ইমাম হুসাইন (আ.) তার বাহাত্তর জন সঙ্গীসাথীসহ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কারবালার মরুপ্রান্তরে শহীদ হন । শাহাদতের একদিন পর ইমাম ও তাঁর সাথিদের পবিত্র মৃতদেহগুলি, গাযেরিয়ার অধিবাসী বনী আসাদ গোত্রের লোকদের দ্বারা সমাহিত হয়।
যে দিন ইমাম (আ.) নিহত হন সেই দিনই তাঁর পবিত্র মাথাটিকে খাওলা ইবনে ইয়াযীদ এবং হামিদ ইবনে মুসলিম আযদীর সাথে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের জন্যে কুফাতে প্রেরণ করা হয়। খাওলা কুফাতে প্রবেশের পর ‘দারুল ইমারাত’ প্রাসাদে (গভর্ণরের বাসভবন) রওনা করে কিন্তু দরজা বন্ধ দেখে সরাসরি তার নিজের বাড়ীতে যায় এবং পবিত্র মাথাটিকে তার বাড়ীতে একটি বড় পাত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখে।
অতি প্রত্যুষে খাওলা সেই মাথাটিকে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যায়। উমর ইবনে সা’দ সেই দিন এবং পরের দিন বিলম্ব করে। অতঃপর হামিদ ইবনে বুকাইর আহমারীকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্যে ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে আদেশ দেয়। কুফার সৈন্যরা কুফার উদ্দেশ্যে রওনা করে। এই যাত্রায় ইমাম হুসাইনের (আ.) কন্যাগণ, ভগ্নীগণ, তাঁর শিশুরা এবং অত্যন্ত অসুস্থ আলী ইবনে হুসাইনকে (আ.) তাদের সাথে নিয়ে যায়।
ছৌল কুররাহ ইবনে কায়িস তামীমী’র উদ্ধৃতি দিয়ে তাবারী বলেন : “যখন হুসাইন, তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও তাঁর সন্তান-সন্ততির রক্তে ভেজা লাশগুলির পাশ দিয়ে হুসাইনের পরিবারের নারীদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমি স্বয়ং দেখেছি, তাঁরা বিলাপ ও আহাজারী করছিলেন এবং মাথা ও মুখমণ্ডলে চাপড়াচ্ছিলেন ...।”
কায়িসের ছেলে বলেন : “আমার স্মৃতি হতে যেসব বিষয় মুছে যাবে না, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ফাতিমার কন্যা যয়নবের কথাগুলি ! তিনি তাঁর নিহত ভাই হুসাইনের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে বলছিলেন :
“ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! সাল্লা’আলাইকা মালা-ইকাতুস্ সামায়ি, হাযা হুসাইনুন্ বিল্ আ’রা-য়ি !! মারমালুন্ বিদ্দিমা-য়ি মাক্বত্বাউ’আল্ আ’যা-য়ি, ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! ওয়া বানাতুকা সাবায়া ওয়া যুররিয়্যাতুকা মুক্বাত্তালাতান্ তাসফী’আলাইহাস্ সাবা।”
কুররাহ বলেন : “আল্লাহর শপথ ! যয়নব তাঁর এই বক্তব্যগুলি দ্বারা তাঁর সমস্ত বন্ধু ও শত্রুকে কাঁদিয়ে ছিলেন।”
তাবারী বলেন :অপর বাহাত্তর জন শহীদের বিচ্ছিন্ন মাথাগুলিকে শিমার ইবনে যিল জাওশান, কায়িস ইবনে আশ্আছ, আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং উযরাহ্ ইবনে কায়িসের মাধ্যমে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট প্রেরণ করা হয়।
ফুতূহে ইবনে আ’ছিম, মাকতালে খাওয়ারেযমী এবং অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে : “উমর ইবনে সা’দের সৈন্যরা রাসূলের পরিবারকে (তাঁর সন্তান-সন্ততি) কারবালা হতে বন্দী হিসেবে বেঁধে কুফার অভিমুখে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। বন্দিদের কাফেলা যখন কুফায় উপস্থিত হয় তখন কুফার লোকেরা সে দৃশ্য দেখার জন্যে বেরিয়ে আসে এবং তাঁদের অবস্থা দেখে করুণাসিক্ত হয় ও প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা চিৎকার করে কান্না ও বিলাপ করে।
আলী ইবনে হুসাইন (ইমাম হুসাইনের ছেলে) প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন তবুও তাকে শক্ত করে শিকল দিয়ে বেধে টেনে হিচড়ে কুফায় নিয়ে আসা হয়। তিনি কুফাবাসীদের এরূপ অস্থিরতা ও কান্না দেখে বলেন : “এরা যে আমাদের বিপদে এরূপ ক্রন্দন ও আর্তনাদ করছে তাহলে আমাদের হত্যাকারী কারা ?!”
