সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৮৩-২৮৬
সূরা বাকারাহ'র ২৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنْ كُنْتُمْ عَلَى سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَقْبُوضَةٌ فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آَثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
"আর যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোন লেখক না পাও তবে (নগদ নয় এমন লেনদেনের ক্ষেত্রে বা ঋণ-প্রদানের ক্ষেত্রে)কিছু বন্ধক রাখা বৈধ। আর যদি তোমরা পরস্পরকে বিশ্বাস কর,তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়,সে যেন (বিশ্বাস বজায় রেখে)গচ্ছিত দ্রব্য বা আমানত ফিরিয়ে দেয় এবং নিজ প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে। আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে কেউ তা গোপন করবে নিশ্চয়ই তার অন্তর পাপপূর্ণ। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।" (২:২৮৩)
ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে কোন পক্ষের ভুল বা স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে সমস্যা দেখা না দেয় সেজন্যে লিখিত দলীল রাখার পরামর্শ দেয় ইসলাম। এ বিষয়ে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে,সফরের সময়ও লেনদেনের দলীল লিখে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- যদি কোন লেখক না পাওয়া যায় তাহলে কোন কিছু গচ্ছিত রেখে লেনদেনকে সুদৃঢ় করতে হবে। এই গচ্ছিত আমানত আল্লাহকে স্মরণ রেখে মূল মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। আয়াতের শেষাংশে মুমিন মুসলমানদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে,মানুষের অধিকারের ব্যাপারে কথা বলতে বা সাক্ষ্য দিতে কেউ যেন অবহেলা না করে কারণ,আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর রাখেন এবং কেউ যদি কারো অধিকারের ব্যাপারে নীরব থাকে বা অধিকার গোপন রাখে,তাহলে তা হবে অত্যন্ত বড় পাপ।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলোঃ
এক. নগদ নয় এমন সব লেনদেন মুখের কথার ভিত্তিতে করা উচিত নয়। বরং লিখিত প্রমাণ রেখে স্বাক্ষী রেখে ও প্রয়োজন হলে বন্ধক বা জামানত রেখে লেনদেন সুদৃঢ় করা উচিত।
দুই. সমাজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে সময় মত দেনা পরিশোধের মাধ্যমে পারস্পরিক বিশ্বাস অটুট রাখতে হবে।
এরপর ২৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
"আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে,সমন্ত আল্লাহর,তোমাদের অন্তরে যা আছে,তা প্রকাশ কর অথবা গোপণ রাখ,আল্লাহ তার হিসেব তোমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন। এরপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন। বস্তুত আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।" (২:২৮৪)
এই আয়াতে বিশ্বাসীদের সাবধান করে দিয়ে বলা হয়েছে- আল্লাহ অন্তরের পাপ সম্পর্কেও অবহিত এবং অন্তরের পাপ অনুযায়ী আল্লাহ তোমাদের বিচার করবেন। কিন্তু শয়তান যদি মানুষের অন্তরে খারাপ কাজের কূ-মন্ত্রণা দেয় এবং মানুষ যদি খারাপ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ঐ কাজে জড়িত না হয়,তাহলে সে জন্য শাস্তি পাবেনা। অবশ্য পাপের চিন্তা বা ইচ্ছা,ধীরে ধীরে মানুষের অন্তরকে অন্ধকার ও কলুষিত করে এবং পাপের পথ খুলে দেয়।
এরপর ২৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
"রাসুল,তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা অবতীর্ণ হয়েছে,তাতে সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং বিশ্বাসীরাও আল্লাহ,তাঁর ফেরেশতাগণ,তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের ওপর বিশ্বান স্থাপন করেছে। তাঁরা বলেন ,আমরা আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে কোন পার্থক্য করিনা ,তাঁরা বলে,আমরা শুনেছি এবং পালন করেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাই এবং তোমারই কাছে আমরা ফিরে যাবো।" (২:২৮৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে,বিশ্ব একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত। নবীগণ মানবজাতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছেন। মানুষের চিন্তা ও বিবেক যখন আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী উপলদ্ধি করার যোগ্য হ'ল,তখন আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সঃ )কে মানবজাতির জন্য সর্বশেষ নবী হিসেবে মনোনীত করেন। তাই একজন মুসলমান সমন্ত নবী ফেরেশতা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে প্রেরিত সমস্ত গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং তাঁরা নবীদের মধ্যে কোন বৈষম্য করে না।
এরপর এই সুরার ২৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
"আল্লাহ কাউকেই তার সাধ্যের চেয়ে বেশী দায়িত্ব দেন না। ভালো এবং মন্দ যে যা উপার্জন করবে সে তারই প্রতিদান পাবে। (বিশ্বাসীরা বলে)হে আমাদের প্রতিপালক!যদি আমাদের ভুল ত্রুটি হয়,তবে আপনি আমাদের অপরাধী করবেন না,হে আমাদের প্রতিপালক!আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন গুরুভার অর্পন করেছিলেন,আমাদের ওপর তেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করবেন না। যে ভার সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই,তা আমাদের ওপর আরোপ করবেন না। আমাদের কে ক্ষমা করুন,আমাদেরকে দয়া করুন,আপনিই আমাদের অভিভাবক। তাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের জয়যুক্ত করুন।" (২:২৮৬)
মহান আল্লাহতা'লা মানুষকে বিভিন্ন গুণ ও যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কেউ বেশী প্রতিভাবান,কেউ কম প্রতিভাবান,কেউ শক্তিশালী ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। আবার কেউ দুর্বল ও রুগ্ন। কেউ ফর্সা,কেউ কালো এবং কেউ নারী ও কেউ পুরুষ। এসবের মধ্যে কোন কোন পার্থক্য মানব প্রজন্ম সৃষ্টি ও রক্ষার জন্য জরুরী। আবার কোন কোন পার্থক্য বা বৈষম্য মানুষের ওপর জুলুম ও সামাজিক অবিচারেরই ফল মাত্র। এটা স্বাভাবিক যে,এই সব পার্থক্য ও বৈষম্য মানুষের শরীর এবং মনের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখে। মানুষের মধ্যে এতসব পার্থক্য সত্ত্বেও আল্লাহ যদি তাদের কাছ থেকে একই ধরনের প্রত্যাশা রাখেন,তবে তা হবে অবিচার। তাই এ আয়াতে আল্লাহর অন্যতম প্রধান গুন হিসেবে তাঁর ন্যায়পরায়নতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,আল্লাহ কাউকে তার ক্ষমতা বা সাধ্যের চেয়ে বেশী দায়িত্ব দেন না এবং তার কাছে এর চেয়ে বেশী প্রত্যাশা ও করেন না। তাই শাস্তি ও পুরস্কার দায়িত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
১. ইসলাম সহজ সরল ধর্ম। ইসলাম সাধ্যের চেয়ে বেশী দায়িত্ব পালন করতে বলে না। যেমনটি ইসলামের নবী (সাঃ)ও বলেছেন,আমি সহজ ও সরল ধর্মের নবী মনোনীত হয়েছি।
২. পুরস্কার ও শাস্তির ভিত্তি হলো,কাজ বা তৎপরতা। আর কাজ করা হয় ইচ্ছার ভিত্তিতে। তাই ভুল করে যেসব অপরাধ করা হয় সেগুলোর জন্য আল্লাহ শাস্তি দেবেন না।
৩ : আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়ালু ,করুণাময় এবং ক্ষমাশীল। তাই মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তাদের পাপ ক্ষমা করে দেন এবং পাপের কালিমা থেকে তাদেরকে পবিত্র করেন।