সূরা বাকারাহ;(৬৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৬৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 10:32:44 23-8-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৫৬-২৫৯

সূরা বাকারাহ'র ২৫৬ ও ২৫৭তম আল্লাহপাক আয়াতে বলেছেন-

 

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (২৫৬) اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آَمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

 

"ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন জোর জবরদস্তি নেই। কারণ,বিভ্রান্তির পথ থেকে সত্য পথকে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করেছে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে,সে এমন সুদৃঢ় রজ্জু ধরে আছে যা কখনও ছিন্ন হওয়ার নয়। আর আল্লাহ শ্রবণকারী,মহাজ্ঞানী।" (২:২৫৬)

"যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে,আল্লাহ তাদের অভিভাবক,তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। অন্যদিকে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষক হলো,তাগুত,যে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। এরাই নরকের অধিবাসী। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে।" (২:২৫৭)

ঈমান বা বিশ্বাসের সম্পর্ক হৃদয়ের সাথে। আর বিশ্বাস কখনও জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। আচার আচরণ,দলীল প্রমাণ ধর্মীয় উপদেশ বা বক্তৃতা মানুষের মনকে কোন ব্যক্তি বা আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী করে তোলে। মহান আল্লাহ মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য একদিকে নবী রাসুল ও ঐশী গ্রন্থ পাঠিয়েছেন,তেমনি অন্যদিকে মানুষকে তার ইচ্ছামত নবী বা ঐশী গ্রন্থ বেছে নেয়ার বা তা অস্বীকার করারও অধিকার দিয়েছেন। আর এজন্যে নবীরা ঈমান আনার জন্যে কাউকে বাধ্য করেননি। এছাড়া তাঁরা জানতেন জোর করে বিশ্বাস করানোর কোন মূল্য নেই। কেউ যদি শয়তানী বা স্বৈরাচারী তাগুতী শক্তির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে ও শুধু আল্লাহর দাসত্ব মেনে চলে তাহলে আল্লাহ তার তত্ত্বাবধান করেন এবং জীবনের সংকটময় মুহূর্তে ও সব সময়ই তাকে সুপথ দেখিয়ে রক্ষা করেন। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর ভরসা করে এবং তাগুতের অনুসরন করে তারা শির্ক ও কু-সংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়,আল্লাহ তাদেরকে বাস্তবতা উপলব্ধির পথ থেকে দূরে রাখেন।

 

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত : ধর্মের প্রতি বিশ্বাস তখনই মূল্যবান,যখন তা সচেতনতা ও জ্ঞান ভিত্তিক হয় এবং তা নিজ ইচ্ছায় কেউ গ্রহণ করে।

দ্বিতীয়ত : সত্যের পথ একটি,কিন্তু বিচ্যুতি বা বিভ্রান্তির পথ অনেক। আর এজন্যে পবিত্র কোরআন নূর বা আলোর ক্ষেত্রে একবচন ও জুলমাত বা অন্ধকার শব্দের ক্ষেত্রে বহুবচন উল্লেখ করেছে।

তৃতীয়ত : সত্যের পথ হলো আলোকিত এবং তা উন্নতি,গতিশীলতা,আশা ও প্রশান্তি এনে দেয়। আর মিথ্যার পথ হলো অন্ধকারময় এবং তা বিভ্রান্তি,অজ্ঞতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

 

এরপর এই সূরার ২৫৮তম আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

 

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آَتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

 

"হে নবী,আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেননি,যে দম্ভভরে ইব্রাহীমের সঙ্গে তাঁর প্রতিপালক সম্পর্কে বিতর্ক করেছিল,যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দান করেছিল। যখন ইব্রাহীম বলেছিলেন,আমার প্রতিপালক তিনি,যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। সে (নমরুদ) বলেছিল,আমিই জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইব্রাহীম বললেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিকে উদয় করান,তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও,এতে সেই অবিশ্বাসী হতবুদ্ধি হয়েছিল এবং আল্লাহ অত্যাচারীদলকে পথ প্রদর্শন করেন না।" (২:২৫৮)

