সূরা বাকারাহ;আয়াত ২০৬-২১০
সূরা বাকারাহ'র ২০৬ ও ২০৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-
وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ
"যখন অশান্তি সৃষ্টিকারীদের বলা হয়- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অশান্তি সৃষ্টি কর না,তখন তাদের একগুঁয়েমী বৃদ্ধি পায়। অহংকার ও বিদ্বেষ তাদেরকে পাপের দিকে আকৃষ্ট করে। নরকের আগুন তাদের জন্য যথেষ্ট এবং নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দয়াশীল।" (২:২০৬-২০৭)
ধোঁকাবাজ মুনাফিকদের অশান্তি ও অত্যাচার সম্পর্কে পূর্ববর্তী আয়াতের সূত্র ধরে ২০৬ নম্বর আয়াতে মুনাফিকদের দম্ভ ও অহংকারের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,যদি কেউ তাদেরকে সতর্ক করতে যায় এবং অন্যায় কাজ বন্ধ করতে বলে তাহলে তারা পরামর্শ তো শুনেই না বরং তারা তাদের একগুঁয়েমীপনা ও অপকর্মের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনকি তারা যা খুশী তা-ই করা শুরু করে।
অন্যদিকে এসব দুনিয়াপূজারী ও দাম্ভিক লোকদের বিপরীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। বিভিন্ন তাফসীরে বলা হয়েছে- যখন মক্কার মুশরিকরা রাতের বেলায় রাসূল (সা.) এর ঘরে হামলা করে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়,তখন আল্লাহর রাসূল ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হন এবং মক্কা থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। রাসূল (সা.) তাঁর ঘরে নেই এটা যাতে শত্রুরা বুঝতে না পারে সে জন্যে হযরত আলী আল্লাহর রাসূলকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার পদক্ষেপ নেন। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সূরা বাকারার ২০৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। ইতিহাসে এই রাত লাইলাতুল মাবাইত বা উন্মুক্ত আকাশের নীচে রাত্রিযাপন নামে বিখ্যাত।
এই আয়াত থেকে আমরা যা যা শিখলাম তা হলো-
প্রথমতঃ অপরাধ বা পাপের পুনরাবৃত্তির অন্যতম কারণ হল বিদ্বেষ,একগুঁয়েমী এবং অহংকার। ফলে মানুষ পাপের কারণে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে আরো বেশী পাপ করতে থাকে ।
দ্বিতীয়ত : মুমিন হল কাজে বিশ্বাসী। মুমিন আল্লাহর সাথে লেনদেন করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকে,কিন্তু মুনাফিকরা পার্থিব বিষয়ের সাথে লেনদেন করে এবং তারা মানুষের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় রয়েছে।
এরপর সূরা বাকারাহ'র ২০৮ ও ২০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ فَإِنْ زَلَلْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْكُمُ الْبَيِّنَاتُ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
"হে বিশ্বাসীগণ,তোমরা পুরোপুরি ইসলাম গ্রহণ কর এবং শয়তানের পথ অনুসরণ করো না,নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
কিন্তু তোমাদের কাছে উজ্জল নিদর্শনাবলী আসার পরও যদি তোমরা পথভ্রষ্ট হও,তবে জেনে রাখ যে আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময়। " (২:২০৮-২০৯)
এই আয়াতে সমস্ত মুমিনদেরকে ঐক্য ও শান্তির দিকে আহবান জানানো হয়েছে,এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিবাদ পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে। কারণ,দ্বন্দ্ব ও বিবাদ হলো শত্রুতা ও বিভেদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শয়তানের প্রধান অস্ত্র। মূলতঃ বর্ণ,লিঙ্গ,ভাষা ও সম্পদের মত বাহ্যিক পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব ও বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যম। শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসই মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে এবং এভাবে সমাজে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ঐশি নির্দেশনা মেনে নিয়ে শয়তানের পথ পরিহারের চেষ্টা করতে হবে। কেউ যদি সমাজে ফেতনা বা অশান্তি সৃষ্টি করে তাহলে বুঝতে হবে যে এই ব্যক্তিটির ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। আর এ ধরনের মানুষের জানা উচিত যে তাদেরকে এক সময় মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময় আল্লাহর মুখোমুখী হতে হবে।
এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তাহলো -
প্রথমতঃ একমাত্র আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ঈমানের মাধ্যমেই শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছাড়া মানুষের গড়া আইনের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ ও অশান্তি থেকে রেহাই পাবে না।
দ্বিতীয়তঃ শয়তান ঐক্যের শত্রু। যেকোন ধরনের বিচ্ছিন্নতার আহবান শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ভূত।
এই সূরার ২১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِنَ الْغَمَامِ وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ
"তারা কি এজন্যেই অপেক্ষা করছে যে,এতসব সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ মেঘের ছায়ায় ফেরেশতাসহ তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে নতুন প্রমাণ ও নিদর্শন দেখাবেন? অথচ আল্লাহ পথ-প্রদর্শনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। আর সব কিছু আল্লাহরই কাছে ফিরে যাবে।" (২:২১০)
অনেক মানুষেরই আশা যে,তারা আল্লাহ ও ফেরেশতাদের দেখবেন এবং তাঁদের কথা শুনে ঈমান আনবেন! অথচ এটা অসম্ভব এক বিষয়। আল্লাহ ও ফেরেশতা শরীরধারী কেউ নন যে তাঁদের দেখা যাবে। আল্লাহ মানুষকে বিবেক দেয়া ছাড়াও তাদের জন্য কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এভাবে মানুষকে সুপথ দেখানোর কাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন। তাই স্থুলবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষের অদ্ভুত আব্দার বাস্তবায়নের কোন প্রয়োজন নেই।
এই আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হলো- ইন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে আল্লাহকে দেখার ইচ্ছা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা ঈমানের তখনই মূল্য থাকে যখন তা যুক্তি ও মানুষের প্রকৃতি থেকেই উদ্ভূত হয়। আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার তৌফিক দিন।