সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৭৮-২৮২
সূরা বাকারাহ'র ২৭৮ ও ২৭৯তম আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (২৭৮) فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ
"হে বিশ্বাসীরা,আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদ বাবদ মানুষের কাছে যা তোমাদের পাওনা আছে তা পরিত্যাগ কর,যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। (২:২৭৮)
"আর যদি তা না কর,তবে ধরে নেয়া হবে যে,তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছ। যদি তোমরা তাওবা কর,তবে তোমাদের জন্যই তোমাদের মূলধন রয়েছে। তোমরা সুদ নিয়ে অত্যাচার করো না এবং মূলধন হারিয়ে অত্যাচারিতও হয়ো না।" (২:২৭৯)
পবিত্র কোরআনে যখন সুদ বর্জনের নির্দেশ দেয়া হয়,তখন অনেক মুসলমানেরই সুদের অর্থ অন্যদের কাছে পাওনা ছিল। তাই তারা এ বিষয়ে রাসুলের কাছে প্রশ্ন করলে এই দুই আয়াত নাজেল হয় এবং নবী (সঃ) মুসলমানদের সমাবেশে সুদ সংক্রান্ত সকল চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। রাসুল (সঃ) সবার আগে সুদের লেন দেন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য নিজের আত্মীয় স্বজনের প্রতি আহবান জানান। এর আগে কয়েকটি আয়াতে বলা হয়েছে বঞ্চিতদেরকে অর্থ সাহায্য করা ও তাদেরকে ঋণ দেয়া আল্লাহকে ঋণ দেয়ার সমতুল্য। আর আল্লাহ নিজেই তাদের পুরস্কার দিবেন। এই আয়াতে সুদ নিয়ে বঞ্চিতদের ওপর জুলুম করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে,যদি সুদ নেয়া থেকে বিরত না হও,তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল বঞ্চিতদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : ঈমান আনার অর্থ শুধু নামাজ পড়া ও রোজা রাখা নয়। অবৈধ সম্পদ থেকে দূরে থাকাও ঈমান ও তাকওয়ার শর্ত।
দ্বিতীয়ত : ইসলাম মালিকানাকে সম্মান করে,কিন্তু সুদ গ্রহণ বা গরীব মানুষকে শোষন করার অনুমতি দেয় না।
তৃতীয়ত : অত্যাচার করা ও অত্যাচারিত হওয়া উভয়ই নিন্দনীয়। তাই সুদ দেয়া ও নেয়া দুটোই নিষিদ্ধ।
এরপর ২৮০ ও ২৮১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ وَأَنْ تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (২৮০) وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
"ঋণী যদি অভাবগ্রস্ত হয়,তবে তার সচ্ছলতার জন্য অপেক্ষা কর,আর যদি ঋণ ফেরত দেয়ার ক্ষমতাই না থাকে তাহলে তাদের ঋণ মাফ করে দেয়াই উত্তম। যদি তোমরা তা জানতে।" (২:২৮০)
"তোমরা সেই দিনকে ভয় কর,যে দিন তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে,তখন যে যা অর্জন করেছে,তা সম্পূর্ণরূপে দেয়া হবে এবং তোমাদের ওপর অন্যায় করা হবে না।" (২:৮১)
দান খয়রাত ও ঋণ দেয়ার জন্য মুমিনদেরকে উৎসাহিত করার পর,সুদ না নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে,ঋণ দেয়ার পর সুদ নেয়া তো চলবেই না,একই সাথে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি যদি স্বল্প সময়ে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা না রাখে,তবে তাকে সময় দেয়া উচিত,এমনকি যদি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই না রাখে,তাহলে ঋণ মাফ করে দেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে। ঋণ মাফ করে দেয়ার জন্য পরকালে প্রতিদান দেয়া হবে বলেও আল্লাহ ঘোষণা করেছেন। ধর্মের এইসব উপদেশ যদি সমাজে বাস্তবায়িত হত তাহলে সমাজে সচ্ছলতা পবিত্রতা ও ভ্রাতৃত্ব কতই না বৃদ্ধি পেত। এর ফলে অভাবগ্রস্তদের অভাব পূর্ণ হওয়া ছাড়াও ধনীরা লোভী কৃপণ ও দুনিয়াপূজারী হতে পারতো না এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানও হ্রাস পেত।
এবারে এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক গুলো হলো,
প্রথমত : বঞ্চিতদের কল্যাণ সাধন করাই দান খয়রাত ও ঋণ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য। তাই এমন কিছু করা উচিত নয়,যাতে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে গরীব আরো অভাবগ্রস্থ হয়ে পরে।
দ্বিতীয়ত : ইসলাম বঞ্চিতদের প্রকৃত সহায়। তাই সুদকে নিষিদ্ধ করে এবং দানকে উৎসাহিত করে ইসলাম সমাজের অর্থনৈতিক শূন্যতা পূরণ করেছে।
তৃতীয়ত : দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করা,সম্পদ অর্জনের চেয়ে ভালো।
