোককে ইসলামের মহা সত্যের বায়াত দান করতে সক্ষম হন। ওই একই সময়ে শায়খ মুহাম্মদ সুলতান রুমী তার শায়খ ও বেশ কিছুসংখ্যক মুরিদ দিয়ে স্থানীয় রাজ পরিবারের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর ৬/১২ শতাব্দীর প্রথম দিকে শায়খ বাবা আদম শহীদ তার সাথীদের সমন্বয়ে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেনের সাথে ইসলামের সত্যের বাণী প্রচারের কারণে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শায়খ বাবা আদম তার সব সাথী সমন্বয়ে মহান আল্লাহর রাহে জীবন দান করে শাহাদাত লাভ করেন। ৭/১৩ শতাব্দীর প্রথম দিকে শায়খ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকান এবং মাখদুম শাহ দৌলা ঢাকা ও পাবনা এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় ইখতিয়ারুদ্দীন বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর থেকে এদেশে ৫৬৫ বছরেরও অধিককাল অর্থাত্ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুসলিম শাসন বহাল থাকে। এ সময়ে প্রায় ৭৬ জন গভর্নর অথবা সুলতান অথবা নাযিম বাংলা শাসন করেন। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কিছুসংখ্যক সুফি-দরবেশ ও ওলামায়ে কেরামের আবির্ভাব হয়, যাদের মাধ্যমে এদেশে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয়। তাদের মধ্যে শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজি (মৃত্যু: ৬৪২/ ১২৪৩) বাংলাদেশে আগমন করেন। তিনি শায়খ আবু সাঈদ ও শায়খ হিশাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর খলিফা ছিলেন।(সবুজ বাংলা ব্লগ)