কুফায় হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য
ইবনে আ’ছাম তার ইতিহাস গ্রন্থে বশীর ইবনে হাযীম আসাদী’র উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : যয়নবকে (আলীর কন্যা) সেইদিন প্রথম দেখেছিলাম, তাঁর পূর্বে তাঁর মত বাগ্মী অন্য কোনো পর্দানশীন নারীকে দেখিনি। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন আমীরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবী তালিবের ভাষায় কথা বলছিলেন এবং ইমামের বাণীগুলিই যেন তাঁর মুখ থেকে উৎসারিত হচ্ছিল।
প্রথমেই তিনি লোকজনকে চুপ করতে আদেশ দেন। তাঁর ইশারায় সবাই চুপ হয়ে গেল এমনকি চতুষ্পদ জন্তুগুলির ঘণ্টাধ্বনিও থেমে গেল, চারিদিকে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছিল। অতঃপর তিনি বললেন :
“আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার নানা মুহাম্মদ, আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর পবিত্র ও মনোনীত বংশধরগণের উপর দরুদ প্রেরণ করছি। অতঃপর হে কুফার লোক সকল ! হে প্রতারক, ধোকাবাজ ও বিশ্বাসঘাতক জনতা ! তোমরা এখন ক্রন্দন করছ ?! তোমাদের চক্ষুগুলো কখনই যেন কান্না হতে বিরত না হয়! তোমাদের অশ্রুধারা যেন না শুকায় এবং তোমাদের বিলাপ ও আর্তনাদ যেন শান্ত না হয়! তোমরা ঠিক সেই নারীর ন্যায়, যে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ার পর নিজেই তা বিচ্ছিন্ন করে! তোমরা ঠিক তাদের ন্যায় যারা নিজ শপথ ও প্রতিশ্রুতিগুলিকে প্রতারণা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উপাদানে পরিণত করেছে! লোকেরা তোমাদের নিকট হতে দম্ভোক্তি, আত্মপ্রশংসা, প্রতারণা ও শত্রুতা ব্যতীত আর কি আশা করতে পারে? তোমরা ক্রীতদাসীদের ন্যায় তোষামোদ কর এবং শত্রুদের ন্যায় প্রতারণার দিকে ধাবিত হও। তোমরা কোনো নর্দমার পাশে গজিয়ে উঠা আগাছা স্বরূপ, অথবা কোনো চুনামাটির অংশ যা দ্বারা কোনো কবরকে পূরণ করা হয়। তবে জেনে রেখ যে, স্বীয় ভবিষ্যতের জন্য কিরূপ মন্দ উপঢৌকন আল্লাহর সমীপে প্রেরণ করেছ আর তা হচ্ছে মহান আল্লাহর ক্রোধ ও চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
এখন ক্রন্দন ও শোক প্রকাশ করছো ?! হ্যাঁ,আল্লাহর শপথ, বেশী কাঁদো ও অল্প হাঁসো; কারণ নিজেদের জন্যে এমন লজ্জা ও অপমানকে প্রস্তুত করেছো যে, তা কোনো দিন মুছে যাবার নয়। আর কিভাবে নিজেদের সত্তাকে শেষ নবীর সন্তান হত্যার অপবিত্রতা হতে পবিত্র করবে ! কারণ তিনি ছিলেন বেহেশ্তি যুবকদের নেতা, পবিত্র লোকদের আশ্রয়দাতা,তোমাদের বিপদের আশ্রয়স্থল, তোমাদের জন্য উজ্জ্বলতম দলীল ও সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং তোমাদের কণ্ঠের ভাষা ! মাথায় কি ধরনের অপরিপক্ক ধারণা লালন করছ ! তোমাদের উপর মৃত্যু ও ধ্বংস নেমে আসুক ! তোমাদের আকাঙ্খাগুলি নিরাশায় পরিণত হয়েছে এবং তোমাদের প্রচেষ্টাগুলি তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে নি! তোমাদের হাতগুলি মুণ্ডিত হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি-শ্রুতিগুলি তোমাদের ক্ষতির কারণ হয়েছে। তোমরা আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের রোষানলে পতিত হয়েছো এবং তোমাদের উপর লজ্জা ও চরম দুরবস্থা ধার্য হয়েছে। হে কুফার জনতা ! তোমাদের ধ্বংস হোক !! তোমরা কি জান যে, আল্লাহর রাসূলের কোন কলিজাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছো, তাঁর কোন রক্ত ঝরিয়েছো, তাঁর কোন আবৃত সত্তার আবরণ অন্যায়ভাবে হরণ করেছো এবং কোন ধরনের মর্যাদার পর্দা উন্মোচন করেছো ?!