এরপর আল্লাহ পাক এই সূরার ২৮২ নম্বর আয়াতে বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ وَلْيَكْتُبْ بَيْنَكُمْ كَاتِبٌ بِالْعَدْلِ وَلَا يَأْبَ كَاتِبٌ أَنْ يَكْتُبَ كَمَا عَلَّمَهُ اللَّهُ فَلْيَكْتُبْ وَلْيُمْلِلِ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلَا يَبْخَسْ مِنْهُ شَيْئًا فَإِنْ كَانَ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ سَفِيهًا أَوْ ضَعِيفًا أَوْ لَا يَسْتَطِيعُ أَنْ يُمِلَّ هُوَ فَلْيُمْلِلْ وَلِيُّهُ بِالْعَدْلِ وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ فَإِنْ لَمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَنْ تَضِلَّ إِحْدَاهُمَا فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى وَلَا يَأْبَ الشُّهَدَاءُ إِذَا مَا دُعُوا وَلَا تَسْأَمُوا أَنْ تَكْتُبُوهُ صَغِيرًا أَوْ كَبِيرًا إِلَى أَجَلِهِ ذَلِكُمْ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ وَأَقْوَمُ لِلشَّهَادَةِ وَأَدْنَى أَلَّا تَرْتَابُوا إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً حَاضِرَةً تُدِيرُونَهَا بَيْنَكُمْ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَلَّا تَكْتُبُوهَا وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ وَلَا يُضَارَّ كَاتِبٌ وَلَا شَهِيدٌ وَإِنْ تَفْعَلُوا فَإِنَّهُ فُسُوقٌ بِكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
"হে বিশ্বাসীগণ,যখন একে অন্যের সাথে কোন নির্দিষ্টকালের জন্য ঋণ সংক্রান্ত আদান প্রদান করবে তখন তা লিখে রাখ এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন ন্যায়ভাবে তা লিখে দেয়,যেহেতু আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন তাই লেখক যেন লিখতে অস্বীকার না করে। এবং ঋণ গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও কম-বেশী না করে। আর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ কিংবা দুর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়,তবে তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখাবে। দুজন পুরুষকে সাক্ষী করবে,যদি দুজন পুরুষ না হয়,তবে নিজেদের পছন্দ মত একজন পুরুষ ও দুজন মহিলাকে (সাক্ষী করে নেবে)। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে একজন যদি ভুলে যায়,তবে অপর জন তা স্মরণ করিয়ে দিবে। যখন সাক্ষীদেরকে ডাকা হয়,তখন যেন তারা অস্বীকার না করে। দেনা কম হোক আর বেশি হোক মেয়াদ পর্যন্ত তা লিখতে অলসতা কর না,এ লিপিবদ্ধ করণ আল্লাহর কাছে সুবিচারকে অধিক কায়েম রাখে,সাক্ষ্যকে অধিক সুসংহত রাখে এবং তোমাদের সন্দেহে পতিত না হওয়ার পক্ষে অধিক উপযুক্ত। কিন্তু যদি কারবার নগদ হয়,পরস্পর হাতে হাতে আদান-প্রদান কর,তবে তা না লিখলে তোমাদের প্রতি কোন পাপ নেই। তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সাক্ষী রাখ। কোন লেখক ও সাক্ষীকে (চাপ প্রয়োগ) ক্ষতিগ্রস্ত করো না। যদি তোমরা এ ধরনের কিছু কর,তবে তা তোমাদের পক্ষে পাপের বিষয়। আল্লাহকে ভয় কর তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ সব কিছু জানেন।" (২:২৮২)
সুরা বাকারার এই আয়াতটি পবিত্র কোরআনের দীর্ঘতম আয়াত। মানুষের অর্থ সম্পদ রক্ষার বিষয়ে এতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দান খয়রাত করা ও ঋণ দেয়ার উপদেশ সম্পর্কিত আয়াত এবং সুদ নেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এই আয়াতে লেনদেনের সঠিক পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে,যাতে মানুষকে লেনদেনের ক্ষেত্রে সব ধরনের ভুল ও অন্যায় থেকে দূরে রাখা যায় এবং কোন পক্ষই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লেনদেনের সঠিক পদ্ধতির যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে,এবারে তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
প্রথমত : যে কোন ধর্মাবলম্বীর সাথে বেশী বা কম অর্থের ঋণ বা অন্য কোন ধরনের লেনদেন করা হোক না কেন তা দলীল আকারে লিখে রাখা উচিত।
দ্বিতীয়ত : কোন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দলীল লেখাতে হবে। তা-না হলে দেনার দায় লেখকের ওপর চাপানোর ভয় থাকে।
তৃতীয়ত : লিখিত প্রমাণ ছাড়াও উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য দু'জন সাক্ষী থাকতে হবে।
পঞ্চমত : নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত দলীল জরুরী নয়। সাক্ষীই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।
এবারে সুরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় কিছু দিক তুলে ধরছি।
প্রথমত : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামাজিক ধর্ম। ব্যক্তিগত দিক ও মানুষের আত্মিক বিকাশ ছাড়াও এ ধর্মে সমাজের অর্থনৈতিক এবং আইনগত বা অধিকারগত বিষয়ের ওপর গভীর দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : লেনদেনের চুক্তি লিখে রাখার কথা বলা হয়েছে এমন এক সময়ে যখন সাধারণ মানুষ লেখাপড়া জানতো না। আর এ থেকেই বোঝা যায় শিক্ষা ও জ্ঞানের উন্নতির প্রতি ইসলাম ধর্ম গুরুত্ব আরোপ করে।
তৃতীয়ত : চুক্তিপত্র লিখতে বলার উদ্দেশ্য হলো,জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করা। অবিশ্বাস সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য নয়। ভুল করা ,ভুলে যাওয়া বা অবহেলা করা সমাজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে।