সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৬১-৬৪
সূরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ (৬১)
"হে নবী আপনার কাছে যে জ্ঞান এসেছে,তা নিয়ে যারা আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে তাদেরকে বলুন এস,আমরা আমাদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের ও তোমাদের নারীদের এবং স্বয়ং আমাদেরকে ও স্বয়ং তোমাদেরকে আহবান করি। তারপর প্রার্থনা করি যে,মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক।" (৩:৬১)
ইতিহাসে এসেছে দশম হিজরীতে মহানবী (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেনের নাজরান এলাকায় একদল মুসলমানকে পাঠিয়েছিলেন। এর জবাবে নাজরানের খ্রিস্টানরাও মহানবীর সাথে বিতর্কের জন্য একদল খ্রিস্টানকে মদীনায় পাঠায়। তারা মদীনায় রাসূল (সা.)'র সাথে হযরত ঈসা (আ.)'র ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। কিন্তু তারা যুক্তি ও সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। এরপর আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) পারস্পরিক অভিশাপের প্রস্তাব দেন। তিনি খ্রিস্টানদের বললেন,আপনারা আপনাদের কয়েকজন পুত্র,নারী ও ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে আসুন। আর আমরাও একই কাজ করে জনসমাবেশে এসে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণের জন্য প্রার্থনা করবো। নাজরানের খ্রিস্টানরা এই প্রস্তাব শুনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শের জন্য সময় চায়। খ্রিস্টানদের প্রধান তাদেরকে বললো,প্রস্তাব মেনে নাও। কিন্তু যদি দেখ,মোহাম্মদ জনসমক্ষে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে পারস্পরিক অভিশাপ কামনা বা মোবাহেলার জন্য উপস্থিত হয়,তবে তা করা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনভাবে আপোস করবে। নির্দিষ্ট দিনে খ্রিস্টানরা দেখলো মহানবী (সা.) মাত্র চারজনকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এই চারজন হলেন,রাসূল কন্যা ফাতেমা (সা.),জামাতা আলী (আ.) এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন (আ.)। খ্রিস্টানদের প্রধান অন্যান্য খ্রিস্টানদের বললেন,আমি এমন কিছু চেহারা দেখতে পাচ্ছি,যদি তাঁরা দোয়া করেন,তাহলে পাহাড় টলে যাবে এবং যদি আমাদের ওপর অভিশাপ দেন,তাহলে আমরা একজনও জীবিত থাকবো না। এ অবস্থায় তারা পারস্পরিক অভিশাপ বা মোবাহেলায় যোগ দিতে অস্বীকার করল।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যে কোন প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দেয়া উচিত। সত্যের বিরুদ্ধে তর্ক ও সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করার পরিণামে আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তি পেতে হবে।
দ্বিতীয়ত : যদি আমরা আল্লাহর ধর্মে বিশ্বাস রাখি,তাহলে এই পথে আমাদেরকে সুদৃঢ় থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে,মিথ্যার অনুসারী হবার কারণে শত্রুরা অবশ্যই পিছু হটে যাবে।
তৃতীয়ত : রাসূল (সা.)'র মত রাসুলের আহলে বাইতের দোয়া ও আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে থাকে। মোবাহেলার সময় রাসূল (সা.) হাসান ও হোসাইন (আ.)কে নিজের সন্তান এবং হযরত আলী (আ.) কে নিজের আহলে বাইত বা ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচয় করিয়ে দেন।
চতুর্থত : স্বাভাবিক শক্তি প্রয়োগের পর অদৃশ্যের সাহায্য তথা আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। মহানবী (সা.) প্রথমে প্রচার ও আলোচনা করেছেন এবং এরপরই তিনি প্রার্থনা ও পারস্পরিক অভিশাপের প্রস্তাব দেন।
সূরা আলে ইমরানের ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلَّا اللَّهُ وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (৬২) فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِالْمُفْسِدِينَ (৬৩)
"হযরত ঈসা (আ.)'র জীবন সম্পর্কে এটাই সত্য কাহিনী এবং আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই,নিশ্চয়ই সে আল্লাহ পরাক্রান্ত বিজ্ঞানময়।" (৩:৬২)
"যদি তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখ,আল্লাহ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের অবস্থা খুব ভালোভাবেই জানেন।" (৩:৬৩)