এমন এক আশ্চর্য ও বড় কর্মে (অপরাধে) লিপ্ত হয়েছো যে,তার আতঙ্কে আসমানসমূহ ফেটে যাওয়ার উপক্রম, জমিন তার মুখ খুলে দেয়ার উপক্রম এবং পর্বতমালা বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম ! এমন এক কাজ করেছো যে, তা এতটা কঠিন ও বড়, বন্ধুর, জটিল ও মন্দ যে জমিন ও সমস্ত আসমানের বিশালতার অনুরূপ ! তোমরা কি হতবাক হবে যদি এই বিপদের কারণে আসমানসমূহ রক্ত বর্ষণ করে ? নিশ্চিত যে, তোমাদের আজাবের অপর স্থানটি হবে যথেষ্ট লজ্জাকর এবং কঠিনতর, আর তোমাদের আর্তনাদে কেউ সাড়া দিবে না !
অতএব, যে সুযোগ পেয়েছো তাতে এত অধিক আনন্দিত ও অসচেতন হয়ো না ! কারণ, এই বিষয়ে মহান আল্লাহর কোনো তাড়া নেই এবং প্রতিশোধ গ্রহণের সময়কাল বিলম্বিত হওয়াতে তিনি ভয় পান না। হ্যাঁ, কখনও এইরূপ নয় এবং তোমাদের আল্লাহ্ তোমাদের (শাস্তি দানের) জন্য ওঁৎ পেতে আছেন।”
বশীর বলেন : “আল্লাহর শপথ ! আমি সেইদিন লোকজনকে চরম দুর্দশা- গ্রস্ত ও দিশাহারা এবং নেশাগ্রস্তদের ন্যায় উদ্দেশ্য ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় দেখেছি। তারা ক্রন্দন করছিল, গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিল, অনিচ্ছায় চিৎকার করছিল, অতীত ক্রিয়াকলাপের জন্য আক্ষেপ ও অনুতাপ করছিল এবং অনুতাপে আঙ্গুল কামড়াচ্ছিল। কুফার একজন বৃদ্ধ লোককে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এমন করুণভাবে কাঁদতে দেখলাম যে তার চোখের পানিতে তার দাড়িগুলি ভিজে গিয়েছিল এবং সে বলছিল :
“আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক ! আপনি সত্য বলেছেন। আপনাদের বৃদ্ধ ব্যক্তিগণ সর্বোত্তম বৃদ্ধ, আপনাদের যুবকগণ সর্বোত্তম যুবক, আপনাদের নারিগণ সর্বোত্তম নারী এবং আপনাদের বংশ সর্বোত্তম বংশ; অপমান ও পরাজয় আপনাদের কখনও স্পর্শ করতে পারে না।”
ইবনে যিয়াদের দরবারে যয়নবের (আ.) বক্তব্য
তাবারী স্বীয় সূত্রে হামিদ ইবনে মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন : “উমর ইবনে সা’দ আমাকে কাছে ডাকে তার পরিবারের নিকট তার বিজয়ের সুসংবাদ ও সুস্থ থাকার খবর পৌঁছাতে আদেশ দেয়। আমি কুফায় প্রবেশ করি এবং নিজ দায়িত্ব পালন করি। অতঃপর অবস্থা দেখার জন্যে ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে গমন করি। কারণ, বন্দীগণকে সেইখানে নিয়ে যাবার কথা ছিল এবং সমস্ত লোকজন সেইখানে সমবেত হয়েছিল।
গভর্ণরের প্রাসাদে প্রবেশের পর যিয়াদের পুত্র ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তার সম্মুখে রেখে চিন্তায় নিমগ্ন এবং হাতের লাঠি দ্বারা তাঁর (আ.) ঠোঁট ও সম্মুখের দাঁতগুলিতে আঘাত করছে। কিছু সময় ধরে সে এই কাজটি অব্যাহত রাখল। যায়িদ ইবনে আরকাম সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং ঘটনাটি দেখছিলেন। তিনি তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন :
‘তোমার হাতের লাঠিটি এই ঠোঁট ও দাঁতসমূহ থেকে সরিয়ে নাও, আল্লাহর কসম ! আমি একাধিকবার আল্লাহর রাসূলকে (সা.) এই ঠোঁট ও দাঁতগুলিতে চুম্বন করতে দেখেছি।’