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়,নমরুদ ছিল প্রাচীন ইরাকের অর্থাৎ ব্যবিলন সাম্রাজ্যের রাজা। সে নিজেকে খোদা বলে দাবী করত এবং প্রজাদেরকে নিজের দাস বা বান্দা বলে মনে করত। যখন সে শুনল,ইবরাহীম (আঃ) মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবান করছে তখন সে ইবরাহীম (আঃ)-কে বললো,আমি যাকে ইচ্ছে মৃত্যু দেই ও যাকে ইচ্ছে জীবিত রাখি। এরপর সে দুইজন বন্দিকে এনে একজনকে মুক্তি দিল আর অপরজনকে হত্যার নির্দেশ দিল। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার কথা শুনে বললেন,আল্লাহ পাকের নির্দেশে সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে উদিত হয় তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে উদয় কর! নমরুদ এ প্রশ্ন শুনে হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে যায়। তারপরেও কিন্তু সে সত্যকে মেনে নিতে রাজী হয়নি। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী নমরুদ তখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেয়।

 

এই আয়াতে যা শিক্ষণীয় তার সারসংক্ষেপ হলো-

প্রথমত : কোন মানুয়ের মধ্যে যদি জ্ঞান বা সচেতনতা না থাকে তাহলে সে ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে আল্লাহর দাস ভাবার পরিবর্তে নিজেই প্রভু হওয়ার দাবী করতে পারে এবং এভাবে সে অহংকারী ও গর্বিত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত : নবীরা যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করেছেন। কিন্তু যারা তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িছিল তাদের কোন যুক্তি ছিল না,তারা মূলত গোয়াতুমীর ভাষায় কথা বলতো।

 

সুরা বাকারাহ'র ২৫৯তম আয়াতে বলা হয়েছে-

 

أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّى يُحْيِي هَذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِئَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِئَةَ عَامٍ فَانْظُرْ إِلَى طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانْظُرْ إِلَى حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آَيَةً لِلنَّاسِ وَانْظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

 

"তুমি কি সে লোককে দেখনি,যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়ীঘরগুলো ভেঙ্গে ছাদের উপর পড়ে ছিল? সে বলল,মৃত্যুর পর কিভাবে আল্লাহ একে জীবিত করবেন? এরপর আল্লাহ তাকে একশত বছর মৃত রেখে পুনরায় জীবিত করেন। আল্লাহ বলেন: তুমি কতকাল অবস্থান করলে? সে বলল,একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। আল্লাহ বললেন না,তুমি বরং একশত বছর অবস্থান করেছ। তোমার খাবার ও পানীয়ের দিকে লক্ষ্য কর তা অবিকৃত আছে এবং তোমার গাধার দিকে তাকাও,কারণ তোমাকে মানব জাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করব। আর গাধার হাড়গুলোর দিকে তাকাও,কিভাবে সেগুলোকে যুক্ত করি ও মাংস দিয়ে ঢেকে দেই। যখন এই বাস্তবতা তার কাছে স্পষ্ট হলো,তখন সে বলল,আমি জানি যে,আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।" (২:২৫৯)

 

বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী বনী ইসরাইলের নবী হযরত উজাইর (আঃ)-র জীবনে এ ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়। তিনি ধ্বংসস্তুপে পরিণত একটি শহর অতিক্রমের সময় পুনরুত্থান বা কিয়ামত দিবসে মৃতদের পুনর্জীবিত করার ঘটনা দেখতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি কিয়ামতের ওপর ঈমান রাখতেন,তা সত্ত্বেও তিনি অন্তরের প্রশান্তির জন্য অনুরূপ কিছু দেখানোর জন্য আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেন। আর আল্লাহর নির্দেশে এই ঘটনা ঘটার ফলে তার কাছে আল্লাহর শক্তির বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হয়। একশ' বছর পরও পচনশীল খাবার তাজা ছিল এবং আল্লাহর অনুগ্রহে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গাধার হাঁড় পুনরায় প্রথম অবস্থা ফিরে পায়। অর্থাৎ গাধাটিও জীবিত হয়। উজাইর (আঃ)নিজে একশ বছর মৃত থাকা সত্ত্বেও তার শরীরে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষের মতই সতেজ ছিলেন।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : পুনরুত্থান দিবস বা কেয়ামতের দিনে মানুষের পুনরায় জীবিত হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। আর আল্লাহ পৃথিবীতেই এর প্রমাণ দেখিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহ বিভিন্ন পন্থায় পৃথিবীতে তার শক্তির প্রমাণ দেখিয়ে থাকেন যাতে মানুষ এটা বুঝতে পারে যে,আল্লাহ সব কিছু করার ক্ষমতা রাখেন,তাই পুনরুত্থান বা কিয়ামতের ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।