মোবাহেলার ঘটনার পর আল্লাহ রসুল (সা.)কে বললেন,ঈসা সম্পর্কে যা কিছু আপনার কাছে নাজিল করা হয়েছে সেটাই তাঁর প্রকৃত জীবন ইতিহাস। আর একমাত্র আল্লাহই ঈসা নবীর জীবন সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। যারা ঈসাকে খোদার পুত্র বলে মনে করে তারা অলীক কল্পনার জগতে বাস করছে। কারণ,আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি ছাড়া কোন প্রভু বা উপাস্য নেই। তাই যারা সত্য গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক তারা জেনে রাখুক আল্লাহ তাদের কাজ সম্পর্কে জানেন এবং তিনি তাদের শাস্তি দিতে সক্ষম। মানুষের মধ্যে সাধারণত: যেসব গল্প প্রচলিত রয়েছে,সেগুলো হয় রূপকথা অথবা উপন্যাস বা লেখকদের কল্পনার ফসল। এসব কখনোই বাস্তব নয়। অনেক সময় ইতিহাসের ভিত্তিতে এসব গল্প লেখা হলেও তাতে সত্য ও মিথ্যা মিশে থাকে। কিন্তু কোরআনে উল্লেখিত ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ বাস্তব এবং যে কোন ধরনের ভুল-ত্রুটিও অতিরঞ্জন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যদি কোরআন না থাকতো,তাহলে হযরত ঈসা নবীসহ অনেক নবী ও জাতির প্রকৃত ঘটনা বা ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জানতে পারতাম না।
দ্বিতীয়ত : সত্যের বিরোধিতা করা বা সত্য মেনে না নেয়া অন্যায় বা দুর্নীতির এক বড় দৃষ্টান্ত। এ দুর্নীতি সমাজকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
তৃতীয়ত : আমরা যদি এটা মনে রাখি যে,আল্লাহ আমাদের সব কাজই দেখছেন,তাহলে আমরা আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সাবধান হব।
সূরা আলে ইমরানের ৬৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ (৬৪)
"হে নবী! আপনি ঐশী গ্রন্থের অনুসারী বা আহলে কিতাবদের বলুন,আমাদের ও তোমাদের মধ্যে যে বাক্যে মিল আছে,তার দিকে এসে যেন আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা না করি এবং তার সাথে কোন শরীক বা অংশীদার স্থির না করি এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমরা পরস্পর কাউকে যেন প্রভু হিসেবে গ্রহণ না করি। এরপর তারা যদি ফিরে যায়,তবে তাদের বলুন সাক্ষী থাক যে আমরাই মুসলমান বা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনকারী।" (৩:৬৪)
পবিত্র কোরআন পূর্ববর্তী আয়াতে খ্রিস্টানদেরকে যুক্তি ও প্রমাণ দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। কিন্তু তারা এ আহবান গ্রহণ না করায় পরে তাদেরকে মোবাহেলায় অংশগ্রহণ অর্থাৎ মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তারা এতেও শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়নি। এরপর আল্লাহ ইসলামের নবীর উদ্দেশ্যে বললেন তাদের বলুন তোমরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে না চাও তাহলে অন্তত ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের অভিন্ন বিশ্বাসের ভিত্তিতে যেন আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হও এবং শিরক ও কুফুরির বিরুদ্ধে অবস্থান নাও। তোমরা ত্রিত্ববাদ তথা তিন খোদায় বিশ্বাস কর,অথচ এটা যে তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের বিরোধী তা বুঝতে পারছ না। তাই আস,আমরা একত্ববাদকে অভিন্ন মূলনীতি হিসেবে মেনে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হই এবং বিভিন্ন কলুষিত ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা তথা শিরক থেকে মুক্ত হই। কোন কোন খ্রিস্টান পণ্ডিত আল্লাহর বিধি নিষেধ বা হালাল হারামকে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করেছেন। তাই কোরআন এ সম্পর্কে বলে,এস আমরা যেন এমন সব লোকের অনুসরণ না করি যারা আইন বিষয়ে নিজেদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে করে। আয়াতের শেষাংশে মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে,আহলে কিতাবরা যদি তোমাদের একত্ববাদের ডাকে সাড়া না দেয় তবে নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে নিরাশ হয়োনা। বরং দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা কর যে,একমাত্র আমরাই আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পনকারী এবং তোমরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ফলে আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোন প্রভাব পড়বে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : পবিত্র কোরআন আমাদেরকে আহলে বাইতের অনুসারীদের সাথে অভিন্ন বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানায়। তাই মুসলমানদের মধ্যে যে কোন ধরনের বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ইসলাম ও কোরআনের বিরোধী।
দ্বিতীয়ত : সমস্ত মানুষই সমান। তাই কেউই কারো ওপর প্রভুত্ব করার অধিকার রাখেনা। মানুষের ওপর শুধুমাত্র আল্লাহর আইনের কর্তৃত্বই বৈধ।
তৃতীয়ত : আহলে কিতাব বা ঐশী গ্রন্থের অনুসারীদের ইসলামের দিকে আহবান জানাতে হবে। এক্ষেত্রে সমস্ত লক্ষ্য অর্জিত না হলেও আংশিক লক্ষ্য অজর্নের জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখা ঠিক হবে না।