অতঃপর তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুর বন্যা প্রবাহিত হয় এবং তীব্রভাবে ও উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকে বলে : ‘মহান আল্লাহ্ তোমার চক্ষুগুলিকে যেন সবসময় কান্নারত রাখেন। আল্লাহর কসম ! তুমি যদি অচল, নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন বৃদ্ধ মানুষ না হতে তবে তোমার গর্দানকে উড়িয়ে দিতাম !’ ইবনে যিয়াদের এইরূপ বক্তব্য শুনে যায়িদ ইবনে আরকাম উঠে দাঁড়ান এবং সভা ত্যাগ করেন।”
“যখন ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তাঁর সন্তান, ভগ্নী ও অন্যান্য নারিগণের সাথে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যাওয়া হল তখন ফাতিমার (আ.) কন্যা যয়নব তাঁর সর্বাধিক মূল্যবান জামাটি পরিধান করলেন যাতে তাঁকে চিনা না যায়, আর তাঁর দাসীগণ তাঁকে বেষ্টন করল। তিনি রাজ প্রাসাদে প্রবেশের পর একটি কোণায় বসলেন। উবাইদুল্লাহ্ তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করল: ‘তুমি এমন কে যে, আমার আদেশ ছাড়াই বসে গেলে ?’ যয়নব কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। উবাইদুল্লাহ্ তিনবার তার প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করলে তাঁর জনৈকা দাসী বললেন : “ইনি ফাতিমার কন্যা যয়নব !” উবাইদুল্লাহ্ এই উত্তর শুনে তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল : ‘সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তোমাদেরকে অপমানিত করেছেন, তোমাদেরকে ধ্বংস করেছেন এবং তোমাদের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন।”
যয়নব (আ.) বললেন : “কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে তাঁর রাসূল হযরত মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। যে কোনো প্রকারের অপবিত্রতা হতে সর্বোত্তম অবয়বে পাক ও পবিত্র করেছেন এবং তুমি যা বললে সেই রূপ নয়। বরং পাপাচারীরাই অপমানিত হবে এবং চরিত্রহীন ও অন্যায়কারীরাই মিথ্যা বলে।” উবাইদুল্লাহ্ বলল: ‘তোমার পরিবারের সাথে আল্লাহর ক্রিয়াকলাপকে কিরূপ দেখলে?’ তিনি বললেন: “মহান আল্লাহ্ শাহাদতকে তাঁদের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন এবং তাঁরাও গর্বিতভাবে নিজ আত্মোৎসর্গের ভূমিতে পা রেখেছেন। খুব শীঘ্রই মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে একে অপরের সামনে দণ্ডায়মান করবেন, যেন তাঁর নিকটে ন্যায়বিচার প্রার্থনা এবং দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন কর।”
বর্ণনাকারী বলেন : এতে উবাইদুল্লাহ্ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করতে শুরু করলে আমর ইবনে হারিছ তাকে বলল : ‘মহান আল্লাহ্ আমীরকে দীর্ঘজীবি করুন ! তিনি হলেন নারী, নারিদের কথার প্রতি পুরুষদের কোনোরূপ গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়। তাঁদেরকে বক্তব্যের মাঝে নিন্দা ও তিরস্কার করাও ঠিক নয়।’ ইবনে যিয়াদ যয়নবের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল ‘মহান আল্লাহ্, আমার ভিতরের অস্বস্তি ও অন্তরদাহকে তোমার পরিবারের একগুঁয়ে মহান ব্যক্তিগণের হত্যার দ্বারা শান্তি ও পরিত্রাণ দিয়েছেন !”
যয়নব তার কথায় প্রচণ্ড ক্রন্দন করতে করতে বললেন : “হ্যাঁ, আমার প্রাণের কসম, আমার নেতাকে হত্যা করেছো, আমার পরিবারের মূলোৎপাটন করেছ, আমার জীবনের ডালপালাগুলিকে কেটে দিয়েছো এবং আমার শিকড়কে উপড়িয়ে ফেলেছো। যা করেছো, তা যদি তোমার প্রশান্তির কারণ হয় তবে নিঃসন্দেহে সেই প্রশান্তিকে স্মৃতিতে ধরে রেখ !”
ইবনে যিয়াদ যয়নবকে ইশারা করে বলল ‘ছন্দ ও ঝঙ্কারপূর্ণ কথা বলছ।” অতঃপর, তাঁকে সম্বোধন করে, এরূপ বলে : “আমার নিজ জীবনের শপথ ! তোমার পিতাও কবি ছিলেন এবং ছান্দিকরূপে কথাবার্তা বলতেন।”
যয়নব উত্তর দিলেন : “ছন্দ ও ঝঙ্কারের সাথে নারিদের কি সম্পর্ক ? আমি এইরূপ অবস্থায় ঝঙ্কার ও অন্তঃমিল দিয়ে কথা বলছি না বরং যা কিছু বললাম তা আমার বুকের ভিতরের জ্বালা ছিল।”
ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য
ইমাম আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) কন্যা যয়নব, ইয়াযীদের সভায় দণ্ডায়মান হয়ে বলেন :
“সমস্ত প্রশংসা বিশ্বের প্রতিপালকের এবং রাসূল (সা.) ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক ! পরম পবিত্র আল্লাহ্ তায়ালা কতটা সত্য কথা বলেছেন ! তিনি বলেন : ‘গোনাহ্গার ও মন্দ লোকদের পরিণতি এই হবে যে,আমাদের নিদর্শনগুলিকে মিথ্যা মনে করবে এবং সেইগুলিকে উপহাসের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করবে।’ ইয়াযীদ ! তুমি কি মনে করেছো ? তুমি কি মনে করছ যে, তুমি আমাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশকে সংকীর্ণ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে বন্দি অবস্থায় এদিক-সেদিক ঘুরে নিয়ে বেড়াচ্ছ । ভেবেছো এসব কাজ দ্বারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হীন ও অযোগ্য করে দিবে এবং তোমাকে সম্মানিত ও মহত্বে পৌঁছাবে; আর আল্লাহর নিকট তোমার উচ্চমর্যাদার কারণে এই বাহ্যিক বিজয় ঘটেছে ? এই কারণে তুমি চরম আনন্দিত এবং নিজের অতীতে ফিরে গেছ, পৃথিবীকে নিজের জন্যে প্রস্তুত, সুসজ্জিত ও সুস্বাদু দেখে তুমি খুশী ও আনন্দে বাগ বাগ হয়েছো ? আমাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন তোমার করতলগত হয়েছে এইরূপ করছ ? শান্ত হও, শান্ত হও ! মহান আল্লাহর বাণী কি ভুলে গেছ (?) তিনি বলেছেন : ‘যারা কুফরী করে তারা যেন এইরূপ ধারণা না করে যে, পৃথিবীর যে সব সুযোগ-সুবিধা আমরা তাদেরকে দান করি সেগুলি তাদের জন্যে কল্যাণকর। আমরা এই সুযোগ-সুবিধাগুলি তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করি যে, সেইগুলি যেন তাদের পাপসমূহকে বৃদ্ধি করে এবং আগামীতে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।”
হে আমাদের নানার মুক্তকৃত লোকদের সন্তান ! এইটি কি ন্যায়বিচার যে, তুমি নিজ নারী ও দাসীদেরকে পর্দায় রেখেছ আর রাসূলুল্লাহর কন্যাগণকে বন্দী হিসেবে ইসলামী দেশের চতুর্দিকে ঘোরাচ্ছ ? তাঁদের পর্দা কেড়ে মুখমণ্ডলসমূহকে প্রকাশ করছ ? শত্রুদের দ্বারা তাঁদেরকে শহর হতে শহরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য করছ ? তাঁদেরকে শহরের লোকজনদের নিকট বিনোদনের উপাদান বানাচ্ছ, যাতে পরিচিত-অপরিচিত এবং উত্তম-অধম সবাই তাঁদের মুখমণ্ডলগুলিকে লক্ষ্য করে। আর এই অবস্থায় তাঁদের সাথে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই এবং তাঁদের পুরুষগণের পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে না ?!
হে আল্লাহ্, কি বলব ! নিরাপত্তার ব্যাপারে কি করে তাদের প্রতি আশা করা যায় (?) যারা সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত হামযা’র মত পবিত্রতম ব্যক্তিত্বের কলিজা চিবিয়েছে এবং ওহুদের শহীদগণের রক্তের দ্বারা যাদের রক্ত মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে ? আমাদের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে নরম আচরণ করবে বলে তাদের উপর কি করে আশা করা যায় যারা আমাদেরকে অস্বীকার করে, শত্রুতা, ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে গুনাহর কোন অনুভূতিই নেই, এই কাজটিকে বড় কোন অন্যায় বলে মনে করে না? বরং বলছে : ‘লোকেরা যেন আনন্দ করে, খুশীতে থাকে, উল্লাস করে ! আর বলে, এ কর্মের জন্যে হে ইয়াযীদ! তোমাকে ধন্যবাদ।’ এই অবস্থায়, বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার হযরত আবু আব্দিল্লাহর দাঁতগুলিকে তুমি তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করছ ! কেনই বা তুমি এইরূপ কাজ করবে না ?! মুহাম্মদের (সা.) নাতি ও আলে আব্দিল মুত্তালিবের আকাশের তারকাগণের রক্তপাতের মাধ্যমে তুমি তোমার হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ নোংরা বস্তুগত চেহারার পর্দা উন্মুক্ত করেছো এবং তোমার মূলে ফিরে গেছ, তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করছ ও তাদেরকে আহ্বান করাকে কল্যাণকর ধারণা করছ, অথচ খুব শীঘ্রই তুমি তাদের প্রবেশের স্থানে প্রবেশ করবে ! সেইখানে তুমি চাইবে যে, যদি তুমি খোঁড়া, অক্ষম ও বোবা হতে এবং এই সব না বলতে ও এইরূপ কর্ম না করতে !
হে আল্লাহ্ ! আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ কর ! যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অত্যাচার করেছে তার নিকট হতে প্রতিশোধ নাও ! যে ব্যক্তি আমাদের রক্তপাত করেছে ও আমাদের অভিভাবকগণকে হত্যা করেছে তুমি তাদের উপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত প্রেরণ কর !
ইয়াযীদ ! আল্লাহর শপথ ! তুমি তোমার নিজের চামড়া ব্যতীত অন্য কিছু চিরনি এবং তোমার নিজেরই মাংস ব্যতিত অন্য কিছুই কাটনি ! আল্লাহর রাসূলের সন্তান-সন্ততির রক্তপাত,তাঁর ইতরাত (বংশধর) ও তাঁর শরীরের অংশসমূহের সম্মান বিনষ্ট করার ফলে যেসব অপরাধ তোমার কাঁধে চেপেছে সেসব সহকারে তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর (রাসূল) নিকট প্রবেশ করবে ! আল্লাহ্ তাঁদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহকে সংযোজন করবেন, তাঁদের বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সংযুক্ত করবেন এবং তাঁদের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ! আর তোমরা এইরূপ ধারণা করো না যে, যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁরা মারা গেছেন, বরং তাঁরা জীবিত আছেন এবং তাঁদের প্রতিপালকের নিকট হতে রিয্ক গ্রহণ করেন।
তোমার জন্যে এই যথেষ্ট যে, মহান আল্লাহ্ তোমার নিকট হিসাব গ্রহণ করবেন, মুহাম্মদ (সা.) তোমার সাথে দুশমনি করবেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আমাদের পৃষ্ঠপোষক হবেন। যে ব্যক্তি তোমার জন্যে এইরূপ অপরাধকে সুসজ্জিত করেছে এবং মুসলমানদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী করেছে সে অচিরেই বুঝবে যে, অত্যাচারীর জন্যে জাহান্নামের মন্দ স্থান নির্ধারিত রয়েছে এবং তুমিও বুঝবে যে, তোমাদের ও আমাদের মাঝে কারা মন্দ স্থানে রয়েছে এবং কারা দুর্বলতর শক্তির অধিকারী।
ইয়াযীদ ! বর্তমানে পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে তোমার সাথে কথা বলছি ! তুমি জেনে রেখ ! আমি তোমাকে এতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করি যে, তোমাকে ভর্ৎসনা করাটাও তোমার সত্তার চেয়ে বড় মনে করি এবং তোমার জন্যে তিরস্কার করাটাও বেশী মনে করি (অর্থাৎ তুমি ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের অযোগ্য) ! কিন্তু কি করি !? চক্ষুগুলি অশ্রুতে পূর্ণ এবং অন্তরসমূহ অগ্নিদগ্ধ ! জেনে রেখ ! বিস্ময়কর ! সবই বিস্ময়কর !! শয়তানের দলের মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের হাতে হিযবুল্লাহর মহানুভব ব্যক্তিগণ নিহত হচ্ছেন ! এই হাতগুলি হতে আমাদের রক্ত ঝরছে, এই মুখগুলি আমাদেরকে শোষণ করছে এবং আমাদের পবিত্র ব্যক্তিগণের দেহসমূহকে নেকড়েরা ছিন্নভিন্ন করছে, হায়েনারা মাটির উপর টানাটানি করছে !
ইয়াযীদ ! তুমি যদি আমাদেরকে তোমার জন্য গনিমত মনে করে থাক তবে জেনে রেখ যে, খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখবে ! পূর্বে প্রেরিত আমলগুলি ছাড়া সেইখানে আর অন্য কিছু পাবে না ! তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী লোকদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ! আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করছি এবং তাঁর উপর আমার ভরসা আছে।
ইয়াযীদ ! তুমি যতই চেষ্টা কর এবং মানুষের সাথে মিথ্যাচার ও প্রতারণা কর, আল্লাহর শপথ ! তুমি আমাদের স্মরণকে বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের ঐশী প্রেরণাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। এই অপরাধের লজ্জা ও অপমান তোমার থেকে কখনই মুছে যাবে না। দুর্বল (যুক্তি)ও মিথ্যা (ভাষ্য) ব্যতীত তোমার কি আছে ? মুষ্টিমেয় কয়েকটি দিন এবং বিক্ষিপ্ত জনতা ছাড়া তোমার আর কি আছে ? যে দিন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন : ‘জেনে রাখ ! জালিমের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে !’ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৌভাগ্য ও মাগফিরাতসহ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়েছেন এবং আমাদের উত্তরসুরিগণকে শাহাদত ও রহমত দ্বারা নৈকট্য দান করেছেন। মহান আল্লাহর নিকট কামনা করব, তিনি যেন তাঁদেরকে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেন এবং তাঁদের শাহাদতকে তাঁর নিয়ামত বৃদ্ধির উপকরণ বানিয়ে দেন ! আমাদেরকে তাঁদের উত্তম প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করেন ! তিনি হচ্ছেন করুণাময় ও দয়ালু। তিনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম ভরসাস্থল।” - আল-হাসানাইন